আগন্তুক (শেষ পর্ব)
– মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর
৬ষ্ঠ পর্ব
এরপর আমরা হামযা ইউসুফের লেখার অংশ দেখব। উনি ছয় বছর মৌরিতানিয়ায় থেকে দ্বীন শিক্ষা করেছেন। উনি কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষ – দ্বীন শিক্ষা করার জন্য মরুভূমিতে অত্যন্ত কষ্ট করেছেন। তিনি এই বইতে গসম্যান নামে একজন লেফটেন্যান্ট এর কিছু গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়েছেন যা আমরা দেখব:-
১) টিভির ৪০% সহিংসতা করছে এমন চরিত্র, যাদের মানুষ আদর্শ মনে করে – যেমন, শাহরুখ খান।
২) এই সহিংসতাগুলো যারা করে, তাদের তিন ভাগের এক ভাগ খারাপ চরিত্রের কোন শাস্তি হয় না। এতে বাচ্চারা কী শিখে? আপনি খারাপ কাজ করে বেঁচে যেতে পারবেন। আর আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন তো খারাপ কাজ করা হিরোই ছিল – টেলিভিশনে রবিনহুড দেখাত তখন, সে তো ডাকাত ছিল!
৩) টিভিতে যেসব সহিংসতা দেখান হয় তার অর্ধেকের বেশিতে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে – যদি আসলেই কেউ এগুলো বাস্তবে করতে যায়, তবে সে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। পড়েন নাই পেপারে, এসব করতে গিয়ে বাচ্চারা নিজে মরে গেছে বা অন্যকে মেরে ফেলেছে?
৪) ৪০% সহিংসতার ভেতর আবার হাস্যরস থাকে। অর্থাৎ একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে কিন্তু আপনি হাসছেন।
৫) টিভিতে যা দেখান হয় তার মাঝে ৬০% সহিংসতা থাকে এবং ৬০%র বেশি অংশে আক্রমণাত্মক আচরণ থাকে – তবে এটা কিন্তু ১৯৯৯এর কথা। এখন আরও বেশি হবে। বাচ্চারা যদি দিনে দুই ঘন্টা করে কার্টুন দেখে তাহলে বছরে তারা ৫০০ সহিংস আচরণ দেখবে, যা তাদের ভেতর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্ম দেবে।
এখানে হামযা ইউসুফ নিজে আরও কিছু ডাটা দিচ্ছেন। আমেরিকায় ১৫-২০ বছর বয়সী যে সব বাচ্চারা মারা যায় তাদের মৃত্যুর কারণের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ‘খুন’। আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের মাঝে এটা প্রথম কারণ। আমেরিকায় প্রতি পাঁচ মিনিটে সহিংসতা ঘটানোর জন্য একটা বাচ্চাকে অ্যারেস্ট করা হয় এবং বন্দুকের ব্যবহার থেকে প্রতি তিন ঘণ্টায় একটা বাচ্চা মারা যায়। আমেরিকায় ৪৮৮১টা সন্ত্রাসী দল আছে যাদের সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।
নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে বড় হওয়া একটা বাচ্চার চেয়ে ওয়াশিংটন ডিসি বা শিকাগোতে বড় হওয়া একটা বাচ্চার খুন হওয়ার সম্ভাবনা ১৫গুণ বেশি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের কথা কেন বলছেন উনি? কারণ সেখানে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আই.আর.এ. আছে কিন্তু তাদের আক্রমণে বাচ্চারা মরে না, অথচ আমেরিকায় বাচ্চারা মরছে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে কিশোর বয়সীদের আত্মহত্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন? ৬০এর দশক থেকেই কিন্তু টিভি এসেছে! এরপর হামযা ইউসুফ বলছেন, দুই লক্ষ সত্তুর হাজার বাচ্চা প্রতিদিন স্কুলে বন্দুক নিয়ে আসে। আমাদের দেশে এরকম হয় না, কিন্তু আমাদের দেশেও কিশোর কিশোরকে মোবাইল ফোনের জন্য হত্যা করেছে। এটা পেপারে উঠেছে। “ওর আছে, আমার নাই!” – এ জন্য মেরে ফেলেছে! আমেরিকায় প্রতি ১৫টা বাচ্চার মাঝে একজনের বাবা অথবা মা কেউ একজন জেলে আছে। এই সব কিছুর পেছনে টিভি বিষয়ক ব্যপারকে দায়ী করা হচ্ছে।
এখন হামযা ইউসুফ যেখানে পড়াশোনা করেছেন, মৌরিতানিয়া, সেখানকার কথা বলছেন। আর সব ইসলামী সমাজের মতো এখানেও মৌখিক সংষ্কৃতি বিরাজ করত, অর্থাৎ শোনার মাধ্যমে মুখে মুখে প্রচারের প্রক্রিয়া ছিল; আমাদের কুরআন মুখস্ত করা, হাদীসের বিস্তার এ সবই মৌখিক সংষ্কৃতির মাধ্যমেই হয়েছে। আর মুরব্বীদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। আমরা এখন একটা মুরব্বীহীন সমাজে পরিণত হয়েছি। আগে পাড়ার সবচেয়ে অথর্ব বৃদ্ধকে দেখলেও ছেলেরা সিগারেট ফেলে দিত! আর এখন মুরুব্বীর মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ছে কিশোরেরা। এরপর উনি বলছেন যে, তার পড়াশোনার সময়কালে সেখানে টিভি ছিল না।
দশ বছর পর উনি যখন সেখানে আবার গেলেন, তখন আগের দেশটা আর নেই! সেটা অন্যরকম হয়ে গেছে! কেন? যে আতিথেয়তা, মানুষের সাথে কথা বলা – উনি আগে পেয়েছিলেন – সেটা এখন আর নেই। এখন টিভির কারণে মানুষের আর সময় নেই তো, তাই! সেখানে মানুষের সাথে মেলামেশা, কথা বলা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং সবার মাঝে কিভাবে আমেরিকায় যাওয়া যায়, বড়লোক হওয়া যায় ও সেখানে গিয়ে টিভিতে যা কিছু দেখায় সব কিনে ফেলা যায় এই তাড়না প্রবল হয়েছে। আমাদের দেশে একই অবস্থা না এখন? একদম একই অবস্থা! আর একটা বিশাল পার্থক্য তিনি দেখেছেন যা হোল টিভির আবির্ভাবের বদৌলতে মানুষের মাঝে “পশ্চিমা আচরণ” বিরাজ করছে – অন্যের জন্য তাদের কাছে সময় কমে গেছে। বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য মানুষের কাছে এখন আর সময় নেই।
আমরা আজ এখানেই শেষ করছি। আমরা যেন এখান থেকে বোঝার চেষ্টা করি, চিন্তা করি আমরা কী হারিয়ে ফেলছি এবং আমরা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে টিভি আমাদের মাঝে যা এনে দিচ্ছে তা ইসলাম বিরোধী ও অনৈসলামিক জীবনযাত্রা।