আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন, “(হে প্রিয় মাহবুব!) আমি (আল্লাহ) আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত গাছটিও শুধু মানুষের পরীক্ষার জন্য।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ১৭/৬০)
“আমি (আল্লাহ) আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছি তা” এ আয়াত সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, এ আয়াতে رُؤْيَا (স্বপ্নে দেখা নয়, বরং) চোখ দ্বারা সরাসরি দেখা বোঝানো হয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে মি‘রাজের রাতে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। আর এখানে الشَّجَرَةَ الْمَلْعُوْنَةَ (অভিশপ্ত বৃক্ষ) বলতে ‘যাক্কুম’ বৃক্ষ (যা জাহান্নামীদের খাদ্য হবে) বোঝানো হয়েছে। (সহীহ বুখারী ৪৭১৬)
জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যখন কুরায়শরা (মিরাজের ঘটনায়) আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতে লাগল, তখন আমি হিজরে দাঁড়ালাম। আল্লাহ্ তা‘আলা বায়তুল মাকদাসকে আমার সামনে পেশ করে দিলেন। আমি তা দেখে তার সকল নিশানা তাদের বলে দিতে লাগলাম। (সহীহ বুখারী ৪৭১০, সহীহ বুখারী ৩৮৮৬)
শুধু কাফের মুশরিকরা উনাকে অস্বীকার করত যে, এমন নয়, মুনাফিকরাও উনাকে অস্বীকার করত, সন্দেহ করত।
তাফসীরে খাযেনে, “(হে সর্বসাধারণ!) আল্লাহর শান/নিয়ম এ নয় যে, তোমাদেরকে অদৃশ্যের জ্ঞান দিয়ে দেবেন। তবে আল্লাহ নির্বাচিত করে নেন তার রাসূলগণের মধ্য থেকে যাঁকে চান। সুতরাং ঈমান আনো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং যদি তোমরা ঈমান আনো এবং পরহেযগারী অবলম্বন করো, তবে তোমাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৯) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে,
(একদিন) প্রিয় নবী ﷺ বলেন, আমাকে বলে দেয়া হয়েছে কে আমার উপর ঈমান আনবে আর কে আমাকে অস্বীকার করবে। যখন এ খবর মুনাফিকদের কাছে পৌঁছালো, তখন তারা হেসে বলতে লাগলো, হুযুর ﷺ ওসব লোকদের জন্মের আগেই তাদের মুমিন ও কাফির হওয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন, অথচ আমরা তাঁর সাথেই আছি কিন্তু আমাদেরকে চিনতে পারেন নি।’ এ খবর যখন হুযুর ﷺ এঁর নিকট পৌঁছলো, তখন তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ইরশাদ ফরমান এসব লোকদের কি যে হলো, আমার জ্ঞান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন বিষয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাস করো, আমি অবশ্যই বলে দিব।’’ [ইমাম খাযেন: লুকাবুত তা’ভীল: ১/৩২৪ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৫হি.]
রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নামাজসমূহ আদায়ের পরপর মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা (বর্ণনা) দিতে থাকেন। এতে তিনি পূর্বে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সব জানিয়ে দেন।
(সহীহ মুসলিম ৭১৫৯)
তিনি ﷺ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন। অবশেষে তিনি জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীর নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করার কথাও উল্লেখ করেন। যাদের স্মরণশক্তি ভাল ছিল, তারা এগুলো স্মরণ রাখতে পেরেছেন। (সহীহ বুখারী ৩১৯২)
তিনি ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে বলে জানান সেসবের কিছু ঘটলেই সাহাবায়ে কেরাম তা স্মরণ করতে পারতেন যেভাবে কেউ তার পরিচিত লোকের অনুপস্থিতিতে তার চেহারা স্মরণ রাখে। অতঃপর তাকে দেখা মাত্র চিনে ফেলে। (সুনান আবূ দাউদ ৪২৪০)
হুযায়ফা (রাঃ) আল্লাহ্র কসম করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত ফিতনা সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতে বাদ দেননি, যাদের সংখ্যা হবে তিনশ’রও বেশী। তিনি তাদের নাম, তাদের পিতার নাম এবং তাদের গোত্রের নামও উল্লেখ করেন। (সূনান আবু দাউদ ৪২৪১)
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, দাজ্জালের সংবাদ সংগ্রাহক দলের প্রতিটি ব্যক্তির নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন। (সহীহ মুসলিম ৭১৭)
প্রিয় নবী ﷺ মিম্বরে আরোহণ করে ঘোষণা করলেন, তোমরা আমাকে যা-ই প্রশ্ন করবে, আমি তারই উত্তর প্রদান করব। অতঃপর এমন এক ব্যক্তি, যাকে পারস্পরিক বাকবিতণ্ডার সময় অন্য এক ব্যক্তির (যে প্রকৃতপক্ষে তার পিতা নয়) সন্তান বলে সম্বোধন করা হতো, (তিনি) উঠে তার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, তোমার পিতা হুযাফা। (সহীহ বুখারী ৭০৮৯)
ইমাম বুখারী রহঃ উল্লেখ করেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, কিছু লোক ছিল তারা ঠাট্টা করে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করত, কেউ বলত আমার পিতা কে? আবার কেউ বলত আমার উষ্ট্রী হারিয়ে গেছে তা কোথায়? তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেছেন- “ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা এমন বিষয়ে প্রশ্ন করো না যা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হলে তোমাদের খারাপ লাগবে।” (সূরা মায়িদাহঃ ৫/১০১)(সহীহ বুখারী ৪৬২২)
বর্তমানের মুনাফিকদেরও স্বভাব এমন যে, আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় নবীজি ﷺ সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলে দেয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর জ্ঞান নিয়ে সমালোচনা করে। এছাড়াও
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা গোটা পৃথিবীকে ভাজ করে আমার সামনে রেখে দিলেন। অতঃপর আমি এর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিয়েছি। পৃথিবীর যে পরিমাণ অংশ গুটিয়ে আমার সম্মুখে রাখা হয়েছিল সে পর্যন্ত আমার উম্মতের রাজত্ব পৌছবে। আমাকে লাল ও সাদা দুই প্রকারের ধনাগার দেয়া হয়েছে। (সহীহ মুসলিম ৭১৫০)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার সামনে সকল উম্মতকে পেশ করা হয়েছিল। (সহীহ বুখারী ৫৭০৫)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার উম্মতের সমস্ত আমল আমার সামনে পেশ করা হয়েছিল। (সহীহ মুসলিম ১১২০)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মেহেরবানী করে তাঁর প্রিয় হাবিবের অজানা সবকিছুই উনাকে জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি এমন কোন জিনিস নেই যা উনাকে দেখানো হয়নি।
আসমা বিনতে আবূ বকর (রা.) বলেন, আমি (একদিন) ‘আয়িশাহ্ (রা.)-এর নিকট গেলাম। লোকজন তখন (সূর্যগ্রহণের) নামাজ আদায় করছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকদের কী হয়েছে? তখন তিনি মাথা দিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি কোন নিদর্শন? তিনি মাথা দিয়ে ইঙ্গিত করে, হ্যাঁ বললেন। (এরপর আমিও তাঁদের সঙ্গে নামাজ যোগ দিলাম) অতঃপর রাসূলূল্লাহ্ ﷺ নামাজ এত দীর্ঘায়িত করলেন যে, আমি প্রায় অজ্ঞান হতে যাচ্ছিলাম। আমার পার্শ্বেই একটি চামড়ার মশকে পানি রাখা ছিল। আমি সেটা খুললাম এবং আমার মাথায় পানি দিতে লাগলাম। অতঃপর যখন সূর্য উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ নামাজ সমাপ্ত করলেন এবং লোকজনের উদ্দেশ্যে খুৎবা পেশ করলেন।
প্রথমে তিনি আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন, আম্মা বা‘দু। আসমা (রা) বলেন, তখন কয়েকজন আনসারী মহিলা শোরগোল করছিলেন। তাই আমি চুপ করাবার উদ্দেশে তাঁদের প্রতি ঝুঁকে পড়লাম।
অতঃপর ‘আয়িশাহ্ (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি (নবী ﷺ) কী বললেন? ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) বললেন, তিনি ﷺ বলেছেন, এমন কোন জিনিস নেই যা আমাকে দেখানো হয়নি আমি এ জায়গা হতে সব কিছুই দেখেছি (সুবহান আল্লাহ)। এমন কি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখলাম। আমার নিকট ওয়াহী পাঠান হয়েছে যে, তোমাদেরকে কবরে মাসীহ্ দাজ্জালের ফিতনার ন্যায় অথবা তিনি বলেছেন, সে ফেতনার কাছাকাছি ফিতনায় ফেলা হবে। (অর্থাৎ তোমাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে) তোমাদের প্রত্যেককে (কবরে) উঠানো এবং প্রশ্ন করা হবে, এ ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ্ ﷺ) সম্পর্কে তুমি কী জান? তখন মু’মিন অথবা মুকিন (নবী ﷺ এ দু’টোর মধ্যে কোন শব্দটি বলেছিলেন এ ব্যাপারে বর্ণনাকারী হিশামের মনে সন্দেহ রয়েছে) বলবে, তিনি হলেন, আল্লাহর রাসূল, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ , তিনি আমাদের নিকট সুস্পষ্ট দলীল ও হিদায়াত নিয়ে এসেছিলেন। অতঃপর আমরা ঈমান এনেছি, তাঁর আহবানে সাড়া দিয়েছি, তাঁর আনুগত্য করেছি এবং তাঁকে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। তখন তাঁকে বলা হবে, তুমি ঘুমিয়ে থাক, যেহেতু তুমি নেককার। তুমি যে তাঁর প্রতি ঈমান এনেছ তা আমরা অবশ্যই জানতাম।
আর মুনাফিক বা মুরতাব (সন্দেহ পোষণকারী) (এ দু’টোর মধ্যে কোন্ শব্দটি বলেছিলেন এ সম্পর্কে বর্ণনাকারী হিশামের মনে সন্দেহ রয়েছে)-কেও প্রশ্ন করা হবে যে, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী জান? উত্তরে সে বলবে, আমি কিছুই জানি না। অবশ্য মানুষকে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছি, আমিও তাই বলতাম। হিশাম (রহ.) বলেন, ফাতিমা (রা) আমার নিকট যা বলেছেন, তা সবটুকু আমি উত্তমরূপে স্মরণ রেখেছি। তবে তিনি ওদের প্রতি যে কঠোরতা করা হবে তাও উল্লেখ করেছেন। (সহীহ বুখারী ৯২২)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ মি’রাজের রাত্রে আমি মূসা (আঃ) এর নিকট দিয়ে গিয়েছি। তিনি দেখতে গন্দুম বর্ণের, দীর্ঘদেহী, অনেকটা যেন শানুয়াহ গোত্রীয় লোকদের ন্যায়। ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ) কে দেখেছি, তার রং ছিল শ্বেতলোহিত; সুঠামদেহী আর তার চুলগুলো ছিল স্বাভাবিক। বর্ণনাকারী বলেন, যে নিদর্শনসমূহ কেবল তাকেই দেখানো হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে জাহান্নামের রক্ষী মালিককে এবং দাজ্জালকে দেখানো হয়।
“অতএব, তুমি তার সাক্ষাৎ সম্বন্ধে সন্দেহ করো না”— (সূরা আস্ সিজদাহ ৩২ঃ ২৩) এ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ্ (রাঃ) বলতেন যে, নবী ﷺ মূসা (আঃ) এঁর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। [সহীহ মুসলিম; অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল ঈমান, হাদিস নম্বরঃ ৩০৮, ইফাঃ ৩১৬]
হ্যা, ঐ সাক্ষাৎ রূহানী নয়, স্বশরীরেই ছিল।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যে রাত্রে আমার মি‘রাজ হয়েছিল সে রাত্রে আমি মূসা (‘আঃ)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। লাল বালুকা স্তুপের নিকট তাঁর কবরে তিনি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। [সহীহ মুসলিম; অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল মানাকিব (ফযিলত), হাদিস নম্বরঃ ৬০৫১, ইফাঃ ৫৯৪২]
প্রিয় নবী ﷺ বলেনঃ মিরাজ রজনীতে আমি মূসা (আলাইহিস সালাম) এঁর দেখা পেয়েছি। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী ﷺ মূসা (আলাইহিস সালাম) এঁর আকৃতি বর্ণনা করেছেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) একজন দীর্ঘদেহী, মাথায় কোকড়ানো চুলবিশিষ্ট, যেন শানুআ গোত্রের একজন লোক। নবী ﷺ বলেন, আমি ঈসা (আলাইহিস সালাম) এঁর দেখা পেয়েছি। এরপর তিনি তাঁর আকৃতি বর্ণনা করে বলেছেন, তিনি হলেন মাঝারি গড়নের গৌর বর্ণবিশিষ্ট, যেন তিনি এই মাত্র গোসলখানা হতে বেরিয়ে এসেছেন।
আর আমি ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কেও দেখেছি। তাঁর সন্তানদের মধ্যে আকৃতিতে আমিই তার বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। নবী ﷺ বলেন, তারপর আমার সামনে দু’টি পেয়ালা আনা হল। একটিতে দুধ, অপরটিতে শরাব। আমাকে বলা হল, আপনি যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারেন। আমি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করলাম এবং তা পান করলাম। তখন আমাকে বলা হল, আপনি ফিত্রাতকে গ্রহণ করে নিয়েছেন। দেখুন! আপনি যদি শরাব গ্রহণ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। [সহীহ বুখারী ৩৩৯৪, ৩৪৩৭, সহীহ মুসলিম ৩১৩]