হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই তাঁর কসম! আল্লাহর কিতাবে এমন কোন সূরা নেই যা নাযিল হওয়ার জায়গা সম্পর্কে আমার অজানা, এরূপ কোন আয়াত নেই যার নাযিল হওয়ার স্পষ্ট কারণ আমার অজানা। যদি আমি এমন কোন লোককে জানতাম যিনি আমার তুলনায় অধিক কুরআন জানেন এবং তার নিকট উট যেতে পারে, তবে আমি তার নিকট যাওয়ার জন্য উটে আরোহণ করতাম। (সহীহ মুসলিম ৬২২৭)
ইনি হচ্ছেন সেই আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) যাঁর কাছ থেকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ কুরআন শিক্ষা নিতে বলেছিলেন। (সহীহ মুসলিম ৬২২৯)
আর আমাদের সমাজে কিছু নির্বোধ আছে যারা কুরআনের আয়াতের শানে নুযূল না দেখে, তাফসীর না পড়ে, শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থ প্রয়োগ করে, এগুলোর মাধ্যমে দলিল পেশ করতে থাকে, দু’একটা আয়াত আর হাদিস পড়েই মুজতাহিদ সেজে বসে আছে, ফতোয়াবাজি করে। কুরআনের কিছু কিছু আয়াত বা আয়াতের হুকুম যে রহিত হতে পারে এ বিষয়েও তারা অজ্ঞ, এরা কাফের মুশরিকদের উপর নাযিলকৃত আয়াতও মুসলমানদের উপর প্রয়োগ করে। হ্যা, কিছু আয়াত আছে যেগুলো সাধারণ (উভয়ের জন্য প্রযোজ্য)। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ওরা যেসব আয়াত পেশ করে সেগুলো স্পষ্টতই দেব-দেবী-মুর্তিদের সম্পর্কে নাযিলকৃত যেমনঃ এসব মুর্তিরা যে, শাফায়াত করতে পারবে না এ বিষয়ক। ইমাম বুখারী রহঃ উল্লেখ করেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) এদেরকে (খারেজীদেরকে) নিকৃষ্ট সৃষ্টি বলেছেন যারা কাফেরদের উপর নাযিলকৃত আয়াত মুসলমানদের উপর প্রয়োগ করত। (সহিহ বুখারী ৬৯৩০)
ঐসব নির্বোধদের দেখলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার প্রিয় হাবীব ﷺ এঁর সুন্দর সুন্দর বাণীগুলো খুব মনে পড়ে-
ইমাম তিরমিজি রহঃ ও ইমাম ইবনে মাজাহ রহঃ মারিকা অর্থাৎ খারিজীদের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন,
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ শেষ যুগে আবির্ভাব ঘটবে এক সম্প্রদায়ের, যারা বয়সে হবে নবীন, বুদ্ধিতে অপরিপক্ক ও নির্বোধ হবে। তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের গলার নীচের হাড়ও অতিক্রম করবে না। তারা সৃষ্টির সেরা মানুষের কথাই বলবে, কিন্তু তারা এমনভাবে ধর্ম হতে বেরিয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। (সূনান আত তিরমিজী ২১৮৮, সুনান ইবনে মাজাহ ১৬৮)
ইমাম বুখারী রহঃ বর্ণনা করেন-
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, শেষ যামানায় এমন একদল মানুষের আবির্ভাব হবে, যারা হবে কমবয়স্ক এবং যাদের বুদ্ধি হবে স্বল্প। ভাল ভাল কথা বলবে, কিন্তু তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান গলার নীচে পৌঁছবে না। (সহিহ বুখারী ৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩০)
এই খারেজীদের পূর্বপুরুষ প্রকাশ পেয়েছিল প্রিয় নবী ﷺ এঁর সময়ে তাঁর শানে বেয়াদবীর মাধ্যমে। অতঃপর সে এমনভাবে অভিশপ্ত হল যে, তার বংশধর-সঙ্গী-সাথী-অনুসারীরা উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক ইবাদাতকারী হিসেবে বিরাজ করেও জাহান্নামের কুকুর বলে অভিহিত হয়েছে এবং এ কুকুরগুলো সর্বাবস্থায় বিরাজ থাকার কথা এবং শেষে ঐ অভিশপ্ত দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে বলেও বলেছেন। ইমাম নাসাঈ রহঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তারা সর্বাবস্থায় আবির্ভূত হতে থাকবে। পরিশেষে তাদের সর্বশেষ দলটি বের হবে মাসীহে দাজ্জাল-এর সাথে। (নাসাঈ ৪১০৩, মিশকাত ৩৫৫৩) সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে “খারেজীর আলোচনা” নামক পরিচ্ছেদের ১৭৪ নং হাদিস শরীফেও এসেছে, এই খারেজীদের মধ্যে থেকেই দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। এদের বৈশিষ্ঠ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম বুখারী রহঃ আরো বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
তাদের নামাজের তুলনায় নিজের নামাজ এবং রোজা নগণ্য বলে মনে করবে (তাদের ‘আমলের তুলনায় তোমাদের ‘আমলকে তুচ্ছ মনে করবে)। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে কিন্তু কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না।… (সহীহ বুখারী ৩৬১০, ৫০৫৮….)
বিদআতী ৭২ বাতিল ফেরকার মধ্যে খারেজীদের থেকেই কয়েকটা দলের অাবির্ভাব হবে। উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী ছাড়াও এদের আরো একটি আলামত বর্ণিত হয়েছে, সেটা হল মাথা মুন্ডানো (মাথা নেড়াওয়ালা গোষ্ঠী)। (সুনান আবূ দাউদ ৪৭৬৫)
এছাড়াও বাতিল ফেরকার অনুসারীদের আরো একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা মুতাশাবিহাত (অস্পষ্ট) আয়াতসমূহ দিয়ে দলিল পেশ করার চেষ্টা করে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ কুরআন পাঁচটি বিষয়সহ নাযিল হয়েছেঃ (১) হালাল (২) হারাম (৩) মুহ্কাম (৪) মুতাশাবিহ ও (৫) আমসাল (উপদেশপূর্ণ ঘটনা)। সুতরাং তোমরা হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম মনে করবে। মুহকামের উপর ‘আমল করবে, মুতাশাবিহের সাথে ঈমান পোষণ করবে। আর আমসাল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৮২]
মুতাশাবিহাত আয়াতের ক্ষেত্রে হুকুম হচ্ছে –
আম্মাজান আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এ আয়াত (সূরা আলে ইমরানঃ ৭) এর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে প্রশ্ন করা হলঃ (আয়াতটি)
“তিনিই আপনার উপর এমন কিতাব নাযিল করেছেন, যার কতিপয় আয়াত মৌলিক-সুস্পষ্ট অর্থবোধক (মুহকামাত), এগুলো হল কিতাবের মূল আর অন্যগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয় (মুতাশাবিহাত, রুপক); কিন্তু যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা গোলযোগ (ফিতনা) সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে উক্ত আয়াতগুলোর অনুসরণ করে যেগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। মূলত; এর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ’র-ই জানা আছে (আল্লাহ কাউকে জানালে শুধুমাত্র তিনি জানতে পারেন)। যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে যে, আমরা তার উপর ঈমান এনেছি, এ সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে, মূলতঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই নসীহত গ্রহণ করে না।”
(জবাবে) রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ তোমরা কুরআনের মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের অনুসারীদের দেখলে অনুধাবন করে নিবে যে, আল্লাহ তা’আলা এদেরই নামোল্লেখ করেছেন। কাজেই তোমরা তাদের পরিহার করবে। (সাবধান থাকবে) (সূনান তিরমিজী ২৯৯৪, সহীহ বুখারী ৪৫৪৭)
সূনান আত তিরমিজীর ২৯৯৩ এ রয়েছে, অধঃস্তন এক বর্ণনাকারীর বর্ণনায় আছেঃ তোমরা তাদের দেখলে চিনে রাখবে। তিনি দুই অথবা তিনবার এ কথা বলেছেন।
তাই আমরা অস্পষ্ট বা মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহের পিছনে ছুটব না। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, “তাঁর কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা (সূরা আশ-শুরাঃ ১১)”। তিনি অনাদিকাল থেকে আছেন, অনন্তকাল থাকবেন। তিনি স্থান-আকার-আকৃতি এসবের মুখাপেক্ষী নন, এসব থেকে মুক্ত (পবিত্র)। স্থান-আকার-আকৃতি এগুলো শুধুমাত্র সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, স্রষ্টার নয়। ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’য়ালাকে মানবীয় গুণাবলী হতে কোন গুণের দ্বারা গুণান্বিত করবে সে কাফির।” (ইমাম তাহাবী, আকিদাতুত তাহাভী, ৪১ পৃষ্ঠা, আকিদা নং ৩৪)
ফলে অস্পষ্ট অর্থসমৃদ্ধ কিছু আয়াতকে অপব্যাখ্যা করে যারা আল্লাহ’র জন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, স্থান (আরশ) সাব্যস্থ করে, আমাদের উচিৎ তাদেরকে চিহ্নিত করে রাখা এবং তাদের থেকে দূরে থাকা যাতে আমাদের ঈমান আমল হেফাজতে থাকে। এত সুন্দর করে কুরআন ও হাদিসে নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করার পরও যারা হক্ব-বাতিল অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে না, তাদের জন্য শতকোটি আফসোস। হ্যা, এটা মনে রাখা উচিৎ ৭২ বাতিল ফেরকার সবাই চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, কিন্তু যাদের আকীদায় কুফরী রয়েছে সেসব মুনাফিকরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আমরা কাউকে ফতোয়া দিব না, আমাদের ইমামগণ যাদেরকে তাকফির করেছেন তাদেরকে ব্যতিত কিন্তু আমরা এসব বাতিল ফেরকার বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকব। আল্লাহ’র নির্দেশ অনুযায়ী সাদেকীন তথা সত্যবাদীদের সাথে থাকব।
আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
“(হে নবী) আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা ছোয়াদঃ ২৯) “তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মদঃ ২৪) “আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণ/ স্মরণ করার জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী/ স্মরণকারী আছে কি? (সূরা আল ক্বামারঃ ১৭,২২,৩২,৪০)