আজ ২রা শাবান। ১৫০ হিজরির এই দিনে কারারুদ্ধ অবস্থায় বিষপানে ইমামে আজম আবূ হানিফা (নূমান ইবনে সাবিত) রাঃ কে হত্যা করা হয়। তিনি প্রতিষ্ঠিত হক্ব চার মাজহাবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসরণকারী হানাফি মাজহাবের মহান ইমামই নন বরং তিনি একজন তাবেঈও বটে অর্থাৎ তিনি তাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন যাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হয়েছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ফিকহুল আকবরের শুরুতে রয়েছে, উনার উস্তাদদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাহাবা এবং ৯৩ জন তাবেঈন।
শুধু তা-ই নয়, হাদিস শিক্ষার জন্য তিনি বিভিন্ন দেশে সফরকালে, যখন মক্কা থেকে মদীনা আসেন তখন প্রিয় নবী ﷺ বংশের প্রদীপ সায়্যিদুনা ইমাম বাকের রাঃ এঁরও সাহচর্য পান। ১১৪ হিজরিতে ইমাম বাকের রাঃ এঁর ওফাতের পর উনার পুত্র, নবী বংশের অন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সায়্যিদুনা ইমাম জাফর সাদেক রাঃ এঁর সাহচর্যে থেকে ইলম হাসিল করতে থাকেন। আহলে বাইত সম্পর্কে ইমামে আজম আবূ হানিফা রহঃ বলতেন যে, হাদিস ও ফিকহের তথা যাবতীয় মাজহাবী ইলম আহলে বাইতের বিদ্যালয় থেকে নিঃসৃত। ইমাম আবূ হানিফা বলেন, ইমাম জাফর সাদিক রাঃ এঁর মত ফকিহ বা বুদ্ধিমান আমি কখনো দেখিনি।
এছাড়াও ইমাম আবূ হানিফা রহঃ কুফার ইমাম শা’বী রহঃ এঁর নিকট থেকে হাদিসের দরস নেন, যিনি পাঁচ শতাধিক সাহাবীকে দেখেছিলেন। তিনি বসরার হযরত কাতাদা রাঃ এর দরসে হাজির হন এবং হযরত শু’বা রাঃ এঁর দরসেও যোগ দেন যাঁকে হাদিস শাস্ত্রে আমীরুল মুমিনীন বলা হয়। তিনি আবূ হানিফা রহঃ সম্পর্কে বলেন, আবূ হানিফা ও ইলম দুই বস্তু নয়। (আল ফিকহুল আকবর ইফাঃ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪)
ইবনে কাছীর ‘ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে , ইমাম শাফিঈ রহঃ বলেনঃ “যে কেউ ফিকহ জানতে ইচ্ছা করে, সে আবু হানীফা রাঃ এঁর মুখাপেক্ষী।” (১০/১০৭ )
শুধুমাত্র ইলমের জগতেই তাঁর আধিপত্য ছিল এমন নয়। উনার জীবন ছিল আমলেও পরিপূর্ণ।
খলীফা হারুন অর রশীদ একবার ইমাম আবু ইউসূফ রহঃ কে ইমাম আবূ হানীফা রহঃ সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বলেনঃ ইমাম আবু হানীফা রাঃ ছিলেন একজন মহান চরিত্রের অধিকারী সম্মানিত ব্যক্তি। দুনিয়াদারদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন এবং পার্থিব যশ ও গৌরব তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। খুব বড় আলিম ছিলেন। সম্পদের ন্যায় জ্ঞান বিতরণে ছিলেন উদার। ইমাম সাহেব প্রত্যহ ফজরের নামাযের পর দীর্ঘক্ষণ তিলাওয়াতে কুরআন ও নির্ধারিত অযীফা আদায় করতেন। তারপর আগন্তুকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। যােহরের নামাযের পর ঘরে যেতেন । দুপুরের আহারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন । আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত লােকদের সঙ্গে দেখা – সাক্ষাৎ করতেন ও ব্যবসায় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারক করতেন । মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত দরস দিতেন । এশার পর প্রায়ই মসজিদে থাকতেন এবং ফজর পর্যন্ত তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য অযীফা আদায় করতেন । তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ। কারাে দুঃখ – বেদনায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। সাধ্যানুযায়ী মানুষের সাহায্য করতেন । বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন । তিলাওয়াতের সময় তার চোখ থাকত অশ্রুসিক্ত । নামাযে কিংবা নামাযের বাইরে যখনই আযাবের অথবা ধমকের কোন আয়াত তিলাওয়াত করা হতাে তখন তাঁর ওপর এমন প্রভাব করতাে যে , তিনি কাঁপতে থাকতেন ও চোখ দিয়ে অশ্রু বিগলিত হতো। (আল ফিকহুল আকবর ইফা:, ১৬ পৃষ্ঠা)
তিনি জীবনে কখনাে নিজের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরত সায়্যিদুনা ইমাম হাম্মাদ রাঃ এঁর সম্মানিত ঘরের দিকে পা প্রসারিত করে ঘুমাননি । অথচ তাঁর ঘর ও তাঁর সম্মানিত উস্তাদপর ঘরের মধ্যে প্রায় সাতটি গলির ব্যবধান ছিল। (এমনকি উনার একমাত্র পুত্রের নামও রাখেন হাম্মাদ) (আল খায়রাতুল হিসান ৮২ পৃষ্ঠা)
ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ বলেন : ইমাম আযম রাঃ রমজান মাসে ঈদের দিন সহ ৬২ বার কুরআন খতম আদায় করতেন । (দিনে এক খতম , রাতে এক খতম , তারাবীহতে সারা মাসে এক খতম , ঈদের দিনে এক খতম )। তিনি প্রচুর সম্পদ দান করতেন। ইলম শিক্ষাদানে খুবই ধৈৰ্যশীল ছিলেন । নিজের সম্পর্কে কৃত সমালােচনা । কেবল শুনে থাকতেন ; একটুও রাগ করতেন না। তিনি বিরতিহীন (রোজা রাখার হারাম দিনগুলো ব্যতিত) ত্রিশ বছর ধরে রােজা রেখেছেন। ত্রিশ বছর যাবৎ এক রাকাত নামাযে সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদ খতম করতে থাকেন । চল্লিশ (বা ৪৫) বছর পর্যন্ত ইশার ওযু দিয়ে ফজরের নামায আদায় করেছেন। যে স্থানে তাঁর ওফাত হয় সেই স্থানে তিনি সাত হাজার বার কুরআন পাক খতম করেছেন।
(আল খায়রাতুল হিসান , পৃষ্ঠা- ৫০)
এখন আবার অনেকের মনে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি হতে পারে এত এত ইবাদত, এত কম সময়ে এত বেশি কুরআন খতম কি করে করতেন!! হ্যা, এগুলো সাধারণদের পক্ষে সম্ভব নয়, আল্লাহওয়ালা তথা আল্লাহর বন্ধু বা আউলিয়ারা এমন হয়। বুখারীর হাদিসে কুদসীতে রয়েছে, সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“যে ব্যক্তি আমার কোন অলি বা বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, তা দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই…. সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি।..
হযরত মাওলা আলী রাঃ ঘোড়ার উপর আরোহন করার সময় এক রিকাবে পা রাখতেন তখন কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন আর অপর রিকাবে কদম রাখার আগে আগে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করে নিতেন। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত, পৃষ্ঠা ২১২)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, দাউদ (‘আঃ) এঁর জন্য কুরআন (যাবুর) তেলাওয়াত সহজ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর পশুযানে গদি বাঁধার আদেশ করতেন, তখন তার উপর গদি বাঁধা হতো। অতঃপর তাঁর পশুযানের উপর গদি বাঁধার পূর্বেই তিনি যাবুর তিলাওয়াত করে শেষ করে ফেলতেন। তিনি নিজ হাতে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহিহ বুখারী ৩৪১৭)
এমনকি ভন্ড আহলে হাদিসদের এপ্স আল হাদিস, বাংলা হাদিস এবং hadithbd ওয়েবসাইটের সুনান আত তিরমিজির ২৯৪৬ নং হাদিসের ফুটনোটে রয়েছে, হযরত উসমান (রাঃ) বিতরের শেষ রাকাআতে সম্পূর্ণ কুরআন শেষ করতেন। সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাহঃ) কা’বা শরীফে এক রাকাআতে সম্পূর্ণ কুরআন শেষ করেছেন।
হ্যাঁ, এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের অসংখ্য ক্ষমতা (মু’জিযা ও কারামত) দিয়ে থাকেন এবং আর তা-ই তো মুনাফিকরা নবীজির জ্ঞান সমালোচনা করলে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় আমাদের নবী ﷺ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত নামাজসমূহ আদায়ের পরপর মিম্বরে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির সূচনা থেকে পূর্বে যা ঘটেছে, ভবিষ্যতে যা ঘটবে, এমনকি জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীর নিজ স্থানে প্রবেশের কথাও জানিয়ে দেন। (সহীহ মুসলিম ৭১৫৯, সহীহ বুখারী ৩১৯২, সুনান আবূ দাউদ ৪২৪০)। এছাড়াও প্রিয় নবী ﷺ বলেনঃ আমি ‘জাওয়ামিউল কালিম (ব্যাপক অর্থবহ সংক্ষিপ্ত কথা) সহ প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। (অর্থাৎ তিনি এমন সংক্ষিপ্ত কথা বলতেন যা শব্দ বা উচ্চারণের দিক থেকে হত অল্প কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক) (সহীহ বুখারী ৭২৭৩)
১৫০ হিজরির ২ রা শাবান শাহাদাতের অমৃত সুধা পানের মাধ্যমে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আজও পুরো মুসলিম বিশ্ব তার রেখে যাওয়া অবদানগুলোর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত উপকৃত হতে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, উনি আল্লাহ তায়ালার এমন নৈকট্য হাসিল করেছেন যে, পূর্ববর্তী বুজুর্গগণও উনার মাজার জিয়ারত করে উনার উসিলায় বরকত হাসিল করতেন।
ইমাম শাফেঈ রহঃ বলেন, “নিশ্চয়ই আমি ইমাম আবু হানিফা রহঃ হতে বরকত হাসিল করি। যখন আমার কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন আমি উনার মাজার শরীফে এসে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। অতঃপর উনার উসীলা দিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনা করি। তা অতি তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যায়। [ফতোয়ায়ে শামী, মুকাদ্দিমা ১ম খন্ড ৫৫ পৃষ্ঠা। তারিখে বাগদাদ,১ম খন্ড, পৃঃ ১২৩। রুদ্দুল মুখতার, ১ম খন্ড,পৃঃ৩৮]
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহঃ) লিখেন, উলামা ও যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এঁর মাজারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা উসিলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাজারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর রহঃ) কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমি দু’রাকাত নামাজ আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর ওসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায়। [খায়রাত আল্ হিসান, ১৬৬ পৃষ্ঠা]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এ মহান ইমামের উসিলায় আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিক। আমাদেরকে সহজ সরল সঠিক পথের উপর দায়েম ও কায়েম রাখুক।