উটের মূত্র পান হারাম হওয়া সত্ত্বেও ঐ লোকদেরকে কেন সেই মূত্র পান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন..!!
—-
একদল লোক (আটজন) রাসূলূল্লাহ্ ﷺ এঁর কাছে এল। তারা তাঁর হাতে ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করল। কিন্তু সে এলাকার আবহাওয়া তাদের অনুকূলে হল না এবং তারা অসুস্থ হয়ে পড়ল। তারা রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এঁর কাছে এর অভিযোগ করল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি আমার রাখালের সঙ্গে তার উটপালের কাছে গিয়ে সেগুলোর দুধ ও মূত্র পান করবে না? তারা বলল, হ্যাঁ। তারপর তারা সেখানে গিয়ে সেগুলোর দুধ ও মূত্র পান করল। ফলে তারা সুস্থ হয়ে গেল।
(সহিহ বুখারী ৬৮৯৯)
এভাবে তো আরো অনেক ঘটনা পাওয়া যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অসুস্থতার অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে আসতেন কিংবা তাঁর ওফাতের পর তাঁর ব্যবহৃত জুব্বা বা তাঁর চুল মুবারককে শিফার উসিলা হিসেবে ব্যবহার করতেন যেভাবে আমরা ওষুধকে ব্যবহার করি। কিন্তু উপরিউক্ত ঘটনা ছাড়া রাসূলুল্লাহ্ ﷺ কখনো এমন নিকৃষ্ট হারাম জিনিস পান করার অনুমোদন দিয়েছেন এমন কোন ঘটনা কি পেয়েছেন?? আসুন কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়।
ইবনে আবূ ‘উবায়দ (র.) বলেন, আমি সালামাহ (ইবনে আকওয়া) (রাঃ)-এঁর পায়ের নলায় আঘাতের চিহ্ন দেখে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আবূ মুসলিম! এ আঘাতটি কিসের? তিনি বললেন, এ আঘাত আমি খাইবার যুদ্ধে পেয়েছিলাম। লোকজন বলাবলি করল, সালামাহ মারা যাবে। আমি নবী ﷺ-এঁর কাছে আসলাম। তিনি ক্ষতটিতে তিনবার ফুঁ দিলেন। ফলে আজ পর্যন্ত এসে কোন ব্যথা অনুভব করিনি।
(সহীহ বুখারী ৪২০৬)
(খাইবারের যুদ্ধের সময়) রাসূলূল্লাহ্ ﷺ বলেন, আমি আগামীকাল এমন এক ব্যক্তিকে পতাকা দিব যাঁর হাতে আল্লাহ্ বিজয় দান করবেন [সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ পাক রাসূলে পাককে ভবিষ্যতের বিষয়গুলো সম্পর্কেও অবগত করেছেন। এজন্যই তো, রাসূলুল্লাহ ﷺ একদিন ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নামাজসমূহ আদায়ের পরপর মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা (বর্ণনা) দিতে থাকেন। এ ভাষণে তিনি পূর্বে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সব জানিয়ে দেন। (সহীহ মুসলিম ৭১৫৯) তিনি ﷺ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন। অবশেষে তিনি জান্নাতবাসী ও জাহান্নাম বাসীর নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করার কথাও উল্লেখ করলেন। যাদের স্মরণশক্তি ভাল ছিল, তারা এগুলো স্মরণ রাখতে পেরেছেন, বাকিরা ভুলে গিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ৩১৯২)]। রাবী বলেন, তারা এই আগ্রহ ভরে রাত্রি যাপন করলেন যে, কাকে এ পতাকা দেয়া হবে। যখন ভোর হল তখন সকলেই রাসূলূল্লাহ্ ﷺ এঁর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাদের প্রত্যেকেই এ আশা করছিলেন যে পতাকা তাকে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আলী ইবনু আবূ তালিব কোথায়? তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলূল্লাহ্ ﷺ তিনি চক্ষু রোগে আক্রান্ত। তিনি বললেন, কাউকে পাঠিয়ে তাকে আমার নিকট নিয়ে এস। যখন তিনি এলেন, তখন রাসুল ﷺ তাঁর দু’চোখে থুথু লাগিয়ে দিলেন এবং তাঁর জন্য দু‘আও করলেন। এতে তিনি এমন সুস্থ হয়ে গেলেন যেন তাঁর চোখে কোন রোগই ছিল না। রাসূল ﷺ তাঁকে পতাকাটি দিলেন। (সহিহ বুখারী ৩৭০১)
এক অন্ধ সাহাবী নবী ﷺ এঁর নিকট এসে আরজ করলেন, আপনি আল্লাহ্র কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে রোগমুক্তি দান করেন। তিনি বলেনঃ তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুআ করতে বিলম্ব করবো, আর তা হবে কল্যাণকর। আর তুমি চাইলে আমি দুআ করবো। সে বললো, তাঁর নিকট দুআ করুন। তিনি তাকে উত্তমরূপে উযূ করার পর দু রাকআত নামাজ পড়ে এ দুআ করতে বলেনঃ
হে আল্লাহ্! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এঁর উসিলা দিয়ে, আমি তোমার প্রতি মুতাওয়াজ্জু হচ্ছি/ মনোনিবেশ করলাম। ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আমার চাহিদা পূরণের জন্য আমি আপনার উসীলা দিয়ে আমার রবের প্রতি মনযোগী/ মুতাওয়াজ্জু হলাম যাতে আমার প্রয়োজন মিটে। হে আল্লাহ্! আমার জন্য তাঁর সুপারিশ কবূল করো। (অতঃপর তার অন্ধত্ব দূর হয়। বর্তমানে এর উপর আমল করতে চাইলে, “ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ” এর স্থলে “ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ” বলতে বলা হয়েছে) (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৩৮৫, সুনান আত তিরমিযি ৩৫৭৮)
আবদুল্লাহ ইবনু মাওহাব (র.) বলেন, আমাকে আমার পরিবারের লোকেরা এক পেয়ালা পানিসহ উম্মু সালামাহ্র কাছে পাঠাল। (উম্মু সালামাহ্ রা. কাছে রক্ষিত) একটি পানির পাত্র হতে (আনাসের পুত্র) ইসরাঈল তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কিছু পানি তুলে নিল। ঐ পাত্রের মধ্যে নবী ﷺ এঁর কয়েকটি চুল ছিল। কারো চোখ লাগলে কিংবা কোন রোগ দেখা দিলে, উম্মু সালামাহ্র নিকট হতে পানি আনার জন্য একটি পাত্র পাঠিয়ে দিত। আমি সে পাত্রের মধ্যে একবার তাকালাম, দেখলাম লাল রং-এর কয়েকটি চুল।
(সহিহ বুখারী ৫৮৯৬)
আসমা (রাঃ) এঁর নিকট রাসুলুল্লাহ ﷺ এঁর ব্যবহৃত জুব্বা ছিল। তিনি বলেন, এটি আয়িশা (রা.) এঁর ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। তাঁর ওফাতের পর আমি এটি নিয়েছি। নবী ﷺ এটি পরিধান করতেন। তাই আমরা রোগীদের শেফা হাসিলের জন্য এটি ধৌত করি এবং সে পানি তাদের কে পান করিয়ে থাকি। (সহীহ মুসলিম ৫৩০২)
কোন ক্ষেত্রেই তো শিফার উসিলা হিসেবে মূত্রের মত হারাম কিছু ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু হ্যা, প্রিয় নবী ﷺ যুবায়র (রাঃ) ও ‘আবদুর রহমান (রাঃ)-কে তাদের চর্মরোগের বা শরীরে চুলকানীর কারণে রেশমী কাপড় পরিধান করার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। (সহীহ বুখারী ৫৮৩৯, ২৯১৯) অথচ রেশমি কাপড় পরিধান করা পুরুষদের জন্য হারাম। কেননা একবার প্রিয় নবী ﷺ ডান হাতে রেশম ও বাম হাতে স্বর্ণ নিয়ে বলেনঃ এ দু’টি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম। (সূনান আবূ দাউদ ৪০৫৭)
হারাম হওয়া সত্ত্বেও উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে মূত্র পানের অনুমোদন এবং রেশমি কাপড় ব্যবহারের অনুমোদন রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছিলেন বলেই তারা ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন, “আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক।” (সূরা হাশরঃ ৭) তিনি কখনো মনগড়া কথা বলেন না। তা তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজম ৩-৪) এছাড়াও তিনি নির্দেশ দিলে সেটায় শরীয়ত হয়ে যায়। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যদি আমি মু’মিনদের জন্য কষ্টকর মনে না করতাম, তবে তাদের অবশ্যই ‘ইশার নামাজ বিলম্বে আদায় করার এবং প্রত্যেক নামাজের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম। (সূনান আবূ দাউদ ৪৬)
কিন্তু হারাম হওয়া সত্ত্বেও উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে মূত্র পানের অনুমোদন এবং রেশমি কাপড় ব্যবহারের অনুমোদন রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছিলেন বলে এখন কারো চর্মরোগ হলেই সে রেশমি কাপড় পরিধান করতে পারবে না কিংবা উটের মূত্র পান করতে পারবে না (মূত্র পান করা হারাম)। সেগুলো ছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর বিশেষ নির্দেশ এবং বর্তমানে রোগমুক্তির জন্য অনেক হালাল ওষুধের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু একান্ত নিরুপায় হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে হুকুম ভিন্ন। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, “তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে তা তোমাদের জন্য বিশদভাবে বলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।” (সূরা আনআমঃ ১১৯)
আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসলাম। কেন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ তাদেরকে এমন নিকৃষ্ট হারাম- মূত্র পান করতে বললেন?? কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এর মধ্যেই তাদের রোগের শিফা রেখেছিলেন এবং আল্লাহ’র দয়ায় রাসূলে পাক ﷺ এঁরও তা জানা ছিল। মনের ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে, এমন নিকৃষ্ট জিনিসের মধ্যেই বা কেন তাদের রোগের শিফা রাখলেন?? উত্তর আসে, তারা যে, মুনাফিক ছিল এবং পরবর্তীতে যে, তারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করবে সেটা তো আল্লাহ পাকের জানাই ছিল এবং আমার আকীদা এটাও যে, মহান আল্লাহ পাকের দয়ায় তাঁর প্রিয় হাবিব ﷺও এই বিষয়ে অবহিত ছিলেন। কেননা মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে মানুষের অন্তরের খবর জানারও ক্ষমতা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমরা কি মনে কর যে, আমার দৃষ্টি (কেবল) ক্বিবলার দিকে? আল্লাহর কসম! আমার নিকট তোমাদের খুশু’ (অন্তরের বিনয়/ নামাজের একাগ্রতা) ও রুকূ’ কিছুই গোপন থাকে না। অবশ্যই আমি আমার পেছন হতেও তোমাদের দেখতে পাই।(সহীহ বুখারী ৪১৮)
তাদের মুনাফেকী বা মুরতাদ হওয়ার স্বরূপ এই যে, উটের দুধ এবং মূত্র খেয়ে সুস্থ হওয়ার পর তারা রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এঁর রাখালকে (নির্মমভাবে) হত্যা করে উটগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে চলল। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এঁর কাছে পৌঁছলে তিনি তাদের পেছনে ধাওয়া করার জন্য লোক পাঠালেন। তারা ধরা পড়ল এবং তাদেরকে নিয়ে আসা হল। তাদের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হল। তাদের হাত-পা কাটা হল, লৌহশলাকা দিয়ে তাদের চোখ ফুঁড়ে দেয়া হল। এরপর তপ্ত রোদে তাদেরকে ফেলে রাখা হল। অবশেষে তারা মারা গেল।
(সহিহ বুখারী ৬৮৯৯)
দলটিকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়েছিল কারণ তারা ছিল ধর্মত্যাগী (মুরতাদ), হত্যাকারী, ডাকাত, খিয়ানতকারী। প্রশ্ন হতে পারে, রাসূলুল্লাহ ﷺ যদি জেনে থাকেন যে, তারা মুনাফিক ছিল তাহলে তাদেরকে প্রথমেই কেন হত্যা করলেন না!! আমার উত্তর হবে, খারেজীদের পূর্বপুরুষ যুল খুওয়াইসিরা যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর শানে বেয়াদবী করে তার মুনাফেকী প্রকাশ করে দিল, তখন হযরত উমর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমাকে অনুমতি দিন আমি এ মুনাফিকটাকে হত্যা করি। তিনি ﷺ বললেন, আল্লাহর পানাহ, এতে লোকেরা রটাবে যে, আমি আমার সঙ্গীদের হত্যা করছি। আর এ ব্যক্তি ও তার সাথীরা কুরআন পাঠ করবে- কিন্তু তাদের এ পাঠ তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা কুরআন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
(সহিহ মুসলিম ২৩৩৯)
কোন একটা হাদিস কিংবা ঘটনা দিয়েই একটা পুরো বিষয়কে বিবেচনা করা/ ঐ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিৎ নয় বরং ঐ বিষয়ে কুরআন হাদিসের সকল বর্ণনা বিবেচনা করেই এবং অত্র বিষয়ের ব্যাখ্যায় ফোকাহায়ে কেরাম/ ইমামগণ কি বলেছেন সেগুলো বিবেচনা করেই পুরো বিষয়টাকে মূল্যায়ন করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমার ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করুক। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ ই অধিক অবগত আছেন।