১.
রাষ্ট্রপ্রধানের জবাবদিহিতা
মুহাম্মাদ বিন ওবায়দুল্লাহ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিকটে কিছু কাপড় আসলে তিনি সেগুলি হকদারগণের মাঝে বণ্টন করে দেন। এতে আমাদের প্রত্যেকে একটি করে কাপড় পেল। কিন্তু তিনি নিজে দু’টি কাপড় দিয়ে তৈরী একটি পোষাক পরিধান করে খুৎবা দিতে মিম্বরে আরোহণ করলেন। কিন্তু শ্রোতাদের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে লোকসকল! তোমরা কি আমার কথা শ্রবণ করছ না? এমতাবস্থায় বিখ্যাত ছাহাবী সালমান ফারেসী (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, জি না, আমরা শ্রবণ করব না। ওমর (রাঃ) বললেন, কেন হে আবু আব্দুল্লাহ? তিনি বললেন, আপনি আমাদেরকে একটি করে কাপড় দিয়েছেন। অথচ আপনি পরিধান করেছেন (দুই কাপড়ের) বড় পোষাক ! ওমর (রাঃ) বললেন, ব্যস্ত হয়ো না হে আবু আব্দুল্লাহ! অতঃপর তিনি ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর দিকে ইশারা করলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহ্র কসম করে জিজ্ঞেস করছি, আমার পোষাকে যে অতিরিক্ত কাপড় রয়েছে, সেটা কি তোমার নয়? আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বললেন, জি, আমার । অতঃপর সালমান ফারেসী (রাঃ) বললেন, এখন আপনি বক্তব্য শুরু করুন, আমরা শ্রবণ করব (ইবনুল কাইয়িম, ই’লামুল মুওয়াকেঈন ২/১২৩; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ১/২০৩)।
শিক্ষা : রাষ্ট্রপ্রধান জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। তাঁকে পরকালে যেমন আল্লাহ্র কাছে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি দুনিয়াতেও তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন ।
২.
আমানতদারিতার অনন্য দৃষ্টান্ত
ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৬ হিজরীতে মুসলিম সৈন্যদল মাদায়েন জয় করেছে। গণীমতের মাল জমা হচ্ছে। এমন সময় এক ব্যক্তি মহামূল্যবান ধন রত্ম নিয়ে এল। জমাকারী বললেন, এমন মূল্যবান সম্পদ তো আমরা ইতিপূর্বে দেখিনি। তুমি এখান থেকে নিজের জন্য কিছু রেখে দাওনি তো ভাই? লোকটি বলল, “ palailypal, ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহর ভয় না থাকত, তাহ’লে আমি কখনোই এ সম্পদ আপনাদের কাছে নিয়ে আসতাম না’। সবাই তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, যদি আমি পরিচয় দেই, তাহলে আপনারা আমার প্রশংসা করবেন। অথচ আমি কেবল আল্লাহ্র প্রশংসা করি এবং তাঁর নিকটেই প্রতিদান কামনা করি। এরপর তিনি চলে গেলেন। তখন তার পিছনে একজন লোককে পাঠানো হ’ল এবং জানা গেল যে, তিনি হলেন, আমের বিন আবদে কায়েস (তারীখুত ত্বাবারী
শিক্ষা: আমানতদারিতা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ।
৩.
পাত্রী নির্বাচন
ওমর (রাঃ) জনসাধারণের সঠিক অবস্থা জানার জন্য রাত্রিতে ঘুরে বেড়াতেন । এক রাতে একটি ছোট কুটিরের সামনে এলে তিনি বাড়ীর ভিতরের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। মা মেয়েকে আদেশ করছেন, ‘দুধের সাথে পানি মিশাও। ভোর হয়ে এল। মেয়েটি উত্তর দিল, ‘না মা, ওমর (রাঃ) দুধে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানতে পারলে শাস্তি দিবেন’। মা বললেন, ‘ওমর দেখতে পেলে তো? মেয়ে বলল, ‘আমি প্রকাশ্যে তাঁর আনুগত্য করব, আর গোপনে তাঁর অবাধ্যতা করব? আল্লাহ্র কসম! এটা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলল, ওমর (রাঃ) হয়ত আমাদেরকে দেখছেন না, কিন্তু তাঁর প্রভু তো আমাদেরকে দেখছেন! গোপনে সব শুনে ওমর (রাঃ) বাড়ীটি চিহ্নিত করে ফিরে এলেন। পরে তার ছেলে আছেমের সাথে ঐ মেয়ের বিবাহ দিলেন। তার গর্ভে দু’টি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করল, যাদের একজনের গর্ভে ওমর বিন আব্দুল | আযীয (রহঃ)-এর জন্ম হয়েছিল (তারীখু মাদীনাতি দিমাশক ৭০/২৫৩)।
শিক্ষা : পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল গুণের উপর দ্বীনদারী ও আল্লাহভীরুতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৪.
হাক্কুল ইবাদ রক্ষার অনুপম দৃষ্টান্ত
সিরিয়া বিজেতা সেনাপতি আৰু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রাঃ) যুদ্ধ কৌশল হিসাবে সিরিয়া থেকে আপাততঃ সৈন্যদল পিছিয়ে অন্যত্র চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে সিরিয়ার খৃষ্টান নেতৃবৃন্দকে ডেকে তিনি তাদের নিকট থেকে গৃহীত জিযিয়া কর ফেরত দিয়ে দিলেন। এতে শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দলে দলে এসে ক্রন্দন করতে লাগল ও আকুতি-মিনতি করে বলতে লাগল, আপনারাই আমাদের এলাকা শাসন করুন। আমাদের স্বজাতি খৃষ্টান যালেম শাসকদের হাতে আমাদেরকে পুনরায় ন্যস্ত করবেন না। সেনাপতি বললেন, *আপাততঃ আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু আপনাদের প্রদত্ত জিযিয়া কর আমরা রাখতে পারি না’। হাক্কুল ইবাদ রক্ষার এই অনুপম দৃষ্টান্ত দেখে তারা খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল (বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃঃ ১৩৪)।
শিক্ষা : তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করেছে- এ ধারণা সর্বৈব নির্জলা মিথ্যা। বরং মুসলমানদের আদব-আখলাক ও জনগণের অধিকার রক্ষায় তাদের সচেতনতাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
৫.
ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর সাদাসিধে জীবনযাপন
খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাঃ) আড়াই বছর খেলাফতে থাকার পর মাত্র সাড়ে ৩৯ বছর বয়সে শত্রুদের বিষ প্রয়োগে শাহাদত বরণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হ’ল যে, তিনি দুটি বদ্ধ ঘরে সোনা-দানা ভর্তি করে রেখে গিয়েছেন, যার সবই রাষ্ট্রীয় বায়তুল মাল থেকে তিনি আত্মসাৎ করেছেন। পরবর্তী খলীফা ইয়াযীদ বিন আব্দুল মালেক অভিযোগকারীকে সাথে নিয়ে ওমরের বাড়ীতে গিয়ে উক্ত কক্ষ দু’টি খুললেন। দেখা গেল সেখানে আছে কেবল একটি চামড়ার চেয়ার, একটি পিতলের বদনা, ৪টি পানির কলসি। অন্য ঘরে আছে একটি খেজুর পাতার চাটাই, যা মুছাল্লা হিসাবে রাখা হয়েছে। আর আছে ছাদের সঙ্গে ঝুলানো একটি শিকল। যার নীচে গোলাকার একটি বেড়ী রয়েছে, যার মধ্যে মাথা ঢুকানো যায়। ইবাদতে রাত কাটানোর সময় কাহিল হয়ে পড়লে বা ঝিমুনি আসলে এটা তিনি মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন, যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন। সেখানে একটি সিন্দুক পেলেন, যার মধ্যে একটি টুকরী পেলেন। যাতে ছিল একটি জামা ও একটি ছোট পাজামা। আর তাঁর পরিত্যক্ত বস্তুর মধ্যে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পেলেন, তালি দেওয়া একটা জামা ও একটি মোটা জীর্ণশীর্ণ চাদর। এ অবস্থা দেখে খলীফা কেঁদে ফেললেন এবং অভিযোগকারী ভাতিজা ওমর ইবনে ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’। আমি কেবল লোকমুখে শুনেই অভিযোগ করেছিলাম (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ৯/২২৩)।
শিক্ষা : ইসলামী খিলাফতের খলীফাগণ এমনই মহত্তম দৃষ্টান্ত পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে গেছেন, যা শত্রু-মিত্র সকলের জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা বহন করে।
৬.
বীর সেনানী মুহাম্মাদ বিন কাসিম
বিখ্যাত তরুণ সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম ঐতিহাসিক সিন্ধু বিজয়ের পর মাত্র সাড়ে তিন বছর সেখানে অবস্থান করেন। তাঁর সুচারু দেশ পরিচালনায় সিন্ধুবাসী এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে, যখন তিনি সিন্ধু ছেড়ে রাজধানী দামেশকে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন, তখন সিন্ধুর অমুসলিম নাগরিকরা পর্যন্ত রাস্তায় কেঁদে গড়াগড়ি দিয়েছিল যেন তিনি এ দেশ থেকে চলে না যান। পরে মিথ্যা অজুহাতে যখন তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হ’ল, সে খবর শুনে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাঁর ‘মূর্তি’ গড়ে পূজা শুরু করে দিয়েছিল (বালাযুরী, ফুহুল বুলদান, পৃঃ ৪৪৬)।
শিক্ষা : মুসলিম বিজেতাগণ তাদের সুসভ্য আচরণের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের সোনালী পাতায় লিপিবদ্ধ এমনই অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি একটি জ্বলন্ত ঘটনা।
৭.
অমুসলিমের অধিকার রক্ষায় বাদশাহ আওরঙ্গযেব
বাদশাহ আওরঙ্গযেব বিশাল ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও রাজকোষ থেকে কোন বেতন-ভাতা নিতেন না। নিজ হাতে টুপী সেলাই করে আর কুরআন মজীদ কপি করে যা পেতেন, তাই দিয়ে অতি কষ্টে দিন গুযরান করতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদে দণ্ডায়মান হয়ে কেঁদে চক্ষু ভাসাতেন । তাঁর জীবনের অসংখ্য শিক্ষণীয় ঘটনাবলীর মধ্যে একটি ছিল নিম্নরূপ: তাঁর একজন মুসলিম সেনাপতি পাঞ্জাব অভিযানকালে একটি গ্রাম অতিক্রম করছিলেন। সে সময় একজন ব্রাহ্মণের পরমা সুন্দরী এক মেয়েকে দেখে তিনি তার পিতার কাছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পিতা অনন্যোপায় হয়ে বাদশাহ্র শরণাপন্ন হলেন। ওয়াদা অনুযায়ী উক্ত সেনাপতি একমাস পরে বরের বেশে উক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করেই দেখলেন ছদ্মবেশী সম্রাট আলমগীর উলঙ্গ তরবারি হাতে স্বয়ং তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে সেনাপতি সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। গ্রামবাসী হিন্দুরা ঐদিন থেকে গ্রামের নাম পাল্টিয়ে রাখলো ‘আলমগীর’। যে কামরায় বসে বাদশাহ আলমগীর ঐ রাতে ইবাদতে রত ছিলেন, ঐ কামরাটি আজও হিন্দুদের নিকট পবিত্র স্থান বলে সম্মানিত হয়ে আছে। কেউ সেখানে জুতা পায়ে প্রবেশ করে না (ইতিহাসের ইতিহাস, পৃঃ ১৬৬)।
শিক্ষা : আধুনিক বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবীদার রাষ্ট্র ভারত সরকার কি বর্তমানে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার রক্ষা করতে পারছে? না, বরং প্রতিনিয়ত তাদের প্রতি চালাচ্ছে নির্যাতনের স্টীম রোলার। অথচ মুসলিম শাসক আওরঙ্গযেব মাত্র একজন হিন্দুর অধিকার হরণের ঘটনাকে বরদাশত করতে না পেরে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এরপরেও কি তাদের বোধোদয় হবে না?
৮.
মৃত্যুর দুয়ারে ত্যাগের মহিমা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই ভালবাসবে যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’ (বুখারী হা/১৩)। ইয়ারমুক যুদ্ধের বিশাল ময়দান। এক প্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল আর অপর প্রান্তে রোমকদের বিশাল সৈন্যবাহিনী। উভয় দলই ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি দণ্ডায়মান। যুদ্ধ শুরুর পূর্বমুহূর্তে আবূ ওবায়দাহ, মু’আয বিন জাবাল, আমর ইবনুল আছ, আবূ সুফিয়ান, আবু হুরায়রা প্রমুখ ছাহাবী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হৃদয়গ্রাহী উপদেশ দেন। আবূ ওবায়দাহ উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগলকে স্থির রাখবেন। হে মুসলিম সেনাবাহিনী। তোমরা ধৈর্যধারণ করো। কেননা ধৈর্য কুফরী থেকে বাঁচার, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের এবং লজ্জা নিবারণের উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে সরে দাঁড়াবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপ ও অগ্রসর হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধের সূচনাও করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা মনে মনে আল্লাহ্র যিকির করতে থাকবে’।
যুদ্ধ শুরু হ’ল এবং প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। যুদ্ধের সময় হুযায়ফা (রাঃ) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। তার সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফার চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে অবিরত ধারায় রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশংকাজনক। হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি পানি পান করবে? সে তার কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম না হয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত করল। আহত ব্যক্তি হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাটা আর্তনাদ শুনে তার পূর্বে তাকে পানি পান করানোর জন্য হুযায়ফাকে ইঙ্গিত দিলেন। হুযায়ফা তার নিকট গিয়ে বললেন, আপনি কি পানি পান করতে চান? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন। তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো। হুযায়ফা আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে। অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফার হাতে। এতটুকু পানি । অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির পিপাসা মিটাবার জন্য এতই পাগলপরা ছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারেননি। অথচ সবারই প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭/৮ ১১ প্রভৃতি দ্রঃ) ৷
শিক্ষা : মুমিন ব্যক্তি সর্বদা মানুষের জন্য অন্তঃপ্রাণ থাকে। সে নিজেকে কখনো পরের উপরে প্রাধান্য দেয় না। বরং সর্বদা অপরের কল্যাণকেই ধ্যান জ্ঞান করে। জীবনের চরম ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তে পর্যন্ত সে তার কর্তব্য ভুলে যায় না। এমনকি পরার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও সে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না। সর্বদাই তাঁর হৃদয়কন্দরে গুঞ্জরিত হতে থাকে, ‘সকলের তরে আমরা সবে, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’।
৯.
শত্রুর জিঘাংসা
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওমিয়্যাহ কর্তৃক বর্ণিত, হযরত আলী বিন আৰু ত্বালিব (রাঃ)-এর হত্যাকারী আব্দুর রহমান বিন মুলজিম বন্দী অবস্থায় (হযরত আলীকে হত্যার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল) থাকাকালীন সময়ে হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর নিকট যখন নিয়ে আসা হ’ল, তখন সে বলল, হে হাসান! আমি তোমার সাথে কানে কানে কিছু কথা বলতে চাই । তিনি অস্বীকার করলেন এবং সাথীদেরকে বললেন, তোমরা জান সে কি চেয়েছে? তারা উত্তর দিলেন, না। হযরত হাসান বললেন, সে চেয়েছিল আমি আমার কান তার মুখের কাছে নিয়ে গেলে সে দাঁত দিয়ে আমার কানটি কেটে নিবে। ঐ পাপী একথা শুনে বলল, আল্লাহ্র কসম আমি ঠিক এমনটাই ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম। চিন্তা করে দেখুন, সবেমাত্র হযরত হাসান (রাঃ)-এর পিতৃবিয়োগ হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ এখন বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কিভাবে ঐ বদমায়েশের কূট-কৌশলের রহস্যটি বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে গেলেন এবং ঐ শয়তান মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও কি ধরনের জঘন্য চাল চালতে চাইল!! (ইবনুল ক্বাইয়িম, আত-তুরুক আল-হুকমিইয়্যাহ ১/৩৭)।
শিক্ষা : শত্রু সুযোগ পেলেই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। অতএব সর্বদা সাবধান থাকতে হবে।
১০.
বুদ্ধিমান বালক
(১) খলীফা মামূনুর রশীদ তাঁর একটি ছোট্ট ছেলের হাতে হিসাবের খাতা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বৎস এটা কি? বাচ্চা উত্তরে বলল, এটা এমন একটি বস্তু যাতে মানুষের মস্তিষ্ক তীক্ষ্ম হয়, অলসতা দূরীভূত হয় ও সচেতনতা ফিরে আসে এবং একাকী থাকার সময় সঙ্গী হয়। খলীফা আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে এমন ছেলে দিয়েছেন, যে চর্মচক্ষুর চেয়ে জ্ঞানের চক্ষু দিয়ে বেশী দেখে।
(২) আছমা’ঈ বলেন, আমি আরবের একজন কিশোরকে বললাম, হে বৎস! তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমাকে এক লক্ষ টাকা দিব এবং তুমি আহাম্মক (বোকা) হবে। সে উত্তরে বলল, না। আমি বললাম, কেন? সে বলল, হ’তে পারে একদিন এই টাকা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আহাম্মক দোষটি আমার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাবে।
শিক্ষা : অনেক সময় ছোট্ট বাচ্চাদের মুখ থেকে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা বের হয়, যা কল্পনাও করা যায় না।
১১.
ইহসান ইলাহী যহীর ও ভণ্ড ছূফীর কেরামতি
আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভীক সেনানী আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর বাতিল ফিরকাগুলোর কেন্দ্রে ও তাদের মাহফিলে গিয়ে মুনাযারা করতেন নির্ভয়ে-নিঃশঙ্কচিত্তে। ১৯৬৫ সালে ইরাকের সামারায় এক রেফাঈ ছুফী নেতার সাথে তাঁর মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ ছুফী নেতার দাবী ছিল, সে কারামতের অধিকারী। অস্ত্র তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। আল্লামা যহীর এর প্রত্যুত্তরে বিতর্কসভায় বলেছিলেন, যদি অস্ত্র, বর্ণা ও চাকু আপনাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে, তাহলে আপনারা কেন যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন না? গুলি ও অন্যান্য মারণাস্ত্র যাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, সেসব লোকের ইরাকের বড্ড প্রয়োজন। তিনি সেখানে ঐ রেফাঈ ছুফী নেতাকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি আমার হাতে একটা রিভলভার দিন। আমি গুলী ছুঁড়ে দেখিয়ে দিচ্ছি, ওটা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারে কি-না। একথা বলার পর ঐ ভণ্ড ছুফী পালাতে দিশা পায়নি (দিরাসাত ফিত-তাছাওউফ, পৃঃ ২৩২)।
শিক্ষা: ভণ্ড ডুফীরা শয়তানী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজেদের অনেক বড় কিছু হিসাবে পরিচয় দেয় এবং অজ্ঞ মানুষকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুতঃ তাদের কূটচক্র তাসের ঘরের চেয়েও দুর্বল। কেবল আল্লাহর উপর ভরসাহীন মূর্খরাই এদের প্রতারণার শিকার হয়।
১২.
জনৈক মহিলা ও সোনার ডিম
এক মহিলার একটি মুরগী প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়ত। মহিলা মনে মনে বুদ্ধি আঁটল, আমি যদি তার খাবার বেশি করে দেই তাহলে সে প্রতিদিন দু’টি করে ডিম পাড়বে। অতঃপর সে যখন তার খাবার বৃদ্ধি করে দিল, তখন পাকস্থলী ফেটে মুরগীটি মরে গেল ।
শিক্ষা : অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ।
১৩.
সবল ও দুর্বল বিড়াল
এক গরীব বুড়ির একটি দুর্বল বিড়াল ছিল। বুড়ির আহারের দু’লোকমা খেয়ে সে বেঁচে থাকতো। একদিন কষ্ট করে ঘরের চালে উঠে পাশের বাড়ির এক মোটা-তাজা বিড়ালকে চলাফেরা করতে দেখে বলল, ও ভাই! তুমি এত মোটা-তাজা হলে কী করে? মোটা বিড়ালটি জবাব দিল, এই বান্দা প্রতিদিন , শাহী মহলে যাতায়াত করে। সেখানে চুরি করে পোলাও কোরমাতে ভাগ বসায়, আর কিছুটা অন্য সময়ের জন্য নিয়েও আসে। দুর্বল বিড়ালটি শাহী দস্তরখানের মজাদার খাবারের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়ল। খুব বিনয়ের সুরে সবল বিড়ালকে বলল, ভাই প্রতিবেশীর হক আদায় করা তোমার কর্তব্য। তুমি নিজে প্রত্যেকদিন শাহী দস্তরখানের স্বাদ লুটবে আর আমি কিছুই পাব না একি ইনছাফের কথা! সবল বিড়ালটি বলল, ভাই আমাকে এত কৃপণ মনে কর না। তোমাকে আমার খাবারে অংশীদার করতে কোন আপত্তি নেই। আমার সাথে আগামীকাল যেও । পরদিন সবল বিড়ালের সাথে দুর্বল বিড়ালটি শাহী মহলে গেল। ওদিকে এরই মধ্যে দস্তরখানের আশপাশে বিড়ালের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় বাদশাহ তীরন্দায নিযুক্ত করে বিড়াল আসামাত্রই তীর ছুড়ে মারার নির্দেশ দিলেন। দুর্বল বিড়ালটি যখন শাহী মহলের কাছে আসল এবং রাজকীয় খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে জিভ বের করল, অমনি রক্ষীরা তাকে তীর মেরে জীবনলীলা সাঙ্গ করে দিলো।
শিক্ষা : অতি লোভে তাঁতী নষ্ট।
১৪.
লোভী শিয়াল ও ঢোল
একটি শিয়াল শিকারের খোঁজে ফিরছিল। পথে একটি মোরগকে কিছু খুঁটে খেতে দেখতে পেল। সে মোরগটিকে ধরতে যাবে এমন সময় ঢোলের আওয়ায শুনতে পেলো। ঢোলটিকে কোন ব্যক্তি গাছের ডালে বেঁধে রেখেছিল। বাতাসের কারণে গাছের ডালের আঘাতে তা থেকে আওয়ায বের হচ্ছিল। শিয়াল লক্ষ্য করল যে, মোরগের চেয়ে ঢোলের দেহটি বেশ মোটা ও নাদুসনুদুস। তাই বেশি পাওয়ার লোভে সে মোরগ ছেড়ে ঢোলের দিকে এগিয়ে চলল। অনেক কষ্টে গাছে উঠে ঢোলটি নামিয়ে এনে দেখল, তাতে কাঠ এবং চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই যে কথায় বলে, ‘দূরের বাদ্য শুনতে মধুর’। শিয়ালেরও তাই হ’ল। ওদিকে মোরগও ততক্ষণে চলে গেছে। সুতরাং আক্ষেপ করা ছাড়া শিয়ালের ভাগ্যে আর কিছুই জুটল না।
শিক্ষা : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ।
১৫.
শিকারী ও বাঘ
এক শিকারী শিয়ালের গর্তের নিকট এক মস্ত বড় কূপ খনন করে তার উপর ঘাস-পাতা দিয়ে ঢেকে গোশতের কিছু টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। শিয়াল গোশতের গন্ধ শুঁকেই শিকারীর কুমতলব আঁচ করতে পারল। কিন্তু এক সবল বাঘ সেই গোশত খাওয়ার লোভে সেই গর্তে পড়ে গেল । শব্দ শুনে শিকারী দৌড়ে গিয়ে শিয়াল মনে করে সেই গর্তে লাফিয়ে পড়ল। সুযোগ পেয়ে বাঘ তার পেট চিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে দিল।
শিক্ষা : অত্যধিক লোভ মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।
১৬.
পশুর কৃতজ্ঞতাবোধ
স্নেহ-দয়া-মায়া-ভালবাসা ইত্যাদি হৃদয়ের কোমল বৃত্তিগুলি আল্লাহপাক কেবল উন্নত জীব মানুষকেই দান করেননি। ইতর প্রাণী পশু-পাখিতেও দিয়েছেন। তাই মানুষ যেমন অতি আদর-যত্নে সন্তান-সন্ততিকে লালন-পালন করে, পশু পাখিও এদিক দিয়ে কম নয়। তারাও সহজেই মানুষের আদর-সোহাগ বুঝতে পারে। এক ক্রীতদাস তার মনিবের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে এক বনে ঢুকে পড়ে। বনের ভিতর দিয়েই পথ চলতে চলতে সে দেখতে পেল, একটি সিংহ একস্থানে স্থির হয়ে তার দিকে একটি পা বার বার উঠিয়ে কি যেন ইশারা করছে। সে সিংহটিকে অসুস্থ মনে করল। সিংহের ইশারায় সে সাহসে বুক বেঁধে আস্তে আস্তে সিংহের কাছে গেল। সে দেখল, সিংহের পায়ে একটি বড় কাঁটা বিঁধে রয়েছে। ফলে পা-টি ফুলে গেছে। সে পা থেকে কাঁটাটি বের করল। তারপর পথ চলতে লাগল । এর কিছুদিন পর পলাতক ক্রীতদাসটি ধরা পড়ে গেল। আর ঐ সিংহটিও ধরা পড়েছে। ধৃত সিংহটি একটি সার্কাস পার্টির হাতে এসে পড়ল। যে শহর থেকে লোকটি পালিয়েছিল, সার্কাস পার্টি ঐ শহরে এল সার্কাস দেখাতে।শহরের বিচারকমণ্ডলী পলাতকের অপরাধের শাস্তি হিসাবে ঐ সিংহকে দিয়ে তাকে ভক্ষণ করানো স্থির করল। তাহলে এটি একটি দৃষ্টান্ত হবে, যাতে আর কোন ক্রীতদাস এভাবে পালিয়ে না যায়। বিচার ব্যবস্থা নির্মম মনে হলেও সে যুগে সেটি মোটেই নির্মম ছিল না। যাহোক তারা ঘোষণা দিল, অমুক দিন অমুক সময় পলাতককে সিংহের সামনে নিক্ষেপ করা হবে। কিভাবে সিংহ তাকে ভক্ষণ করে, এ দৃশ্য দেখতে প্রচুর উৎসুক দর্শক উপস্থিত হ’ল। চারিদিক লোকে লোকারণ্য। মাঝখানে পলাতক লোকটি। এখন সিংহটিকে শিকল লাগিয়ে খাঁচা থেকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল। সবাই ভাবছিল ছাড়া পেয়ে সিংহটি আক্রমণাত্মকভাবে দৌড়ে তাকে শেষ করে দিবে। কিন্তু একি! সবাইকে বিস্মিত করে সিংহটি তাকে খেল না। বরং পলাতককে সে সঠিকভাবেই চিনল। সে-ই তার পা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল।
শিক্ষা : একটি ইতর প্রাণী তার পা থেকে কাঁটা বের করার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। আর আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা হয়ে কৃতজ্ঞতার বদলে যত রকম অন্যায় ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে মোটেই কার্পণ্য করি না। এটা কি আমাদের চরিত্র হওয়া উচিত?
১৭.
বাদশাহ আমানুল্লাহ্র বিচক্ষণতা
দুই ভাই আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল শহরে দীর্ঘদিন ধরে কসাইগিরি করে প্রচুর টাকা উপার্জনের পর বাড়ী ফিরছিল। পথে এক ফকীরের সাথে তাদের দেখা হ’ল। ফকীর ও তারা এক গাছের নীচে বসে খাবার খেল। ফকীর তাদের সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হ’ল। ফকীর বলল, তোমরা এত টাকা উপার্জন করে বাড়ী ফিরছ, টাকাগুলি আমাকে একবার দেখাও। ফকীর টাকাগুলি নিয়ে তার থলেতে পুরে নিল। দু’ভাই তৎক্ষণাৎ ফকীরের কাছ থেকে টাকাগুলি ছিনিয়ে নিল। ফকীর তখন প্রাণপণে চিৎকার শুরু করে দিল। ফকীরের চিৎকারের বিষয় ছিল, ‘আমার টাকা এরা দু’জনে ছিনিয়ে নিয়েছে। চিৎকারে বেশকিছু লোক সমবেত হ’ল। ফকীর বর্ণনা দিল, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী শহরে থেকে ভিক্ষা করে টাকাগুলি উপার্জন করেছি। খেতে বসে গল্পে সে কথা প্রকাশ করায় ওরা দু’জনে মিলে আমার টাকাগুলি ছিনিয়ে নিয়েছে’। অপরদিকে দু’ভাইয়ের কথা তো বানিয়ে বলার দরকার নেই। তারা যা ঘটনা তাই বলল। সমবেত লোকজন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে পারল না। অগত্যা তারা ফকীর ও দু’ভাইকে বাদশাহ আমানুল্লাহ্র দরবারে হাযির করল। বাদশাহ উভয়ের বক্তব্য শুনলেন। তিনি একটা পাতিলে পানি গরম করতে বললেন। পানি গরম হ’লে তিনি টাকাগুলি পানিতে ফেলে দিলেন। পানির স্বাভাবিক রং বদলে গেল। কারণ টাকাগুলিতে কসাইগিরির রক্ত লেগেছিল। বাদশাহ এবং উপস্থিত সকলে বুঝলেন, টাকাগুলির সত্যিকার মালিক দু’ভাই। টাকাগুলি তাদের দিয়ে দেওয়া হ’ল এবং ফকীরকে শাস্তি দেওয়া হ’ল।
শিক্ষা : অনেক সময় উপস্থিত বুদ্ধি বিচারের কাজে সহায়ক হয়।
১৮.
বক ও কাঁকড়া
একটি বক কোনো এক জলাশয়ের ধারে বাস করতো আর জলাশয়ের মাছ খেয়ে দিন কাটাতো। বৃদ্ধ বয়সে যখন তার মাছ শিকারের শক্তি থাকল না, তখন মনে মনে ভাবল, এবার কৌশলে মাছ শিকার করতে হবে। একদিন খুব বুকভরা দরদ নিয়ে জলাশয়ের ধারে গিয়ে বসল। তার মুখ দেখে এক কাঁকড়ার দয়ার উদ্রেক হ’ল। সে জিজ্ঞেস করল, কি ভাই তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন? বক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কী বলব ভাই, আজ দু’জন শিকারীকে আলাপ আলোচনা করতে দেখলাম। তাদের একজন বলল, জলাশয়টিতে অনেক মাছ আছে, চলো আমরা জাল দিয়ে মাছগুলো ধরে নিয়ে যাই। অন্যজন বলল, না। তার আগে চারদিকে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে; পরে সুযোগ মতো ধীরে ধীরে নিলেই চলবে। এসব কথা শুনে আমি খুব ব্যথিত হয়েছি। যদি সব মাছ ধরে নিয়ে যায়, তাহলে আমার কি উপায় হবে? এদের উপরই আমার জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। এতদিন এখানে থাকতাম, এখন বাকি জীবনে বুড়া বয়সে কোথায় যাব। কাঁকড়া এ কথা শুনে সব মাছকে খবর দিল। ওরা শুনে হায়! হায়! করতে শুরু করল এবং বকের নিকট এসে এ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় জানতে চাইল। বক বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, কাছেই খুব বড় একটি নদী আছে। আমি তোমাদেরকে এতটুকু সাহায্য করতে পারি যে, প্রতিদিন কিছু কিছু মাছকে সেখানে পৌঁছে দিব। মাছেরা পরামর্শ শুনে খুব খুশি হল। এমনি করে বক কৌশলে মাছ ধরে খেতে আরম্ভ করল। এভাবে কিছুদিন খাওয়ার পর কাঁকড়ার একদিন সে নদী দেখার সাধ জাগল। বকের পিঠে চড়ে সে নদীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। দূর থেকে মাছের হাড়ের স্তূপ দেখেই সে বকের কৌশল বুঝতে পারল। তখন তার মনে পড়ল- জ্ঞানীরা বলেছেন, শত্রু যখন তোমার অধীনে থাকে তখনি তাকে শেষ করে দাও। তাতে যদি সফল হও কিয়ামত পর্যন্ত তোমার নাম থাকবে, আর মারা গেলেও বেইয্যতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। কাঁকড়া বুদ্ধি করে বকের গলা চেপে ধরল । বৃদ্ধ বক কিছুক্ষণ ছটফট করে মারা গেল ।
শিক্ষা : যে অন্যের জন্য কূপ খনন করে, সেই তাতে নিপতিত হয়।
১৯.
হাতেম তাঈর মহত্ত্ব
হাতেম তাঈ দানশীলতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর দানশীলতার সুনামে বাদশাহ নওফেল ক্রোধান্বিত হলেন। কারণ তিনিও একজন দাতা ছিলেন। কিন্তু হাতেমের দানের সুখ্যাতি লোকের মুখে মুখে। বাদশাহর দান হাতেমের দানের কাছে ম্লান ও নিষ্প্রভ। যেন চাঁদের আলোর কাছে তারার আলো। বাদশাহ শুধু এ কারণেই ক্রোধান্বিত হয়ে ফরমান জারী করলেন, ‘যে কেউ হাতেমকে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাকে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে’। ঘোষণাটি হাতেমও শুনতে পেলেন। তিনি তাঁর অবস্থানে থাকাটা নিরাপদ মনে করলেন না। তিনি এক গভীর জংগলে আত্মগোপন করে রইলেন। পুরস্কারের লোভে অনেকেই হাতেমকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। এক কাঠুরে ও তার স্ত্রী হাতেমের লুকিয়ে থাকা জংগলে কাঠ কাটতে এলো। স্ত্রী বাদশাহর ঘোষণার কথা স্বামীকে শুনিয়ে বলল, ‘আমরা যদি হাতেমকে পেতাম, তাহ’লে তাঁকে বাদশাহর নিকট হাযির করলে আমাদেরকে আর কাঠ কেটে খেতে হত না। স্ত্রীর কথা শুনে স্বামী মর্মাহত হ’ল এবং স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করল। কাঠুরে বলল, ‘আমি এভাবে ধনী হতে চাই না। একজন সৎ ব্যক্তিকে বিপদে ফেলে আমি বড় হওয়াকে ঘৃণা করি’। স্বামীর কথা শুনে স্ত্রী নীরব হয়ে রইল। হাতেম স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন শুনছিলেন। তিনি ভাবলেন, ‘আমার এভাবে লুকিয়ে থাকায় সার্থকতা কি? বরং আমি কাঠুরেকে ধরা দিলে তারা আমাকে বাদশাহর নিকট হাযির করে পুরষ্কৃত হয়ে উপকৃত হ’তে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি গোপন আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে কাঠুরেকে ধরা দিলেন। কাঠুরে তাঁকে নিয়ে বাদশাহর নিকট যেতে অস্বীকৃতি জানালো । এরই মধ্যে কতিপয় লোক হাতেমকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে উপস্থিত হ’ল। তারা হাতেমকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাদশাহর নিকট উপস্থিত করল এবং পুরস্কার দাবী করল। কি ঘটে তা জানার জন্য কাঠুরে ও তার স্ত্রী তাদের সাথে গেল। হাতেম বললেন, এই কাঠুরেই প্রথমে আমাকে ধরেছে। অতএব, পুরস্কার সেই পাবে। কাঠুরে বলল, ‘না, আমি তাঁকে মোটেই ধরিনি। তিনি স্বেচ্ছায় আমাদের ধরা দিয়েছেন। যাতে আমরা তাঁকে আপনার নিকট হাযির করে পুরস্কার পেয়ে উপকৃত হই। বাদশাহ কাঠুরের কথা শুনে বুঝলেন, গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান হাতেম যথার্থই একজন পরোপকারী ব্যক্তি। তাই তাঁকে ছেড়ে দিলেন এবং কাঠুরেকে পুরস্কৃত করলেন।
শিক্ষা : দানশীলতা অতি উত্তম মানবিক গুণ। এর মাধ্যমে মানুষ দুনিয়াতে মর্যাদার পাত্র হয়। এটি পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম।
২০.
সিংহ ও ইঁদুর
এক সিংহ তার গুহায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ একটি ছোট ইঁদুর ছোটাছুটি করতে করতে সিংহের নাকের এক ছিদ্রে ঢুকে পড়ল। ফলে সিংহের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ইঁদুরটিকে থাবা দিয়ে ধরে মেরে ফেলতে উদ্যত হ’ল। ইঁদুরটি অত্যন্ত বিনয়ের সুরে বলল, দয়া করে আমাকে মেরে ফেলবেন না। সময়ে আমিও আপনার উপকারে আসতে পারি। একথা শুনে সিংহটি হেসে বলল, তুই এত ছোট জীব হয়ে আমার কি উপকার করবি? যাক সিংহটি তাকে ছেড়ে দিল। এর কিছুদিন পরের ঘটনা। সিংহটি একটি দড়ির শক্ত ফাঁদে আটকে গেল। ফাঁদে পড়ে সিংহটি ভীষণ গর্জন করতে লাগল। গর্জন শুনে ইঁদুরটি দৌড়ে সেখানে গেল। সিংহের বিপদ দেখে সে তার কানের কাছে গিয়ে তাকে গর্জন করতে নিষেধ করল। কারণ যারা ফাঁদ পেতে রেখেছে তারা গর্জন শুনে ছুটে আসতে পারে। ইঁদুরটি এবার তার কাজ শুরু করল। সে তার দাঁত দিয়ে ফাঁদের দড়ি কাটতে শুরু করল। অবশেষে সে সিংহকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করল। মুক্তি পেয়ে সিংহটি ইঁদুরকে ধন্যবাদ দিল এবং সেই সংগে বলল, ‘তোকে আমি অবজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু বুঝলাম, কাউকে অবজ্ঞা করতে নেই’।
শিক্ষা : ছোট বলে কাউকে অবজ্ঞা করতে নেই। বিপদে যে কেউ উপকারে আসতে পারে।
২১.
শিকারী ও ঘুঘু
নদীর তীরের একটি গাছের উঁচু ডালে একটি ঘুঘু বসে নদীর পানির দিকে চেয়ে আছে। সে দেখতে পেল, একটি পিঁপড়া নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। পিঁপড়ার প্রতি তার দয়া হ’ল। তাই সে গাছ থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে পিঁপড়ার সামনে ফেলে দিল। পিঁপড়াটি পাতায় চড়ে প্রাণে বেঁচে গেল । পিঁপড়াটির বাসা ঐ গাছের কাছেই। একদিন সে গাছে ঘুঘুটি বসে রয়েছে। এক শিকারী ঘুঘুকে লক্ষ্য করে তার ধনুকে তীর সংযোগ করল। সে তীর ছুঁড়তে যাচ্ছে, এমন সময় ঐ পিঁপড়াটি এসে তার পায়ে শক্ত কামড় বসিয়ে দিল। কামড়ের চোটে সে জোরে ‘উহ’ করে উঠল। পাখীটি শব্দ শুনে উড়ে গেল । তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ল।
শিক্ষা : বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।
২২.
জীবিকা অর্জনের চেষ্ট
কোনো এক জঙ্গলে এক দরবেশ বাস করতো। একদিন একটি কাককে গাছের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখে তার মনে কৌতূহল জাগল, কাক ওখানে কেন যাওয়া-আসা করে। হঠাৎ দেখলেন একটি অন্ধ সাপকে কাক আহার করাচ্ছে। দরবেশ এ ঘটনায় আল্লাহ্র অসীম কুদরতের কথা বুঝতে পেরে মনে মনে ভাবলেন, আল্লাহ পাক যখন একটি প্রাণীর রূযী-রোযগারের ব্যবস্থা বিনা পরিশ্রমে করে দিচ্ছেন, তখন খাবারের জন্য এত চিন্তা করে মাথা খারাপ করার কি প্রয়োজন রয়েছে? আমার খাবারও ঠিক সময়ে এসে যাবে। এই ভেবে তিনি আস্তানায় ফিরে এসে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয়ে গেলেন। তিন দিন তিন রাত চলে গেলো, কিন্তু খাবারের কোনো ব্যবস্থা হ’ল না। আল্লাহ তা’আলা তার জন্য কিছুই পাঠালেন না। অবশেষে তখনকার নবীকে আল্লাহ তা’আলা দরবেশের কাছে পাঠালেন। নবী এসে দরবেশকে বললেন, তোমার শক্তি-সামর্থ্য রয়েছে। তুমি কেন নিজেকে দুর্বল অন্ধ সাপের সাথে তুলনা করতে গেলে। তোমার উচিত অন্যের বোঝা না হয়ে, অন্যের উপকার করা। দরবেশ তার ভুল বুঝতে পারল এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাইল।
শিক্ষা : রূযীদাতা আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে তা অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। ঘরে বসে থাকলে চলবে না।
২৩.
চাষী ও ইঁদুর
এক চাষী ভবিষ্যতের জন্য কিছু ধান জমা করে রেখেছিল। তার ঘরের পাশে একটি ইঁদুর বাস করতো। সে দেয়াল ছিদ্র করে ধান সরাতে শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যেই অনেক ধান নিয়ে গেল। যখন আশপাশের ইঁদুরগুলো দেখল যে, অমুক ইঁদুরের অবস্থা খুব ভালো হয়ে গেছে। তখন তার কাছে সব ইঁদুর জমা হ’তে লাগল। দিন-রাত তোষামোদ ও নানা রং-বেরংয়ের কথা বলে তার মেযাজ বিগড়ে দিল। ইঁদুরও অহংকারে মাটিতে পা ফেলত না। গর্বে চারদিকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। চাষী ধানের ঘরে ইঁদুরের আনাগোনা ও লাফালাফি দেখতে পেয়ে সমস্ত ধান অন্যত্র সরিয়ে নিল। ওদিকে অল্পদিনেই ইঁদুরের ধান শেষ হয়ে গেল। যেসব ইঁদুর তার সাথে সাথে চলাফেরা করতো, তারাও নিজ নিজ পথ দেখল। ইঁদুর আর কি করবে, একদিন মনের দুঃখে দেয়ালে মাথা ঠুকে মারা গেল।
শিক্ষা : আয় বুঝে ব্যয় করাই মানুষের কর্তব্য। যে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে, তার পরিণাম ঐ ইঁদুরের মতোই মন্দ হয়।
২৪.
বানর ও কাঠমিস্ত্রী
কোনো এক জঙ্গলের ধারে এক কাঠমিস্ত্রী করাত দিয়ে গাছ ফাঁড়ছিল এবং দু’টি তক্তার মাঝখানে খিল মেরে রেখেছিল। অন্য এক গাছ থেকে একটি বানর তার করাত চালনা ও খিল মারা দেখছিল। বানরের মনে এসব দেখে ইচ্ছা হ’ল, সেও গাছ ফাঁড়বে। কাঠমিস্ত্রী খাওয়ার জন্য চলে গেলে বানর এসে গাছটির উপর এমনভাবে বসল যে, তার লেজটি তক্তার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে পড়ল। বানর করাতের কাছে ঘেঁষে যেমনি তক্তার খিল ধরে টান দিল, অমনি খিল খুলে গিয়ে দু’টি তক্তা পরস্পর মিলে গেল। আর বানরের লেজ তক্তার ফাঁকে আটকা পড়ল। তখন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে চিৎকার করে বলছিল, আমার কাজ ছিল গাছে গাছে ফলমূল খেয়ে বেড়ানো। আমি কেন করতে চালাতে আসলাম। ইতিমধ্যে কাঠমিস্ত্রী এসে উপস্থিত হ’ল এবং লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বানরের বাঁদরামি শেষ করে দিল।
শিক্ষা : যার কাজ তার সাজে, অন্যের নয়।
২৫.
খরগোশ ও শিয়াল
এক নেকড়ে বাঘ একটি ঘুমন্ত খরগোশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেচারা নিদ্রা থেকে জেগে দেখল, সে মৃত্যুর কবলে। তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। সে তখন অনুনয়-বিনয় করে বলতে লাগল, আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার মতো এত দুর্বল প্রাণী জাঁহাপনার ক্ষুধা মেটাতে পারবে না। যদি জাঁহাপনা এই এক লোকমার আশা ত্যাগ করেন, তাহলে এক শিয়ালকে আমি দেখিয়ে দিতে পারি, যা শিকার করলে জাঁহাপনার তৃপ্তি হবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে বান্দাতো জাঁহাপনার খেদমতে হাযির আছেই। কথাটা নেকড়ে বাঘের মনঃপূত হ’ল। সে খরগোশের সাথে রওয়ানা হ’ল। কাছেই শিয়ালের একটি গর্ত ছিল। খরগোশের সঙ্গে তার অনেক দিনের শত্রুতা। খরগোশ গর্তের কাছে গিয়ে বলল, জনাবের নির্জন বাস ও ধার্মিকতার খ্যাতি শুনে একজন জ্ঞানী সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। যদি অবসর থাকে, তাহ’লে এখনি সাক্ষাতের সুযোগ দিন; নতুবা আপনার সুবিধা মতো খেদমতে হাযির হবেন। শিয়াল ওর মিষ্টি কথায় প্রতারণার আভাস পেয়ে উল্টো ধোঁকা দেওয়ার জন্য বলল, সৌভাগ্য যে, এমন বুযুর্গব্যক্তি আমার মতো নাচীযের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ বিলম্ব করতে হবে। কারণ আমি ঘরটিকে ঝেড়ে মুছে জনাবের বসার উপযুক্ত না করে বাইরে আসতে পারছি না। খরগোশ নেকড়ে বাঘকে এ সংবাদ জানাল এবং সে একথা শুনে খুব খুশি হ’ল। শিয়াল পূর্ব থেকে গর্তে ঢোকার রাস্তায় একটি গভীর কূপ খনন করে রেখেছিল। তাই নতুন করে লতা-পাতা দিয়ে ঐ গর্তটি ঢেকে দিল। খরগোশ নেকড়ে বাঘকে নিয়ে সেই অন্ধকার গর্তে ঢুকতে গেল এবং দিশা না পেয়ে সেই গভীর কূপে পড়ে গেল। নেকড়ে বাঘ এ ঘটনাকে খরগোশের চালাকি মনে করে তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলল ।
শিক্ষা : বুদ্ধিমানকে কখনো ধোঁকা দেয়া যায় না।
২৬
মাছের বুদ্ধিমত্তা
কোনো এক জলাশয়ে তিনটি মাছ বাস করতো। তাদের মধ্যে একজন অতীব বুদ্ধিমান, একজন মাঝারি মানের বুদ্ধিমান এবং একজন নির্বোধ। একদিন সেখানে কয়েকজন জেলে এসে পরামর্শ করল, জাল এনে কিভাবে সেখান থেকে মাছ ধরে নেওয়া যায়। জেলেদের কথা শুনে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মাছটি তৎক্ষণাৎ নালা দিয়ে অন্য জলাশয়ে চলে গেল। ইতিমধ্যে জেলেরা জাল এনে চারিদিক বন্ধ করে দিলো। দ্বিতীয় মাছটি যখন দেখল যে, সে আটকা পড়ে গেছে তখন তার অর্ধেক বুদ্ধির জোরে নিজেকে মরার মতো করে পানির উপর ভাসিয়ে দিলো। জেলেরা ওকে মরা মনে করে জালের বাইরে ফেলে দিল। ফলে সেও বেঁচে গেল। আর তৃতীয় নির্বোধ মাছটি ওদের জালে আটকা পড়ল।
শিক্ষা : বিপদে পড়েও যে নিজেকে রক্ষার উপায় অবলম্বন করে না, সে মূর্খ ।
২৭.
কচ্ছপ ও হাঁস
এক পুকুরে দু’টি হাঁস এবং একটি কচ্ছপ বাস করতো। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে হাঁস দু’টি কচ্ছপকে বলল, বন্ধু! এখানে আর আমাদের থাকা সম্ভব নয়। কাজেই এবার আমাদের বিদায় নিতে হবে। কচ্ছপ বলল, তা কি করে হয়? তোমাদেরকে বিদায় দিয়ে আমি একা এখানে থাকব কিভাবে? তোমাদের বিরহ-বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই আমিও ভাবছি, পুকুরের পানি একেবারে শুকিয়ে গেলে আমি তোমাদের সাথে চলে যাব। হাঁস দু’টি বলল, কিন্তু আমাদের সাথে তুমি যাবে কি করে ? কারণ আমরা উড়তে পারি, তুমি তো আকাশে উড়তে পারো না? কচ্ছপ বলল, এর উপায়ও তোমরাই চিন্তা করো। হাঁস দু’টি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু শর্ত হ’ল সর্বদা আমাদের কথা মেনে চলতে হবে। আমরা তোমাকে নিয়ে যখন উড়াল দিব, তখন তা দেখে নিচের লোকেরা চেঁচামেচি করবে, কিন্তু সাবধান! তুমি টু শব্দটিও করতে পারবে না। কচ্ছপ এ শর্ত মেনে নিল। হাঁস দু’টি বুদ্ধি করে একটি কাঠি এনে কচ্ছপের মুখে দিয়ে বলল, একে শক্ত করে কামড় দিয়ে ধরে রাখবে। এ বলে দু’দিক থেকে দুই হাঁস কাঠিটি ঠোঁটে চেপে ধরে আকাশে উড়ল। যাওয়ার পথে ওরা এক শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। লোকেরা এভাবে তাদেরকে উড়তে দেখে চিৎকার করে বলতে শুরু করল, আরে কি মজার ব্যাপার, দেখো দু’টি হাঁস একটি কচ্ছপকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কচ্ছপ অনেকক্ষণ চুপ করেই ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য ধরতে পারল না। সে বলতে চাইল যে, তাতে তোদের কি? কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই মুখ থেকে কাঠি ছুটে গেল, আর সে মাটিতে পড়ে পটল তুলল। হাঁস দু’টি চিৎকার করে বলল, বন্ধুর কাজ হ’ল উপদেশ দেয়া আর যারা সৌভাগ্যবান, তারাই শুধু সে উপদেশ থেকে লাভবান হয়।
শিক্ষা : যারা হিতাকাঙ্খী বন্ধুর কথা শোনে না তারা বিপদে পড়ে।