যে নামাজী মুনাফিক, দরবারে রিসালাত থেকে পিঠ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিল, সেও লম্বা লম্বা দাঁড়িবিশিষ্ট, সাদা কাপড়ে বেষ্টিত, টাকনুর উপর লুঙ্গি পরিহিত (বাহ্যত পাক্কা মুসলমান) ছিল যার বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব ঘটার ভবিষ্যদ্বাণী হয়েছিল, যারা শ্রুতিমধুর কন্ঠে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নিচে নামবেনা, আরো বলা হয়েছিল তোমাদের পাঠ তাদের পাঠের তুলনায় নিম্নমানের হবে। অনুরূপভবে তাদের নামাজ ও রোজার তুলনায় তোমাদের নামাজ রোজা সামান্য বলে মনে হবে। এমনসব মুনাফিকদের গর্দান উড়িয়ে দিতে চাইতেন হযরত উমার রা., খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.৷ নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আজ এমন মুনাফিকরা সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে কিন্তু মুসলিম বিশ্ব ঐ উমর রা., খালিদ রা. এঁর মত মহান বীরদের অনুপস্থিতিতে ভুগছে। অবশ্য হাদিসে পাকে বলেই দেয়া হয়েছে যে, উমর রা. হচ্ছেন ফিতনাসমূহ আগমনের সামনে দরজাস্বরুপ। যখনই এ দরজা ভেঙে যাবে অর্থাৎ
উমর রা. দুনিয়া হতে পর্দা করবেন, ফিতনাসমূহ প্রবেশ করতে থাকবে। তাই এমনটা তো হওয়ারই ছিল কিন্তু তবুও কেন জানি হৃদয়ের দ্বারে এ আশা কড়া নাড়ে, এ বুঝি উমররুপী কেউ আসবে বলে।
যেই শানে রিসালাতে কটাক্ষ করে, দরবারে রহমতকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তার সেই ঘটনাটির প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক-
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আলী (রাঃ) ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে সিলম বৃক্ষের পাতা দ্বারা পরিশোধিত এক প্রকার (রঙিন) চামড়ার থলে করে সামান্য কিছু তাজা স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তখনও এগুলো থেকে সংযুক্ত খনিজ মাটিও পরিষ্কার করা হয়নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ চার ব্যক্তির মধ্যে স্বর্ণ বন্টন করে দিলেন। তারা হলেন, উয়ায়না ইবনু বাদর, আকরা ইবনু হারিস, যায়দ আল-খায়ল এবং চতুর্থজন আলকামা কিংবা আমির ইবনু তুফাইল (রাঃ)। তখন সাহাবীগনের মধ্য থেকে একজন বললেন, এ স্বর্নের ব্যাপারে তাঁদের অপেক্ষা আমরাই অধিক হকদার ছিলাম। রাবী বলেন, কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত পৌঁছল। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না অথচ আমি আসমান অধিবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে।
এতে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “আপনি কেবল নজদের নেতৃস্থানীয় লোকদের দান করছেন আর আমাদের বাদ দিচ্ছেন, এটা কেমন ব্যাপার?” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ আমি তাদের শুধু চিত্তাকর্ষণ অর্থাৎ তাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও অনুরাগ সৃষ্টির জন্য দিচ্ছি।
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, হুনায়ন যুদ্ধের দিন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হাওয়াযিন গোত্রের যে সম্পদ দান করলেন তা থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ কুরাইশদের কিছু লোককে একশত উট দান করলেন। আনসারগণ বলতে লাগলেন, আল্লাহ তাঁর রাসূলুল্লাহ ﷺ কে ক্ষমা করুন। তিনি কুরাইশদের দিচ্ছেন, আর আমাদেরকে বাদ দিচ্ছেন। অথচ আমাদের তরবারী থেকে এখনো তাদের রক্ত ঝরছে।
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, তাদের এ কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট বর্ণনা করা হল। তখন তিনি আনসারদের ডেকে পাঠালেন এবং তাদের চামড়ার একটি তাঁবুর মধ্যে সমবেত করলেন। তাঁরা সকলে সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের নিকট আসলেন এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কথাটি কী, যা তোমাদের থেকে আমার নিকট পৌছেছে? তখন প্রজ্ঞাবান আনসারগণ রাসুলুল্লাহ ﷺ কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমাদের জ্ঞানী লোকেরা কিছুই বলেনি, অবশ্য আমাদের মধ্যে কিছু অল্প বয়সের লোক বলেছে যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলুল্লাহ ﷺ কে ক্ষমা করুন, তিনি কুরায়শদের দান করছেন। আর আমাদের বাদ দিচ্ছেন। অথচ তাদের রক্ত এখনো আমাদের তরবারী থেকে ঝরছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যারা সবেমাত্র কুফুরি বর্জন করে ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন কতিপয় ব্যক্তিকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য আমি দান করেছি। তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, লোকেরা ধন দৌলত নিয়ে যাবে আর তোমরা আপন গৃহে প্রস্থান করবে আল্লাহর রাসূল ﷺ কে নিয়ে? আল্লাহর কসম! তোমরা যা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে তা উত্তম এ জিনিস থেকে যা নিয়ে তারা প্রত্যাবর্তন করছো। তারপর-আনসারগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা এতে সন্তুষ্ট আছি। এরপর তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার পেতে দেখবে। এমতাবস্থায় তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাত লাভ করবে। আমি অবশ্য হাউযে কাওসারের পাশে থাকব (সেখানে আমাকে তোমরা পাবে)। (সহীহ মুসলিম ২৩২৬)]
পূর্বের ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক –
এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। লোকটির চোখ দু’টি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপালধারী, তার দাড়ি ছিল অতিশয় ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরনের লুঙ্গি ছিল উপরের দিক উঠান (সাদা কাপড় পরিহিত)। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আল্লাহ্ কে ভয় করুন। [ইমাম মুসলিম রহঃ ও ইমাম নাসাঈ রহঃ বর্ণনায় এভাবেও রয়েছে, সে এসে বললঃ হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় কর। (নাউজুবিল্লাহ) ]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহ্ কে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি বেশি হকদার নই? আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, লোকটি (এ কথা বলে) চলে যেতে লাগলে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেবনা? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ না, হতে পারে সে নামায আদায় করে। খালিদ (রাঃ) বললেন, অনেক নামাজ আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন এমন কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি।
(অথচ ব্যক্তিটি নবীজির দরবার হতে চলে যাওয়ার সময়, তার বংশধারার মাধ্যমে যে, এমন মুনাফিকদের ছিলছিলা বজায় থাকবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও দিয়ে দেন। তাই বলা যায়, “আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি।” এর দ্বারা তিনি তাঁর উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, মানুষের প্রতি যেন খারাপ ধারণা পোষণ না করা হয়)
তারপর তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তখন লোকটি পিঠ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি ﷺ বললেন, এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব ঘটবে যারা শ্রুতিমধুর কন্ঠে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নিচে নামবেনা। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে যেভাবে নিক্ষেপকৃত জন্তুর দেহ থেকে তীর বেরিয়ে যায়।…..
(সহিহ বুখারি ৪৩৫১)
[মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, উমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমাকে অনুমতি দিন আমি এ মুনাফিকটাকে হত্যা করি। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি। তাহলে লোকে বলবে, আমি আমার সঙ্গী-সাথীদের হত্যা করি।।
বুখারীর অন্য বর্ণনায় এমনও রয়েছে, ‘উমর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমাকে অনুমতি দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দিই। তিনি বললেন, একে ছেড়ে দাও। তার এমন কিছু সঙ্গী সাথী রয়েছে তোমরা তাদের নামাজের তুলনায় নিজের নামাজ এবং রোজা নগণ্য বলে মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। অন্য এক বর্ণনায়, উমর রা. ও খালিদ রা. উভয়েই ঐ মুনাফিককে হত্যা করতে অনুমতি চাওয়ার কথা রয়েছে।]