আলহামদুলিল্লাহ! মৃতব্যক্তির খাটিয়া বহনকালে উচ্চস্বরে যিকর করবে কিনা এ ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা গেলেও, মুতাআখখিরিন বা পরবর্তীকালের ফকিহগণ যিকিরের সপক্ষে জোর প্রদান করেছেন। বরং এ কাজ মুস্তাহাব-মুস্তাহসান রূপে মুসলিমরা প্রাচীন যুগ থেকে আমল করে আসছেন।
যিকরে ইলাহী যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা সহিহ মুসলিমের হাদিস থেকে বোঝা যায়। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে,আল্লাহ বলেন, ❝যে ব্যক্তি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি আর যে ব্যক্তি সমাবেশে আমাকে যিকর করে, আমিও তাকে এর থেকে ভাল সমাবেশে (অর্থাৎ ফিরিশতাদের সমাবেশে) স্মরণ করি।❞ (সহিহ মুসলিম ২৬৭৫)
সুতরাং জানাযার লাশ বহন কেনো কেবল, ইসলামি ফকিহগণ ক্বুরআন হাদিস থেকে নিষিদ্ধ যেসব সময় তাহকিক করে বের করেছেন, সেসময়গুলো বাদে যিকরে ইলাহী করা শরিয়ত সম্মত।
➥ হাদিস শরিফ থেকে সাহাবায়ে কেরামের এরকম আমল দেখা যায়।
যেমন ‘মুসনিদ’ (যিনি সনদ সহ হাদিস বর্ণনায় পারদর্শী) ইমাম আহমাদ রিযা খান মুহাদ্দিসে আযম বেরেলভি রহ. ‘জামিউল আহাদিস’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন, হযরত ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ❝আমি রাসূল ﷺ কে জানাযার সাথে যেতে এবং ফিরে আসা কালে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ব্যতীত অন্য কিছু বলতে শুনিনি।❞
[হাফেয যায়লায়ি,নাসবুর রায়াহ,২/২৯২]
এই হাদিসের সনদের প্রকৃতি কিছুটা দূর্বল হলেও ফাযায়েলে আমলের এবং মুস্তাহাবের দলিল গ্রহণ করার জন্য মুহাদ্দিসগণের সম্মতিতে গ্রহণযোগ্য। এর পাশাপাশি তা আরো একটি হাদিস দ্বারা শক্তিশালী হয়।
ইমাম দায়লামি ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হযরত আনাস রা. বলেন, নবিজি ﷺ বলেছেন, ❝জানাযায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বেশী করে পাঠ করো।❞
[ফয়যুল ক্বদির,হাদিস নং ১৪০৮]
আর এরকম হাদিস একে অন্যকে শক্তি জুগিয়ে উসুলের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ করে আর আমল উপযোগী হয়ে যায়। আর এম্নিতেও চার মাযহাব এ ব্যাপারে একমত যে, ফাযায়েলে আমলের জন্য দূর্বল হাদিস গ্রহণ করা হয়। যেমন ইমাম নববি বলেন,
قد اتفق العلماء على جواز العمل بالحديث الضعيف فى فضائل الاعمال:مقدمة المؤلف
❝উলামায়ে কিরাম এই বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন দুর্বল হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য।’❞
[ইমাম নববী : আরবাঈন : ১/২০ পৃ. এবং ইমাম ইবনে দাকিকুল ঈদ, শরহে আরবাঈনুন নববিয়্যাহ, ১/২০ পৃ]
আর এক্ষেত্রে তো দুটি হাদিস পাওয়া গেলো যেগুলো পরস্পর পরস্পরের দূর্বলতা কমিয়ে দেয়।
➥ ফকিহগণের মতামত:
ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শা’রানি স্বীয় কিতাব عهود مشائخ এ বলেছেন-
وانما لم يكن الكلام والقرأة والذكر امام الجنازة فى عهد السلف لانهم كانوا اذا مات لهم ميت اشتركوا كلهم فى الحزن عليه حتى كان لا يعرف قرابة الميت الميت من غيره فكانوا لايقدرون على النطق الكثير لماهم عليه من ذكر الموت بل خرست السنتهم عن كل كلام فاذا وجدنا جماعة بهذه الصفة فلك يا اخى علينا ان لا تأمرهم بقرءة ولاذكر
❝আগের যুগে জানাযার সাথে গমন করার সময় কথা বলা, কুরআন পাঠ ও যিকর এ জন্য ছিল না যে যখন কেউ মারা যেত, তখন সবাই শোক প্রকাশ ও সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন। এমন কি মাইয়্যাতের নিকটাত্মীয় ও অন্যান্যদের মধ্যে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না। মৃত্যুর ধ্যানে সবাই এ রকম বিভোর হতো যে কথা বলার শক্তিও কারো থাকতো না। তাদের মুখ বাকহীন হয়ে যেত। যদি আজকাল আমরা সেই রকম লোক পাই তাহলে ওদেরকে কুরআন পাঠ ও যিকর করার নির্দেশ দেব না।❞
উনি আরো বলেন,
فمما احدثه المسلمون واستحسنوه قولهم امام الجنازة لا إله إلاَّ اللهُ محمَّدٌ رسولُ الله او وسيلتنا يوم العرض على الله لا إله إلاَّ اللهُ محمَّدٌ رسولُ الله نحو ذالك فمثل هذا لايجب انكاره فى هذا الزمان لانه ان لم يشتغلوا بذالك استغلوا بحديث الدنيا وذالك لانه قبلهم فارع من ذكر الموت بل رئيت بعضهم يضحك امام الجنازة ويمزح
❝মুসসলমানগণ যে পদ্ধতিটা মুস্তাহসান মনে করে গ্রহণ করেছেন, সেটা হচ্ছে জানাযার আগে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ বলা বা ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে আমাদের উসীলা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ বা এ রকম অন্যান্য যিকর করা। এ যুগে এটা করা থেকে বারণ করা অনুচিত। কেননা এ যুগের লোকেরা যদি সেই যিকরে নিয়োজিত না হয়, তাহলে দুনিয়াবী কথাবার্তায় মশগুল হয়ে যাবে। কারণ তাদের মন মৃত্যু ভয় থেকে উদাসীন। বরং আমি কতেক লোককে জানাযার সাথে হাসিঠাট্টা করে যেতে দেখেছি।❞
বিখ্যাত ফতোয়া গ্রন্থ দুররুল মুখতারে তো মৃত ব্যক্তির প্রশংসায় শায়েরি করাকেও জায়েয ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে যিকরে এলাহি বা না’তে মুস্তাফা ﷺ কি প্রকারে নাজায়েয হতে পারে?
ইমাম হাসকাফি বলেন,
وَلَا بَأْسَ بِنَقْلِهِ قَبْلَ دَفْنِهِ وَبِالْإِعْلَامِ بِمَوْتِهِ وَبِإِرْثَائِهِ بِشَعْرٍ أَوْ غَيْرِهِ
❝মাইয়্যাতের দাফন করার আগে স্থানান্তরিত করা, এর জানাযার প্রচার করা, মাইয়্যাতের শোকগাথা পদ্যে হোক বা অন্যভাবে পাঠ করা জায়েয।❞
সুতরাং বুঝা গেলো খাটিয়া বহনকারী সহ জানাযার অনুগামী কর্তৃক উচ্চস্বরে যিকর করা বা অন্যান্য কালিমা পড়া শরীয়তে অনুমোদিত।