নবী ইবরাহিমের (আ) জীবনে ‘অগ্নি পরীক্ষা’র ঘটনাটি সমধিক আলোচিত হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এইরকম যে, হযরত ইবরাহিমের (আ) সাথে যখন প্রতিপক্ষের লোকজন যুক্তি ও বিতর্কে এঁটে উঠতে পারলো না, তাদের পক্ষে উপস্থাপন করার মত কোন দলীল-প্রমাণ থাকল না, তখন তারা বিতর্কের পথ এড়িয়ে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের পথ অবলম্বন করে। তারা নবীর আলোকিত পথের বিপরীতে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতা টিকিয়ে রাখতে গোয়ার্তুমির আশ্রয় নেয়।
পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়া ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে: “তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করল, অতঃপর আমি তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করে দিলাম।” -সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৬৮-৭০]
তৎকালের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তারা বিভিন্ন স্থান থেকে কঠোর চেষ্টার মাধ্যমে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা এ সংগ্রহের কাজে রত থাকে। তাদের মধ্যে কোন মহিলা পীড়িত হলে মানত করত যে, যদি সে আরোগ্য লাভ করে তবে ইবরাহিমকে (আ) পোড়াবার লাকড়ি সংগ্রহ করে দেবে।
এরপর তারা বিরাট এক গর্ত বানিয়ে তার মধ্যে লাকড়ি নিক্ষেপ করে ও অগ্নি সংযোগ করে। ফলে তীব্র দাহনে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা এত উর্ধে উঠতে থাকে, যার কোন তুলনা হয় না। তারপর ইবরাহিমকে (আ) ‘মিনজানিক’ নামক নিক্ষেপণ যন্ত্রে বসিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, এ যন্ত্রটি কুর্দি সম্প্রদায়ের হাযান নামক এক ব্যক্তি তৈরি করেছিল। ‘মিনজানিক’ যন্ত্র সে-ই প্রথম আবিষ্কার করে। আল্লাহ্ তাকে মাটির মধ্যে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকবে।
তারপর তারা ইবরাহিমকে (আ) আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তখন নবী বলতে থাকেন- “আপনি (আল্লাহ্) ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, আপনি মহা পবিত্র, বাদশাহির মালিক কেবল আপনিই, আপনার কোন শরিক নেই।”
অতঃপর তারা ইবরাহিমকে (আ) মিনজানিকের পাল্লায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে আগুনে নিক্ষেপ করে। তখন তিনি বলেন- “আমার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক।” (হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল, নি’মাল মাওলা ওয়া নি’মান-নাসির’।) যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হলে উল্লিখিত দোয়া বেশি বেশি পড়তে পারেন। এটি আলে ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াত এবং সুরা আনফালের ৪০ নম্বর আয়াতের (আবার সুরা হজের ৭৮ নম্বর আয়াত) অংশের মিলিত রূপ।
আবু ইয়ালা (র)… আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ইবরাহিমকে (আ) কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন তিনি এ দু’আটি পড়েন-
‘হে আল্লাহ্! আপনি আকাশ রাজ্যে একা আর এই যমীনে আমি একাই আপনার ইবাদাত করছি।’
পূর্ববর্তী যুগের কোন কোন আলিম বলেন, জিবরাঈল (আ) শূন্য থেকে ইবরাহিমকে (আ) বলেছিলেন- আপনার কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে ইবরাহিম (আ) বলেছিলেন- সাহায্যের প্রয়োজন আছে, তবে আপনার কাছে নয় (আল্লাহর কাছে)।
আর আল্লাহর নির্দেশ বাণী অধিক দ্রুত গতিতেই পৌঁছে যায় – ‘(আল্লাহ্ বলেন) আমি বললাম, হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের উপর শান্তিদায়ক হয়ে যাও।’
হযরত ইবরাহিমকে (আ) যখন প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যকার উক্ত গহ্বরে অবস্থান করছিলেন, তখন তার চতুষ্পার্শ্বে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করছিল, অথচ তিনি ছিলেন শান্তি ও নিরাপদে।
আবু হুরায়রা (রা) বলেন, ইবরাহিমের (আ) পিতা আপন পুত্রের এ অবস্থা দেখে একটি উত্তম কথা বলেছিল, তা হল-
‘হে ইবরাহিম! তোমার প্রতিপালক কতই না উত্তম প্রতিপালক।’
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত একটি আয়াত রয়েছে। যেটি পড়লে আগুন নেভাতে প্রভাব পড়ে, আগুনের ক্রিয়া নিস্তেজ হয়ে আসে। আয়াতটিতে হজরত ইবরাহিমকে (আ) আগুন যেন স্পর্শ না করে, সে নির্দেশ দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন—
يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ
উচ্চারণ: ‘ইয়া না-রু কু-নি বারদান ওয়া সালামান আলা ইবরাহীম।’ অর্থাৎ ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬৯)
জীবনে দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বলে-কয়ে আসে না। যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং নিভে যেতে পারে তরতাজা প্রাণ ও সহায় সম্পদ। তাই কোথাও আগুন লাগলে আশপাশে যারা থাকেন, তাদের উচিৎ আগুন নেভানোর যাবতীয় চেষ্টা অব্যাহত রাখার, আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা এবং কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়া পড়া। অর্থাৎ, আগুন দেখে ভীত ও হতাশ না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তা নিভানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। একইসঙ্গে আল্লাহর কাছে তা সহজে নির্মূলে দোয়া ও আমল করা জরুরি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোথাও আগুন (লাগতে) দেখো, তখন তোমরা (উচ্চস্বরে— আল্লাহু আকবার) তাকবির দাও। কারণ উচ্চস্বরে এই তাকবির আগুন নিভিয়ে দেবে।’ (তাবরানি)। (اَللهُ اَكْبَر) তাকবিরের অর্থ হলো হলো— আল্লাহ মহান। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আগুন যত ভয়ংকর হোক না কেন, তাকবিরের মাধ্যমে তা নিভে যায়। আর আজানের মাধ্যমে শয়তান পলায়ন করে।
সর্বোপরি, প্রতিটি ইমানদার মুসলমানকে ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক তিনটি বিষয়ের প্রতি সর্বাবস্থায় আস্থাশীল ও মনোযোগী থাকতে হবে। এগুলো হলো, তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। এর মধ্যে তাওহিদ হলো প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত। সব নবী–রাসুল (আ.)–গণের কালিমা বা প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল এই তাওহিদেরই মর্মবাণী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। অর্থাৎ ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। দ্বিতীয় অংশে হলো যুগের নবী–রাসুলের পরিচয় ও স্বীকৃতির ঘোষণা। যেমন ‘আদামু ছফিয়ুল্লাহ’ (আদম আ. আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত), ‘নূহুন নাজিয়ুল্লাহ’ (নূহ আ. আল্লাহ কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত), ‘ইবরাহিমু খলিলুল্লাহ’ (ইবরাহিম আ. আল্লাহর খলিল বা বন্ধু), ‘দাউদু খলিফাতুল্লাহ’ (দাউদ আ. আল্লাহর খলিফা), ‘মুসা কালিমুল্লাহ’ (মুসা আ. আল্লাহর কালামপ্রাপ্ত), ঈসা রুহুল্লাহ’ (ঈসা আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা রুহ), ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল)।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, কালিমা শরিফের দ্বিতীয় অংশ রিসালাতের বিবরণ আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কালিমার প্রথম অংশ তাওহিদ তথা আল্লাহর জাত ও সিফাতের (সত্তা ও গুণাবলি) বিবৃতি কোনোরূপ পরিবর্তিত হয়নি।
মনে রাখা দরকার যে, তাওহিদের বিপরীত হলো শিরক। শিরক অর্থ শরিক বা অংশীদার স্থির করা। ইসলামি পরিভাষায় শিরক হলো আল্লাহর জাত (সত্তা), সিফাত (গুণাবলি) ও ইবাদত (আনুগত্যে)-এ কোনো কাউকে সমকক্ষ, শরিক বা অংশীদার, হকদার তথা উপযুক্ত মনে করা। মহাজ্ঞানী লুকমান (আ.) তাঁর প্রিয় সন্তানকে শিরক বিষয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন: ‘হে আমার স্নেহের পুত্র! তুমি আল্লাহর সাথে শরিক করবে না, নিশ্চয়ই শিরক মহা অন্যায়।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৩)।
তাওহিদ ফিয্যাত: আল্লাহ এক, একক, অদ্বিতীয়, অবিভাজ্য। তিনি ‘লা শরিক’ অংশীবিহীন। কোরআন মাজিদে সুরা তাওহিদে এই বিষয়ের পরিপূর্ণ বিবরণের সারসংক্ষেপ বিবৃত হয়েছে। ‘বলো, আল্লাহ একক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (স্বনির্ভর), তিনি জনকও নন এবং তিনি জাতও নহেন, আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’ (সুরা-১১২ ইখলাস, আয়াত: ১-৪)।
তাওহিদ ফিছিছফাত: মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ‘সিফাতে কামাল’ বা পরিপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী। সৃষ্টির গুণ বা বৈশিষ্ট্য অসম্পূর্ণ। এর ব্যতিক্রম বিশ্বাস হলো ‘শিরক ফিছিছফাত’ অর্থাৎ কোনো কাউকে কোনো গুণে বা বৈশিষ্ট্যে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা সমান্তরাল ভাবা হলো ‘শিরক ফিছিছফাত’।
তাওহিদ ফিল ইবাদত: ইবাদত তথা আনুগত্যে ও উপাসনায় তাঁর কোনো শরিক নেই। মহাগ্রন্থ আল–কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘বলো, হে অবিশ্বাসীরা! আমি সেসবের ইবাদত করি না, যেসবের উপাসনা তোমরা করো। এবং তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও, আমি যাঁর ইবাদত করি। আর আমিও ইবাদতকারী নই তাদের, যাদের তোমরা উপাসনা করো। এবং তোমরাও ইবাদতকারী নও তাঁর, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমরা তোমাদের দীন (কর্মফল) ভোগ করবে, আর আমি আমার দীন (পরিণতি) লাভ করব।’ (সুরা-১০৯ কাফিরুন, আয়াত: ১-৬)। এর ব্যত্যয় হলো ‘শির্ক ফিল ইবাদাত’ অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে শরিক করা।
প্রতিটি মুসলমানকে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ার প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে স্বচ্ছ ও সতর্কতার সঙ্গে নিবেদিত থাকা আবশ্যক। তাহলো:
১ ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ’: আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, রিযিকদাতা, সবকিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিশ্বাস করা;
২. ‘তাওহিদুল ঊলূহিয়্যাহ’: শুধুমাত্র আল্লাহর উপাসনা করা, তাগুতকে বর্জন করা; এবং
৩. ‘তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত’: কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিসে উল্লেখিত আল্লাহর নাম ও গুণাবলিগুলো বিকৃতি, ধরন নির্ধারণ, সাদৃশ্য প্রদান ছাড়াই বিশ্বাস করা।