চিন্তা ও চিন্তক

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

চিন্তা ও চিন্তক

মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির 

চিন্তা মানে কি? এর শাব্দিক, পারিভাষিক পরিচয় জানতে চাচ্ছেন? এর পরিচয় সম্পর্কে চিন্তা করতে গেলেই আমরা অনেকে অচিন্তনীয় সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়ে যাই। চিন্তার গোড়াকার, চিন্তার ধরন, মানুষে মানুষে চিন্তার পার্থক্য- এ রকম নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন চিন্তাবিদ এমন সব বিচিত্রধর্মী ও বিরোধাত্মক মতামত দিয়েছেন যে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে একান্তভাবে দিশেহারা হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। চিন্তার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়েও আছে নানান ধরনের কূটকচালি।

এসব কূটকচালির হাত থেকে মুক্ত হওয়া মোটেই সহজ নয় জেনেও আমাদেরকে অনেক সময় সাড়া দিতেই হচ্ছে। এমনটি করতে গিয়ে আমিও নিজের চিন্তাবৃত্তেই আটকে না থেকে পারছি না। তবে সে সঙ্গে এ কথাও স্মরণে রাখছি, কোনো মানুষেরই একান্ত নিজের চিন্তা বলে কিছু নেই। সমাজে প্রত্যেক মানুষকেই অপরের চিন্তার অংশ নিয়ে নিজের চিন্তাকে গঠন করে নিতে হয় অথবা বয়ে চলতে হয়।। এভাবেই চিন্তা ও ভাষার সম্পর্ক নিয়ে আমার নিজের চিন্তাটি গড়ে উঠেছে মার্কসবাদীদের সংস্পর্শে এসে।

মার্কসবাদ দেখিয়েছে যে, শ্রমই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। ‘শ্রমই বিধাতা’- কোনো কোনো মার্কসবাদী এমন কথাও বলেছে। শ্রম থেকেই মানুষ চিন্তাশক্তির অধিকারী হয়েছে, মানুষ ভাষাও লাভ করেছে চিন্তার সূত্রে, ভাষা ও চিন্তা অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গ্রথিত। বলা হয়ে থাকে- চিন্তা করা মানে মনে মনে কথা বলা। আর কথা বলা মানে জোরে জোরে চিন্তা করা। অর্থাৎ ভাষা শুধু মানুষের চিন্তাকে প্রকাশ করে না, চিন্তাকে ধারণ করে।

প্রজাতি রূপে সব মানুষ অভিন্ন হলেও প্রতিটি মানুষেরই আছে জাতিসত্তা, ব্যক্তিসত্তা, এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আছে তার শ্রেণিসত্তাও। এ সমাজে এই শ্রেণিসত্তাই মানুষের চিন্তাকে যে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, সে কথাটিও ভুলে গেলে চলবে না। মার্কসীয় দর্শন এ বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের শ্রমের ফল অপহরণ বা আত্মসাৎ করে নিয়েই অল্প সংখ্যক মানুষ সমাজের কর্তৃত্বশীল অধিপতি হয়ে বসেছে। এরাই হয়েছে শোষক, আর এদেরই শোষণের শিকার হয়েছে শ্রমের মাধ্যমে সম্পদের স্রষ্টা অগণিত মানুষ। এভাবেই শোষক-শোষিতের বিভাজনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের। এই সমাজের কর্তৃত্বশীল শ্রেণি অন্যদের কায়িক শ্রমের ফসলই শুধু অপহরণ করে নেয়নি, তাদের মানসিক শ্রম তথা চিন্তা-চেতনার ওপরেও থাবা বিস্তার করেছে। শোষকরা শোষিতদের শ্রেণি-চেতনাকেও ভোঁতা করে ফেলেছে। অনেকে ক্ষেত্রেই শোষিতরা কর্মে যেমন, চিন্তায়ও তেমনি শোষকদের শ্রেণিস্বার্থকেই রক্ষা করে চলেছে। এ কারণেই সমাজে শ্রেণি সংগ্রাম চললেও সে সংগ্রামে শোষিতদের সহজ জয়লাভ ঘটেনি, শোষক শ্রেণির আধিপত্যই কোনো না কোনোভাবে বজায় থেকে গেছে।

তাই বলে এ অবস্থাটিই যে চিরস্থায়ী হয়ে থাকেনি, ইতিহাসের বির্বতন যে ঘটেই চলেছে, এবং ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শোষিত শ্রেণির মানুষরাই যে পুরনো চিন্তার খোলস থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিয়েছে- সেসব কথাও ভুলে থাকলে চলবে না। সারা পৃথিবীতেই এমনটি ঘটেছে; ঘটছে আমাদের দেশেও।

আমাদের এই বাংলাদেশটি যখন পাকিস্তান নামক একটি অমানবিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল, তখন পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে গিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনাকেই বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে দিতে চেয়েছিল। আমরা এর প্রতিরোধ করেছি রক্ত দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে। আমরা আমাদের ভাষার অধিকারই প্রতিষ্ঠা করিনি শুধু; পাকিস্তানের শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রেরও পত্তন ঘটিয়েছি, আমাদের চিন্তাকেও করেছি শৃঙ্খলমুক্ত। সেই শৃঙ্খলমুক্ত চিন্তার মাধ্যমে আমরা আমাদের বর্ণমালার বিকৃতি রোধ করেছি, রবীন্দ্রনাথকে একান্ত যথাযথ রূপে অনুধাবনের প্রয়াস পেয়েছি, নজরুলের খণ্ডায়ন রোধ করেছি।

আমাদের চিন্তার মুক্তি ঘটানোতে কেবল যে পাকিস্তানের শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদেরই অবদান আছে, তা কিন্তু নয়। আমাদের বিপুল সংখ্যক নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের অসাধারণ ভূমিকার কথাও একান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। উনিশ শতকের লালন ফকির থেকে শুরু করে শাহ আবদুল করিম পর্যন্ত অজস্র লোককবি তথা লোকায়ত চিন্তাধারার বাহক মানুষদের অবদানকে অস্বীকার করলে আমাদের চিন্তার মুক্তির ইতিহাস হবে একান্তই খণ্ডিত ইতিহাস। প্রাকৃতজনের ভেতর থেকে উঠে আসা মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল বা নিবারণ পণ্ডিতের মতো লোকায়ত চিন্তকদের কৃতীই তো আমাদের প্রগতি ভাবনাকে গরিষ্ঠ সংখ্যক লোকসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এখনও প্রাকৃতজনের মধ্যে তাদের উত্তরাধিকারের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। অথচ এদের সঙ্গে প্রতিতুলনায় আমাদের একালের তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতদের অনেকের কাণ্ডকৃতিই তো একান্ত লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে আমদের এ দেশে যারা মুক্তিবুদ্ধির প্রসার ঘটাতে যত্নবান হয়েছিলেন, সেই সব চিন্তাবিদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী আজ কোথায়? ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থের ধারক রূপেই কি এখনকার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর চিন্তা-চেতনা নিয়োজিত হচ্ছে না? সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রসাদভোগী হওয়ার চিন্তাকে বাদ দিয়ে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন এমন চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা একেবারেই অঙুলিমেয় নয় কি? ধর্মান্ধতার ভয়াবহ বিস্তৃতি কি মানুষের প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিকে প্রতিনিয়ত কোণঠাসা করে চলছে না?

এমন অবাঞ্ছিত অবস্থার অবসান ঘটাতেই হবে। তেমন ঘটানোর চিন্তাকে ধারণ করেন, এমন চিন্তাবিদ মানুষের অবস্থান সমাজে অবশ্যই আছে। তবে তারা আছেন বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই মুহূর্তে এই বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণে প্রয়াস গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই। একান্ত সঙ্গতভাবেই আশা করতে পারি, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৃত মুক্তিবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাশীল মানুষদের শুভ সম্মিলন ঘটবেই। এমন মানুষ কেবল সমাজের উচ্চমঞ্চে সংকীর্ণ বাতায়নেই নিজেদের আবদ্ধ করে রাখবেন না। তারা সেই নিল্ফেম্ন নেমে আসবেন, যেখানে প্রাকৃতজন এখনও বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতির প্রগতিশীল ধারাকে প্রবহমান রেখেছেন। সমাজের সর্বক্ষেত্রের মুক্তিবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব চিন্তকের এমন সম্মিলন ঘটলেই দুর্বুদ্ধিজীবী অপচিন্তকের দল পিছু হটতে বাধ্য হবে। সেই শুভদিনের অপেক্ষায় আমরা আছি। সেদিন আসবেই।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment