মূল: শায়খ আহমদ সুকায়রিজ আত্ তিজানী (রহ:)
ইংরেজি ভাষান্তর: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ (বৈরুত)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
শায়খ আহমদ সুকায়রিজ আত্ তিজানী (১৮৭৮-১৯৪৪ খৃষ্টাব্দ) তাঁর প্রণীত ‘আশ্ শাতাহাত আস্ সুকায়রিজিয়্যা’ গ্রন্থের ৫৫-৫৭ পৃষ্ঠায় বলেন:
মুসলমান সর্বসাধারণ যাঁরা মীলাদ উদযাপন করেন, তাঁরা হযরত জাবের (রা:)-এর বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করে থাকেন, যে বর্ণনাটিতে হযরত জাবের (রা:) রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেছিলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। (অনুগ্রহ করে) আমায় বলুন, আল্লাহতা’লা সর্বপ্রথম বা সর্বাগ্রে কী সৃষ্টি করেন?’ জবাবে মহানবী (দ:) বলেন, ‘ওহে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ পাক সর্বাগ্রে তোমার নবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি)-কে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেন।’ ইমাম কসতুলানী (রহ:) নিজ ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা’ গ্রন্থে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেন এবং জানান যে এটি মোহাদ্দীস হযরত আবদুর রাযযাক (রহ:)-এর বর্ণিত। এভাবেই আমরা এটি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। অনুরূপভাবে, মীলাদুন্নবী (দ:) যাঁরা উদযাপন করেন, তাঁরা ওই বর্ণনাটিও উদ্ধৃত করেন যেখানে বিবৃত হয়েছে, ‘আল্লাহতা’লা তাঁর নিজের এক মুঠি (পরিমাণ) নূর নিয়ে সেটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), অস্তিত্বশীল হোন! [এই বর্ণনা হাদীসের গ্রন্থগুলোতে পাওয়া না গেলেও আস্ সুফুরী তাঁর ’নুযহাত আল-মাজালিস্’ পুস্তকের ‘মহানবী (দ:)-এর মীলাদ’ অধ্যায়ে তা বর্ণনা করেন]
আল্লাহতা’লা তাঁর নূর থেকে এক কবজা নূর নেয়ার মানে ওই নূর তাঁর সাথেই সম্বন্ধযুক্ত (’মোযাফ লাহু’); আর ’মিন নূরিহী’ (তাঁর নূর হতে) বাক্যটিতে ’মিন’ (’হতে’) শব্দটি হলো ’লিল বয়ান’ তথা ব্যাখ্যামূলক। ব্যাকরণবিদরা যেভাবে নিরূপণ করেন, সেভাবে ‘মিন’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করে মহানবী (দ:) যেন বলছেন, ’রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূর (প্রকৃতপক্ষে) আল্লাহতা’লারই নূর’ এবং ‘খোদায়ী এক মুঠি (কবজা) হচ্ছে খোদারই নিজস্ব নূর।’ আমাদের সাইয়্যেদ (ছরকার) মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নূর সকল নূরের উৎস বটে, যা থেকে সেগুলোকে নিজস্ব পর্যায় অনুযায়ী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে। তাই ওই নূর সৃষ্টি করা হয়। কোনো এক আ’রেফ (খোদা-জ্ঞানী) বলেন, ’নূরিহী’ বাক্যটিতে ‘হু’ (তিনি) যমীর (সর্বনাম)-টি ‘তোমার নবী (দ:)-এর নূর’ বাক্যটিতে ‘তোমার নবী (দ:)’-কে উদ্দেশ্য করে। অতএব, এটি এক রকম ‘এসতেখদাম’ তথা দ্ব্যর্থমূলক প্রয়োগ পদ্ধতি [“এসতেখদাম হলো এমন কোনো শব্দের প্রয়োগ যার দু’টি অর্থ বিদ্যমান; এর মধ্যে খোদ শব্দটি দ্বারাই প্রথম অর্থ বেরিয়ে আসে; আর দ্বিতীয় অর্থটি তার সর্বনাম দ্বারা প্রকাশ পায়। যেমন এরশাদ হয়েছে – ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ ওই (রমযান) মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই সেটির রোযা পালন করে’ (আল-কুরআন, ২:১৮৫)। এখানে ‘মাস’ বলতে নতুন চাঁদকে বোঝানো হয়েছে, আর ’সেটি’ বলতে (রোযার) ’সময়কাল’কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।” – কারাম আল-বোস্তানী, আল-বয়ান (বৈরুত, মকতাবাত সাদির, তারিখবিহীন), ৮৬-৮৭ পৃষ্ঠা]। মহানবী (দ:) যেন এতে (ওপরোক্ত বাক্যে) বলছেন, ’তোমার নবী (দ:)-এর নূর সৃষ্ট হয়েছে তোমার নবী (দ:)-এর নূর হতেই’; তা এই অর্থে যে ওই নূর হতে মহানবী (দ:)-এর সত্তা মোবারক তথা তাঁর পবিত্র রূহ এবং তাঁরই সমস্ত আহওয়াল বা (আত্মিক) অবস্থাকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব,তাঁর নূর দ্বারা তিনি অস্তিত্বশীল হন, এবং তাঁরই নূর হতে সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব পায়।
খোদাতা’লার সত্তা মোবারকের নূর (জ্যোতি) প্রসঙ্গে বলা যায়, এটি প্রাক-সূচনালগ্ন থেকে বিদ্যমান, মানে এর কোনো সূচনাকাল নেই। আর মহান আল্লাহতা’লার ’নূর’কে কোনো পদ্ধতিতে বর্ণনা করা যেমন যায় না, তেমনি সেটি কল্পনা করাও যায় না। উপরন্তু, তাঁর ক্ষেত্রে ‘নূর’ শব্দটি ‘মুনাওয়ার’ (আলোকোজ্জ্বলকারী) অর্থে বোঝাবে, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে আল-কুরআন ২৪:৩৫-এর তাফসীরে – “আল্লাহ নূর আসমানসমূহ ও জমিনের” – মানে তিনি হলেন আসমানসমূহ ও দুনিয়াতে নূর (জ্যোতি) বিচ্ছুরণকারী। অতএব, তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে কোনো কিছু (সরিয়ে) নেয়া যায় না; আমাদের প্রভুর মহান সত্তা, তাঁর বৈশিষ্ট্যমণ্ডলী, কিংবা তাঁর ক্রিয়া কল্পনারও অতীত! আরেক কথায়, মহানবী (দ:) বলতে চেয়েছেন, ‘আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টিশীল নূর হতে তোমার নবী (দ:)-এর নূরকে সৃষ্টি করেন এবং ওই (সৃষ্টিশীল) নূর-ই তোমার নবী (দ:)-এর নূর। অতএব, সমস্ত সৃষ্টিজগতে (মহানবী দ:-এর) ওই নূরের আগে কিছুই ছিল না, বরঞ্চ সমগ্র সৃষ্টিজগতেরই উৎপত্তি হয় ওই নূর হতে। সম্ভাবনাময়তার আওতাভুক্ত প্রতিটি বিষয় বা বস্তু-ই ওই নূরের ফলশ্রুতিতে অস্তিত্ব পেয়ে থাকে। আর সৃষ্টিজগতে প্রতিটি অস্তিত্বশীল বস্তু, তা যা-ই হোক না কেন, সবই ওই নূরের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়।
আমি ওপরের বিষয়টি নিয়ে স্বপ্নে দেখলাম আমাদের সূফী মাশায়েখদের অন্যতম শায়খ আবূ আল-কাসেম মোহাম্মদ ফাতাহ বিন কাসেম আল-কাদেরী (রহ:)-এর সাথে আলাপ করছি। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলাম সে সব ব্যাপারে যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সূচনা ও তাঁর নূর হতে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্যান্য নূরের সৃষ্টি; যে বিবর্তনে রয়েছে শারীরিকভাবে জন্মগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে চিরকল্যাণপ্রাপ্তি ও অন্যান্য ফলশ্রুতি, যা হতে পারে মহিমান্বিত বা লজ্জাকর, আশীর্বাদধন্য বা অধঃপতিত, জীবন বা মৃত্যু, প্রাণিকুল, জড় পদার্থ, উদ্ভিদ ও অন্যান্য বিষয়। ওই স্বপ্নে তিনি আমাকে বলেন:
”নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক যখন বিশ্বজগত সৃষ্টি করেন, তখন সমগ্র আলম (জগত) ও সৃষ্টিকুল যেগুলো অস্তিত্বশীল হবার খোদায়ী এরাদা (ইচ্ছা)-প্রাপ্ত হয়েছিল, সেগুলোকে তাদের নিজ নিজ অস্তিত্বপ্রাপ্তি ও বিলুপ্তির ক্রমানুসারে একটি সর্বব্যাপী মহা-বলয়ের আওতায় সৃষ্টি করা হয় (তাহতা দা’য়েরাত আল-ফালাক আল-মুহীত বিল-কুল্ল); এতে সন্নিবেশিত হয় অন্যান্য বলয়ের স্তর যা শেষ অস্তিত্বশীল বস্তু পর্যন্ত বিস্তৃত, যেমনটি না-কি কোনো গোলক বা রসুনের আকৃতি। ওতে (মহা-বলয়ে) বিরাজমান হয় ছিদ্রসমূহ যা সকল স্তরকে ছেদ করে এমনভাবে, যার দরুন প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে আলো বেরিয়ে গোলকের সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গোলকের স্তরগুলো হচ্ছে শতাব্দী, বছর, মাস, দিন, সপ্তাহ ও মিনিট (ক্ষণ), এমন কি চোখের এক পলক চাহনি-ও। আল্লাহতা’লা যখন এরাদা (ইচ্ছে) করেছিলেন তিনি নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে সকল বস্তু সৃষ্টি করবেন এবং সেগুলোকে অস্তিত্বশীল করবেন, তখন তিনি নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সৃষ্টি করেন। সেই সর্বব্যাপী মহা-বলয় বা গোলক মুখোমুখি হয় ওই নূরের তাজাল্লী তথা আলোকোচ্ছ্বটার, যে নূর ব্যতিরেকে সেটি আবির্ভূত হতে অক্ষম ছিল। ওই নূর সেই গোলকের ভেতরে আলো বিচ্ছুরণ করে এবং ছিদ্রগুলো দিয়ে গোলকের বাইরে প্রসারিত হয়। অতঃপর আল্লাহ পাক সেই বলয়কে ঘুরতে আদেশ করেন এবং সেটির অভ্যন্তরভাগের সকল স্তরকেও ঘুরতে আদেশ করেন; এটি এমন-ই এক বিস্ময়কর ব্যবস্থা যা সর্বজ্ঞানী ও অতুলনীয় স্রষ্টার এক মহা-পরিকল্পনা ছাড়া কিছু নয়। অতঃপর ছিদ্রগুলো একে অপরের সাথে ঘাত-প্রতিঘাতরত হয় এবং সেগুলোর মধ্য দিয়ে প্রসারিত আলোও তাতে রত হয়; এমতাবস্থায় হয় আলো ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে ওপরে যা আছে তার সাথে গিয়ে মেশে, নয়তো এর বিপরীতে ছিদ্রটির পাশে যা আগমন করে তার মধ্য দিয়ে আলো বের হতে না পারলে আগত ওই বস্তু-ই ছিদ্রটিকে বন্ধ করে দেয়। শেষোক্ত ক্ষেত্রে সেই ছিদ্র দিয়ে আলো বের হবার পথ-ই বন্ধ হয়ে যায়। যাঁর ওপর ওই নূর কিরণ ছড়ান, তিনি আশীর্বাদধন্য ও আলোকিত, আর যে ব্যক্তি তা (আলোপ্রাপ্তি) থেকে রহিত, সে হতভাগা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত। এভাবেই ঈমানদারী ও কুফরীর আবির্ভাব ঘটে; সেই সাথে সেসব বিষয়েরও আবির্ভাব হয়, যেগুলো প্রকাশ্যে বা গোপনে, প্রতিটি যুগে আল্লাহর ইচ্ছায় (কাউকে) ওই দু’টোর (ঈমানদারী বা কুফরীর) যে কোনো একটির দিকে ধাবিত করে। সবাই ওই নূর হতে সেই পরিমাণ-ই গ্রহণ করেন, যতোখানি তাঁদের জন্যে (ঐশীভাবে) বরাদ্দ করা হয়েছে। অতএব, তুমি দেখতেই পাচ্ছো যে সবাই তাঁর (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) কাছ থেকে এসেছেন এবং তাঁর নূর হতে নিজ নিজ নূর গ্রহণ করছেন……।”
আল্লাহর রহমতে এটি এক্ষণে সুস্পষ্ট যে, ‘নূরিহী’ (তাঁর জ্যোতি) বাক্যটিতে ‘হু’ (তাঁর) যমীর (সর্বনাম) দ্বারা নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে ‘এসতেখদাম’ তথা দ্ব্যর্থবোধক অর্থ প্রয়োগ পদ্ধতির সাহায্যে, যেটি ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞদের ব্যবহৃত শব্দের এক ধরনের আলঙ্কারিক প্রয়োগ বটে। তবে এ কথা বলা উচিত হবে না যে এখানে ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দটি এবং ‘তোমার নবী (দ:)-এর নূর’ বাক্যটিতে উদ্দেশ্যকৃত প্রথম ’নূর’ একই; এতে ধারণা জন্মাবে যে কোনো বস্তু আপনাআপনি বা নিজ হতেই সৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম। (পক্ষান্তরে) আমরা যা বলি তা হলো, ‘মিন নূরিহী’ (‘তাঁর জ্যোতি হতে’) বাক্যটিতে ’মিন’ (’হতে’) শব্দটি বয়ানিয়্যা তথা ব্যাখ্যামূলক, যার মানে “নূরু নাবিইয়্যিকা আল্লাযি হুয়া নূরুহ” (’তোমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নূর, যার মধ্যে তিনি নিজেই নূর’)। এটি নিশ্চয় ”তাব’এদিয়্যা” তথা সমষ্টির অংশ-নির্দেশক শব্দ নয়। আপনারা এ কথাও বলতে পারেন যে ‘তাঁর’ সর্বনামটি সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাককে উদ্দেশ্য করে, যার দরুন ‘নূর’ সৃষ্ট হলেও আল্লাহর সাথে তেমনিভাবে সম্পর্কিত, যেমনটি আল-কুরআনের আয়াতে ঘোষিত হয়েছে – “এ তো আল্লাহর সৃষ্ট” (৩১:১১)। অতএব, এটি আল্লাহ পাকের সাথে ’এযাফত’ তথা সম্বন্ধযুক্ত এবং সৃষ্ট ওই নূর আপনাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এরই নূর, অন্য কিছু নয়।
প্রশ্ন করা হতে পারে, যে কোনো সৃষ্ট বস্তু-ই স্থান ও কাল দ্বারা আবদ্ধ; মানে স্থান-কাল সৃষ্টির জন্যে বাধ্যতামূলক। এতে আগেভাগে ধরে নেয়া হতে পারে যে স্থান-কাল সৃষ্টির সাথে, অথবা তারও আগে বিদ্যমান; যদিও এক্ষেত্রে মহানবী (দ:)-কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই বর্ণনা এসেছে। এটি কীভাবে সম্ভব? জবাবে আমরা বলি, স্থান-কাল রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ছায়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যাঁকে ছাড়া ওগুলো গঠিত হতেই পারতো না। মহানবী (দ:) তাঁর দিব্যদৃষ্টি দ্বারা নিজ ছায়া থেকে সেগুলোর গঠন প্রত্যক্ষ করেন এবং আবর্তমান সর্বব্যাপী বলয়ের মাধ্যমে স্থান-কালের গতি-ও তিনি দর্শন করেন। এভাবেই আমরা উপলব্ধি করি খোদায়ী দয়ার্দ্রতা ও দানশীলতায় ভরা উচ্চ মকামে তাঁর অধিষ্ঠানের (ঐশী) ঘোষণাকে: “হে মাহবূব! আপনি কি আপন রব্ব (প্রভু)-কে দেখেননি, তিনি কীভাবে সম্প্রসারিত করেছেন ছায়াকে? এবং তিনি যদি ইচ্ছে করতেন, তবে সেটিকে স্থির করে দিতেন; অতঃপর আমি সূর্যকে সেটির ওপর দলীল (চালনাকারী) করেছি” (সূরা ফোরকান, ৪৫ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ’নূরুল এরফান’)। আল্লাহতা’লা এই আয়াতে রাসূলে করীম (দ:)-কে সেসব বিষয় সম্পর্কে বলেছেন যেগুলো তিনি দেহের সাথে রূহ (আত্মা)-এর একত্রিকরণের সময় তাঁর উচ্চ-মকামে অবস্থান করে প্রত্যক্ষ করেছিলেন; আর এই ঘটনা তিনি যখন সম্পূর্ণভাবে রূহ ছিলেন, তখনকার অবস্থা স্মরণ করার জন্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) অস্তিত্বশীল হওয়ার সাথে সাথে এমন মেধা ও উপলব্ধি-ক্ষমতা প্রাপ্ত হন যে আল্লাহ পাক তাঁকে যা কিছুই প্রদর্শন করেছিলেন, তার সবই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। নিশ্চয় তিনি তখন একেবারে একাকী তাঁর প্রভু খোদাতা’লার সান্নিধ্যে ছিলেন ওই মহান দরবারে, যখন কোনো কিছুরই সৃষ্টি হয়নি – না আদম (আ:)-এর সৃষ্টি, না অন্য কোনো সত্তার, যেমনটি তিনি স্বয়ং একটি হাদীসে ইঙ্গিত করেছেন, “আমি তখনো নবী ছিলাম, যখন আদম (আ:) নিজ রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন” [হযরত আবূ হোরায়রাহ (রা:) হতে আত্ তিরমিযী (রহ:) কৃত ‘সুনান’ (ফযল আন্ নবী রচিত ’মানাকিব’: হাসান সহীহ গরিব) এবং আত্ তাহাবী প্রণীত ‘শরহে মুশকিল আল-আসা’র’(১৫:২৩১ #৫৯৭৬); হযরত মায়সারাত আল-ফাজর (রা:) হতে ইমাম আহমদ (রহ:) রচিত ’মুসনাদ’ (৩৪:২০২ #২০৫৯৬), আল-হাকীম লিখিত ‘মোসতাদরাক’ (২:৬০৮-৯), আত্ তাবারানী (রহ:) কৃত ‘আল-মো’জাম আল-কবীর’ (২০:৩৫৩ #৮৩৩-৪) এবং অন্যান্য; হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে আত্ তাবারানী (রহ:) প্রণীত ‘আল-মো’জাম আল-আওসাত’ (৪:২৭২ #৪১৭৫) এবং ‘আল-মো’জাম আল-কবীর’ (১২:৯২ #১২৫৭১); এবং হযরত আবূল জাদা’আ (রা:) হতে ইবনে সা’আদ রচিত ‘তাবাকাত’ (১:১২৩)]। ওই সময় মহানবী (দ:) নিজ মহান ছায়ার প্রতি বর্ষিত তাঁরই প্রভুর সমস্ত দান প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এবং তার (পবিত্র ছায়ার) সম্প্রসারণ এবং তা হতে সমগ্র সৃষ্টির উৎপত্তি হবার ঘটনার সাক্ষীও তিনি হয়েছিলেন। আল্লাহতা’লা উক্ত আয়াতে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই যেন বলেছেন, “হে মাহবূব! আপনি কি আপন রব্ব (প্রভু)-কে দেখেননি, তিনি কীভাবে সম্প্রসারিত করেছেন ছায়াকে?” কেননা, তিনি-ই নিজ প্রভুকে এবং তাঁর দ্বারা সেই ছায়া সম্প্রসারণের ক্রিয়া-পদ্ধতিকে প্রত্যক্ষ করেছেন, যে ছায়া দ্বারা সকল সৃষ্টি গঠিত হয়েছিল। অতএব, আমাদের মহানবী (দ:) উভয় ধরনের (সাক্ষ্য) বহন করছেন, যথা – আল্লাহতা’লা সম্পর্কে সাক্ষ্য এবং সৃষ্টিকুলসম্পর্কিত সাক্ষ্য, এমন এক পর্যায়ে এই দর্শনক্ষমতা তাঁর প্রতি প্রদত্ত হয় যা তিনি ছাড়া আর কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। তাঁর নিজস্ব বাস্তবতা তিনি ছাড়া আর কেউই এতো ভালভাবে জানতে সক্ষম হননি। তাই তিনি এরশাদ ফরমান, “লা এয়ারিফুনী হাকীকাতান্ গায়রু রাব্বী”; মানে “আমার প্রভু ছাড়া আমাকে কেউই চেনে না” [’এই বর্ণনা আমি পাইনি’ – ড: হাদ্দাদ]। ইবনে মাশীশ (রহ:)-এর বাণীতে এ কারণে তাঁকে ’সবচেয়ে বড় পর্দা’ অভিহিত করে বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে বড় পর্দাকে আমার আত্মার প্রাণরূপে পরিণত করুন।’
মহানবী (দ:), তাঁর আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাবে কেরাম (রা:)-এর প্রতি শান্তি ও আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, আমীন।
-আস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা ২০১২