হক্কপন্থী উলামা ও ফুকাহাবৃন্দের সমর্থনসূচক দলিলঃ
১/ – ইবনে কাসীর, যাকে সালাফী/ওহাবীরা তাফসীর ও ইতিহাস শাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে থাকে, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামের মুজাহিদ সুলতান গাযী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ভগ্নিপতি শাহ মালিক আল-মুযাফফর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অথচ সালাফীরাই ইবনে কাসীরের কথাকে বিকৃত করে এই মর্মে মিথ্যে ছড়িয়েছে যে মুযাফফর শাহ একজন ফাসেক, নিষ্ঠুর ও বেদআতী শাসক ছিলেন (নাউযু বিল্লাহ)।
প্রকৃতপক্ষে ইবনে কাসীর লিখেন:
”(মুযাফফর শাহ) ছিলেন একজন উদার/সহৃদয় ও প্রতাপশালী এবং মহিমান্বিত শাসক, যাঁর সকল কাজ ছিল অতি উত্তম। তিনি কাসিইউন-এর কাছে জামেয়া আল-মুযাফফরী নির্মাণ করেন…..(প্রতি) রবিউল আউয়াল মাসে তিনি জাঁকজমকের সাথে মীলাদ শরীফ (মীলাদুন্নবী) উদযাপন করতেন। উপরন্তু, তিনি ছিলেন দয়ালু, সাহসী, জ্ঞানী, বিদ্বান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক – রাহিমুহুল্লাহ ওয়া একরাম – শায়খ আবুল খাত্তাব (রহ:) সুলতানের জন্যে মওলিদুন্ নববী সম্পর্কে একখানি বই লিখেন এবং নাম দেন ‘আত্ তানভির ফী মওলিদ আল-বাশির আন্ নাযীর’। এ কাজের পুরস্কারস্বরূপ সুলতান তাঁকে ১০০০ দিনার দান করেন। সালাহিয়া আমল পর্যন্ত তাঁর শাসন স্থায়ী হয় এবং তিনি ’আকা’ জয় করেন। তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র থেকে যান।
”আস্ সাবত্ এক ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করেন যিনি সুলতানের আয়োজিত মওলিদ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন; ওই ব্যক্তি বলেন: ‘অনুষ্ঠানে সুলতান ভালভাবে রান্নাকৃত ৫০০০ ছাগল, ১০,০০০ মোরগ, ১ লক্ষ বৌল-ভর্তি দুধ এবং ৩০,০০০ ট্রে মিষ্টির আয়োজন করতেন’।” [’তারিখে ইবনে কাসীর’, ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়া’ ১৩তম খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা]
২/ – ইমাম সেহাবউদ্দীন আবুল আব্বাস কসতলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন
যিনি ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ শীর্ষক সীরাতের বই রচনা করেন, তিনি বলেন:
”মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদত তথা এ ধরণীতে শুভাগমন রাতে হয়েছে বলা হলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে দুটো রাতের মধ্যে কোনটি বেশি মর্যাদাসম্পন্ন – কদরের রাত (যা’তে কুরআন অবতীর্ণ হয়), নাকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরাধামে শুভাগমনের রাত?
হুযূর পূর নূর (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর বেলাদতের রাত এ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতর ৩টি কারণে –
প্রথমতঃ নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এ বসুন্ধরায় আবির্ভূত হন মওলিদের রাতে, অথচ কদরের রাত (পরবর্তীকালে) তাঁকে মন্ঞ্জুর করা হয়। অতএব, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর আবির্ভাব, তাঁকে যা মন্ঞ্জুর করা হয়েছে তার চেয়েও শ্রেয়তর। তাই মওলিদের রাত অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন।
দ্বিতীয়তঃ কদরের রাত যদি ফেরেশতাদের অবতীর্ণ হবার কারণে মর্যাদাসম্পন্ন হয়, তাহলে মওলিদের রাতে মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এ ধরণীতে প্রেরিত হবার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ফেরেশতাদের চেয়েও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, আর তাই মওলিদের রাতও শ্রেষ্ঠতর।
তৃতীয়তঃ কদরের রাতের বদৌলতে উম্মতে মোহাম্মদীকে বিশিষ্টতা দেয়া হয়েছে; অথচ মওলিদের রাতের মাধ্যমে সকল সৃষ্টিকে ফযিলাহ দেয়া হয়েছে। কেননা, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -কে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যে রহমত করে পাঠানো হয়েছে (আল-কুরআন ২১:১০৭)।
অতএব, এই রহমত সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্যে সার্বিক।”
রেফারেন্স: ইমাম কসতলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’, ১ম খণ্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা। এ ছাড়াও ইমাম যুরকানী মালেকী স্বরচিত ‘শরহে মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া’, ১ম খণ্ড, ২৫৫-২৫৬ পৃষ্ঠা।
ইমাম কসতলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি আরও বলেন: ”যাদের অন্তর রোগ-ব্যাধি দ্বারা পূর্ণ, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর মীলাদের মাস, অর্থাৎ, রবিউল আউয়ালের প্রতিটি রাতকে যাঁরা উদযাপন করেন তাঁদের প্রতি আল্লাহতা’লা দয়াপরবশ হোন!” [আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া, ১ম খণ্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা]
– ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী রহমাতুল্লাহে আলাইহি যিনি হিজরী ৯ম শতকের মোজাদ্দেদ (ইসলাম পুনরুজ্জীবনকারী), তিনি লিখেন:
“মীলাদুন্নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) উদযাপন যা মূলতঃ মানুষদের সমবেত করা, কুরআনের অংশ-বিশেষ তেলাওয়াত, মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর ধরাধামে শুভাগমন (বেলাদত) সংক্রান্ত ঘটনা ও লক্ষ্মণগুলোর বর্ণনা পেশ, অতঃপর তবাররুক (খাবার) বিতরণ এবং সবশেষে সমাবেশ ত্যাগ, তা উত্তম বেদআত (উদ্ভাবন); আর যে ব্যক্তি এর অনুশীলন করেন তিনি সওয়াব অর্জন করেন, কেননা এতে জড়িত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর মহান মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁর সম্মানিত বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।” [ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ১ম খণ্ড, ২৯২ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরিয়া, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]