৮. শহীদগণ আলমে বরযখে কিভাবে জীবিত অবস্হায় জীবন অতিবাহিত করেন এবং রিযিক লাভ করেন?? এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন,রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন:
أَرْوَاحهمْ فِي جَوْف طَيْر خُضْرٍ لَهَا قَنَادِيل مُعَلَّقَة بِالْعَرْشِ تَسْرَح مِنْ الْجَنَّة حَيْثُ شَاءَتْ
“শহীদগণের রূহ সবুজ রঙের পাখির পেটের ভিতরে বিশেষ সম্মানিত অবয়বে অনন্য জীবন লাভ করে। আর তাদের জন্য আরশে প্রদীপসমূহ লটকানো হয়। তারা জান্নাতে যেখানে খুশীতে বিচরণ করেন।”
[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৮৭]
❏ ৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ
الشُّهَدَاءُ عَلَى بَارِقِ نَهْرٍ بِبَابِ الْجَنَّةِ ، وَيَظْهَرُ بِبَابِ الْجَنَّةِ فِي قُبَّةٍ خَضْرَاءَ يَخْرُجُ عَلَيْهِمْ رِزْقُهُمْ مِنَ الْجَنَّةِ بُكْرَةً وَعَشِيًّا
“শহীদগণ জান্নাতের দ্বারে নির্ঝরণীর ঝলকে সবুজ গম্বুজের মধ্যে অবস্হান করেন। তখন জান্নাত থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের নিকট রিযিক আগমন করে।”
[মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং ২৩৮৬]
❏ ১০. অপরদিকে সাধারণ মুমিনগণের রূহ সম্পর্কে হযরত কা‘ব ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন:
إِنَّمَا نَسَمَةُ الْمُؤْمِنِ طَائِرٌ يَعْلُقُ فِي شَجَرِ الْجَنَّةِ ، حَتَّى يُرْجِعَهُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى جَسَدِهِ يَوْمَ يَبْعَثُهُ
“মুমিনের রূহ পাখিরূপে জান্নাতের গাছে বিচরণ করে-যে পর্যন্ত রোজ কিয়ামতে তার দেহে তাকে ফেরানো না হবে।”
[মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৫৩৫১]
শহীদগণের রূহ তারকার ন্যায়-যা সবুজ পাখির ভিতর প্রবেশ করে। পক্ষান্তরে সাধারণ মুমিনগণের রূহ স্বয়ং পাখির স্বরূপ হয়ে যায়।
[তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা]
❏ ১১. শহীদগণ আল্লাহর পুরস্কার পেয়ে হয় আনন্দিত হবেন।কুরআনে কারীমের সূরা আল-ইমরানের ১৭০-১৭১ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-“আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে শহীদদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবংতাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না, আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ্ মু‘মিনদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না”।
[সূরা আল-ইমরান,আয়াত নং ১৭০-১৭১]
❏ ১২. শহীদদের একটি বিশেষ মর্যাদা হল,তারা নিজেদের এই সম্মানজনক পুরস্কার দেখে পুনরায় শহীদ হওয়ার জন্য দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্খা প্রকাশ করবে।বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: একমাত্র শহীদ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিই মৃত্যুর পরে দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে না।শুধুমাত্র শহীদ ব্যক্তিই জান্নাতে যাওয়ার পর পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্খা করবে। কারণ শাহাদাতের বিনিসময়ে সে আল্লাহর নিকট এমন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়েছে যা দুনিয়া ও তার সমস্ত সম্পদের সমান।সে বাস্তবে শাহাদতের এই অবর্ণনীয় মর্যাদা দেখে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে আর একবার আল্লাহর পথে প্রাণ দিয়ে শহীদ হতে আনন্দ অনুভব করবে”।
[সহীহ আল-বুখারী,কিতাবুল জিহাদ- ১/৩৯২]
এই আকাঙ্খা শুধু শহীদরা জান্নাতে যাওয়ার পর করবে তা নয়; বরং আল্লাহর রাসূল ﷺ দুনিয়াতে থাকতেই বারবার আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করছেন ও উম্মতকেও শিক্ষা দিয়েছেন শহীদি মৃত্যু লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে বলেছেন।
❏ এ সম্পর্কে সহীহ বুখারীর কিতাবুল জিহাদের এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন-“সেই সত্তার শপথ যাঁর মুঠির মধ্যে আঁমার প্রাণ,আঁমার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় হচ্ছে,আঁমি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যাই,অতপর জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই,তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই,তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই”। [সহীহ বুখারী-১/৩৯২]
❏ ১৩. শহীদদের আরেকটি বিশেষ মর্যাদা হল,তাদের মৃত্যুকষ্ট সামান্য চিমটি কাটার চেয়ে বেশি হয় না।এসম্পর্কে তিরমিযীর এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন-“শহীদ ব্যক্তি মৃত্যুর সময়সামান্য একটু চিমটি কাটার মতো স্পর্শ অনুভব করে মাত্র।”
[জামে তিরমিযী-১/২৯৬]
অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ নিহত হওয়ার সময় সাধারণত মারণাস্ত্রের আঘাতে যে ধরনের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে তা ভয়াবহ কষ্টদায়ক হয়ে থাকে।কিন্তু আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তি তীর- তলোয়ারের আঘাতে হোক কিংবা গুলি- বোমার আঘাতে হোক অথবা পানিতে ডুবে কিংবাআগুনে পুড়ে হোক যেভাবেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুক সামান্য একটু চিমটি কাটার চেয়ে বেশি কষ্ট সে অনুভব করে না।এটা শহীদের জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ মর্যাদা ও রহমত।
❏ ১৪. শহীদের অন্যতম আরেকটি মর্যাদা হল,মানুষের পাওনা ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন-“শহীদের ঋণ ছাড়া তার সকল গুনাহ শাহাদত প্রাপ্তির কারণে ক্ষমা হয়ে যায়”।
[সহীহ মুসলিম,কিতাবুল ইমারত-২/১৩৫]
কিন্তু ঋণ যেহেতু মানুষের অধিকার,তা পাওনাদার থেকে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা’লাও তা ক্ষমা করেন না।
❏ ১৫. মাসরুক (রা:) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“আমরা আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা:) কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি:
﴿وَلَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٰتَۢاۚ بَلۡ أَحۡيَآءٌ عِندَ رَبِّهِمۡ يُرۡزَقُونَ ١٦٩﴾ [ال عمران: ١٦٩]
“আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে কর না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিযিক দেওয়া হয়”।
[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯]
তিনি বলেন: জেনে রেখ,আমরাও এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তাদের রূহসমূহ সবুজ পাখির পেটে, যার জন্য রয়েছে আরশের সাথে ঝুলন্ত প্রদীপ, সে জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা ভ্রমণ করে, অতঃপর উক্ত প্রদীপে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। একদা তাদের দিকে তাদের রব দৃষ্টি দেন অতঃপর বলেন: তোমরা কিছু চাও? তারা বলবে: আমরা কি চাইব, অথচ আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করি? এভাবে তাদেরকে তিনবার জিজ্ঞাসা করবেন, যখন তারা দেখবে যে কোনো কিছু চাওয়া ব্যতীত তাদেরকে নিস্তার দেওয়া হবে না, তারা বলবে: হে রব আমরা চাই আমাদের রুহগুলো আমাদের শরীরে ফিরিয়ে দিন, যেন দ্বিতীয়বার আপনার রাস্তায় শহীদ হতে পারি। যখন তিনি দেখবেন যে তাদের কোনো চাহিদা নেই তাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে”।
[সহীহ মুসলিম,নাসাঈ ও ইবন মাজাহ, হাদীসটি সহীহ]
❏ ১৬. শাকিক (রহ:) থেকে বর্ণিত,ইবন মাসউদ (রা:) তাকে বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আঠারো জন সাহাবী যারা বদরের দিন শহীদ হয়েছিল,আল্লাহ তাদের রুহগুলো জান্নাতে সবুজ পাখির পেটে রেখেছেন যে জান্নাতে বিচরণ করে।তিনি বলেন: তারা এভাবেই ছিল,এক সময় তোমার রব তাদের দিকে দৃষ্টি দেন, অতঃপর বলেন: “হে আমার বান্দাগণ তোমরা কী চাও?” তারা বলল: হে আমাদের রব এর ওপরে কি আছে? তিনি বলেন: অতঃপর তিনি বলবেন: “হে আমার বান্দাগণ তোমরা কি চাও?” তারা চতুর্থবার বলবে: আঁপনি আমাদের রুহগুলো আমাদের শরীরে ফিরিয়ে দিন,যেন আমরা শহীদ হতে পারি যেমন শহীদ হয়েছি”।
[ইবন হিব্বান,হাদীসটি মওকুফ ও সহীহ]
❏ ১৭. আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “জান্নাতি এক ব্যক্তিকে আনা হবে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে বনি আদম তোমার স্থান কি রকম পেয়েছ? সে বলবে: হে আমার রব সবচেয়ে উত্তম। তিনি বলবেন: চাও,আশা কর।সে বলবে: তোমার নিকট প্রার্থনা করছি তুমি আমাকে দুনিয়াতে ফিরিয়ে দাও,যেন তোমার রাস্তায় আমি দশবার শহীদ হতে পারি,যেহেতু সে শাহাদাতের মর্যাদা প্রত্যক্ষ করবে”।
[নাসাঈ,আহমদ ও হাকেম,হাদীসটি সহীহ]
❏ ১৮. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তার দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করেন,যে তার রাস্তায় বের হয়,(যাকে আঁমার প্রতি ঈমান ও আঁমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস ব্যতীত কোনো জিনিস বের করে নি),আঁমি তাকে অতিসত্বর তার পাওনা সাওয়াব অথবা গনিমত দেব অথবা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব।যদি আঁমার উম্মতের জন্য কষ্ট না হত,তাহলে আঁমি কোনো যুদ্ধ থেকে পিছপা হতাম না।আঁমি চাই আঁমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হব,অতঃপর আঁমাকে জীবিত করা হবে অতঃপর আঁমি শহীদ হব,অতঃপর আঁমাকে জীবিত করা হবে অতঃপর আঁমি শহীদ হব”।
[সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম,নাসাঈ ও ইবন মাজাহ,হাদীসটি সহীহ]
❏ ১৯. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামতের দিন জান্নাতী এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে,অতঃপর আল্লাহ বলবেন: হে বনি আদম তোমার স্থান কেমন পেয়েছ? সে বলবে: সবচেয়ে উত্তম, অতঃপর তিনি বলবেন: চাও,আশা কর। সে বলবে: এ ছাড়া আমি কি চাইব ও কি আশা করব যে, আপনি আমাকে দুনিয়াতে ফিরিয়ে দিন,অতঃপর আপনার রাস্তায় আমি দশবার শহীদ হই,যেহেতু সে শাহাদাতের ফযীলত প্রত্যক্ষ করবে”। [আহমদ,হাদীসটি সহীহ]
❏ ২০. হজরত ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রব থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেছেন: “আঁমার যে কোনো বান্দা আঁমার সন্তুষ্টির নিমিত্তে আঁমার রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়, আঁমি তার জন্য জিম্মাদার যে আঁমি তাকে তার পাওয়া সাওয়াব ও গনিমত পৌঁছে দেব, যদি তাকে মৃত্যু দেই তাহলে তাকে ক্ষমা করব, তাকে রহম করব ও তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব”।
[আহমদ ও সুনান নাসাঈ,হাদীসটি সহীহ লি গায়রিহী। শহীদদের ফযীলত;সহীহ হাদীসে কুদসী,৫৮,৫৯,৬০,৬১,৬২,৬৩,৬৪]