এক আরব বেদুইনের শৈশবের স্মৃতিচারণ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

আমাদের পড়শী ‘ঊফা ‘ আন্টি।

আমার শৈশব কালে মক্কা-জেদ্দা মহাসড়কের শুমাইসী এলাকায় গ্রামীণ পরিবেশে আমাদের একটি ছোট্ট বাসা ছিল । কাদা মাটির তৈরি ঐ বাড়িটিকে ছোট না বলে বরং বড় বাড়ী বলাই যথার্থ, কেননা এখানেই বসবাস করতেন আমার মরহুমা মা- বাবা এবং আমরা কয়েকজন ভাইবোন ।

কাদা মাটির তৈরি এই বাড়ি সংলগ্ন আর ও কয়েকটি বাড়ি ছিল ,যে গুলো কাদা মাটির তৈরি বলব না কখনো, কারণ প্রকৃত ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল পরস্পরের সাথে,আর এই বাড়ি গুলোর অধিবাসীদের মধ্যে ছিল সততা, সহানুভূতি, পরোপকার প্রভৃতি গুণের উপস্থিতি পুরো মাত্রায়। পড়শীরা ছিলেন স্বচ্ছ মনের অধিকারী এবং নম্র ও ভদ্র , এক কথায় সাদা মনের মানুষ।

এখানে বসবাস করতেন আল কাঊদ,আল মুদাইহেশ,আল শুআইয়্যের গোত্রের লোকেরা এবং অন্যান্যরা যাদের কথা এ মূহুর্তে স্মরন করতে পারছিনা, কারণ আমার তখন বয়স ছিল মাত্র আট বছর, যাযাবর জীবনের স্রোত আমাদের অন্য আরেক অঞ্চলে নিয়ে এসেছে।

যতদূর মনে পড়ে, আমাদের বাড়িটা ছিল একটা মাটির বাঁধের পাশে, বাড়ির অধিবাসীদের সবাই ছিলেন মেহমানদের সেবায় হাতেম তাঈ, তাদের মন ছিল পুত-পবিত্র, শহুরে জীবনের মেকি চাকচিক্য মুক্ত ও তথাকথিত সভ্যতার দুষণ মুক্ত জীবনের অধিকারী ছিলেন সবাই।

তখনকার মানুষেরা পোশাক আশাক পরিস্কার রাখার চেয়ে নিজেদের মন পরিস্কার রাখার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন। ঐ সকল মানুষের ভেতর থেকে যেন ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সুরভী বের হত,আর ও পরে আমি ফ্রান্সের আতরের সাথে পরিচিত হয়েছি, সেই আতরের চেয়ে ও মনে হয় তখনকার সুরভী বেশি মান সম্পন্ন ছিল।

আমাদের পাড়া মহল্লার মানুষের মাঝে

বিরাজমান সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য দেখেই আমাদের সময়ের সকালটা হাসতে হাসতে আগমন করত, এমনকি পূর্ণিমার চাঁদ ও মনে হয় হাস্যোজ্জল সকালের আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণত এবং এ নিয়ে কিছু বলাবলি করত!

আমাদের পড়শীরা প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতেন, মেঘবৃষ্টির সময় আনন্দে মেতে উঠতেন, আশেপাশের লতা পাতা ও গাছগাছালির সাথে নিজেদের ও গৃহপালিত পশু পাখির জীবন কে জড়িয়ে মহা আনন্দে সময় অতিবাহিত করতেন। সবার মন গোলাপ জল সদৃশ পবিত্র, আর খাঁটি মধু মিশে ছিল তাদের আচরণ ও কথা বার্তায়, দুনিয়ার জীবনে তাদের চেয়ে সুখি মানুষ কেউ ছিল না,পরকালে কেবলমাত্র জান্নাতের সুখ ই সেই সুখের সাথে তুল্য হতে পারে।

মনে পড়ে সে বছর বড় বোনের বিয়ের

অনুষ্ঠানের কথা। বিয়ের কথা বাবার মুখে উচ্চারিত হওয়ার পরপরই প্রতিবশি ঊফা আন্টি আমার মা’কে বলে দিয়েছেন,দেখ,পাড়ার মধ্যে আমার বাসাটি সবচেয়ে প্রসস্থ, অথচ আমি একা, আমার সন্তান সন্ততি শহরে জীবনের অধিবাসী, অনেক দিন পর পর তারা আমাকে দেখতে আসে, সুতরাং মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান এখানে ই হতে হবে, তাঁর পিড়াপিড়িতে মা সম্মতি দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য যে মহল্লায় বিয়ের অনুষ্ঠান হলে বাঁধ ঘেঁষা উম্মুক্ত খোলা মাঠে বর ও বরযাত্রীর জন্য প্যান্ডেল সাজানো হত, এবং মেয়েদের জন্য মহিলা অঙ্গনে সেই গুফা আন্টির বাসায় সুব্যবস্থা হত।

উভয় স্থানেই আতর ও বখূরের বন্দোবস্ত করা হত, সাধারণত আমার বাবাই বিষয়টি সম্পর্কে তদারকি করতেন।

মেহমানদের জন্য গাহওয়া,রুতাব ও আজওয়া খেজুর এবং পরিশেষে গোটা গোটা উট-দুম্বা ভূনা করে বাসমতি চালের বিরিয়ানি রান্না হত এবং বড় বড় ডিসে করে সে গুলো পরিবেশন করা হত।

আমার বোনের বিয়েতে মেয়ে মহলের জন্য সাজানো ডিসটি এত বড় ছিল যে ঊফা আন্টির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো অসম্ভব হয়ে পড়ে,তখন আন্টি আমার বাবাকে অনুরোধ জানান গেইটের দেয়াল ভেঙে গেইটটি প্রসস্থ করতে, বাবা যখন ইতস্তত বোধ করছিলেন শেষ পর্যন্ত আন্টির পিড়াপিড়িতে গেইটের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

ঊফা আন্টির আন্তরিকতা ও ত্যাগের কথা ভুলতে পারি না। তিনি দিনে সিয়াম পালন এবং এবং রাতে কিয়াম করতেন। বড় উদার মনের মানুষ ছিলেন। প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করতে আনন্দ পেতেন।ছোট কালে বোন কে নিয়ে একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি তিনি সালাত আদায় করছেন , বাড়িতে উদ কাঠের ধূয়ো, তিনি আল্লাহর দরবারে মুনাজাতে রত ছিলেন, আমরা বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে চলে আসি,তিনি হয়তো টের ও পাননি।

ইতিহাস হয়ে আছে আমাদের সময়ের ঊফা আন্টির কাহিনী। হাতেম তাঈয়ের যুগের ঘটনা হলে ঐতিহাসিকরা ও এ ঘটনা উল্লেখ করতেন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment