মাওলানা ফাতহ মুহাম্মদ (রাহ:) বলেন-শাইখ দাহ্হান নামক মক্কার বড় এক আলেম ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন-
মক্কা মোয়াজ্জমায় এক মাওলানা বসবাস করতেন। একদা তাঁর মৃত্যু হলে যথারীতি দাফন-কাফনের যাবতীয় কাজ সমাপ্ত করে তার আত্মীয় স্বজনরা বাসায় ফিরে আসে। কিছুদিন পর ঐ এলাকার আরেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তাকেও ঐ আলেমের পাশে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে কবর খুঁড়া শুরু হলো। উপস্থিত লোকজন কয়েকদিন পূর্বে মৃত্যু হওয়া আলেম সাহেবকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলা বলি করলো। কেউ ভালো বলল, কেউ মন্দ বলল । তবে ভাল বলার মাত্রাটাই বেশি। এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে কবর খননের কাজ। খননের কাজ শেষ হয়নি। সামান্য কাজ এখনো বাকি আছে। ঠিক এমন সময় পাশের কবরের মাটি ভেঙ্গে আলেম সাহেবের কবর উন্মুক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! সেখানে আলেম সাহেবের লাশ নেই। বরং তদস্থলে তারা এমন পরমা সুন্দরী এক যুবতী মেয়ের লাশ দেখতে পেল, আকার আকৃতিতে যাকে ইউরোপিয়ান বলেই মনে হলো।
এ দৃশ্য দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া। বিস্ময়ে বিস্ফারিত। খানিক সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। যেন সবাই সম্বিত হারিয়েছে। এক সময় গুঞ্জন শুরু হলো। চলতে লাগলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। যে যা পারছে বলছে। কিন্তু আসল রহস্য রয়ে গেলো দৃষ্টির
অন্তরালেই। উপস্থিত লোকদের মাঝে একজন ছিল ইউরোপিয়ান। আল্লাহ তা’আলা বোধ হয় কুদরতের অপার মহিমা স্বচক্ষে দেখানোর জন্যই এ লোকটিকে এখানে এনেছেন। কেননা তার মাধ্যমেই চলমান ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছিল। মেয়ের চেহারা দেখে লোকটি বলল, এ মেয়েটি আমার পরিচিত। আমি তাকে চিনি । সে ফ্রান্সের অধিবাসী এবং এক খ্রিস্টানের কন্যা। খ্রিস্টান পরিবারেই সে বড় হয়েছে। তবে সে ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় পুস্তক অধ্যয়ন করতো। এতে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ সৃষ্টি হয়। প্রচুর ভালবেসে ফেলে ইসলামকে। ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধান রীতি-নীতি তার নিকট খুবই পছন্দ লাগতে শুরু করে। সে ভাবতে থাকে, ইসলাম ধর্মের ছোট বড় যে কোনো নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন অন্য যে কোন ধর্মের নিয়ম-নীতি থেকে অধিক সুন্দর, কল্যাণকর ও বিজ্ঞানসম্মত। সুতরাং সত্যিকার শান্তি ও সফলতার মুখ দেখতে হলে ইসলাম গ্রহণ ও সেই ধর্মের বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন ব্যতিরেকে অন্য কোনো উপায় নেই ।
দিন যতই যায়, ইসলামের প্রতি মেয়েটির দুর্বলতা ততই বাড়তে থাকে। অবশেষে হেদায়েতের আলোকে উদ্ভাসিত হয় তার হৃদয়-মন। সে কালেমা পড়ে আশ্রয় নেয় ইসলামের সুশীতল ছায়ায়।
পরিবারের সবাই খ্রিস্টান হওয়ার কারণে বাধ্য হয়েই তাকে ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখতে হয়েছিলো। এক পর্যায়ে আমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সে আমার নিকট উর্দু শিক্ষার আগ্রহ ব্যক্ত করে। আমি তাকেমাঝে মাঝে গোপনে উর্দু পড়াতাম। নামাজ-কালাম ও ইসলামের বিধি- বিধান শিখাতাম। সে অত্যন্ত উৎসাহ ভরে এগুলো শিখত ও আমল করতো। আমি তাকে কয়েকটি ইসলামি বইও পড়তে দিয়েছিলাম। এগুলো পড়ে সে দারুণ মুগ্ধ হয়। আনন্দে উৎফুল্লিত হয় প্রচুর পরিমাণে। ইসলামের ছোট ছোট বিধানকেও সে এতটা শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে পালন করতো যা কল্পনাকেও হার মানায়। আমি তার জন্য দোয়া করে বলতাম, হে আল্লাহ! তুমি তাকে কবুল করো। ইসলামের উপর অটল ও অবিচল থাকার তৌফিক দাও।
কিন্তু খোদার কি মর্জি। ইসলাম গ্রহণের পর বেশি দিন সে দুনিয়ার আলো-বাতাস ভোগ করতে পারেনি। পারেনি যৌবনকাল অতিক্রম করতে। বরং এর আগেই সে রোগাক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমায় ।
এদিকে আমিও চাকুরি ছেড়ে মক্কায় চলে আসি ।
লোকটির বর্ণনা শুনে উপস্থিত জনতা বলল, মেয়েটির এখানে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ না হয় বুঝলাম যে, সে মুসলমান ও নেককার ছিলো। ইসলামি রীতি-নীতি সে খুব পছন্দ করত, ভালবাসতো। এজন্য আল্লাহ তায়ালা দয়াপরবশ হয়ে নবীর দেশে তাকে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন ও কৌতূহল হল, আলেম বেচারার লাশ গেল কোথায়?
এ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম মন্তব্য করল। তবে অধিকাংশ লোক বলল, মেয়েটির লাশ যখন আলেমের কবরে এসেছে হতে
পারে আলেমের লাশ মেয়েটির কবরে স্থানান্তরিত হয়েছে।
যা হোক, অবশেষে উপস্থিত জনতা ইউরোপিয়ান লোকটিকে অনুরোধ করে বলল, আপনি হজ্জ শেষে ফ্রান্সে গিয়ে মেয়েটির কবর খুঁড়ে দেখবেন যে, আমাদের আলেম সাহেবের লাশ সেখানে আছে কি না? –
জনতার অনুরোধ ইউরোপিয় লোকটি সাদরে গ্রহণ করলো। সে তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল- এজন্য যা কিছু করার সবই করবো এবং তার ফলাফল আপনাদের অবশ্যই জানাবো। তাছাড়া ঘটনার শেষ পর্যন্ত দেখার আগ্রহ আপনাদের চেয়ে আমারও কম নয়।
ইউরোপীয় লোকটি হজ্জ শেষে বাড়ি ফিরল। সে প্রথমেই মেয়েটির পিতা মাতার নিকট সব কিছু খুলে বলল। ঘটনা শুনে তারা যার পর নাই বিস্মিত হয়ে বলল, এটা কি করে সম্ভব যে, মেয়ের লাশ দাফন করলাম ফ্রান্সে, আর তুমি কিনা তাকে মক্কার জনৈক আলেমের কবরে দেখে এসেছো। অবশেষে কৌতুহল বশত: তারা মেয়েটির কবর খুঁড়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো এবং মেয়ের মা-বাবাসহ অনেকে এ বিস্ময়কর ঘটনা তদন্তের জন্য কবরস্থানে গেল ।
কবর খুঁড়ার পর সকলেই হতবাক। তারা দেখলো, বাস্তবিকই মেয়েটির লাশ কবরে নেই। বরং সেখানে সেই আলেম সাহেবের লাশ পড়ে আছে- যাকে মক্কায় দাফন করা হয়েছিল।
শাইখ দাহহান বলেন-তদন্তের পর ইউরোপীয় লোকটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে আমাকে বলল, আপনাদের আলেমের লাশ ফ্রান্সের সেই নও মুসলিম মেয়ের কবরে পাওয়া গেছে। এ দৃশ্য আমি একাই কেবল দেখিনি, মেয়ের পিতা-মাতাসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সংবাদ পেয়ে মক্কাবাসীরা আবার চিন্তায় পড়ে গেল। তারা ভাবতে লাগলো, ব্যাপারটা কি? মেয়েটির লাশ মক্কায় আনায় তো বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে কবুল করে নিয়েছেন এবং কবুল হওয়ার কারণ ও আমরা জানতে পেরেছি যে, সে মুসলমান হয়েছিল।
ইসলামি রীতি-নীতি ও কৃষ্টি-কালচার অত্যধিক ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে সে পালন করতো। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, আলেম বেচারার লাশ পবিত্র ভূমি মক্কা থেকে কাফিরের দেশে চলে গেছে কেন?
কেন এরূপ হল?
কেন তিনি মক্কা থেকে মৃত্যুর পরেও বিতাড়িত হলেন- সকলের শিক্ষা গ্রহণের জন্য এ বিষয়টির উদ্ঘাটন হওয়া বড় প্রয়োজন।
এ নিয়ে তারা বেশ চিন্তা-ভাবনা করল। অবশেষে সকলে সিদ্ধান্ত নিল যে, একজন লোকের প্রকৃত অবস্থা তার ঘরের লোকদেরই ভালো জানা থাকে। আর ঘরের লোকদের মধ্যে আপন স্ত্রী-ই স্বামীর ব্যাপারে ভালো জানে। সুতরাং প্রথমেই আমরা তার নিকট জিজ্ঞেস করে দেখি। এরপর প্রয়োজনে না হয় অন্য চেষ্টা করে দেখবো।
তারা সবাই আলেম সাহেবের ঘরে গেল। অতঃপর স্ত্রীকে ডেকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সবশেষে বলল, মুহতারামা ! আপনার স্বামীর মধ্যে আপনি ইসলাম পরিপন্থি কিছু দেখেছেন কি?
স্ত্রী বললো, না এ রকম কিছু দেখিনি। তিনি তো নিয়মিত নামজ পড়তেন। কুরআন তিলাওয়াত করতেন, এমনকি তাহাজ্জুদ গোজারও ছিলেন। আমার সাথে তার ব্যবহারও খারাপ ছিলো না ।
লোকজন বললো, আপনি একটু ভাল করে চিন্তা করে দেখুন।
আমাদের বিশ্বাস, আপনার মাধ্যমেই বিষয়টির সুন্দর সুরাহা হবে।
লোকদের কথায় আলেম সাহেবের স্ত্রী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল । কিছুক্ষণ পর সে মাথা উত্তোলন করে বলল- হ্যাঁ, একটা দোষ অবশ্য তার মধ্যে ছিল। তা এই যে, আমার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর যখনই তিনি গোসল করতে যেতেন, তখনই বলতেন-খ্রিস্টানদের ধর্মে এ ব্যাপারটি বড়ই সহজ। স্ত্রী সম্ভোগের পর তাদের ধর্মে গোসল ফরজ হয়না। তাই শীতের মধ্যে কষ্ট করে গোসল করার প্রয়োজন পড়ে না । এতুটুকু শুনে কৌতূহলী জনতা বলতে লাগলো-মুহতারামা! আপনাকে আর বলতে হবে না। আমরা সব কিছু বুঝে নিয়েছি। আপনার স্বামী নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি ধর্মীয় বিধান ঠিকমত পালন করলেও খ্রিস্টানদের রীতি-নীতি তিনি পছন্দ করতেন। তাই আলেম হওয়া সত্ত্বেও তার লাশকে খ্রিস্টান জাতির দেশে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! এ লোকটি বাহ্যত মুত্তাকী আলেম ও পুরোপুরি মুসলমানই ছিলেন। কিন্তু কাফিরদের একটি মাত্র রীতিকে ইসলামি রীতির মোকাবেলায় বেশি পছন্দ করেছিলেন। তাই তাকে ইসলামি দেশ থেকে অমুসলিম দেশে বিতাড়িত করা হয়েছে।