সালতানাতে উসমানীয়্যার সর্বশেষ ক্ষমতাধর খলিফা ছিলেন সুলতান ২য় আব্দুল হামিদ। যেই সময়টাতে তিনি ক্ষমতায় বসেন তখন একসময়কার মহা-প্রতাপশালী এই সালতানাতের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। সারা বিশ্বে তখন ব্রিটিশ ও পশ্চিমা উপনিবেশবাদের রাজত্ব। ব্যবসা করার নাম দিয়ে তারা বিশ্বের বহু স্বাধীন ভুখন্ডের শাষকদের সাথে বেঈমানি করে, রাষ্ট্রীয় লোকদের কিনে নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলো। এসব স্বাধীন ভুখন্ডের মধ্যে অনেক মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রও ছিলো যারা সালতানাতে উসমানীয়্যার আনুগত্য করত। তাছাড়া সালতানাতে উসমানীয়্যার অবস্থাও ছিলো খুবই করুণ, ৩ মহাদেশব্যাপি বিস্তৃত সম্রাজ্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছিলো। এমন সময় ক্ষমতায় আরোহন করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন বিশ্ব রাজনীতি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে হয়তো আজকে মুসলিমদের ইতিহাস অন্যভাবে লিখা হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় জায়নিস্টদের ষড়যন্ত্রে ১৯০৯ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তাই তাকে বলা হয় ‘আস সানী’ অর্থ “শেষ সময়ে জ্বলে উঠা প্রদীপ”। প্রদীপ নেভার আগে একবার দপ্ করে জ্বলে, ওসমানিদের শেষ সময়ে তিনিও ছিলেন তেমন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁকে নিয়ে যেভাবে আলোচনা হবার কথা তেমনটি হয়না। যাইহোক আজ আমি চেষ্টা করব এই মহান খলিফাকে কিছুটা চিনাতে।
সুলতান আব্দুল হামিদ ‘আস সানী’
২১শে সেপ্টেম্বর ১৮৪২ সাল। তোপকাপি প্রাসাদে তিরমিজান খাতুন একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। নাম দেওয়া হল ‘আব্দুল হামিদ’। পিতা হলেন সুলতান আব্দুল মাজিদ। তাঁর মায়ের আসল নাম ভিরজিনিয়া। দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি অকালেই মাকে হারান। পরবর্তিতে অন্যের কোলে লালিত-পালিত হন। এভাবেই প্রাথমিক জীবন অতিবাহিত করেন।
তোপকাপি প্রাসাদ। ১৮৪২ সালের এক শুভদিনে
এই প্রাসাদে সুলতান আব্দুল হামিদ জন্মগ্রহণ করেন
একজন শাহজাদা হয়েও তিনি সবসময় নিজের কাজ নিজে করতেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতে পছন্দ করতেন, এই কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন তিনি। ইস্তানবুলের ইলদিজ ও বেইলারবেই প্রাসাদে তাঁর কাজের নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। আমাদের সমাজে এসব কাজকে অনেক নিচু করে দেখা হয়। যদিও আমাদের পাঠ্যবইয়ে সব পেশার মানুষদের সম্মান করতে বলা হয়, কিন্তু তা পড়ার বইতেই থেকে যায়। যাইহোক উসমানীরা সব পেশার প্রতিই অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। এটা সুলতান আব্দুল হামিদ ‘আস সানী’কে দেখলেই বোঝা যায়।
ইলদিজ প্রাসাদ। ইলদিজ অর্থ তারকা।
তাহলে পুরো নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘তারকা প্রাসাদ’
বেইলারবেই প্রাসাদ। যেটি সুলতান আব্দুল হামিদের দাদা
সুলতান আব্দুল আজিজ নির্মান করেন
৩১শে আগস্ট ১৮৭৬। সিংহাসনে আরোহন করেন আব্দুল হামিদ। মসনদে বসেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি সুলতান আইয়্যুব মসজিদে উপস্থিত হন। তাঁর আগের সুলতানগন এভাবে মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়েন নি, এর কারণ হলো সতর্কতা। খোলাফায়ে রাশিদীনসহ অনেক খলিফাকে নামাজরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিলো। যাইহোক সুলতান সুলতান আব্দুল হামিদ আল্লাহ ছাড়া আর কেউকে ভয় করেন না, তাঁর প্রমান সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন সুলতান। মসজিদে ‘সুলতান উসমানের তরবারি’ হাতে নিয়ে উপস্থিত সবার সামনে শপথ নেন।
আইয়্যুব সুলতান মসজিদ। যেটি প্রখ্যাত সাহাবী
হযরত আইয়্যুব আনসারির (রাঃ) নামে নামকরণ করা হয়।
উসমানী সুলতানগণ সিংহাসনে আরোহন করার পর এখানে এসে শপথ নিতেন
সাহাবী হযরত আইয়্যুব আনসারির (রাঃ) মাজার।
যেটি ইস্তানবুলের গোল্ডেন হর্নে অবস্থিত।
ক্ষমতায় এসে বুঝতে পারলেন, সালতানাত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সমস্যা, বলকান বিদ্রোহ, রুশ-উসমানী যুদ্ধ এসব কারণে সালতানাতে উসমানীয়্যা আগের জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমারা সালতানাতে উসমানীয়্যাকে টিটকারি করে বলে, ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’। যাইহোক এখন সুলতান সালতানাতে উসমানীয়্যাকে আবারো আগের অবস্থানে নিয়ে আসার সংকল্প করলেন। জনগন, পাশারা ভেবেছিলো তিনি তাঁর আগের সুলতানদের মতো পশ্চাত্যের সংস্কারপন্থী নীতি অনুসরণ করবেন। কিন্তু না! সবার ধারণাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে পুর্বের নিরপেক্ষ সরকারকে পুণর্গঠন করেন, তাদের বানানো সংসদ ভেঙ্গে দেন, সেই সাথে সংবিধান পুণর্গঠন করেন। রাজনৈতিক সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে ক্ষমতা সুসংহত করেন। সেসময় ব্রিটিশরা সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো বলে সমুদ্রগুলো প্রায়ই তাদের দখলে ছিলো। এমন সময় উসমানীদের আবারো আগের অবস্থায় আনতে সারাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখা অপরিহার্য হয়ে পড়ে এজন্য সুলতান একটি অসাধারণ পরিকল্পনা করেন। সিদ্ধান্ত নেন ভিয়েনা,বুদাপেস্ট হয়ে আলবেন,কসোভো লাইন ধরে ইস্তাম্বুল হয়ে ইরান আর সেটা হলে যুক্ত হবে ভারত,পাক ও দক্ষিণে এরাবিয়ান পেনিনসুলা ও উত্তর পূর্বে যুক্ত করবে আফ্রিকা। ফলে সমুদ্র ছাড়াও রেললাইনের মাধ্যমে বানিজ্য করা সম্ভব হবে। এভাবে ব্রিটিশদের আধিপত্য অনেকটাই হ্রাস পাবে। এই প্রজেক্টের প্রথম কাজ হলো ইস্তানবুল আর প্রিয় নবী ﷺ এর শহর মদীনাকে সংযুক্ত করা, এরপর মদিনা-মক্কা সংযোগ দেবার পরে সমগ্র আরব ভুখন্ডকে রেললাইনের আওতায় আনার পরে হিন্দুস্থান,চীন, ইউরোপকে যুক্ত করা হবে। সেসময় হজযাত্রীরা অনেক কষ্টে হজ্জ করতেন। আরবের ধুধু মরু-বিয়ানবানগুলো পাড়ি দিতে হাজিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেত, অনেকে মারাও যেত। আবার কখনো কখনো যাত্রাপথে ডাকাত আক্রমণ করে সর্বস্ব কেড়ে নিতো। ফলে এইপথে রেললাইন যুক্ত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এখন বিশাল প্রোজেক্ট এর টেন্ডার যে কোম্পানি পাবে সেই কোম্পানি হবে ইতিহাস সেরা কোম্পানী। দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার দের এই কাজ দিতে চাইলে পাশা রা নিষেধ করলো কারণ এতে ঝুঁকি থাকে ভুল হওয়ার। যাই হোক টেন্ডার পাওয়া নিয়ে শুরু হলো,ব্রিটিশ, ডাচ,ফ্রেঞ্চ ও জার্মান কোম্পানী গুলোর যুদ্ধ।সুলতান টের পান ব্রিটিশরা এই টেন্ডার নিয়ে মারাত্মক ধোকাবাজি করছে,পাশাদের ঘুষ দেয়া নেয়া চলছে।তিনি তারপরও ব্রিটিশ দের এই কাজ দিলেন যাতে ব্রিটিশরা আপাতত যুদ্ধ না বাধায় আর কিছুটা শান্ত থাকে।কিন্তু এখানে সুলতানের আরেকটি অভিসন্ধি ছিল যা ছিল মিসর অভিযান নিয়ে ভাবনা।আর মিসর হয়ে যদি ব্রিটিশরা স্থলপথে আক্রমণ করে তাহলে ফিলিস্তিন এর দক্ষিণে আকাবা লাইন ধরে রেললাইনে করে অস্ত্র সরঞ্জাম পাঠাবে উসমানীরা।
ব্রিটিশরা সেটা জানতো না সেটা করার কথা ছিল দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারদের।কিন্তু সুলতান এর রাজনৈতিক জ্ঞানহীন এক জনসংযোগ মন্ত্রী + লে.জেনারেল সমমান একজন পাশা,, যিনি প্লেভেন যুদ্ধে ঘোড়সওয়ার রেজিমেন্ট এর প্রধান কমান্ডার ছিলেন,তিনি ভুল করে ফাঁস করে দেন।দোষ তার ছিল না,তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার লর্ড কনরাড অন্য এক পাশার নিকট জানতে পারেন আকাবা লাইনের কথা। লর্ড কনরাড সাফ জানিয়ে দেন।আকাবা লাইন এ কাজ করলে তারা রেললাইন বানাতে তো দিবেই না উলটো যুদ্ধ উসকে দিবে।নিরুপায় হলেও সুলতান অনড়! কাজটা হাতে পায় জার্মান কোম্পানী।
হেজাজ রেলওয়ে
তৎকালীন সময়ে এটা ছিল অর্থনৈতিক ও প্রকৌশলগত বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট ছিল ১৬ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পে ৫ হাজার তুর্কি সৈন্য নিয়োজিত ছিল। ১৯০৮ সালের ২৩ আগস্ট রেললাইনের কার্যক্রম পৌঁছে যায় মদিন পর্যন্ত। সুলতান আনুষ্ঠানিকভাবে এই রেললাইন চালু করেন। রেললাইনের বিস্তৃতি পায় সিরিয়ার দামেস্ক শহর থেকে মদিনা পর্যন্ত। এই পথে জর্ডানের আম্মান শহর ছুঁয়ে ট্রেন আসত মদিনায়। মূলত, সে সময়ে ইরাক বা সিরিয়া থেকে হজব্রত পালন করতে আসা সহজ এবং নিরাপদ করাই ছিল এই রেললাইনের উদ্দেশ্য। যেমন ট্রেন চালুর আগে সিরিয়ার দামেস্ক থেকে মদিনায় আসতে সময় লাগত ৪৫ দিন, চালুর পর তা কমে আসে মাত্র ৫ দিনে। ট্রেন চালু হওয়ার ফলে হজযাত্রীরা নিরাপদে পৌঁছাতেন। এইখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়, রেললাইনের কার্যক্রম মদিনা থেকে ৩০ মাইল দূরে এসে থামলে সুলতান এই ৩০ মাইল জুড়ে রেললাইনের পাতকে মোটা সুতোর গাঢ কাপড়ের গিলাফ দ্বারা বেষ্টন করার এবং ৩০ মাইল পর্যন্ত রেলের গতি কমিয়ে দেয়ার আদেশ জারি করেন। যাতে পাতের সাথে রেলের লোহার চাকার ঘর্ষনসৃষ্ট বিকট আওয়াজে মদিনা মুনিব ﷺ ও মদিনাবাসীর কষ্ট না হয়! শুধু তাই নয়; ৩০ মাইল বিস্তৃত এই গিলাফকে দৈনিক একবার করে ধৌত করারও ফরমান জারি করেন। তবে এশিয়া,ইউরোপকে রেললাইনের যুক্ত করার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হয়তো আজকের ইতিহাস অন্যভাবে লিখা হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর আগেই ১৯০৯ সালের ২৭শে এপ্রিল ইয়াং তুর্ক বিপ্লবের মাধ্যমে সুলতানকে পদচ্যুত করা হয়। সেই সাথে উসমানীদের পতন নিশ্চিত করা হয়। আর হেজাজ রেলওয়েও ১৯২০ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়।
কবি হিসেবে সুলতান আব্দুল হামিদের খ্যাতি ছিলো। তাছাড়া তাঁর অন্তরে ছিলো অকৃত্রিম নবীপ্রেম। তিনি বলতেন, “যদি আমি সুলতান না হতাম তাহলে আমি মদিনার রওজা ঝাড়ু দেবার দায়িত্ব নিতাম”।
সুলতানের সিলমোহর। যেখানে লিখা ‘আল-গাজী’
সর্বশেষ আর কিছু বলার নেই আমার। আমি শুধু এতটুকু জোড় দিয়ে বলতে পারি আজ যদি সুলতান আব্দুল হামিদ বেঁচে থাকতেন তবে ফ্রান্স কেন? কোন রাষ্ট্রই নবী ﷺ কে অবমাননা করার কল্পনাই করতো না।