ভূমিকা
মুসলিম সমাজে একটি সাধারণ বিভ্রান্তি হলো— “তাবীজ পড়া কি শিরক?”।
এ বিভ্রান্তির প্রধান কারণ হলো, কিছু মানুষ হাদীসে বর্ণিত ‘তামিমা’ (تميمة) শব্দকে বিকৃত করে বাংলায় ‘তাবীজ’ অনুবাদ করেছেন। অথচ তাবীজ (تعويذ) এবং তামিমা (تميمة) — এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
তামিমা হলো— জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত হাড়, দানা, চামড়া, পাথর, সুতা ইত্যাদি কুসংস্কারপূর্ণ বস্তু, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তিতে বিশ্বাসের প্রতীক।
তাবীজ হলো— কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম, বা শরীয়তসম্মত দোয়া লিখে ঝুলানো, যা আল্লাহর কালামের বরকতের জন্য করা হয়।
১.
তাবীজ ও তামিমার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো:
তাবীজ (تعويذ):
এটি কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম বা শরীয়তসম্মত দোয়া লিখে করা হয়।
উদ্দেশ্য: আল্লাহর বরকত ও সাহায্য প্রার্থনা।
তামিমা (تميمة):
এটি হাড়, চামড়া, দানা, সুতা বা অন্য কোনো কুসংস্কারময় বস্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তিতে বিশ্বাসের প্রতীক।
উদ্দেশ্য: বস্তুকে শক্তিধর মনে করা।
সর্বসম্মতভাবে হারাম ও শিরক।
২.
হাদীসে তামিমার নিষেধাজ্ঞা
হাদীস ১
রাসূল ﷺ বলেন:
“إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ”
“শিরকীয় ঝাড়ফুঁক, তামিমা এবং তিওয়ালা শিরক।”
— আবু দাউদ: 3883; ইবন মাজাহ: 3530
হাদীস ২
রাসূল ﷺ বলেন:
“مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَلَا أَتَمَّ اللَّهُ لَهُ”
“যে তামিমা ঝুলালো, আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন না।”
— মুসনাদ আহমাদ: 17440
হাদীস ৩
“مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ”
“যে তামিমা ঝুলালো, সে শিরক করলো।”
— মুসনাদ আহমাদ: 16969; হাকিম: 4/417
দ্রষ্টব্য: এখানে تميمة (তামিমা) দ্বারা বোঝানো হয়েছে জাহেলিয়াতের কুসংস্কারময় বস্তু, তাবীজ নয়।
৩.
সাহাবাদের আমল: কুরআনযুক্ত তাবীজ
আবদুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ)
“তিনি তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দিতেন, আর ছোটদের জন্য কুরআনের কিছু আয়াত লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিতেন।”
— মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক: 7924; হাকিম: 4/417
এটি প্রমাণ করে যে কুরআনযুক্ত তাবীজ সাহাবাদের আমল।
৪.
ইমামদের বক্তব্য : তাবীজ সম্পর্কে
১. ইমাম আবদুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ)
“كان يعلّق على أعناق أولاده آيات من القرآن” — موسنّف عبد الرزاق: 7924
“তিনি তার সন্তানদের গলায় কুরআনের আয়াত ঝুলাতেন।”
২. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.)
“لا بأس في التعويذ بالقرآن” — مسائل الإمام أحمد: 444
“কুরআনযুক্ত তাবীজে কোনো সমস্যা নেই।”
৩. ইমাম বুখারী (রহ.)
“باب تعويذ المريض” — أداب المفرّد
“রোগীর জন্য কুরআন লিখিত তাবীজ জায়েজ।”
৪. ইমাম নববী (রহ.)
“التعويذ بالقرآن أو باسم الله جائز” — شرح مسلم
“কুরআন বা আল্লাহর নামযুক্ত তাবীজ জায়েজ।”
৫. ইমাম মালিক (রহ.)
“إن كتب القرآن على التعويذ جائز” — فتح القادير 10/260
“কুরআন লেখা থাকলে তাবীজ জায়েজ।”
৬. ইমাম ইবন তাইমিয়াহ (রহ.)
“التعويذ بالقرآن جائز، وما سوى ذلك حرام” — مجموع الفتاوى 19/64
“কুরআনযুক্ত তাবীজ জায়েজ, অন্য কিছু হারাম।”
৭. ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)
“الرقي والتعويذ بالقرآن صحيح” — الجواب الكافي ص. 120
“কুরআন দ্বারা ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ বৈধ।”
৮. ইমাম শাওকানী (রহ.)
“التعويذ بما فيه من القرآن جائز” — نيل الأوطار 9/85
“যে তাবীজে কুরআনের আয়াত আছে, তা জায়েজ।”
৯. ইমাম সুয়ূতি (রহ.)
“التعويذ بالقرآن جائز” — الدرر المنثور 1/227
“কুরআনযুক্ত তাবীজকে জায়েজ।”
১০. ইমাম ইবন আবেদীন (হানাফি)
“التعويذ بالقرآن جائز إذا لم يكن فيه إساءة” — ردّ المحتار 6/364
“কুরআনের তাবীজ জায়েজ, অসম্মান না হয়।”
১১. ফতাওয়ায়ে হিন্দিয়া (হানাফি)
“إذا فيه القرآن جائز، وإن فيه كفر حرام” — فتاوى هندية 5/355
“কুরআন থাকলে জায়েজ, কুফরী থাকলে হারাম।”
১২. ইমাম কুরতুবী (রহ.)
“التعويذ بالقرآن جائز” — الجامع لأحكام القرآن 10/316
“কুরআনযুক্ত তাবীজ ব্যবহার করা বৈধ।”
১৩. ইমাম বাইহাকী (রহ.)
“إن كان فيه اسم الله فالتعويذ جائز” — شعب الإيمان 5/439
“আল্লাহর নাম থাকলে তাবীজ বৈধ।”
১৪. ইমাম বায়যাবী (রহ.)
“التعويذ بالقرآن جائز” — تفسير البيضاوي 4/180
“কুরআন দ্বারা লিখিত তাবীজ বৈধ।”
১৫. ইমাম শিবলী (হানাফি)
“التعويذ بالقرآن جائز” — عقائد الشيبلي ص. 214
“কুরআনযুক্ত তাবীজ বৈধ।”
৫.
উপসংহার
১. তামিমা: জাহেলিয়াতের কুসংস্কার— সর্বসম্মতভাবে হারাম ও শিরক।
২. তাবীজ: কুরআন/আল্লাহর নামযুক্ত হলে — সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত
যারা “তামিমা-কে তাবীজ” অনুবাদ করে, তারা সুন্নাহ বিকৃত করছে এবং সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করছে।
আল্লাহ আমাদেরকে শিরক থেকে বাঁচিয়ে রাখুন এবং তাঁর কালামের বরকত দ্বারা উপকৃত হবার তাওফীক দিন। আমীন।