মূল: জিয়া-ইসলামিক-ডট-কম
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
অনলাইন আরবী রিসোর্স: মওলানা মুহাম্মদ রুবাইয়াত বিন মূসা
[উৎসর্গ: পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর পুণ্যস্মৃতিতে]
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অন্যান্য সকল নবী আলাইহিমুস্ সালাম-এর চেয়ে মাহাত্ম্য, গুণাবলী, মো’জেযা (অলৌকিকত্ব) ও আধ্যাত্মিক মকাম তথা মর্যাদার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তিনি এরশাদ ফরমান:
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ
– “এঁরা রাসূল, আমি তাঁদের মধ্যে এককে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠ করেছি। তাঁদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কেউ এমনও আছেন যাঁকে (অর্থাৎ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে) সবার ওপর মর্যাদাসমূহে উন্নীত করেছি। আর আমি মরিয়ম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ প্রদান করেছি; এবং পবিত্র রূহ দ্বারা তাঁকে সাহায্য করেছি; আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের পরবর্তীরা পরস্পর যুদ্ধ করতো না তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনগুলো আসার পর; কিন্তু তারা তো পরস্পর বিরোধকারী হয়ে গিয়েছে (নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা যা তাদেরকে দান করা হয়েছিল এবং যার জন্যে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে, তারই বশবর্তী হয়ে)। তাদের মধ্যে কেউ ঈমানের ওপর (প্রতিষ্ঠিত) রইলো এবং কেউ কাফের হয়ে গেল; আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতো না; কিন্তু আল্লাহ যা চান করে থাকেন।” ১
*ফেরেশতাকুল-সহ সকল সৃষ্টি-ই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত*
আমাদের ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাসের অনস্বীকার্য দিক হলো অন্তরে এই প্রত্যয় পোষণ করা যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই বিশ্বজগৎ ও এর তাবৎ বস্তু সৃষ্টির মূল উপলক্ষ এবং এগুলোর অস্তিত্বের (একমাত্র) কারণ। সমস্ত সৃষ্টিজগৎ, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ফেরেশতাকুল-ও, তাঁরই উম্মত বলে সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান:
وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ
– “আর আমি সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যে এবং নবুওয়্যতের ক্রমধারা উপলক্ষে প্রেরিত হয়েছি।” ২
মোল্লা আলী কারী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় তাঁর কৃত ‘মেরকাত শরহে মেশকাত’ গ্রন্থে লেখেন: অর্থাৎ,
أَيْ: إِلَى الْمَوْجُودَاتِ بِأَسْرِهَا عَامَّةً مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ الْمَلَكِ وَالْحَيَوَانَاتِ وَالْجَمَادَاتِ،
– আমি সমগ্র বিশ্বজগৎ, জ্বিন-ইনসান, ফেরেশতা, পশুপাখি ও জড় পদার্থের জন্যে রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।৩
আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহিমা ও উচ্চ মকাম/মর্যাদা বর্ণনা করেছেন এবং উম্মতে মুহাম্মদীকে আদেশ করেছেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে, যেমনটি এরশাদ হয়েছে সূরা ফাতাহ’তে –
لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
– “যাতে ওহে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহত্ত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো, আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।”৪
পুণ্যাত্মা জ্বিন ও ইনসান, ফেরেশতা ও সকল সৃষ্টি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। এ কথা ধারণাও করা যায় না যে ফেরেশতাকুল, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম কোনোভাবেই হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হবেন।
আল্লাহতা’লা সূরা তাহরীমে এরশাদ ফরমান:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
“হে ঈমানদারবর্গ! নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে ওই আগুন থেকে রক্ষা করো যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ ও পাথর, যার ওপর শক্তিশালী ও কঠোর ফেরেশতাবৃন্দ নিয়োজিত রয়েছেন, যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেন না এবং যা তাদের প্রতি আদেশ হয়, তা-ই করেন।”৫
আল্লাহতা’লা জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেবক/খেদমতগার বানিয়েছিলেন। তাঁকে সৃষ্টি-ই করা হয়েছিল শুধুমাত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করার উদ্দেশ্যে। ইমাম ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী রহমতুল্লাহি আলাইহি শায়খ আবদুল আযীয দাব্বাগ রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে উদ্ধৃত করে লেখেন:
হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-কে যা যা উচ্চ মকাম বা মর্যাদা (খোদাতা’লার পক্ষ থেকে) মঞ্জুর করা হয়েছিল, তার সবই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা বা সম্পর্ক এবং হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তাঁর খেদমতের কারণেই মঞ্জুর করা হয়েছিল। জিবরীল আলাইহিস সালাম যদি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত না করে সারা জীবন কাটিয়ে দিতেন এবং আপন শক্তি ব্যয়ে ওই সব উচ্চ আধ্যাত্মিক মকামগুলো অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন, তবু নিজ হতে তিনি ওগুলোর একটি মকাম-ও অর্জন করতে সক্ষম হতেন না। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে যা যা (খোদায়ী) আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছেন, সেগুলো সম্পর্কে শুধু তিনি-ই জানেন, আর জানেন সেসব পুণ্যাত্মা, যাঁদের জন্যে খোদাতা’লা তাঁর মা’রেফতের (তথা খোদার ভেদের রহস্যপূর্ণ জ্ঞানের) দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন।
হযরত আবদুল আযীয দাব্বাগ রহমতুল্লাহি আলাইহি আরও বলেন: জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সেবা করার জন্যে, আর তাই তিনি তাঁর গোটা সত্তা দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সমর্থন যুগিয়েছেন।
*রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রহমত (করুণাধারা) হতে জিবরীল আলাইহিস সালাম লাভবান*
ইমাম কাজী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রধান রচনা-কর্ম ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে তিনি লেখেন:
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِجِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: «هَلْ أَصَابَكَ مِنْ هَذِهِ الرَّحْمَةِ شَيْءٌ قَالَ: «نَعَمْ، كُنْتُ أَخْشَى الْعَاقِبَةَ فَأَمِنْتُ لِثَنَاءِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيَّ بِقَوْلِهِ «ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ، مُطاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ .
– বর্ণিত আছে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম-কে বলেছিলেন, আমার বিশেষ রহমত হতে আপনি কি কোনো কিছু প্রাপ্ত হয়েছেন? জবাবে জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, জ্বি হ্যাঁ, আমি আমার ভাগ্য (পরিণতি) সম্পর্কে শংকিত ছিলাম। কিন্তু আমি এখন নিশ্চিন্ত। কেননা, আপনার কারণেই আল্লাহ আমার ব্যাপারে বলেন:
مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ
– “যে (সত্তা তথা জিবরীল) শক্তিশালী (সত্যের প্রতি আহ্বানে, খোদার বাণী পৌঁছে দেয়ার বেলায় এবং আধ্যাত্মিক যোগ্যতায়), আরশ অধিপতির দরবারে সম্মানিত (গৌরব ও মহিমায়), সেখানে তার আদেশ পালন করা হয়, (যে) আমানতদার।” ৬
*আধ্যাত্মিক জগতে জিবরীল আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উজির*
আল্লাহ পাক হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেবক-ই কেবল বানান নি, বরং আধ্যাত্মিক জগতে তাঁকে তাঁর উজির-ও বানিয়েছেন। ইমাম হাকিম নিশাপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘মুস্তাদরাক’ কেতাবে এই প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সূত্রে একখানা হাদীস বর্ণনা করেন:
إِنَّ لِي وَزِيرَيْنِ مِنْ أَهْلِ السَّمَاءِ ، وَوَزِيرَيْنِ مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ ، فَأَمَّا وَزِيرَايَ مِنْ أَهْلِ السَّمَاءِ: فَجَبْرَائِيلُ ، وَمِيكَائِيلُ ، وَأَمَّا وَزِيرَايَ مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ: فَأَبُو بَكْرٍ ، وَعُمَرُ “
– হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আধ্যাত্মিক জগতে আমার দু’জন উজির এবং এই দুনিয়ায় দু’জন উজির আছেন। আধ্যাত্মিক জগতে দু’জন হলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম ও মিকাইল; আর দুনিয়ায় দু’জন হলেন আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।৭
এই হাদীসটি শব্দচয়নে সামান্য পরিবর্তনসহ অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থের ২টি জায়গায় এর উল্লেখ করেন; আরও উল্লেখ করেন ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘জামেউ তিরমিযী’ পুস্তকের এক জায়গায়, ইমাম সৈয়ুতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘জামেউল আহাদীস ওয়াল মারাসীল’ গ্রন্থের পাঁচ স্থানে, ‘কানযুল উম্মাল’ কেতাবের চার জায়গায় এবং ইমাম নাসাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘ফাযাইলে সাহাবা’ পুস্তকের এক স্থানে।
হযরত শায়খুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ আনওয়ারুল্লাহ ফারূকী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন: ফেরেশতাকুলের মধ্যে জিবরীল আলাইহিস সালাম ও মিকাইলের মতো দু’জন উজির আসমানে, আর দু’জন উজির জমিনে থাকলে এই বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানী জগৎ ও পার্থিব জগতের (অবিসংবাদিত) সুলতান তথা সম্রাট?
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষক আল্লাহতা’লা, কোনোভাবেই জিবরীল আলাইহিস সালাম নন*
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সৃষ্টিকুলের মাঝে (আল্লাহতা’লার) সর্বপ্রথম সৃষ্টি। বিশ্বজগতের স্রষ্টা যা ঘটে গিয়েছে এবং যা ঘটবে, এসব বিষয় সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাঁকে সমগ্র বিশ্বজগতের শিক্ষক বানিয়েছেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই জগতের কারো কাছ থেকে কখনোই কোনো কিছু শেখেননি। স্বয়ং আল্লাহতা’লা-ই তাঁকে সর্বপ্রকারের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহতা’লা কুরআন মজীদের সূরা আর-রহমানের মধ্যে এরশাদ ফরমান:
الرَّحْمَنُ (1) عَلَّمَ الْقُرْآنَ (2) خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَانَ (4)
– “পরম দয়ালু (আল্লাহ), যিনি আপন মাহবূব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। মানবতার প্রাণ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে সৃষ্টি করেছেন; যা সৃষ্ট হয়েছে এবং যা সৃষ্টি করা হবে সব কিছুর (মা কানা ওয়া মা এয়াকূনু) সুস্পষ্ট বিবরণ তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন।”৮
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষক হলেন খোদ খোদাতা’লা-ই। হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম আল্লাহর যে সমস্ত বাণী হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নিয়ে এসেছিলেন, তা তিনি একজন সেবক ও প্রতিনিধি হিসেবেই এনেছিলেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর কাজ ছিল আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া। কিন্তু এর অর্থ, অন্তর্নিহিত মর্ম এবং গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্বয়ং আল্লাহ পাক-ই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শিখিয়েছিলেন। অতএব, জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ‘শিক্ষা’ শব্দটি যেখানে আরোপ করা হয়েছে, সেখানে এর মানে এই নয় যে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শিক্ষা দিয়েছেন, বরং এর মানে তিনি আল্লাহর কালাম (বাণী) পৌঁছে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে, এর আক্ষরিক অর্থে যদি একে বিশ্বাস করা হয়, তাহলে জিবরীল আলাইহিস সালাম-কেই ’প্রকৃত শিক্ষক’ বলে স্বীকার করে নিতে হবে; কিন্তু স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয় তো একই সময়ে প্রকৃত শিক্ষক হতে পারেন না। আল্লাহ পাক (ওপরোক্ত আয়াতে করীমায়) প্রকৃত শিক্ষক হওয়ার বিষয়টি নিজের প্রতি আরোপ করে এই ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা দিয়েছেন। তিনি আরও এরশাদ করেন:
إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
“নিশ্চয় সেটি (কুরআন মজীদ) সংরক্ষিত করা (আপনার পবিত্র বক্ষে) এবং পাঠ করা (আপনার পবিত্র জিহ্বায়) আমারই দায়িত্বে।”৯
ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ
– একই (কেয়ামাহ) সূরায় আরও এরশাদ হয়েছে, “অতঃপর নিশ্চয় এর সূক্ষ্ম বিষয়াদি আপনার কাছে প্রকাশ করা আমার দায়িত্ব।” ১০
سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَى
সূরা আল-আ’লায় আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান, “হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এক্ষণে আমি আপনাকে পড়াবো (শেখাবো এমন পন্থায়), যার ফলে আপনি (কখনো) ভুলবেন না।” ১১
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে হাদীস শরীফে এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং গড়ে তুলেছেন এবং তা তিনি সর্বোত্তম পন্থায়-ই করেছেন।”১২
তাফসীরে রূহুল বয়ানে বলা হয় –
ان جبريل عليه السلام نزل بقوله تعالى كهيعص فلما قال كاف قال النبي عليه السلام (علمت) فقال ها فقال (علمت) فقال يا فقال (علمت) فقال عين فقال (علمت) فقال صاد فقال (علمت) فقال جبريل كيف علمت ما لم اعلم
, “একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন সূরা মরিয়মের ‘কা….ফ, হা…, ইয়া…, আঈ…ন, সোয়া…দ’ আয়াতটি (১৯:০১) নিয়ে আসেন এবং তেলাওয়াত করেন, তখন হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’ জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, ‘কা..ফ’; এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’ জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, ‘হা..’, আর নবীয়্যে মকবূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’ জিবরীল আলাইহিস সালাম আবার বলেন, ‘ইয়া…’, এবারও বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’ অতঃপর জিবরীলআলাইহিস সালাম বলেন, ‘আঈ..ন’, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’ জিবরীল আলাইহিস সালাম এরপর বলেন, ‘সোয়া..দ’, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এর অর্থ ও উদ্দেশ্য জানি।’
“জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম আরয করেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই কী মহিমা আপনার! আমি নিজেই এর অর্থ জানি না, অথচ আপনি তা জানেন’!”
ওপরের উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম কোনোভাবেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন ওহী (ঐশী বাণী)-এর বাহক ও (খোদাতা’লার) প্রতিনিধি এবং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেবক ও উজির।
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে জিবরীল আলাইহিস সালাম ৪২০০০০ বার হাজিরা দেন*
ইমাম মুহাম্মদ ফাসী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘মাতালি’উল মাসসাররাত’ পুস্তকের ৩২২ পৃষ্ঠায় শায়খ আবূ আব্দুল্লাহ রচিত ‘লাফযুদ্ দুররি বি-আমলিল কাফফ’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন: “এর মানে হচ্ছে হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম ৪২০,০০০ বার বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজিরা দিয়েছেন। প্রতিবারই তিনি যথাযথ আদবের সাথে হাজির হন এবং হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে অবস্থান করেন।”
*মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজিরার জন্যে তাঁর কাছে জিবরীল (আ:)-এর অনুমতি প্রার্থনা*
জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে যতোবার হাজির হয়েছেন, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনের মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। সম্মানার্থে তিনি কখনো হঠাৎ করে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন না, বরং তিনি বারবার তাঁর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই কেবল তিনি তাঁর কাছে এসে হাঁটুর সামনে হাঁটু রেখে সমান্তরালভাবে বসতেন।
বস্তুতঃ এই ধরনের বর্ণনাসম্বলিত অনেক হাদীস ‘সিহাহ’, ‘সুনান’ জাতীয় বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। নমুনাস্বরূপ এ ধরনের একখানা হাদীস নিচে উদ্ধৃত হলো:
فَأَتَيْنَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ فَقَالَ: كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَتَاهُ رَجُلٌ جَيِّدُ الثِّيَابِ، طَيِّبُ الرِّيحِ، حَسَنُ الْوَجْهِ، فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «وَعَلَيْكَ» ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَدْنُو مِنْكَ؟ قَالَ: «ادْنُ»
– হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ তাঁর দরবারে সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট, সুগন্ধিময় দেহসৌষ্ঠবসম্পন্ন ও পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন বস্ত্র পরিধানরত এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তিনি এসে আরয করেন, আস্ সালামু আলাইকুম, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি কি কাছে আসতে পারি? হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কাছে আসুন। ওই ব্যক্তি কিছুটা কাছে আসেন। এভাবে তিনি বারংবার কাছে আসার অনুমতি চাইতে থাকেন এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরও কাছে এসে বসেন।১৪
’মুসনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল’ গ্রন্থে এই হাদীসটির শব্দচয়নে সামান্য রদবদল আছে:
فَجَاءَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ ، أَدْنُو ؟ فَقَالَ : ادْنُهْ فَدَنَا رَتْوَةً ، ثُمَّ قَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ ، أَدْنُو ؟ فَقَالَ : ادْنُهْ
জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, আস্ সালামু আলাইকুম, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দেন, ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি কি কাছে আসতে পারি? নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কাছে আসুন।১৫
’কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কথাগুলো এভাবে লেখা হয়েছে:
জিবরীল আলাইহিস সালাম আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি কি কাছে আসতে পারি? বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার কাছে আসুন।১৬
أتاه فقال: أنت رسول الله قال نعم قال أدنو منك؟ قال ادن مني
‘সুনানে নাসাঈ’ কেতাবে বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে এভাবে –
حَتَّى سَلَّمَ فِي طَرَفِ الْبِسَاطِ فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا مُحَمَّدُ، فَرَدَّ عَلَيْهِ السَّلَامُ، قَالَ: أَدْنُو يَا مُحَمَّدُ، قَالَ: «ادْنُهْ» فَمَا زَالَ يَقُولُ: أَدْنُو مِرَارًا، وَيَقُولُ لَهُ: «ادْنُ»
– জিবরীল আলাইহিস সালাম মেঝের ওপর বিছানো ফরাশের প্রান্তসীমায় এসে আরয করেন, হে সকল প্রশংসার যোগ্য অধিকারী (অর্থাৎ, তাঁর নাম মোবারককেও প্রশংসার আকারে উল্লেখ করা হয়েছে এখানে)! আস্ সালামু আলাইকুম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সালামের প্রত্যুত্তর দিলে জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, এয়া মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), আমি কি আপনার কাছে আসতে পারি? হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কাছে আসুন। জিবরীল আলাইহিস সালাম বারংবার কাছে আসার অনুরোধ করতে থাকেন, আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তা বারংবার মঞ্জুর করতে থাকেন।১৭
’মুসনাদে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল’ ও ’সুনানে বায়হাকী’ গ্রন্থগুলোতে তা বর্ণিত হয়েছে এভাবে:
হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি কি আপনার দরবারে প্রবেশ করতে পারি?
’মুসনদে ইমাম আদহাম’ গ্রন্থের ভাষ্যকার এটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:
জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যে এ উপায়ে অনুমতি চেয়েছেন, কেননা তিনি শঙ্কিত ছিলেন যে হঠাৎ কাছে এলে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বেআদবি হতে পারে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে জিবরীল আলাইহিস সালাম কীভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান সহকারে হাজিরা দিতেন, তা এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই। একইভাবে হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবার ত্যাগের আগে জিবরীল (আ:) যাতে তাঁর অনুমতি নেন, অনুমতি ও সম্মতি না নিয়ে যেন চলে না আসেন, সে ব্যাপারেও আল্লাহতা’লা ফেরেশতাকে নির্দেশ দিতেন।
*‘হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি না দিলে ফেরত এসো না’*
সর্ব-হযরত ইবনে সাআদ ও আবূ শায়খ হতে হযরত কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী নকশবন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি একখানা হাদীস বর্ণনা করেন, যা’তে বিবৃত হয়:
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের জ্বেহাদ শেষ করলে পরে জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম একটি লাল ঘোড়ায় চড়ে বর্শা হাতে এবং বর্ম পরিহিত অবস্থায় তাঁর দরবারে আসেন; তিনি আরয করেন: হে মহা প্রশংসিত জন! এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহ পাক আপনার দরবারে আমাকে পাঠিয়েছেন এবং আদেশ করেছেন আপনি রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন আর (খোদার কাছে) ফেরত না যাই। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আমার প্রতি রাজি আছেন? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বলেন, হ্যাঁ, আমি আপনার প্রতি খুশি আছি। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম [আল্লাহর কাছে] ফিরে যান।
*বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর খেদমত*
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ একজন খাদেম ও দ্বাররক্ষী। তিনি হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সওয়ারের লাগাম ধরতেন, যেমনটি ইমাম তাবারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘মুসনদ-এ-শামিয়্যীন’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৬০৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন:
قَالَ: كُنَّا إِذَا رَأَيْنَا أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ فِيمَا يُرْسِلُ إِلَيْهِ عَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ مَرْوَانَ فَخَفَفْنَا لَهُ فَحَدَّثَنَا يَوْمًا قَالَ: غَزَوْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخَذْنَا فِي عَقَبَةٍ حَتَّى إِذَا صَعِدْنَا كَبَّرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , ثُمَّ الْتَفَتَ إِلَيْنَا فَتَبَسَّمَ ثُمَّ سَارَ حَتَّى إِذَا كَانَ فِي وَسَطِهِ كَبَّرَ ثُمَّ الْتَفَتَ فَتَبَسَّمَ , ثُمَّ سَارَ حَتَّى أَسْهَلْنَا فَكَبَّرَ , ثُمَّ الْتَفَتَ فَجَعَلَ يَبْتَسِمُ , فَوَقَفَ حَتَّى إِذَا اجْتَمَعْنَا قَالَ: «هَلْ تَدْرُونَ لِمَ كَبَّرْتُ وَجَعَلْتُ أَبْتَسِمُ إِلَيْكُمْ؟» قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ: ” إِنَّا لَمَّا أَخَذْنَا فِي الْعَقَبَةِ أَخَذَ جِبْرِيلُ بِزِمَامِ الرَّاحِلَةِ فَقَالَ لِي: أَبْشِرْ يَا مُحَمَّدُ وَبَشِّرِ أُمَّتَكَ أَنَّهُ مَنْ مَاتَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ , وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ فَكَبَّرْتُ , ثُمَّ الْتَفَتُ إِلَيْكُمْ , ثُمَّ تَبَسَّمْتُ , ثُمَّ سَارَ سَاعَةً , وَقَالَ: أَبْشِرْ يَا مُحَمَّدُ وَبَشِّرْ أُمَّتَكَ أَنَّهُ مَنْ جَاءِ مِنْكُمْ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ فَكَبَّرْتُ وَالْتَفَتَ إِلَيْكُمْ فَتَبَسَّمْتُ , ثُمَّ سَارَ حَتَّى إِذَا سَهَلْنَا قَالَ: أَبْشِرْ يَا مُحَمَّدُ وَبَشِّرْ أُمَّتَكَ مَنْ مَاتَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ النَّارَ “
– হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, কোনো এক যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। ওই সময় একটি উপত্যকার দিকে এগিয়ে চলেছিলাম আমরা। (উপত্যকার পাহাড়ে) আরোহণ আরম্ভ করার সময় হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবর) বলেন এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে (স্মিত) হাসেন, অতঃপর অগ্রসর হতে থাকেন। উপত্যকার মাঝামাঝি পৌঁছুলে পরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারও ‘তাকবীর’ বলেন এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে (স্মিত) হাসেন, অতঃপর আবারও অগ্রসর হতে থাকেন। আমরা গোটা উপত্যকা যখন পার হয়ে যাই, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় তাকবীর বলেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে (স্মিত) হাসেন এবং থেমে যান। আমরা তাঁর চারপাশে জড়ো হলে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, আমি কেন তাকবীর বলেছি এবং তোমাদের দিকে তাকিয়ে (স্মিত) হেসেছি, তা কি তোমরা জানো? আমরা আরয করি, আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই আমাদের চেয়ে ভাল জানেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমতাবস্থায় এরশাদ ফরমান, আমরা যখন উপত্যকায় আরোহণ করছিলাম, তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার ঘোড়ার লাগাম তাঁর হাতে ধরে রেখেছিলেন। তিনি আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আপনার উম্মতকে এই খোশ-খবরী দিন, কেউ যদি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর হাবীব ও রাসূল, আর এই সাক্ষ্যের ওপরই যদি তার ইন্তেকাল হয়, তবে আল্লাহতা’লা তাকে অবশ্যই জান্নাত দান করবেন। আমি (এ কথা শুনে) তাকবীর বলি এবং তোমাদের দিকে ফিরে (স্মিত) হাসি। জিবরীল আলাইহিস সালাম লাগাম হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকেন। কিছু সময় পরে জিবরীল আলাইহিস সালাম আবার আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অনুগ্রহ করে এই খোশ-খবরী গ্রহণ করুন এবং আপনার উম্মতকে জানান, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা’বূদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন তাঁর প্রেরিত রাসূল, তবে আল্লাহতা’লা তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। আমি (একথা শুনে) তাকবীর বলি এবং তোমাদের দিকে তাকিয়ে (স্মিত) হাসি। জিবরীল আলাইহিস সালাম ওই সময় হাঁটতে থাকেন। আমরা গোটা উপত্যকা পার হয়ে সমতল ভূমিতে এসে পড়লে তিনি আরয করেন, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অনুগ্রহ করে এই খোশ-খবরী গ্রহণ করুন এবং আপনার উম্মতকে জানান, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ বা উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন তাঁর প্রেরিত রাসূল, আর এই সাক্ষ্যের ওপরই যদি তার ইন্তেকাল হয়, তবে আল্লাহ পাক তার জন্যে জাহান্নাম নিষিদ্ধ করে দেবেন।
(দ্বিতীয়াংশ আগামীকাল প্রকাশিতব্য)