হালাল উপার্জন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

সূচি
১. প্রকাশকের কথা
২. ভূমিকা
৩. ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব
৪. হালাল উপার্জন একটি অলংঘনীয় বিধান
৫. হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত
৬. হালাল উপার্জন আখিরাত বিমুখতা নয়
৭. মানব জীবনে উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা
৮. উপার্জনের প্রকারভেদ
৯. হালাল উপার্জনের মূলনীতি
১০. হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে যা আবশ্যক
১১. হারাম উপার্জনের প্রকারভেদ
১২. হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে বর্জনীয় কি কি
১৩. হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিকসমূহ
১৪. হারাম উপার্জন থেকে তাওবা
১৫. হালাল উপার্জন ইবাদত কবুল হবার পূর্বশর্ত
১৬. হালাল উপার্জন দো‘আ কবূল হবার পূর্বশর্ত
১৭. অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারীর
জন্য জাহান্নাম অবধারিত
১৮. হালাল উপার্জনে খোলাফা-ই রাশেদীন
১৯. হালাল উপার্জন সম্পর্কে ওলামা-ই কেরামের বক্তব্য
২০. উপসংহার

প্রকাশকের কথা

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
نَحْمَدُ ه وَنُصَلِّىْ وَنُسَلِّمُ عَلى حَبِيْبِه الْكَرِيْمِ وَعَلى الِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

আল্লাহ্ তা‘আলা জিন ও ইনসানকে পয়দা করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আর এ ইবাদত আল্লাহর মহান দরবারে ক্ববূল বা গ্রহণযোগ্য হবার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘হালাল উপার্জনৎ। যার উপার্জন হালাল নয়; বরং হারাম, আর তা ভক্ষণ করে তার দৈহিক গড়ন তৈরী হয়, দৈহিক শক্তি সঞ্চয় হয়। বলাবাহুল্য, তা ব্যবহার করে সে হয়তো ইবাদত-বন্দেগী করে। হাদীস শরীফে হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করেছেন, যে শরীর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত হয় তা বেহেশতে যাবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র, তিনি অপবিত্রকে পছন্দ করেন না। হারাম ‘মাধ্যমে’ ইবাদত-বন্দেগী ক্ববূল হবে না মর্মে কোরআন মজীদ ও হাদীস-ই পাকে বহু আয়াত ও রেওয়ায়ত এসেছে। এসব বর্ণনা ও শরীয়তের বিধান জানা ও প্রত্যেক ঈমানদার ইবাদতপরায়ণ বান্দার জন্য অপরিহার্য।
তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একটি প্রমাণ্য পুস্তক প্রকাশিত হওয়া সময়ের দাবী। সুখের বিষয় যে, এ বিষয়ে একটি যুগোপযোগী পুস্তক প্রণয়ন করেছেন অধ্যাপক মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন আযহারী, বইটার সম্পাদনা করেছেন আনজুমান রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নন। সর্বোপরি বইটি প্রকাশ করছে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট (প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ)।
আশাকরি, প্রতিটি পাঠককে আশাতীত উপকৃত করবে। আমি লেখক সম্পাদক পাঠক-সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন- সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট

আলহাজ্ব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন-  সেক্রেটারি জেনারেল
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।

ভূমিকা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমতপূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতিকে সর্তক করেছে। তাই ইসলাম মানবজাতির জন্য কল্যাণের আধার হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। মানবদেহের জীবনীশক্তি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা হিসেবে পরিগণিত।
উপার্জন হালাল ও হারাম দু’টিই হ’তে পারে। যেসব জিনিসের বৈধ হওয়া পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত তা-ই হালাল। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত ও অনুমোদিত পথে যে আয়-রোযগার করা হয় তাকে হালাল উপার্জন বলে। আর যখন কোন মানুষ অবৈধভাবে অন্যের মাল হস্তগত ও উপভোগ করে তখন তা তার জন্য হারাম হয়ে যায়।
তাই হালাল উপার্জন ইসলামী জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামের দিকনির্দেশনা হ’ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করতে হবে এবং উপার্জনের পন্থাও অবশ্যই শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় হতে হবে। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষনা করেছে, যাতে প্রতারণা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, জনসাধারণের অকল্যাণ সর্বোপরি জুলুম রয়েছে। তাই সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, জুয়া, মিথ্যাচার ইত্যাদি অসামাজিক অনাচারে লিপ্ত হয়ে জীবিকা উপার্জন করা যাবে না।
মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্য যা কল্যাণকর, পবিত্র, উত্তম ও উপাদেয় তাই আল্লাহ পাক হালাল করেছেন। অন্যদিকে যা বিপদজ্জনক এবং ক্ষতিকর তা হারাম করেছেন। বস্তুতঃ ইসলামী শরী‘আতে হারামের পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং হালালের ক্ষেত্র বিস্তীর্ণ ও সুপ্রশস্ত। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে।

‘উপার্জন’ শব্দের পরিচয়
উপার্জন শব্দটির সমার্থক শব্দসমূহ হচ্ছে আয়, রোজগার, কামাই, লাভ, প্রাপ্তি, সংগ্রহ, অর্জন ইত্যাদি।( ) আরবীতে الكسب এবং ইংরেজীতে বলা হয় Income.
পরিভাষায় উপার্জন হলো: জীবন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা। অন্যভাবে বলা যায় যে, Income is the monetary payment received for goods or services, or from other sources, as rents or investments অর্থাৎ আয়-উপার্জন হলো ওই পারিশ্রমিক প্রদান, যা পাওয়া যায় মালামাল অথবা সেবাকর্ম অথবা অন্য কোন উৎসের বিনিময়ে, যেমন ভাড়া কিংবা পুজি।
—০—

ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্বও অত্যধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার নিমিত্তে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে। অতএব নির্দেশনা বহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত।
ইসলামের বক্তব্য হল মানুষকে নিজের সার্মথ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্য-সামগ্রীর সন্ধান করতে হবে। এটি মানুষের অন্যতম অধিকার। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার দেয়নি যে, সে অর্থ সম্পদ উপার্জনের জন্য স্বীয় খেয়ালখুশিমত যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারবে। তাইতো ইসলাম অর্থ-সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর যাবতীয় ব্যবস্থাকে ইসলাম হালাল করেছে।
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটি শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতির উপরই সীমাবদ্ধ নয়। জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ-রেখার প্রণেতা হিসেবে ইসলামে রয়েছে জীবন ধারণের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ
“ হালাল পন্থায় উপার্জন করাও ফরয আদায়ের পাশাপাশি ফরয।”( )
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ পাক এ সেরা সৃষ্টিকে তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এ মর্মে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন:
وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الْاِنْسَ اِلَّا لِیَعْبُدُوْنِ-ـ مَاۤ اُرِیْدُ مِنْهُمْ مِّنْ رِّزْقٍ وَّ مَاۤ اُرِیْدُ اَنْ یُّطْعِمُوْنِ
‘আমি জিন এবং মানুষকে আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের থেকে কোন রিযিক চাই না এবং তাদের থেকে আমি খাবারও চাই না’।
[যারিয়াত: ৫৬-৫৭] এটা আল্লাহ তা‘আলার বান্দার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার জন্য জমীনে উপার্জন করার বিরাট ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি আমাদের কল্যাণে অগণিত ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
مَا یُرِیْدُ اللّٰهُ لِیَجْعَلَ عَلَیْكُمْ مِّنْ حَرَجٍ وَّ لٰكِنْ یُّرِیْدُ لِیُطَهِّرَكُمْ وَ لِیُتِمَّ نِعْمَتَهٗ عَلَیْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
“আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নি’মাত তোমাদের উপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। [আল মায়েদা-০৬] মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্ধারিত ফরয ইবাদত (যেমন নামায) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষণে জমীনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে ব্রতী হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিশ্রমলব্ধ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقْنٰكُمْ وَ اشْكُرُوْا لِلّٰهِ اِنْ كُنْتُمْ اِیَّاهُ تَعْبُدُوْنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রূযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে থাক’। [বাক্বারা- ১৭২] এ আয়াতে হারাম খাদ্য ভক্ষণ করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কারণ ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য হালাল রূযী খাওয়া অত্যাবশ্যক। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
الحَلاَلُ بَيِّنٌ، وَالحَرَامُ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى المُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ: كَرَاعٍ يَرْعَى حَوْلَ الحِمٰى، يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَهُ.
“হালাল বা বৈধ সুস্পষ্ট এবং হারাম বা অবৈধও সুস্পষ্ট, আর এ দু’ এর মধ্যবর্তী বিষয়গুলো হলো সন্দেহজনক। আর বেশীরভাগ লোকই সেগুলো (সম্পর্কে সঠিক পরিচয়) জানে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সন্দেহজনক জিনিসিগুলোকে পরিহার করলো সে তার দ্বীন ও মান-সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দেহের মাঝে পতিত হলো তার উদাহরণ ঐ রাখালের মত যে পশু চরায় সংরক্ষিত ভুমির সীমানায় এমনভাবে যে, যে কোনো সময় সে তাতে প্রবেশ করবে।”( )
হারাম খাদ্য খেলে মনের মধ্যে খারাপ অভ্যাস সৃষ্টি হয়, ইবাদত-বন্দেগীতে আগ্রহ স্তিমিত হয়ে আসে এবং দো‘আ কবুল হয় না। অন্যদিকে হালাল খাদ্য গ্রহণের ফলে মানব মনে এক প্রকার আলো সৃষ্টি হয়, যা অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করে এবং সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে, ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগ আসে, পাপ কাজে ভয় আসে এবং দো‘আ কবুল হয়। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحاً
‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর’। [মুমিন ৫১] হালাল খাদ্য গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহ বান্দার কোন দো‘আ ক্ববূল করবেন না। হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ فَقَالَ (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ) وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ اَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ) ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهٗ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهٗ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهٗ حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذٰلِكَ.
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি একমাত্র পবিত্র বস্তুকেই ক্ববূল করেন। আল্লাহ রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন, মুমিনগণকেও সেই আদেশ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল পবিত্র খাদ্য ভক্ষণ কর এবং সৎ আমল কর’। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার দেওয়া হালাল পবিত্র রিযিক হ’তে খাও’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেন, ‘কোন ব্যক্তি দূর-দূরান্তে সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলা-বালি লেগে আছে। এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তি উভয় হাত আসমানের দিকে তুলে কাতর স্বরে হে রব! হে রব! বলে ডাকছে। অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয়-বস্ত্র হারাম এবং সে হারামই খেয়ে থাকে। এই ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হবে’? ( )
অন্য একটি হাদীস শরীফে এসেছে
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلَ الرَّجُلُ مِنْ كَسْبِهِ وَإِنَّ وَلَدَهٗ مِنْ كَسْبِهِ
হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হ’তে, বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘নিজের উপার্জিত আহারই সর্বোত্তম। তোমাদের সন্তানও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত’।( )
অন্য হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ بَكْرٍ نِالصِّدِّيْقِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ.
হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘ঐ দেহ-শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না যা হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত হয়েছে’। ( )
আরেকটি হাদীস শরীফে এসেছে,
عن سعيد بن عمير عن عمه قَالَ سُئِلَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْكَسْبِ أَطْيَبُ قَالَ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ وَكُلُّ كَسْبٍ مَبْرُوْرٍ.
হযরত সাঈদ ইবনু উমায়র রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর চাচা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দরবারে আরয করা হ’ল, কোন প্রকার উপার্জন উত্তম। তিনি এরশাদ করেন, ‘হাতের কাজ এবং হালাল ব্যবসার উপার্জন’।( )
ইসলামী দিকনির্দেশনা মোতাবেক হালাল পথে রূযী রোযগার করলে সেটিও ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.
‘অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়, আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’। [জুম‘আ- ১০] এ আয়াতে শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামায আদায়ের পরই রিযিক অন্বেষণের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। সাথে সাথে পরবর্তী আয়াতে স্মরণ করে দেওয়া হয়েছে যে, -وَاللهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ ‘আল্লাহই সর্বোত্তম রিযিকদাতা’ (জুম‘আ ১১)।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِيْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ.
‘আর পৃথিবীতে বিচরণশীল এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহ গ্রহণ করেননি। তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাধিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে’। [হূদ- ৬]

হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান
ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণ করেই শেষ করেনি বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরয ইবাদত সমূহ আদায়ের পর এ মহতি কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের উপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী করে এরশাদ করেন,
عَنِ النبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، قالَ يَأْتي علَى النَّاسِ زَمانٌ، لا يُبالِي المَرْءُ ما أخَذَ منه، أمِنَ الحَلالِ أمْ مِنَ الحَرامِ.
“মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না।”( )

হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। বান্দা যে সব ইবাদত করে থাকে হালাল উপার্জনও তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে,
فَٱبۡتَغُواْ عِندَ ٱللَّهِ ٱلرِّزۡقَ وَٱعۡبُدُوهُ وَٱشۡكُرُواْ لَهُۥٓۖ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ
“তাই আল্লাহর কাছে রিয্ক তালাশ কর, তাঁর ইবাদাত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।” [সূরা আল-‘আনকাবূত: ২৯:১৭।]

হালাল উপার্জনে বরকত লাভ হয়
উপার্জনে বরকত লাভ করতে হলে একমাত্র হালাল পন্থায় হতে হবে। কেননা বরকত দানের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি শুধু বৈধ উপার্জনকেই বরকত মন্ডিত করেন এবং যাবতীয় অবৈধ উপার্জনের বরকত নষ্ট হয়ে যায় আর অপচয় বৃদ্ধি পায়, ফলে সম্পদের প্রাচুর্য লাভে বিলম্ব হয়। অন্যদিকে হালাল উপার্জন কম হলেও তাতে বরকতের কারণে খুব স্বল্প সময়েই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের উপায়
মানুষের দু’টি জীবন রয়েছে, একটি ইহলৌকিক, অপরটি পারলৌকিক। অতএব, হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হতে পারে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে। তাই হালাল পন্থায় উপার্জনকারী দুনিয়াতে কখনও সমস্যায় থাকলেও আখেরাতে জান্নাতে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে হাদিসে পাকে এসেছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ أَكَلَ طَيِّبًا، وَعَمِلَ فِي سُنَّةٍ، وَأَمِنَ النَّاسُ بَوَائِقَهُ دَخَلَ الجَنَّةَ
“যে ব্যক্তি হালাল-পবিত্র খাবার খায় ও সুন্নাতের উপর আমল করে এবং মানুষ তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”।( )

হালাল উপার্জন করা আল্লাহর পথে বের হওয়ার শামিল
হালাল উপার্জন করার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও যেতে হতে পারে। সেজন্য এটিকে কুরআন মাজীদে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সাথে হালাল উপার্জনকে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ اٰخَرُوْنَ یَضْرِبُوْنَ فِی الْاَرْضِ یَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِۙ- وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ
“আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে।” [সূরা আল-মুযযাম্মিল: ২০]

হালাল উপার্জন আখেরাত বিমুখতা নয়
আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে এ দুনিয়াতে হালাল উপার্জন করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। সেজন্য উপার্জন করতে বৈধভাবে চাকুরী, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা অন্য কিছু করা আখেরাত বিমুখতা নয়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ ابْتَغِ فِیْمَاۤ اٰتٰىكَ اللّٰهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللّٰهُ اِلَیْكَ وَ لَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِی الْاَرْضِؕ -اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْمُفْسِدِیْنَ
“আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান কর। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও (সৃষ্টির প্রতি) সেরূপ অনুগ্রহ কর। আর যমীনে ফ্যাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফ্যাসাদকারীদের ভালবাসেন না।” [সূরা আল-ক্বাছাছ: ৭৭]

উপার্জন করার ক্ষমতা দুনিয়ার কল্যাণকর বিষয়
উপার্জন করার যোগ্যতা একটি কল্যাণকর বিষয়। এটা আল্লাহর এক বিশেষ নি’মাত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে চিন্তা, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন, দু’টি হাত দিয়েছেন। যাতে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। অপরের নিকট হাত পাততে না হয়। উপার্জন করার মত কল্যাণকর বিষয়ে দু‘আ করার ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আল-কুরআনে,
وَ مِنْهُمْ مَّنْ یَّقُوْلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ
“আর তাদের মধ্যে এমনও আছে, যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন আর আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।” [বাক্বারা-২০১]

উপার্জন স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম
ইসলাম অপরের উপর নির্ভর করে জীবন পরিচালনার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لَا تَزَالُ الْمَسْأَلَةُ بِأَحَدِكُمْ حَتّٰى يَلْقَى اللهَ وَلَيْسَ فِي وَجْهِه مُزْعَةُ لَحْمٍ.
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে ক্বিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে যে, তার মুখমন্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।”( )

উত্তরাধিকারীদের স্বচ্ছল রেখে যাওয়ার উপায়
হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,
إِنكَ أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ
عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِي أَيْدِيهِمْ
“তোমাদের সন্তান সন্তুতিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বী রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।” ( )

হালাল উপার্জন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন
পৃথিবীর জীবন নির্বাহে হালাল উপার্জন করার সুযোগ বা যোগ্যতা লাভ করা আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নি’মাত। সেজন্য হালাল পন্থায় উপার্জনকারী ইমানদার পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে। হাদীস শরীফে এসেছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أَرْبَعٌ إِذَا كُنَّ فِيكَ فَلاَ عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدُّنْيَا حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفَّةٌ فِي طُعْمَةٍ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন ,“চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে তখন দুনিয়ার অন্য সব কিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। সেগুলো হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনের খাদ্যগ্রহণ” ( )

—০—

মানবজীবনে উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যে সব পেশা অবলম্বন করে তা হলো: কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী, শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের যাবতিয় মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে লক্ষে তিনি মহাশুণ্যের সব সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
هُوَ الَّذِیْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِی الْاَرْضِ جَمِیْعًاۗ-ثُمَّ اسْتَوٰۤى اِلَى السَّمَآءِ فَسَوّٰىهُنَّ سَبْعَ سَمٰوٰتٍؕ-وَ هُوَ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمٌ۠
“তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্য) তৈরী করেছেন।”[বাক্বারা-২৯] তবে এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা যা তার ইখতিয়ারভুক্ত একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। ফলে প্রত্যেকে স্ব-স্ব যোগ্যতা, মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যেমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস চালায়।

জীবন পরিচালনার জন্য উপার্জন আবশ্যকীয় বিষয়
জীবন ধারণ করার জন্য উপার্জনে সক্ষম প্রত্যেককে উপার্জন করতে হবে। উপার্জন ছাড়া পৃথিবীতে বসবাস করা সম্ভব নয়। উপার্জন না করে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই ইসলামে। আর তাই দেখা যায় যে, সালাত শেষ হওয়ার পর পর উপার্জনে বের হওয়ার কথা আল-কুরআনে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
“অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।”[সূরা আল-জুমু‘আ: ১০]

পৃথিবী উপার্জন করার একমাত্র ক্ষেত্র
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শুধু সৃষ্টিই করেননি, জীবন পরিচালনার জন্য এ পৃথিবীকে কর্মক্ষেত্র করে দিয়েছেন। সে সাথে উপার্জন করার জন্য অসংখ্য ক্ষেত্রের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ ذَلُوْلًا فَامْشُوْا فِیْ مَنَاكِبِهَا وَ كُلُوْا مِنْ رِّزْقِهٖؕ-
وَ اِلَیْهِ النُّشُوْرُ
“তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে-প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিয্ক থেকে তোমরা আহার কর। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।” [সূরা আল-মুলক: ৬৭:১৫]

পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা
প্রত্যেক ব্যক্তিই পরিবারের সদস্য। তাই পারিবারিক দায়িত্ব পালনে তাকে উপার্জন করতে হয়। পরিবারে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা রয়েছে, যা উপার্জন করে মেটাতে হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَعَلَى ٱلۡمَوۡلُودِ لَهٌۥ رِزۡقُهُنَّ وَكِسۡوَتُهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ
“আর সন্তানের পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মায়েদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা।”[সূরা আল-বাক্বারাহ: ২:২৩৩]

ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি নিন্দা
ইসলামে অসহায় বিপন্ন মানুষের সহায়তা এবং অনগ্রসর মানুষের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে দান-সাদকা ও যাকাতের বাধ্যবাধকতা করেছে, সাথে সাথে কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমের মর্যাদা দিয়ে যেমন উৎসাহিত করেছে তেমনি প্ররিশ্রম না করে ঘৃণিত পেশা ভিক্ষাবৃত্তি করতে নিরুৎসাহিত করেছে।
তবে মানবিক ও সামাজিক বোধের কারণে সরলপ্রাণ অনেকে বিশ্বাস করে ভিক্ষুকদের যত্রতত্র দান-খয়রাত করছেন বেশ। আর ভিক্ষুকদের যত্রতত্র দান করার ফলে দিন দিন ভিক্ষুকের সংখ্যা শুধু বেড়েই চলছে তা নয়। বরং ভিক্ষাবৃত্তি সিন্ডিকেট করে একশ্রেণির লোক একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এতে সমাজের ভারসম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি অমান্য হচ্ছে ইসলামের হুকুম। অভিযোগ রয়েছে, ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের লোকেরা শিশুদের অপহরণ করে অঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটিয়ে তাদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে থাকে। তাদের সৃষ্ট অগণিত লোমহর্ষক ঘটনা রয়েছে; যার বর্ণনায় গা শিউরে ওঠে এবং বিষয়টি ভয়ংকর একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তাই ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তিকে কখনো প্রশ্রয় দেয়নি। বরং কঠোরভাবে নিষেধ করেছে এর থেকে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
لِلْفُقَرَآءِ الَّذِیْنَ اُحْصِرُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ لَا یَسْتَطِیْعُوْنَ ضَرْبًا فِی الْاَرْضِ٘-یَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِۚ-تَعْرِفُهُمْ بِسِیْمٰىهُمْۚ-لَا یَسْــٴَـلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًاؕ-وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیْمٌ۠
‘দান- খয়রাত ঐ সকল গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়; অজ্ঞ লোক যাঞ্ঝা না করার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না। তোমরা যে অর্থ ব্যয় করবে, তা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই পরিজ্ঞাত।’ [সুরা বাকারা: ২৭৩] ‘আল্লাহ তা‘আলার কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচুমানের ও রাগ সৃষ্টিকারী কর্ম হলো স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ও ভিক্ষাবৃত্তি করা। ( )
এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে ইরশাদ করেন,
من سَأَلَ وَعِنْدَهُ مَا يُغْنِيهِ فَإِنَّمَا يَسْتَكْثِرُ مِنْ جَمْرِ جَهَنَّمَ
‘যে ব্যক্তি অভাব ব্যতীত ভিক্ষা করলো; সে যেন জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলো।( )
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَأَلَ النَّاسَ وَلَهُ مَا يُغْنِيهِ جَاءَ يَوْمَ القِيَامَةِ وَمَسْأَلَتُهُ فِي وَجْهِه خُمُوشٌ، أَوْ خُدُوشٌ، أَوْ كُدُوحٌ، قِيلَ : يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا يُغْنِيهِ؟ قَالَ خَمْسُونَ دِرْهَمًا، أَوْ قِيمَتُهَا مِنَ الذَّهَبِ
যে ব্যক্তি তার কাছে তার প্রয়োজন পরিমাণ থাকার পরও অধিক পাবার জন্য ভিক্ষা করবে, ক্বিয়ামত দিবসে তার জন্য ‘ভিক্ষাবৃত্তি ক্ষত স্বরূপ; এর দ্বারা ভিক্ষুক স্বীয় মুখমন্ডলকে ক্ষত-বিক্ষত করবে।’( )
অন্য হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ
جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ
‘যে ব্যক্তি অপ্রয়োজনে ভিক্ষা করে, সে হাতে অঙ্গার রাখার মতো ভয়াবহ কাজ করে।’ ( )
অপর এক হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কারো কাছে ভিক্ষা চায়, সে তো জাহান্নামের আগুন ভিক্ষা চায়। তার ইচ্ছা, সে চাইলে জাহান্নামের আগুন কম ভিক্ষা করতে পারে, বেশিও ভিক্ষা করতে পারে।’( )
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিক্ষাবৃত্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ইরশাদ করেন,
عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلٰى، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ، وَخَيْرُ الصَّدَقَةِ عَنْ ظَهْرِ غِنًى، وَمَنْ يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللهُ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللهُ.
‘হযরত আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, উপরের (দাতা) হাত নিচের (গ্রহীতা) হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যাদের ভরণ-পোষণ তোমার দায়িত্বে আছে তাদেরকে আগে দাও। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে সাদক্বাহ করা উত্তম। যে ব্যক্তি হারাম ও ভিক্ষা করা থেকে পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন এবং যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবশূন্য করে দেন।” ( )
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ অপচয় ও ভিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করেন না।’ ( )
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ يَتَقَبَّلُ لِي بِوَاحِدَةٍ، وَأَتَقَبَّلُ لَهُ بِالْجَنَّةِ؟ قال قُلْتُ أَنَا قَالَ لاَ تَسْأَلِ النَّاسَ شَيْئًا- وفي رواية مَنْ يَضْمَنْ لِي وَاحِدَةً أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ؟ قَالَ قُلْتُ أَنَا يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: لاَ تَسْأَلِ النَّاسَ شَيْئًا
‘যে ব্যক্তি এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেবে যে, সে অন্যের কাছে হাত পাতবে না। আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারী গ্রহণ করবো।’ ( )
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ الله بْنِ عَمْرٍو، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: لاَ تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِيٍّ، وَلاَ لِذِي مِرَّةٍ سَوِيٍّ. ( )
কোন সম্পদশালী ও সুস্থ দেহের অধিকারীর জন্য সাদক্বাহ গ্রহণ করা হারাম।
তাছাড়া ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন।
এ মর্মে হযরত যুবাইর ইবনে ‘আউয়াম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لَأَنْ يَغْدُوَ أحَدُكم فَيَحْتَطِبَ على ظَهرِهِ، فيَتَصَدَّقَ مِنهُ، و يَسْتَغْنِي به عنِ النَّاسِ، خَيرٌ له من أنْ يَسألَ رَجُلًا، أعطاهُ أو مَنَعهُ، ذَلكَ بِأنَّ اليَدَ العُلْيَا، أفضَلُ من اليدِ السُّفْلَى، و ابْدأْ بِمنْ تَعُولُ
“তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক, পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রয় করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুক এটা তার জন্য মানুষের নিকট ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক, এর চাইতে উত্তম।”( )
অতএব উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতিরেকে যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয় তাদের এ ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنَ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ،حَتَّى يَأْتِيَ يَوْمَ القِيَامَةِ لَيْسَ فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে ক্বিয়ামতের দিনে এমন অরস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমন্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।( )”
—০—

উপার্জনের প্রকারভেদ
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে মানুষের খাদেম করেছেন। মানুষ নির্দেশিত পথে তা থেকে উপার্জন বা সম্পদ আহরণ করবে। ইসলাম এমন একটি জীবন বিধান যা কোনটি হালাল আর কোন্টি হারাম তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
الحَلاَلُ بَيِّنٌ، وَالحَرَامُ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى المُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ: كَرَاعٍ يَرْعَى حَوْلَ الحِمَى، يُوشِكُ أَنْ يُوَاقِعَهُ
“হালাল বা বৈধ সুস্পষ্ট এবং হারাম বা অবৈধও স্পষ্ট আর এ দু’এর মধ্যবর্তী বিষয়গুলো হলো সন্দেহজনক। আর বেশীরভাগ লোকই সেগুলো (সম্পর্কে সঠিক পরিচয়) জানে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সন্দেহজনক জিনিসিগুলোকে পরিহার করলো সে তার দ্বীন ও মান-সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দেহের মাঝে পতিত হলো তার উদাহরণ ঐ রাখালের মত যে পশু চরায় সংরক্ষিত ভুমির সীমানায় এমনভাবে যে, যে কোনো সময় সে তাতে প্রবেশ করবে।”( )।
আলোচ্য হাদীস থেকে বুঝা যায় উপার্জন দুই ধরণেরঃ ক. হালাল উপার্জন খ. হারাম উপার্জন।

হালাল উপার্জনের সম্ভাব্য কিছু মাধ্যম
মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানুষের জীবন নির্বাহের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে সমাদৃত, মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ মানুষকে এর গুরুত্ব অনুধাবন ও বোধগম্য করার নিমিত্তে পবিত্র কুরআনে সালাতের পাশাপাশি যাকাত তথা অর্থের উল্লেখ ৮২ স্থানে করেছেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ কুরআনুল কারিমে অর্থনৈতিক বিধানও নির্দেশ করেছেন। ফলে কুরআনুল কারিমকে একটি অর্থনীতির মহাকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মানুষ কিভাবে উপার্জন করবে, কোন্ পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণাবলী সম্পর্কে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। তাইতো ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদে তিনি যাকাত ফরয করেছেন, যেন সম্পদ এক শ্রেণির লোকদের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা ফরয ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা উপার্জন করার লক্ষ্যে যমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন,
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
“সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। [জুমা-১০] এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ক্বুরত্ববী বলেন:
يَقُول إِذَا فَرَغْتُمْ مِنْ الصَّلَاة فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْض لِلتِّجَارَةِ وَالتَّصَرُّف فِي حَوَائِجكُمْ
“যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেরিয়ে পড়।”
এখানে উপার্জনের একটি মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তা হলো এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আল্লাহর স্মরণে ব্রতী থাকা যায়।
অতএব, যে সব পেশায় বা উপার্জনের পন্থায় আল্লাহর স্মরণ বিমুখতার সম্ভাবনা রয়েছে ইসলাম তা অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হলো ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি কখনও আল্লাহর স্মরণে ব্রতী হওয়ার আহবান আসে, তা হলে তখন যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্ম পরিহার করা সকল ইমানদারদের জন্য ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰى ذِكْرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الْبَیْعَؕ-ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ -فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
হে মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [জুম’আ: ৯-১০] আল্লাহ তাআলা অন্যত্র এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِۚ-وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ
হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত [মুনাফিকূন-০৯] আল্লাহ তাআলা বিশেষ কিছু মু’মিনের প্রশংসায় এরশাদ করেন,
رِجَالٌۙ-لَّا تُلْهِیْهِمْ تِجَارَةٌ وَّ لَا بَیْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَ اِقَامِ الصَّلٰوةِ وَ اِیْتَآءِ الزَّكٰوةِ ﭪ–یَخَافُوْنَ یَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِیْهِ الْقُلُوْبُ وَ الْاَبْصَارُۗۙ
এমন লোকেরা, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। [নূর-৩৭] উপার্জন হল মানুষের সম্পদ লাভের প্রক্রিয়া। ইসলাম নির্দেশিত পথে মানুষ যে উপার্জন করে সেটিকে হালাল উপার্জন বলা হয়। পৃথিবীতে নানা উৎসে সম্পদরাজিকে আল্লাহ ছড়িয়ে রেখেছেন, মানুষকে তা অর্জন করতে হবে। এই অর্জন প্রক্রিয়ায় নানাবিধ মাধ্যম রয়েছে। ইসলাম হালাল উপার্জন করার জন্য কী কী মাধ্যম হতে পারে তার স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে। মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো: কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও চাকুরি। এ মাধ্যমগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও রয়েছে ইসলামে।

ব্যবসা-বাণিজ্য
ব্যবসা-বাণিজ্য একটি সম্মানজনক পেশা। জীবিকা অর্জনের এটি একটি অন্যতম উপায়। যাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ রয়েছে তারা এই পেশা অবলম্বন করে। যে জনপদের উপর আল্লাহ তা‘আলার রহমত রয়েছে সে জনপদে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা সাধারণ উদ্বৃত্ত অঞ্চলের সামগ্রী ঘাটতি অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দিয়ে উদ্বৃত্ত অঞ্চলের অপচয় রোধ করে আর ঘাটতি অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করে মানব সমাজের যে সেবা করছে তা সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক নবী-রাসূল, আলাইহিমুস সালাম এবং অনেক সাহাবায়ে কেরাম, যেমন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সব চেয়ে বড় মাধ্যম। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহৎ পেশা। সমাজ জীবনে যার ক্রিয়াশীলতা ও প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূর প্রসারী। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধু বৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এ ব্যাপারে সবিশেষ উৎসাহ ও গুরুত্ব প্রদান করেছে, যেন মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর বুকে একটি শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰواؕ
“তিনি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”[বাক্বারা-২৭৫] উপরোক্ত আয়াতের মর্ম উপলব্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, সুদভিত্তিক লেন-দেনের মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে তাদের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অতএব অবৈধ পন্থা হতে বাঁচার এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভের এটি অনেক বড় অবলম্বণ হল ব্যবসা-বাণিজ্য। এছাড়াও জীবিকার একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে এ ব্যবস্থাপনায়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
وقالَ عليهِ الصلاةُ والسلامُ: عليكُمْ بالتجارةِ، فإنَّ فيها تسعةَ أعشارِ الرزقِ
“তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা”( )
তাছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়নতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হাদীস বিদ্যমান। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে তিনি নবীগণ, ছিদ্দিক্ব ও শহীদগণের জান্নাতের সাথী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ , عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ. ( )
“সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।( )
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম আরও যেসব মূলনীতি দিয়েছে তাহলো: ধোঁকা ও প্রতারণামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয় বিহীন, পণ্যের দোষ-গুণ স্পষ্ট থাকা, ভাল পণ্যের সাথে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা, মুনাফাখোরী মানোবৃত্তি পরিহার করে কল্যাণমুখী মানষিকতা পোষণ, মজুদদারি চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হের-ফের না করা, সর্বোপরি যাবতীয় শঠতা ও জুলুম থেকে বিরত থাকা।

কৃষিকাজ বা চাষাবাদ
কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উপার্জন মাধ্যম। ইসলাম এটিকে মহৎ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিকার্যের সুচনা হয়েছে আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকেই। তাঁকে কৃষি কার্য, আগুনের ব্যবহার ও কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে এ ব্যবস্থাকে সাব্যস্ত করেছেন।
সৃষ্টিকূলের খাদ্যের উৎস কৃষি। মহান রাব্বুল আলামীন মানুষের কৃষি কাজের সুবিধার্থে পৃথিবীর মাটি ও ভূমিকে উৎপাদন ও ফসল ফলানোর উপাযোগী বানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
فَلْیَنْظُرِ الْاِنْسَانُ اِلٰى طَعَامِهٖۤۙ اَنَّا صَبَبْنَا الْمَآءَ صَبًّاۙ ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ شَقًّاۙ فَاَنْۢبَتْنَا فِیْهَا حَبًّاۙ وَّ عِنَبًا وَّ قَضْبًاۙ وَّ زَیْتُوْنًا وَّ نَخْلًاۙ
“মানুষের কর্তব্য তার খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া, চিন্তা করা। আমিই বৃষ্টি বর্ষণ করি, পরে জমি বিস্ময়করভাবে বিদীর্ণ করি। আর তাতে শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, তরি-তরকারি, যয়তুন, খেজুর, বিশিষ্ট উদ্যানসমূহ, ফল এবং গবাদি-খাদ্য উৎপাদন করি, তোমাদের ও তোমাদের পশুর ভোগের জন্য”। [আবাসা: ২৪-৩২] আলো-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, সমতলভূমি-মরুভূমি সর্বত্র মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টজীবের জীবিকার অসীম উপকরণ রেখে দিয়েছেন- যার অংশ বিশেষও ক্বিয়ামত পর্যন্ত নিঃশেষিত হবে না। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সহজসাধ্য উপায়-উপকরণের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেন মানুষ তা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আর এ পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আল্লাহ তা‘আলার এ নি’মাত যে ব্যক্তি বা জাতি নিয়মিত ও পরিমিতভাবে আহরণ করতে পারে, সে ব্যক্তি বা জাতি তো সমৃদ্ধশালী হবেই।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোকই কৃষি নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ এ ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে তবেই তা হালাল উপার্জন হবে। আর সেগুলো হলো:
ক. ভূমির মালিক যেন নিজেই চাষ করে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
مَنْ كَانَتْ لَهٗ أَرْضٌ فَلْيَزْرَعْهَا، أَوْ فَلْيُحْرِثْهَا أَخَاهُ، وَإِلَّا فَلْيَدَعْهَا.
“যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে। অথবা তার অন্য ভাইকে তা চাষাবাদ করার জন্য দেবে। অথবা, মজুর দ্বারা নিজের তত্বাবধানে চাষ করবে অথবা কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে দিবে।( ) ”
তবে এক্ষেত্রে কারো জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে এনে কিংবা উত্তরাধিকারকে অংশ না দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
খ. উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার শর্তে কাউকে চাষ করতে দেয়া।
গ. প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাউকে এক বা একাধিক বছরের জন্য তার ভোগাধিকার দান করা।
ঘ. জমিতে হারাম দ্রব্য উৎপাদন না করা, যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান রয়েছ্ েযেমন: আফিম, গাঁজা, চরস বা অনুরূপ মাদক দ্রব্য।
ঙ. অংশীদারিত্ব চাষাবাদ যাবতীয় প্রতারণা, ধোঁকা, ঠকবাজি, ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থেকে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ ভিত্তিক নীতির লালন করতে হবে।

শিল্প-কারখানা
মানুষের জীবন যাপনের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন শিল্পোন্নয়ন। অনেক কৃষিজাত দ্রব্য শিল্পের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী না করলে তা থেকে মানুষ উপকার লাভ করতে পারেনা। ইসলাম কৃষি কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে, তবে সকলে এ কাজে মগ্ন থাকতে হবে এমনটি নয়। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় বিপদ-আপদের মোকাবেলা কেবল মাত্র কৃষি দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্য কৃষি কাজের সাথে সাথে শিল্প পেশার কাজ করাও জরুরী।
তাই, ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পকর্মও মানুষের অন্যতম পেশা। এ মহতি পেশায় জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত রয়েছে। এ কর্মটি সম্পর্কে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বরোপ করেছে। যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালাম শুধু উৎসাহের বাণী প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি; বরং শিল্প ও ব্যবসার ময়দানে তাঁদের বিশাল অবদান রয়েছে।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম মাদইয়ানে ৮ বছর কাজ করেছেন, হযরত নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ নির্মাণ করেছেন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কাঠশিল্পে আত্মনিয়োগ করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাল্যকালে ব্যবসা করেছেন, চাকরী করেছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন, মাথায় বোঝা বহন করেছেন। কূপ থেকে পানি তুলেছেন, নিজ হাত মুবারকে স্বীয় জামা ও জুতা মুবারক সেলাই করেছেন, স্ত্রীবর্গকে ঘরে রান্নার কাজে সাহায্য করেছেন, এমনকি দুধ দোহনও করেছেন। তাছাড়া অধিকাংশ নবী-রাসূলগণই শিল্পকাজে জড়িত ছিলেন।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
وَ عَلَّمْنٰهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لَّكُمْ لِتُحْصِنَكُمْ مِّنْۢ بَاْسِكُمْۚ-فَهَلْ اَنْتُمْ شٰكِرُوْنَ
“আমি তাঁকে (দাউদ আলাইহিস সালাম) বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছি যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে।”[আন্বিয়া-৮০] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ وَإِنَّ نَبِيَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَم كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ.
‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য অপেক্ষা উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য খেতেন’।( )
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ مِنَّا فَضْلاً يَا جِبَالُ أَوِّبِي مَعَهُ وَالطَّيْرَ وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيدَ، أَنِ اعْمَلْ سَابِغَاتٍ وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ.
‘আর আমি দাঊদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি এই মর্মে যে, ‘হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর, হে পক্ষীকুল! তোমরাও তাই কর। আমি তার জন্য লৌহকে নরম করে দিয়েছি এবং তাঁকে বলেছি, প্রশস্ত বর্ম তৈরি কর, কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর এবং সৎকর্ম সম্পাদন কর। তোমরা যা কিছু কর, আমি তা দেখি। [সাবা ১০-১১] আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِاَعْیُنِنَا وَ وَحْیِنَا وَ لَا تُخَاطِبْنِیْ فِی الَّذِیْنَ ظَلَمُوْاۚ-اِنَّهُمْ مُّغْرَقُوْنَ- وَ یَصْنَعُ الْفُلْكَوَ كُلَّمَا مَرَّ عَلَیْهِ مَلَاٌ مِّنْ قَوْمِهٖ سَخِرُوْا مِنْهُؕ-قَالَ اِنْ تَسْخَرُوْا مِنَّا فَاِنَّا نَسْخَرُ مِنْكُمْ كَمَا تَسْخَرُوْنَؕ
আর আপনি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশ মোতাবেক একটি নৌকা তৈরী করুন এবং পাপিষ্ঠদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলবেন না। অবশ্যই তারা ডুবে মরবে। তিনি নৌকা তৈরী করতে লাগলেন, আর তাঁর কওমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন পার্শ্ব দিয়ে যেত, তখন তাঁকে বিদ্রুপ করত। তিনি বলতেন, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, আমরাও তদ্রুপ তোমাদের উপহাস করছি। [হুদ: ৩৭-৩৮] হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম ছিলেন স্থপতি। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَ اِذْ یَرْفَعُ اِبْرٰهٖمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَیْتِ وَ اِسْمٰعِیْلُؕ-رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّاؕ-اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
স্মরণ করুন, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ পরওয়ারদেগার! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। (বাক্বারা-১২৭)
হযরত ইলয়াস আলাইহিস সালাম ছিলেন পোষাক শিল্পে পারদর্শী। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম পশুচারণ করতেন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَى قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَى غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَاٰرِبُ أُخْرٰى
হে মূসা, তোমার ডানহাতে ওটা কি? তিনি বললেনঃ এটা আমার লাঠি, আমি এর উপর ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগলপালের জন্যে বৃক্ষপত্র ঝেড়ে নিই এবং এতে আমার অন্যান্য কাজও চলে। (ত্বাহা: ১৭-১৮)
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ছিলেন চিকিৎসক, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَ رَسُوْلًا اِلٰى بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ ﳔ اَنِّیْ قَدْ جِئْتُكُمْ بِاٰیَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ ﳐ اَنِّیْۤ اَخْلُقُ لَكُمْ مِّنَ الطِّیْنِ كَهَیْــٴَـةِ الطَّیْرِ فَاَنْفُخُ فِیْهِ فَیَكُوْنُ طَیْرًۢا بِاِذْنِ اللّٰهِۚ-وَ اُبْرِئُ الْاَكْمَهَ وَ الْاَبْرَصَ وَ اُحْیِ الْمَوْتٰى بِاِذْنِ اللّٰهِۚ-وَ اُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَاْكُلُوْنَ وَ مَا تَدَّخِرُوْنَۙ-فِیْ بُیُوْتِكُمْؕ-اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَۚ
আর বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।
[আ-ল ইমরান-৪৯] এ আকাশ-বাতাস, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, মাটি-বালি ও তার তলদেশে মহান আল্লাহ তা‘আলা যে সম্পদ সৃষ্টি করে রেখেছেন, তার সদ্ব্যবহারের জন্য শিল্পোন্নয়ন জরুরী। শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ সমৃদ্ধি ছাড়া জাতীয় আয়বৃদ্ধি করা যায় না। শিল্প শিক্ষাকে মহান আল্লাহ নি’মত হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ জন্য শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহর নবীগণ কোন না কোন শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে দাউদ আলাইহিস সালাম বর্ম শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন বলে আভাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রথম জীবনে চাষাবাদ করেছেন। তিনি শষ্য বপন ও কর্তন করতেন। হযরত সোলাইমান আলাইহিস সালামের উঁচু উঁচু প্রাসাদ, বড় বড় পানি সঞ্চয় পাত্র ইত্যাদির বর্ণনা পাওয়া যায়।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مثَلُ الصانِعِ الَّذي يَعملُ ويَحتسبُ في صَنعتِهِ الخيرَ كمَثَلِ أمِّ مُوسَى تُرضِعُ ولدَها وتأْخُذُ أجْرَهَا
“যে কারিগর বা মিস্ত্রি এমন কোন কর্ম সম্পাদন করে যা মানুষের কল্যাণে আসে এবং এর মাধ্যমে নেকী বা সাওয়াব প্রত্যশা করে তার দৃষ্টান্ত হল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জননীর ন্যায়। তিনি নিজের সন্তানকে দুধ পান করিয়েছেন; আবার ফেরাউনের কাছ থেকে পাবিশ্রমিকও পেয়েছেন।( )
এজন্য পেশা ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎ হোক তাতে কিছু আসে যায় না। নিজে পরিশ্রম করে শ্রমলব্দ আয়ে নিজের পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য সংগ্রাম করা অতিশয় সম্মান ও পূণ্যের কাজ।

চাকুরি
জীবিকা অর্জনের আরেকটি অন্যতম উপায় হচ্ছে চাকুরি। চাকুরির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা ইসলামী আইনে বৈধ। তবে তাকে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ সক্ষম হতে হবে। ইসলামে চাকুরি লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে যোগ্যতা অর্জন। যথাযথ যোগ্যতা অর্জন ছাড়া কোনো পদের জন্য আবেদন করা ঠিক নয়।
আমাদের দেশে জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী, ব্যাংক-বীমা, এন.জি.ও. ও ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এসব চাকুরীর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল দর্শন হলো প্রত্যেক চাকুরে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সচ্ছতার সাথে পালন করবে। যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি, অন্যায়ভাবে কাউকে সুযোগ সুবিধা দান, কারো প্রতি জুলুম করা, প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। কেননা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিপরায়ণদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
এছাড়াও কর্তব্যে অবহেলা, অনিয়মানুবর্তিতা ও কার্যে উদাসীনতার দরুন চাকুরীজীবিদের উপার্জন অনেক সময় বৈধতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠ দানের পরিবর্তে টিউশন ও কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশী আত্মনিয়োগ করছে। অনেক ডাক্তার হাসপাতালে রোগী না দেখে ক্লিনিকে জমজমাট ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন, যা কর্তব্যে অবহেলার নামান্তর। তারা যদি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ ও পূর্ণভাবে পালন করার পর অতিরিক্ত সময় এসব কাজ করেন তবে তা দোষের নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের মূলনীতি বর্ণনা করে এরশাদ করেন:
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤول عَنْ رَعِيَّتِهِ، الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ ومَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، قَالَ: وَحَسِبْتُ أَنْ قَدْ قَالَ: وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي مَالِ أَبِيهِ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ- وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। আর (ক্বিয়ামত দিবসে) তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল, তাকে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরসংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোলাম তার মুনিবের ধন-সম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই (ক্বিয়ামত দিবসে) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।( )
অতএব গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পর প্রত্যেক মুমিনের উচিত প্রশাসনিক শক্তির যেন অপব্যবহার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। যারা ইচ্ছাপূর্বক অপব্যবহার করবে, তাদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। পৃথিবীতেও আসতে পারে যেকোনো বিপদাপদ। অসৎ পন্থা অবলম্বন করে অন্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, ধোঁকাবাজির কারণেই তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
مَا مِن عبدٍ يسترعِيهِ اللهُ رعيَّةً، يَمُوتُ يومَ يَموتُ وهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ؛ إلَّا حَرَّمَ اللهُ علَيهِ الجَنَّةَ
‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম জনগণের শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে প্রতারক বা আত্মসাৎকারীরূপে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ ( )
অন্য হাদিসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
ما مِن عَبْدٍ اسْتَرْعاهُ اللهُ رَعِيَّةً، فَلَمْ يَحُطْها
بنَصِيحَةٍ، إلَّا لَمْ يَجِدْ رائِحَةَ الجَنَّةِ.
‘যদি কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ ‘জাতি’র দায়িত্ব অর্পণ করেন; কিন্তু সে তাদের কল্যাণকর নিরাপত্তা বিধান করল না, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না।’ ( )
তাই অধীনস্থের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করা ও তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া প্রশাসকের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ সহনশীলতা ও সহানুভূতি প্রকাশ মানবাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
“يَسِّرَا وَلَا تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلَا تُنَفِّرَا”. وفي رواية: “وَتَطَاوَعَا وَلَا تَخْتَلفَا”
‘লোকদের সঙ্গে সহজ-সরল ব্যবহার করো, কষ্টদায়ক ব্যবহার করো না। তাদের সান্ত্বনা প্রদান করো, ভীতি প্রদর্শন করো না।’ অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা অনুগত হও, বিরোধ কর না ( )
অন্য হাদিসে আছে,
عَنْ أَبِي مُوسَى ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا بَعَثَ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِهِ فِي بَعْضِ أَمْرِهِ، قَالَ: بَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا، وَيَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তাঁর কোনো সাহাবিকে কোনো কাজে পাঠাতেন, তখন তাকে এভাবে উপদেশ দিতেন, ‘তোমরা লোকদের আশার বাণী শোনাবে, নৈরাশ্যজনক কথা বলে তাদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলবে না। তাদের সঙ্গে উদার আচরণ করবে, কঠোর ব্যবহার করবে না।’ ( )
অনুরূপ, হারাম কাজ বা জনগণের ক্ষতিকারক কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এক্ষেত্রে হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَلَا تَسْتَعْمِلُنِي قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِي ثُمَّ قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا
“আমি আরয করলাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবেন না ! একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত মুবারক আমার কাঁধের উপর রেখে বললেন, হে আবু যার! তুমি বড় দুর্বল ব্যক্তি। আর এ পদ হচ্ছে কঠিন আমানতের ব্যাপার। ক্বিয়ামতের দিন তা-ই হবে লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ, তবে যে লোক এ দায়িত্ব পূর্ণযোগ্যতার সাথে গ্রহণ করে এবং দক্ষতা ও সততার সাথে যথাযথভাবে তা পালন করবে তার বেলায় নয়।( ) চাকুরির ক্ষেত্রে ইসলামী আইন হচ্ছে উপযুক্ততা ও পরোপকারিতা। চাকুরিজীবিগণ স্ব স্ব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করবে এবং পরোপকারের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে।

বিদেশ গমন
জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে বিদেশে পাড়ি জমানোর নির্দেশও রয়েছে ইসলামে এবং এটিকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সমপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَ اٰخَرُوْنَ یَضْرِبُوْنَ فِی الْاَرْضِ یَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِۙ- وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ
“আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে দেশভ্রমন করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।” [সূরা মুজাম্মিল-২০] আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন:
أي مسافرين في الأرض يبتغون من فضل الله في المكاسب والمتاجر
“অর্থাৎ যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও রিযিক উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায় পৃথিবীতে ভ্রমনরত।”

হালাল উপার্জনের মূলনীতি
হালাল বলতে আমরা সাধারণত: যাবতীয় বৈধ পন্থাকেই বুঝি। যা কল্যাণকর ও হিতকর এবং যাবতীয় অবৈধ ও অকল্যাণ হতে মুক্ত। ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে উপার্জনের জন্যে উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ পন্থাও বাতলে দিয়েছেন। অতএব হালাল উপার্জন বলতে বুঝায় উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধ ও শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন।
হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক, দিন মজুর, ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের সাথে উর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূর্ণ সর্ম্পক তৈরী হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস।
মূলত: ইসলাম যে সব পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে সেসব পেশ কিংবা পন্থায় উপার্জন ব্যতীত অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে বিবেচিত। ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী শরী‘আত হালাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মূলনীতি রয়েছে। এ নীতিগুলো অনুসরণ না করলে উপার্জন হালাল হবে না। যা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

ক. উপার্জেয় বস্তুটি হালাল হওয়া
এক ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে উপার্জেয় বস্তুটি অবশ্যই হালাল হতে হবে। আর ইসলাম কল্যাণকর সকল বস্তুকে মানবজাতির জন্য হালাল করেছে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِی الْاَرْضِ حَلٰلًا طَیِّبًا ﳲ وَّ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِؕ-اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ
“হে মানুষ পৃথিবীতে হালাল ও পবিত্র যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”[সূরা আল-বাক্বারাহ: ২:১৬৮]

খ. উপার্জেয় বস্তুটি পবিত্র (তাইয়্যিব) হওয়া
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ كُلُوْا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا۪-وَّ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیْۤ اَنْتُمْ بِهٖ مُؤْمِنُوْنَ
“আর আহার কর আল্লাহ যা তোমাদের রিয্ক দিয়েছেন তা থেকে হালাল, পবিত্র বস্তু। আর তাক্বওয়া অবলম্বন কর আল্লাহর যার প্রতি তোমরা ঈমান রাখো।” [সূরা আল-মায়িদাহ: ৫:৮৮] সুতরাং শুধুমাত্র হালাল হলেই চলবে না; বরং তা অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত ইত্যাদি বস্তু উদ্দেশ্য। এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যা মূলগতভাবেই নির্ভেজাল, খাঁটি ও পবিত্র। অবশ্য অধিকাংশ মুফাসসির আয়াতে হালাল শব্দ দ্বারা ‘মূলগত বৈধতা’ এবং ‘তাইয়্যিব’ দ্বারা পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এ দু’শব্দ দিয়ে দু’টি মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

গ. উপার্জনের ক্ষেত্রে মাধ্যমটিও বৈধ হওয়া
শুধুমাত্র উপার্জেয় বস্তটি হালাল ও তাইয়্যিব হলে যথেষ্ট নয়, বরং উপার্জনের মাধ্যমটিও বৈধ হতে হবে। তাই উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও মাধ্যমটিও অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে। কেননা যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুমিনদেরকে সর্তক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।” [সূরা আন-নিসা: ৪:২৯।

ঘ. উপার্জনে কম বা বেশি হওয়াকে পরীক্ষা হিসেবে মনে করা
বেশি বা কম উপার্জন করার মধ্যে আল্লাহ পরীক্ষা করে থাকেন। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে,
فَاَمَّا الْاِنْسَانُ اِذَا مَا ابْتَلٰىهُ رَبُّهٗ فَاَكْرَمَهٗ وَ نَعَّمَهٗ ﳔ فَیَقُوْلُ رَبِّیْۤ اَكْرَمَنِؕ
وَ اَمَّاۤ اِذَا مَا ابْتَلٰىهُ فَقَدَرَ عَلَیْهِ رِزْقَهٗ ﳔ فَیَقُوْلُ رَبِّیْۤ اَهَانَنِۚ
“আর মানুষ তো এমন যে, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’।”[ফজর: ১৫-১৬]

ঙ. উপার্জন আল্লাহর বিধান পালনে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না:
অনেক সময় উপার্জন করতে করতে আল্লাহর কথা স্মরণ থাকে না। আল্লাহর ইবাদাতের কথা ভুলে যায়। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِۚ-وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ
“হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।”[মুনাফিকুন-০৯]

চ. কেবল সম্পদ অর্জনই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় নয়
কেবল সম্পদ অর্জন আল্লাহর নৈকট্য লাভে বাঁধাও হতে পারে, এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে,
وَ مَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ بِالَّتِیْ تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفٰۤى اِلَّا مَنْ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا٘-فَاُولٰٓىٕكَ لَهُمْ جَزَآءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوْا وَ هُمْ فِی الْغُرُفٰتِ اٰمِنُوْنَ
“আর তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন বস্তু নয়, যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে। তবে যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, তারাই তাদের আমলের বিনিময়ে পাবে বহুগুণ প্রতিদান। আর তারা (জান্নাতের) সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।”[সাবা-৩৭]

রিযক দেরীতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করা
রিযক দেরীতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لا تَسْتَبْطِئُوا الرِّزْقَ، فَإِنَّهُ لَنْ يَمُوتَ الْعَبْدُ حَتَّى يَبْلُغَهُ آخِرُ رِزْقٍ هُوَ لَهُ، فَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ أَخَذِ الْحَلالِ، وَتَرَكِ الْحَرَامِ
‘রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করো না। কেননা কোনো বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মারা যায় না যতক্ষণ না তার নির্ধারিত শেষ রিযক তার কাছে পৌঁছে যায়। অতঃপর তোমরা হালাল রিযক সুন্দরভাবে তালাশ করো। হালাল গ্রহণ কর, আর হারাম থেকে বিরত হও।’( )

—০—

হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে যা আবশ্যক

ক. সততা
উপার্জন হালাল করার ক্ষেত্রে সততা থাকতে হবে। উপার্জেয় বস্তু হালাল এবং পদ্ধতিগতভাবে হালাল হলেও সততা না থাকলে উপার্জন হালাল হবে না। আর সততা অর্জন করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার বিরাট সুযোগ রয়েছে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ.
“হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী (ক্বিয়ামতের দিন) নবীগণ, সিদ্দিক্বীন ও শহীদগণের সাথে থাকবে।”( )

খ. আমানতদারি
আমানতদারি এমন একটি গুণ যা হালাল উপার্জন করার জন্য অপরিহার্য। আমানতদারি না থাকলে উপার্জন হালাল হবে না । আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
اِنْ اَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْیُؤَدِّ الَّذِی اؤْتُمِنَ اَمَانَتَهٗ وَ لْیَتَّقِ اللّٰهَ رَبَّهٗؕ-
“আর যদি তোমরা একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে কর, তবে যাকে বিশ্বস্ত মনে করা হয়, সে যেন স্বীয় আমানত আদায় করে এবং নিজ রব আল্লাহকে ভয় করে।”[সূরা আল-বাক্বারাহ: ২:২৮৩।]

গ. ওয়াদা পালন করা
চাকরি বা ব্যবসায় যেসব ওয়াদা করা হবে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। ওয়াদা পালন করে হালাল উপার্জন করার পাশাপাশি আল্লাহর ভালবাসাও পাওয়া যায়। আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
بَلٰى مَنْ اَوْفٰى بِعَهْدِهٖ وَ اتَّقٰى فَاِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الْمُتَّقِیْنَ
“হ্যাঁ, অবশ্যই যে নিজ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন।”[সূরা আলে ‘ইমরান: ৩:৭৬।] তাছাড়া ওয়াদাপূরণ জান্নাতে যাওয়ার কারণ। হযরত উবাদা ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: اضْمَنُوا لِي سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ : اُصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ ، وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ ، وَأَدُّوا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ ، وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ
‘তোমরা আমাকে ছয়টি বিষয়ের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমদেরকে জান্নাতে যাওয়ার যামীন হব, যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন ওয়াদা করবে তা পূরণ করবে, যখন আমানত গ্রহণ করবে তখন তা আদায় করবে, তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, তোমাদের চক্ষুগুলো নীচু করে রাখবে এবং হাতগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখবে’।( )

আন্তরিকতা
উপার্জন হালাল করার জন্য উক্ত কাজে আন্তরিক হতে হবে। কথা ও কাজের গরমিল পাওয়া গেলে হালাল উপার্জন থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। আন্তরিকতার ঘাটতি মুনাফিকের লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یَقُوْلُوْنَ بِاَفْوَاهِهِمْ مَّا لَیْسَ فِیْ قُلُوْبِهِمْؕ-
“তারা তাদের মুখে বলে, যা তাদের অন্তরসমূহে নেই।” [আ-ল ইমরান-১৬৭]

ঙ. স্বচ্ছতা
উপার্জন হালাল করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে, কোনো গোজামিল বা অস্পষ্টতা থাকতে পারবে না । আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ قُوْلُوْا قَوْلًا سَدِیْدًاۙ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।”[আহযাব-৭০] আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
قُلْ اِنْ تُخْفُوْا مَا فِیْ صُدُوْرِكُمْ اَوْ تُبْدُوْهُ یَعْلَمْهُ اللّٰهُؕ-وَ یَعْلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِؕ-وَ اللّٰهُ عَلٰى كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ
“বলুন, ‘তোমরা যদি তোমাদের অন্তরসমূহে যা আছে তা গোপন কর অথবা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা জানেন। আর আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা আছে, তাও তিনি জানেন। আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।”[আ-ল ইমরান-২৯]

চ. শৃঙ্খলা
ব্যক্তির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ থাকতে হবে। এমন বিধি-বিধান যা কুর’আন সুন্নাহ বিরোধী নয় তা মেনে চলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِیْعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ وَ اُولِی الْاَمْرِ مِنْكُمْۚ-
“হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের।” [নিসা-৫৯]

ছ. ইলম অর্জন করা
যেহেতু দেশে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা চালু নেই, সেজন্য ব্যক্তিকে হালাল উপার্জন করার জন্য ইলম অর্জন করতে হবে। কারণ তাকে জানতে হবে কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِیْنَةَ اللّٰهِ الَّتِیْۤ اَخْرَ جَ لِعِبَادِهٖ وَ الطَّیِّبٰتِ مِنَ الرِّزْقِؕ-
“বলুন, ‘কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্যোপকরণ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিয্ক?”[আ’রাফ-৩২]

হারাম উপার্জন সম্পর্কে জানা:
হারাম উপার্জন সম্পর্কে জানা না থাকলে উপার্জনকে শতভাগ হালাল করা যাবে না। সেজন্য কোনটি হারাম উপার্জন তা সম্পর্কেও জানতে হবে । এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ
“অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন।”[সূরা আল-আন‘আম: ১১৯।]

হারাম উপার্জনের প্রকারভেদ
হারাম উপার্জন দু’ভাবে হতে পারে: একটি বস্তুগত হারাম অপরটি হলো পদ্ধতিগত হারাম।

১. বস্তুগত হারাম
কিছু কিছু বস্তু রয়েছে যা মূলগতভাবেই হারাম। এগুলোকে কোনভাবেই হালাল করার সুযোগ নেই। যেমন: মদ, চুরি করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, শুকরের গোশত, মৃত প্রাণির গোশত ইত্যাদি।

২. পদ্ধতিগত হারাম
কিছু কিছু বস্তু রয়েছে যা মূলগত হারাম নয়, পদ্ধতির কারণে হারাম। যেমন সুদ, ঘুষ বা উপরি আয় বা বখশিস বা ওহারংরনষব পড়ংঃ বা ংঢ়ববফ সড়হবু, জুয়া, লটারী, ধোঁকা, প্রতারণা, মওজুদদারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, ফটকাবাজারী, চোরাচালান, চটকদার ভুয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করা, ওযন ও পরিমাপে কম দেয়া, মালে ভেজাল মেশানো, ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, বেশ্যাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি অশীøলতা প্রসারকারী ব্যবসা, অশ্লীল নাচ-গান, মাদক দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবসা, মূর্তি বানানো ও মূর্তির ব্যবসা, ভাগ্য গণনার ব্যবসা, জবরদখল, লুন্ঠন, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, মাস্তানী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, আত্মসাৎ, চোরাইমাল ক্রয়-বিক্রয়, খেয়ানত, ধাপ্পাবাজি, সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ইত্যাদি।

হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে বর্জনীয়

মিথ্যাচার ও প্রতারণা
মিথ্যা এমন একটি খারাপ গুণ যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আর মিথ্যা কথা বলে যে উপার্জন করা হবে তা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ،
وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ
“আর তোমরা মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা নিয়ে যায় পাপ কাজের দিকে, আর পাপকাজ জাহান্নামে নিক্ষেপ করে”।( )

লোভ-লালসা
সম্পদ অর্জনে অবশ্যই লোভ-লালসাকে বর্জন করতে হবে। লোভ-লালসা মানুষকে হালাল-হারাম পার্থক্য করতে দেয় না ফলে তা লোভী মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। এ থেকে বিরত থাকার জন্য আলকুরআনে বিশেষভাবে তাকীদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
اَلْهٰىكُمُ التَّكَاثُرُۙ حَتّٰى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَؕ
كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَۙ ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَؕ
“প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাক্ষাৎ করবে। কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানবে”। [ সূরা আল-তাকাছুর: ১-৩।]

যুলুম করা:
ইসলামে যে কোনো ধরণের যুলুম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা যুলুমের ভয়াবহ পরিণাম রয়েছে। সেজন্য তা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا: الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ، فَقَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ، فَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا، فَيَقْعُدُ، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ، فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
তোমরা কি জান কপর্দকহীন কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো কপর্দকহীন। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো কপর্দকহীন, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমলনামা দিয়ে দেওয়া হবে, অতপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ( )

অপচয় ও অপব্যয় করা
ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ অর্জন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যে কোন ধরণের অপচয় ও অপব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ اٰتِ ذَا الْقُرْبٰى حَقَّهٗ وَ الْمِسْكِیْنَ وَ ابْنَ السَّبِیْلِ وَ لَا تُبَذِّرْ تَبْذِیْرًا اِنَّ الْمُبَذِّرِیْنَ كَانُوْۤا اِخْوَانَ الشَّیٰطِیْنِؕ-وَ كَانَ الشَّیْطٰنُ لِرَبِّهٖ كَفُوْرًا
“আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ”।[ সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬-২৭।] আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ خُذُوْا زِیْنَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَّ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا وَ لَا تُسْرِفُوْا ۚ-اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الْمُسْرِفِیْنَ۠
“হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের শোভনীয় বেশ-ভূষা গ্রহণ কর এবং খাও, পান কর, আর অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।”[সুরা আল-আরাফ: ৩১।]

খেয়ানত করা
খেয়ানতের মাধ্যমে যে উপার্জন করা হয় তা অবৈধ। তাই সকল প্রকার খেয়ানত থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ
অর্থ: “নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল এবং তোমাদের সম্মান নষ্ট করা তোমাদের জন্য হারাম”।( )

সুদের সম্পৃক্ততা থাকা
সুদ দেওয়া, নেওয়া বা এর সাথে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা রাখা যাবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖۚ-وَ اِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ اَمْوَالِكُمْۚ-لَا تَظْلِمُوْنَ وَ لَا تُظْلَمُوْنَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরাও যুলুম করবে না এবং তোমাদের উপরও যুলুম করা হবে না।”[আল-বাক্বারাহ: ২:২৭৮-২৭৯।]

ঘুষের সম্পৃক্ততা
ঘুষ দেওয়া, নেওয়া বা এর সাথে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা রাখার কোনো সুযোগ নেই। হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- الرَّاشِىَ وَالْمُرْتَشِىَ
“আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহণকারী উভয়কে লানত দিয়েছেন”।( )

মদ এবং নেশা জাতীয় দ্রব্য সম্পৃক্ততা
মদ এবং যে সকল নেশা জাতীয় দ্রব্য যা পান বা সেবন করা হারাম তার উৎপাদন ও ব্যবসা ইসলাম সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে। এ জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন ও তার ব্যবসালব্ধ আয় অবৈধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَ الْمَیْسِرُ وَ الْاَنْصَابُ وَ الْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ اِنَّمَا یُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّوْقِعَ بَیْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَ الْبَغْضَآءَ فِی الْخَمْرِ وَ الْمَیْسِرِ وَ یَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَ عَنِ الصَّلٰوةِۚ-فَهَلْ اَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ
হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-দেবী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো অপবিত্র শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব তোমরা কি বিরত হবে না?” [সূরা মায়েদা: ৯০-৯১] —০—

হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিকসমূহ

আল্লাহর নির্দেশ অবজ্ঞা করার শামিল
আল্লাহ তা‘আলা কোনটি হালাল ও কোনটি হারাম তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে হারাম পথ বেছে নেবে সে আল্লাহর নির্দেশকে অবজ্ঞা করলো এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলো। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল উপায় অবলম্বন করতে হবে। যারা হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না, তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন,
يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ
مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ
“মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোনো ভ্রমনক্ষেপ করবে না।’( )

জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
হারাম উপার্জন জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
كُلُّ جَسَدٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِه
“আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম” (নিকটে)।( )

জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক
হারাম উপার্জন জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
يا كعب بن عجرة إِنَّهُ لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ
“হে কা‘ব ইবন উজরাহ, যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তা জান্নাতে যাবে না”।( )

হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ গ্রহণ করেন না
হারাম উপার্জন এতই ঘৃণ্য যে, যা থেকে দান করলেও কোনো লাভ নেই এবং আল্লাহ তা‘আলা তা গ্রহণ করেন না। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لاَ يَقْبَلُ اللهُ صَلاَةً بِغَيْرِ طَهُورٍ وَلاَ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ
“আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের দানও আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না।”( )
এ ছাড়া হারাম উপার্জনের অনেকগুলো ক্ষতিকর দিক রয়েছে: যেমন,
১. হারাম খাদ্য খেলে মনের মধ্যে খারাপ অভ্যাস সৃষ্টি হয়, ইবাদত-বন্দেগীতে আগ্রহ স্তিমিত হয়ে আসে এবং দো‘আ কবুল হয় না।
২. অন্যদিকে হালাল খাদ্য গ্রহণের ফলে মানব মনে এক প্রকার আলো সৃষ্টি হয়, যা অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করে এবং সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে, ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগ আসে, পাপের কাজে ভয় আসে এবং দো‘আ কবুল হয়। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحاً
‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর’ (মুমিন ৫১)।

হালাল খাদ্য গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহ বান্দার কোন দো‘আ কবুল করবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ فَقَالَ (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ) وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ) ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ-
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি একমাত্র পবিত্র বস্তুকেই কবুল করেন। আল্লাহ রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন, মুমিনগণকেও সে আদেশ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল পবিত্র খাদ্য ভক্ষণ কর এবং সৎ আমল কর’। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার দেওয়া হালাল পবিত্র রিযিক হ’তে খাও’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেন, ‘কোন ব্যক্তি দূর-দূরান্তে সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলা-বালি লেগে আছে। এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তি উভয় হাত আসমানের দিকে তুলে কাতর স্বরে হে প্রভু! হে প্রভু! বলে ডাকছে। অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারামই খেয়ে থাকে। এই ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হবে’? ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلَ الرَّجُلُ مِنْ كَسْبِهِ وَإِنَّ وَلَدَهُ مِنْ كَسْبِهِ
আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘নিজের উপার্জিত আহার সর্বোত্তম। তোমাদের সন্তানও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
وَعَنْ أَبِيْ بَكْرِ نِالصِّدِّيْقِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ
হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘ঐ শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না যা হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত হয়েছে’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
وعن سعيد بن عمير عن عمه قَالَ سُئِلَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْكَسْبِ أَطْيَبُ قَالَ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ وَكُلُّ كَسْبٍ مَبْرُوْر
হযরত সাঈদ ইবনু উমায়ের তার চাচা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হ’ল কোন প্রকার উপার্জন উত্তম। তিনি বললেন, ‘হাতের কাজ এবং হালাল ব্যবসার উপার্জন’।( )
ইসলামী দিকনির্দেশনা মোতাবেক হালাল পথে রূযী রোযগার করলে সেটিও ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়, আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’। [জুম‘আ ১০] পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানুষকে পাঠানো হয়েছে। বান্দার পার্থিব জীবনের সমস্ত কৃতকর্মের হিসাব পরকালে দিতে হবে। ‘ক্বিয়ামতের ময়দানে বনু আদমকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, সেই পাঁচটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ অর্ধ হাত পরিমাণও সামনে অগ্রসর হ’তে পারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِه فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِه فِيمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهٗ وَفِيمَ أَنْفَقَهٗ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ
“কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়েএক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না।
১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে
২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে
৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে
৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে
৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।”( )
রূযী হালাল পথে উপার্জিত না হ’লে ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দিনে মুক্তির পথ খোলা থাকবে না। কাজেই শরী‘আত নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে রূযী-রোযগার করতে হবে। অলসতা ও কুড়েমী করে বসে থাকা যাবে না। চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী-বাকুরী ইত্যাদির কোনটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। কোন কাজকে অবহে’লা না করে সাধ্যানুযায়ী যে কোন হালাল পেশা বেছে নিতে হবে।
নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য খেতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ وَإِنَّ نَبِيَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَم كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ.
‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য অপেক্ষা উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য খেতেন’।( )
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ مِنَّا فَضْلاً يَا جِبَالُ أَوِّبِي مَعَهُ وَالطَّيْرَ وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيدَ، أَنِ اعْمَلْ سَابِغَاتٍ وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِير-
‘আর আমি দাঊদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি এই মর্মে যে, ‘হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর, হে পক্ষীকুল! তোমরাও তাই কর। আমি তার জন্য লৌহকে নরম করে দিয়েছি এবং তাকে বলেছি, প্রশস্ত বর্ম তৈরি কর, কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর এবং সৎকর্ম সম্পাদন কর। তোমরা যা কিছু কর, আমি তা দেখি। [সাবা ১০-১১]

—০—

হারাম উপার্জন থেকে তাওবাহ

আমাদের উপার্জনের মধ্যে জেনে বা না জেনে অনেক সময় হারাম উপার্জন হয়ে থাকতে পারে। এমতাবস্থায় আমরা তাওবা করার মাধ্যমে পরিত্রাণ পেতে পারি। কেননা আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا تُوْبُوْۤا اِلَى اللّٰهِ تَوْبَةً نَّصُوْحًاؕ-عَسٰى رَبُّكُمْ اَنْ یُّكَفِّرَ عَنْكُمْ سَیِّاٰتِكُمْ وَ یُدْخِلَكُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُۙ-
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা, আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।”
[আত তাহরীম-৮]

ক. হারাম উপার্জন করার জন্য অনুতপ্ত হওয়া
নিজের উপার্জনের মধ্যে হারাম কোনো কিছু থাকলে তার জন্য অনুতপ্ত হতে হবে এবং অনুশোচনা করতে হবে। হারাম উপার্জন করার পর নিজের মনের মধ্যে ব্যাকুলতা অনুভব করবে, এজন্য নিজেকে হীন মনে করবে । এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
اِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللّٰهِ لِلَّذِیْنَ یَعْمَلُوْنَ السُّوْٓءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ یَتُوْبُوْنَ مِنْ
قَرِیْبٍ فَاُولٰٓىٕكَ یَتُوْبُ اللّٰهُ عَلَیْهِمْؕ-وَ كَانَ اللّٰهُ عَلِیْمًا حَكِیْمًا
“নিশ্চয় তাওবা কবুল করা আল্লাহর বদান্যতার জিম্মায় তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে। তারপর শীঘ্রই তাওবাহ করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবা কবুল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।”[নিসা-১৭]

খ. হারাম উপার্জন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
হারাম উপার্জনরত অবস্থায় তাওবা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যে কোনো ধরণের হারাম উপার্জন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللّٰهَ فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ۫- وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللّٰهُ ﳑ وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰى مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ۱
“যারা অশ্লীল কাজ করার পর অথবা নিজেদের প্রতি যুলুম করার পর আল্লাহকে স্মরণ করে এরপর নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ ব্যতীত গুনাহসমূহ ক্ষমা করতে কেউ সক্ষম নয় এবং তারা জেনে-শুনে নিজেদের কৃতকর্মের উপর অটল থাকে না ”[আ-ল ইমরান-১৩৫]

গ. হালাল উপার্জন ও হারাম উপার্জনকে পৃথক করা
বুঝা বা উপলব্ধির সাথে সাথে হালাল উপার্জন ও হারাম উপার্জনকে পৃথক করে ফেলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
قُلْ لَّا یَسْتَوِی الْخَبِیْثُ وَ الطَّیِّبُ وَ لَوْ اَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِیْثِۚ-فَاتَّقُوا اللّٰهَ یٰۤاُولِی الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ۠
“বল, ‘অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের আধিক্য তোমাকে মুগ্ধ করে। অতএব হে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। যাতে তোমরা সফলকাম হও।”[মা-ইদা-১০০]

ঘ. অর্জিত হারাম উপার্জন সাওয়াবের আশা না করে শুধু দায়মুক্তির জন্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা
হারাম পথে উপার্জন করা ধন-সম্পদ নিজের কাছে গচ্ছিত রাখার সুযোগ নেই। বরং তা সাওয়াবের আশা না করে কেবল দায়মুক্তির আশায় জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে ফেলতে হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَ مِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ۪-وَ لَا تَیَمَّمُوا الْخَبِیْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَ لَسْتُمْ بِاٰخِذِیْهِ اِلَّاۤ اَنْ تُغْمِضُوْا فِیْهِؕ-وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ حَمِیْدٌ
“হে মুমিনগণ, তোমরা ব্যয় কর উত্তম বস্তু, তোমরা যা অর্জন করেছ এবং আমি যমীন থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে এবং নিকৃষ্ট বস্তুর ইচ্ছা করো না যে, তা থেকে তোমরা ব্যয় করবে। অথচ চোখ বন্ধ করা ছাড়া যা তোমরা গ্রহণ করো না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত”।[বাক্বারা-২৬৭]

ঙ. কারও হক নষ্ট হলে বা খেয়ে ফেললে তা দ্রুত ফেরত দেওয়া
কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান, কোম্পানীর কোনো হক নষ্ট করলে বা মাল হারাম পন্থায় ভোগ করলে তা দ্রুত ফেরত দিতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينِه فَقَدْ أَوْجَبَ اللهُ لَهُ النَّارَ وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ. فَقَالَ لَهٗ رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيرًا يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ.
“যে ব্যক্তি তার নিজ হাতে কোনো মুসলিমের হক খেয়ে ফেলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন। জান্নাত হারাম করে দেন। একজন লোক প্রশ্ন করলো, যদি তা সামান্য বস্তু হয়। তখন তিনি বললেন, দেখতে যদি তা আরাক গাছের ডাল পরিমাণও হয়।”( )

চ. মাফ চেয়ে নেওয়া
কারো কোনো মাল খেয়ে ফেলার পর যদি তা ফেরত দেওয়ার সামর্থ না থাকে, তবে সে মাফ চেয়ে নিবে। হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ، أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ، وَلاَ دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ
‘যদি কেউ তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করে থাকে, হোক তা মান-ইজ্জত অথবা সম্পদ বিষয়ক, সে যেন আজই তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যখন কোনো টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। সে দিন যদি তার নেক আমল থেকে থাকে তবে যুলুম পরিমাণ নেক আমল তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাযলুম ব্যক্তির গুনাহ নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে’।( )

ছ. বেশি বেশি সদকাহ বা ভাল কাজ করা:
বেশি বেশি সদকাহ বা ভাল কাজ করার মাধ্যমে পরিত্রাণ পাবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা সওয়াবের কাজের মাধ্যমে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
إِنَّ الۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ السَّيِّ‍اتِ
“নিশ্চয়ই ভাল কাজ মন্দ কাজকে মিটিয়ে দেয়।”[হুদ-১১৪]

আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা:
আল্লাহ তা‘আলা চান তার বান্দারা আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করুক। আর কোনো বান্দাহ অন্যায় করার পর তার নিকট ক্ষমা চাইলে তা ক্ষমা করে দেন। সেজন্য বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَ مَنْ یَّعْمَلْ سُوْٓءًا اَوْ یَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ یَسْتَغْفِرِ اللّٰهَ یَجِدِ اللّٰهَ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا
“আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [নিসা-১১০] উপরোক্ত আলোচনা থেকে সাব্যস্ত হলো যে, আমাদেরকে হালাল উপার্জনের জন্য উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। উপার্জন করার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনোভাবেই হারাম উপার্জনের দিকে আমরা না যাই এবং যাবতীয় হারাম উপার্জনের পথ থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমনিভাবে সতর্ক থাকতেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু। একদা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এক চাকর তাঁকে কিছু খাবার দিল। খাওয়া শেষ হলে তিনি দাসকে জিজ্ঞেস করলেন,
فمن أين الطعامُ يا غلام؟ قال: دَفعه إليَّ أناسٌ كنتُ أحسنتُ إليهم في الجاهلية بكهانةٍ صنعتُها لهم، وهنا ارتعدتْ فرائصُ الصديق، وأدخلَ يده في فمه، وقاء كلَّ ما في بطنهِ وقال: “واللهِ لو لم تخرجْ تلك اللقمة إلا مع نفسي لأخرجتها
“এটা কোথা থেকে এসেছে? এ প্রশ্নের জবাবে সে বলল, আমি জাহিলী যুগে এক ব্যক্তির ভাগ্য গণনা করেছি। অথচ আমি ভাগ্য গণনায় পারদর্শী নই। আমি লোকটিকে ধোঁকা দিয়েছি। আর সে আমাকে এটা দিয়েছে। আর তা আপনি এইমাত্র খেলেন। এ কথা শুনে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ মুখে হাত ঢুকিয়ে বমি করে দিলেন। পেটে যা ছিল সব বের করে দিলেন। অত:পর বললেন, আল্লাহর শপথ, ‘যদি তা বের করতে গিয়ে আমার জীবন দিতে হতো তবে আমি তাই করতাম’ ।”( )
পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃত মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে হলে হালাল রূযী উপার্জনের কোন বিকল্প নেই। হালাল পথে উপার্জিত রূযী ভক্ষণে মানুষের স্বভাব-চরিত্র সুন্দর হয়, সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিকাশ ঘটে এবং সত্যানুরাগী হ’তে সতায়তা করে। অন্যদিকে হারাম রূযী মানুষের দেহ-মনের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে, নৈতিক অধঃপতনের প্রেরণা যোগায় এবং বিপথগামী হ’তে সহায়তা করে।

—০—

হালাল উপার্জন ইবাদত ক্ববূল হবার পূর্বশর্ত
অর্থ-সম্পদ দ্বারাই মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তার দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ হয়। কিন্তু এ উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জিত হয় তবে তা কিভাবে বৈধ শারিরিক বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে তার শরীরের রক্তে ও মাংসে অবৈধ বিষয়ের সংমিশ্রন ঘটে। আর এটা দ্বারা যত ইবাদতই করা হোক না তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ অপবিত্র কোন কিছুই গ্রহণ করেন না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদত ক্ববূল হবার পূর্বশর্ত হিসেবে শিরোধার্য। সালাত, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয ইবাদতসমূহ ক্ববূল হওয়ার জন্য অবশ্যই বৈধ পন্থায় উপার্জন করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা এ পৃথিবীতে মানবজাতিকে কেবল তার ইবাদতের জন্যই পাঠিয়েছেন। এ ইবাদতের পরিধি মানব জীবনের সূচনা থেকে অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানব জীবনের সকল পর্যায়ে বিস্তৃত। যদি তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে ও মতে হয়।
ইবাদতের জন্য মানবদেহে শক্তি প্রয়োজন আর শক্তির প্রধান উৎস হলো খাদ্য। কথায় আছে ‘পেটে থাকলে পিঠে সয়’ এ খাদ্য সংগ্রহের জন্যই মানবজাতি উপার্জনে সদা বেতিব্যস্ত। ইসলামও উপার্জন ও পরিশ্রম করার নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ وَ اذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
“অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।”[সূরা আল-জুমু‘আ: ১০]

আল্লাহর ইবাদত করবে অথচ তার উপার্জন হালাল হবে না, এটা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদত ক্ববূল হবার পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ.
হে মানবগণ! পৃথিবীর মধ্যে যা বৈধ-পবিত্র, তা হতে ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (বাক্বারাহ ২/১৬৮)।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقْنٰكُمْ وَ اشْكُرُوْا لِلّٰهِ اِنْ كُنْتُمْ اِیَّاهُ تَعْبُدُوْنَ
হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা জীবিকা স্বরূপ দান করেছি তা হতে পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর যদি তোমরা তারই ইবাদত করে থাকো। (বাক্বারাহ ২/১৭২)।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু হ’তে আহার করুন ও সৎকর্ম করুন; আপনারা যা করেন সে সম্বন্ধে আমি অবগত (মুমিনূন ৫১)।
প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
قَالَ سَهْلُ بْنُ عَبْدِ اللهِ: النَّجَاةُ فِي ثَلَاثَةٍ: أَكْلُ الْحَلَالِ، وَأَدَاءُ الْفَرَائِضِ، وَالِاقْتِدَاءُ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- ১. হালাল খাওয়া ২. ফরয আদায় করা এবং ৩. রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতগুলোর আনুগত্য বা অনুসরণ করা। ( )
عن ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنه قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: “لاَ يَقْبَلُ الله صَلاَةً بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلاَ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ”
“পবিত্রতা ছাড়া কোন সালাত কবুল হয় না, আর ফাঁকি, ধোঁকা ও অবৈধ সম্পদের কোন দান কবুল হয় না”। ( )
হালাল খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের নামায, রোযা, হজ, যাকাত, দান-খয়রাত, লেনদেনসহ যাবতীয় নেক আমল কবুল হওয়ার সমূহ আশা বিদ্যমান এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার প্রবল আশঙ্কাই রয়েছে। এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ [المؤمنون: ৫১] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: ১৭২] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মু’মিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছেন রাসূলগণকে।” আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “হে ইমানদারগণ তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, হে আমার রব, হে আমার রব অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করেছে। সুতরাং তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে?।”( )
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ.
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মানুষের সম্মুখে এমন এক যুগ আসবে যে, কেউ পরওয়া করবে না কি উপায়ে সম্পদ লাভ করল; হারাম না হালাল উপায়ে।( )
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْحَلَالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبْهَاتِ استبرَأَ لدِينهِ وعِرْضِهِ ومَنْ وقَعَ فِي الشبُّهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللهِ مَحَارِمُهُ أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُله أَلا وَهِيَ الْقَلْبُ.
হযরত নু‘মান ইবনু বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “হালাল বা বৈধ সুস্পষ্ট এবং হারাম বা অবৈধও সুস্পষ্ট, আর এ দু’ এর মধ্যবর্তী বিষয়গুলো হলো সন্দেহজনক। আর বেশীরভাগ লোকই সেগুলো (সম্পর্কে সঠিক পরিচয় জানে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সন্দেহজনক জিনিসিগুলোকে পরিহার করলো সে তার দ্বীন ও মান-সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দেহের মাঝে পতিত হলো তার উদাহরণ ঐ রাখালের মত যে পশু চরায় সংরক্ষিত ভুমির সীমানায় এমনভাবে যে, যে কোনো সময় সে তাতে প্রবেশ করবে।”( )
তোমরা জেন রেখো, প্রত্যেক বাদশারই নিজ নিজ নিষিদ্ধ এলাকা রয়েছে । আর আল্লাহ তাআলার নিষিদ্ধ এলাকা হল হারামসমূহ। ‘মনে রেখো মানুষের দেহে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে, যা সঠিক থাকলে সমস্ত দেহই সঠিক থাকে। আর সেই অংশের বিকৃতি ঘটলে সম্পূর্ণ দেহেরই বিকৃতি ঘটে। সেই গোশতের টুকরাটি হল ক্বলব্’ ( )
وَعَنْ رَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَمَنُ الْكَلْبِ خَبِيثٌ وَمَهْرُ الْبَغِيِّ خَبِيثٌ وَكَسْبُ الْحَجَّامِ خَبِيثٌ.
হযরত রাফে‘ ইবনু খাদীজ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, কুকুর বিক্রয়লব্ধ মুল্য ঘৃণিত বস্তু, ব্যভিচারের বিনিময় অর্জিত অর্থও ঘৃণিত, হাজামত বা রক্তমোক্ষণ পেশায় অর্জিত অর্থও ঘৃণিত ( )।
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَنْ ثَمَنِ الْكَلْبِ وَمَهْرِ الْبَغِيِّ وَحُلْوَانِ الْكَاهِنِ.
হযরত আবূ মাসঊদ আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘কুকুরের মূল্য, যিনাকারীনীর উপার্জন ও গণকের উপার্জন থেকে নিষেধ করেছেন’ ( )।
وَعَن أَبِيْ حُجَيْفَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيِّ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَنْ ثَمَنِ الدَّمِ وَثَمَنِ الْكَلْبِ وَكَسْبِ الْبَغِيِّ وَلَعَنَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَالْوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ وَالْمُصَوِّرَ.
হযরত আবু হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, রক্তমোক্ষণ কার্যের বিনিময় হতে, কুকুর বিক্রয়ের মূল্য হতে, ব্যভিচার বা যেনার বিনিময় হতে এবং তিনি লা‘নাত করেছেন সুদ গ্রহীতার প্রতি ও সুদদাতার প্রতি। তিনি আরও লা‘নত করেছেন ঐ ব্যক্তির প্রতি যে দেহের কোন অংশ (নাম বা চিত্র ইত্যাদি) উলকী করে এবং যে উলকী করায়। এতদ্ভিন্ন ছবি অংকনকারীর প্রতিও লা‘নত করেছেন ( ) ।
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نبَتَ منَ السُّحْتِ وكلُّ لحمٍ نبَتَ منَ السُّحْتِ كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ.
হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন( )।
عَنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: حَفِظْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيبُكَ فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِينَةٌ وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ.
হযরত হাসান ইবনু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীটি আমি ভালভাবে স্মরণ রেখেছি যে, যে কাজে মনে খটকা লাগে, সে কাজ পরিহার করে খটকাহীন কাজ অবলম্বন কর। সত্য ও শুদ্ধের ক্ষেত্রে দ্বিধার সৃষ্টি হয় না, মিথ্যা ও অশুদ্ধের ক্ষেত্রেই দ্বিধার সৃষ্টি হয়( )
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَا تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ وَلَا تَشْتَرُوهُنَّ وَلَا تُعَلِّمُوهُنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ وَفِي مِثْلِ هَذَا نَزَلَتْ (وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لهْوَ الحَديثِ(.
হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা গায়িকা ক্রয়-বিক্রয় করিও না, তার মূল্য হারাম। তাদেরকে গান শিক্ষাও দিও না। এই শ্রেণীর কার্য যারা করে তাদের সম্পর্কেই পবিত্র কুরআনের এ আয়াত অবর্তীণ হয়েছে, ‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা রং-তামাশার গাঁথা (তথা গান) ক্রয় করে (তাদের জন্য লাঞ্ছনাময় শাস্তি রয়েছে)’( )
عنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلاَمٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلاَمُ أَتَدْرِي مَا هَذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ إِلاَّ أَنِّي خَدَعْتُهُ فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذَلِكَ فَهَذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنِهِ.
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, হযরত আবূ বাকর ছিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহুর একজন গোলাম ছিল। তিনি তার জন্য রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি তার রাজস্ব হতে খেতেন। একদিন সে কিছু সম্পদ নিয়ে আসে এবং তিনি সেখান হতে কিছু খান। তখন গোলাম তাঁকে বলল, আপনি এ খাদ্য সম্পর্কে কি জানেন? তিনি বললেন এ কেমন খাদ্য? গোলাম বলল, আমি জাহেলী যুগে গণনা করতাম। আমি মানুষকে ধোঁকা দিতাম। ঐ সময়ের এক লোকের সাথে দেখা হলে সে আমাকে এ খাদ্য প্রদান করে। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আবু বাকর ছিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে সব বমি করে দিলেন’ ( )।
عَنْ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بالحرَامِ.
হযরত আবূ বাকর ছিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে দেহ হারাম দ্বারা প্রতিপালিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ( )
عَنْ أَنَسٍ قَالَ مَرَّ النَّبِيُّ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِتَمْرَةٍ فِي الطَّرِيقِ فَقَالَ لَوْلَا أَنِّي أَخَافُ أَنْ تَكُونَ مِنَ الصَّدَقَةِ لَأَكَلْتُهَا.
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাস্তায় পড়া একটি খেজুরের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন ছাদাক্বার খেজুর বলে যদি আমার সন্দেহ না হত, নিশ্চয় আমি তা খেয়ে নিতাম।( )।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ أَخَذَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ فَجَعَلَهَا فِي فِيهِ فَقَالَ النَّبِيُّ النَّبِيُّ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَخْ كَخْ لِيَطْرَحَهَا ثُمَّ قَالَ أَمَا شَعَرْتَ أَنَّا لَا نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ؟
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র) হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যাকাতের একটি খেজুর নিয়ে মুখে দিলেন (এটা দেখে) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কাখ, কাখ. যাতে তা সে ফেলে দেয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি জাননা যে আমরা (নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পবিত্র বংশধর) সাদকা খাইনা? কেননা সদকা হল মালের ময়লা আর আলে বায়তে রাসূলগণ হলেন পবিত্র( )
হাদীসের ভাস্য অনুযায়ী অবৈধ উপার্জনকারীর সকল কর্ম, সকল প্রার্থনা অর্থহীন হবার পাশাপাশি তার অবৈধ উপার্জনের জন্য আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি।
عَنْ أَبي أُمامةَ إِياسِ بْنِ ثَعْلبَةَ الحَارِثِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهَ: أَنَّ رسُول اللَّه النَّبِيُّ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قالَ: مَنِ اقْتَطعَ حَقَّ امرئٍ مُسْلِمٍ بِيمِينِهِ فَقَدْ أَوْجَب اللَّه لَهُ النَّارَ، وحرَّم عَلَيْهِ الْجنَّةَ، فَقالَ لَهُ رَجُلٌ: وإِنْ كَانَ شَيْئًا يسِيرًا يَا رسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: وَإِنْ كَانَ قَضِيبًا مِنْ أَراكٍ رواهُ مُسْلِمٌ.
হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি অবৈধভাবে কোন মুসলিমের কোন সম্পদ আত্মসাৎ করবে তার জন্য আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম নিশ্চিত করে দিবেন এবং তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করা হবে”। এক ব্যক্তি আরয করলোঃ হে আল্লাহর রাসূল, যদি সামান্য কোন জিনিস অবৈধভাবে গ্রহণ করে? তিনি উত্তরে বলেনঃ যদি ‘আরাক’ গাছের একটুকরো খন্ডিত ডালও কেউ অবৈধভাবে গ্রহণ করে তাহলে তারও এই শাস্তি ( )
যুহদ বা দুনিয়াবিরাগ মুমিনের একটি বড় গুণ। আর সবচে বড় যুহদ হলো হারাম পরিত্যাগ করা। হারাম থেকে দূরে থাকা। যে ব্যক্তি হারাম খায়। হারাম লেনদেন করে। মানুষকে যুলম করে তার কোনো তাকওয়াও নেই, যুহদও নেই।
مَنْ كَانَتْ يَعْنِي عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ فِي مَالِهِ أَوْ عِرْضِهِ، فَلْيَأْتِهِ فَلْيَسْتَحِلَّهَا مِنْهُ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ أَوْ تُؤْخَذَ، وَلَيْسَ عِنْدَهُ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ، فَإِنْ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ حَسَنَاتِهِ فَأُعْطِيَهَا هَذَا، وَإِلَّا أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ هَذَا فَأُلْقِيَ عَلَيْهِ
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যদি কেউ তার ভাইয়ের ওপর যুলম করে থাকে, হোক তা মান-ইজ্জত অথবা সম্পদ বিষয়ক, সে যেন আজই তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যখন কোনো টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। সেদিন যদি তার নেক আমল থেকে থাকে তবে যুলম পরিমাণ নেক আমল তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাযলুম ব্যক্তির গুনাহ নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে (আহমদ, সহীহ)।

হালাল উপার্জন দোআ কবুলের পূর্বশর্ত
দোআ’ শব্দের অর্থ প্রার্থনা করা, আহ্বান করা, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করা ইত্যাদি। দোআ’ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার কথোপকথনের প্রধান মাধ্যম। ইসলামে দোআ’ কে একটি স্বতন্ত্র ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে যারাই আল্লাহর প্রিয় হয়েছেন তাঁরা সকলে দোআ’ কে মূল হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দোআ’র মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের পার্থিব ও পরকালীন সফলতা মূল চাবিকাঠি ।
মানুষের প্রাত্যহিক ও জাগতিক জীবনে চাহিদার কোন অন্ত নেই। তবে এগুলো মানুষের কাঙ্খিত ও বাঞ্চিত হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ পাকের দয়া ও অনুগ্রহই হল মূল ও আসল । তাই এ জন্য প্রয়োজন একান্তে তাঁর দরবারে দো‘আ ও ফরিয়াদ করা। আর মহান আল্লাহও মানুষের ডাকে সাড়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোআকে অন্যতম ইবাদত হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ( )
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত হতে বিমুখ তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে। (আল-মুমিন: ৬০)
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রالدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُগ্ধ ثُمَّ قَرَأَ: ﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِىْ أَسْتَجِبْ لَكُمْ﴾
হযরত নু‘মান ইবনু বাশীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ দু‘আই (মূল) ‘ইবাদাত। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “এবং তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমার নিকট দু‘আ করো, আমি তোমাদের দু‘আ কবূল করব।” ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেন:
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রالدُّعَاءُ مُخُّ الْعِبَادَةِগ্ধ.
“হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ দু‘আ হলো ‘ইবাদাতের মগজ বা সারাংশ।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেন:
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রلَيْسَ شَىْءٌ أَكْرَمَ عَلَى اللّٰهِ مِنَ الدُّعَاءِগ্ধ.
“হযরত আবূ হুরায়রাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ আল্লাহর নিকট দু‘আর চেয়ে কোন জিনিসের অধিক মর্যাদা (উত্তম) নেই। ( )
وَعَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِىِّ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রلَا يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلَّا الدُّعَاءُ وَلَا يَزِيدُ فِى الْعُمْرِ إِلَّا الْبِرُّগ্ধ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ
সালমান আল ফারিসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ দু‘আ ছাড়া অন্য কিছুই তাকদীদের লিখনকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং নেক ‘আমাল ছাড়া অন্য কিছু বয়স বাড়াতে পারে না। ( )
وَعَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ الدُّعَاءَ يَنْفَعُ مِمَّا نَزَلَ وَمِمَّا لَمْ يَنْزِلْ فَعَلَيْكُمْ عِبَادَ اللّٰهِ بِالدُّعَاءِগ্ধ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَرَوَاهُ أَحْمَدُ عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ. وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে দো‘আ ঐ সব কিছুর জন্যই কল্যাণকামী যা সংঘটিত হয়েছে এবং যা এখনো সংঘটিত হয়নি । সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা দু‘আ করাকে নিজের প্রতি খুবই জরুরী মনে করবে বা যতœবান হবে। ))
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمَنْ لَمْ يَسْأَلِ اللّٰهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِগ্ধ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ
আবূ হুরায়রাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কামনা (দু‘আ) করে না, আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হন। ( )
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمَا مِنْ أَحَدٍ يَدْعُوْ بِدُعَاءٍ إِلَّا اٰتَاهُ اللّٰهُ مَا سَأَلَ أَوْ كَفَّ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَه مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رِحْمٍগ্ধ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ
জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ যে কোন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোন দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার হয়ত সে দু‘আ কবূল করেন অথবা এরূপ কোন বিপদকে তার ওপর থেকে দূরে সরিয়ে দেন, যদি সে কোন গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদের জন্য দু‘আ না করে। ( )
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রسَلُوا اللّٰهَ مِنْ فَضْلِه فَإِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ أَنْ يُسْأَلَ وَأَفْضَلُ الْعِبَادَةِ انْتِظَارُ الْفَرَجِগ্ধ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ هٰذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ কামনা করো। কেননা আল্লাহ তাঁর কাছে প্রার্থনা করাকে পছন্দ করেন। আর ‘ইবাদাতের (দু‘আর) সর্বোত্তম দিক হলো স্বচ্ছলতার অপেক্ষা করা। ( )
অতএব, দো’আ ইসলামে অন্যতম একটি ইবাদতে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর গভীর প্রেম নিবেদন করা চলে এবং যাবতীয় প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হতে হলে উপার্জন অবশ্যই হালাল হতে হবে। কেননা আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করেননা।
মানুষের খাদ্য-পানীয় যেমন শরীর গঠনে ভুমিকা রাখে তেমনি প্রাণ ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা আছে। খারাপ-পঁচা খাবার যেমন শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তেমনি অবৈধ পথে উপার্জিত সম্পদ ও খাবার আত্মা ও প্রাণের ক্ষতি সাধন করে। সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি, অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ দখল, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাত প্রভৃতি অবৈধ পদ্ধতিতে অর্জিত খাবার খেয়ে বা পোশাক পরিধান করে দোআ’ করলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হয় না।
অতএব অবৈধ উপার্জন যারা করে তাদের খাদ্যের উপার্জন অবৈধ অর্থে হওয়ায় তার রক্ত মাংস সবই হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়। ফলে এ ধরনের ব্যক্তির প্রার্থনাকে ইসলামে কখনো সমর্থন করেনা। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ
إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: ৫১] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: ১৭২] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ،وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআল পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।” আল্লাহ তা’আলা বলেন: “হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।” অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?”( )
ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ تُلَيَتْ هَذِهِ الْآيَةُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلالًا طَيِّباً فَقَامَ سَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مُسْتَجَابَ الدَّعْوَةِ، فَقَالَ يَا سَعْدُ أَطِبْ مَطْعَمَكَ، تَكُنْ مُسْتَجَابَ الدَّعْوَةِ، وَالذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، إِنَّ الرَّجُلَ لَيَقْذِفُ اللُّقْمَةَ الْحَرَامَ فِي جَوْفِهِ مَا يُتَقَبَّلُ مِنْهُ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، وَأَيُّمَا عبد نَبَتَ لَحْمُهُ مِنَ السُّحْتِ وَالرِّبَا فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল। “হে মানবমন্ডলী! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর।” তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দু’আ কবুল হবে।”( )
মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوْا لِلّٰهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রূযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (বাক্বারাহ ১৭২)।
এ আয়াতে হারাম খাদ্য ভক্ষণ করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কারণ ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য হালাল রূযী গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত
ইবন আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা বর্ণিত হাদীসে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ
كُلَّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ
“আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।”( )
কাব ইবন উজরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন:
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ
“যে শরীর হারাম খেয়ে হৃষ্ট পুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।”( )
উপার্জনের উৎস সম্পর্কে কিয়ামাতে জিজ্ঞাসা করা হবে
কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে তার উপার্জনের উৎস সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। সেজন্য মুমিনের জন্য হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এরশাদ করেন,
لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ.
“কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না।
১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে,
২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে,
৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে,
৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।”( )
পরিষেশে বলা যায়, প্রকৃত মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করতে হ’লে হালাল রূযী উপার্জনের কোন বিকল্প নেই। হালাল পথে উপার্জিত রূযী ভক্ষণে মানুষের স্বভাব-চরিত্র সুন্দর হয়, সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিকাশ ঘটে এবং সত্যানুরাগী হ’তে সহায়তা করে। অন্যদিকে হারাম রূযী মানুষের দেহ-মনের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে, নৈতিক অধঃপতনের প্রেরণা যোগায় এবং বিপথগামী হ’তে সহায়তা করে।
—০—

খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন
হালাল উপার্জন অন্বেষণে অনন্য দৃষ্টান্ত

খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন হালাল উপার্জন অন্বেষণে অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁরা যাবতীয় লেন-দেনে হালাল পন্থা অবলম্বন করতেন। হারামের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাঁরা খুবই সচেতন ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটি ঘটনা থেকে তাঁর হারাম বর্জন প্রবণতা ও হালালের বিষয়ে কঠোরতা সহজেই অনুমেয়।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِي اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلَامٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلَامُ أَتَدْرِي مَا هَذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ إِلَّا أَنِّي خَدَعْتُهُ فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذَلِكَ فَهَذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنِهِ.
বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর এক গোলাম ছিল সে তাঁর সঙ্গে কিছু অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি পত্র করে। অতঃপর সে যখন প্রতিদিন মুক্তিপনের কিছু অর্থ নিয়ে আসতো, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এ অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করেছো? যদি সে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারতো, তবেই তিনি তা গ্রহণ ও ব্যবহার করতেন। অন্যথায় ব্যবহার করতেন না। এক রাতে সে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলো। সে দিন তিনি রোযা রেখেছিলেন। তাই সেই খাবার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ভুলে যান এবং তা থেকে এক লোকমা খেয়ে ফেলেন। অতঃপর মনে হওয়া মাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে অর্জন করেছ? সে বললোঃ জাহেলিয়াতের আমলে আমি মানুষের ভাগ্য গণনা করতাম। আমি ভাল গণক ছিলাম না। তাই মানুষকে শুধু ধোঁকা দিতাম। এই খাবার সেই ধোঁকার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংগৃহীত। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ সর্বনাশ তুমি আমায় একি করেছ! অতঃপর তিনি গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে খাবারের কিছুই বের হয়নি। অতঃপর তিনি পানি পান করে ইচ্ছাকৃত বমির মাধ্যমে পেটের সব খাবার বের করে দিলেন। তিনি আরো বললেনঃ উক্ত খাবার বের করতে গিয়ে আমার মৃত্যুর ঝুঁকি থাকত তাহলেও তা বের করে ছাড়তাম। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,ঃ “যে শরীর হারাম খাদ্য দিয়ে স্বাস্থ্য লাভ করে, তার জন্য জাহান্নাম উপযুক্ত স্থান। তাই আমি ভয় পেয়ে যাই, যে এক লোকমা হারাম খাবার দিয়ে আমার শরীর কিভাবে মোটা-তাজা হতে পারে।”( )

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে
উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
বৈধ পন্থায় উপার্জনের গুরুত্ব উপলব্দি করতঃ তার তাৎপর্য ও পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে বিদগ্ধ উলামায়ে কিরাম ও মুফাসসিরগণ পান্ডিত্যপূর্ণ উক্তির অবতারণা করেছেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
كنا ندع سبعين بابا من الحلال، مخافة أن نقع في باب الحرام
“না জানি তা হারামের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় এ আশংকায় আমরা হালাল সম্পদের সত্তুরটি দ্বার পরিহার করতাম।”( )
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
كنا ندع تسعة أعشار الحلال مخافة الوقوع في الحرام
“না জানি তা হারামের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় এ আশংকায় আমরা হালাল সম্পদের দশভাগের নয়ভাগ পরিহার করতাম।”( )
لما شرب عمر من لبن إبل الصدقة غلطا، أدخل إصبعه في فيه وتقيأ
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ভুলক্রমে সদকার উটের দুধ পান করায় তিনি তা বমি কবে বের করে দেন।( )
হযরত ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ তাওবা করে হালাল উপার্জনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ এমন কোন মানুষের নামায কবুল করেন না, যার উদরে হারাম খাদ্য রয়েছে।
ইমাম ওহাব ইবনুল ওয়ারদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যদি তুমি রাত ভর খুটির ন্যায় ইবাদতে দাড়িয়ে থাক, তবুও তা তোমার কোন কাজে আসবে না! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিশ্চিত হবে যে, তুমি যা খাচ্ছ তা হালাল না হারাম।
হযরত সুফিয়ান সাওরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যে লোক অবৈধ অর্থ দিয়ে কোন নেক কাজ করে, সে পেশাব দিয়ে কাপড় পবিত্রকারীর মত।

উপসংহার
ইসলাম কল্যাণকর এক মহতি জীবন ব্যবস্থা। এতে যাবতীয় পবিত্র ও উত্তম বিষয় ও বস্তুকে বৈধ করা হয়েছে। কেননা সব বস্তুর মাঝেই কিছু কল্যাণ ও কিছু অকল্যাণের সমাহার রয়েছে। গুনাগুণের বিচারে যে বস্তুতে মানুষের জন্য কল্যাণকর উপাদানের পরিমাণ বেশী, অকল্যাণের পরিমাণ কম, সে গুলোকেই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর যে সকল বস্তুতে কল্যাণ কম অথচ অকল্যাণের পরিমাণ বেশী, সেগুলোকে মনুষের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (যেমন মদ হারাম হওয়ার কারণ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে) অতএব, আমাদেরক খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আষাক এবং বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবহার, এমনকি যাবতীয় আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সেগুলো যেন হালাল ও উত্তম হয়।
যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাতœক পদার্থ্য দিয়ে তৈরী অথবা যা মানুষের মানবতা বোধকে ধ্বংস করে অথবা যা মানুষের জন্য পাশবিকতার জন্ম দেয় এবং তার সংযমী স্বভাবকে বিনষ্ট করে! কিংবা যা মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ক্ষতির (ব্যাধি) কারণ হয়, এ সকল বস্তু ও উপার্জন মাধ্যম অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তাছাড়া যেসব উপায় দম্ভ, অহংকার জন্ম দেয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে নষ্ট করে, নিষিদ্ধ ভোগ-বিলাসের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে, জুলুম-স্বেচ্ছাচারিতা ও আতœকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়, দুশ্চরিত্রের প্রতি ধাবিত করে, মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব মাধ্যম বর্জন করতে হবে। আমাদের রুজি-রোজগার যখন এসব থেকে পূত পবিত্র হবে তখনই তা হালাল ও সিদ্ধ হবে।
—০—

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment