ইসলাম বনাম জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইসলাম নিরাপত্তা ও শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা শান্তি প্রিয় ও শান্তিকামী। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ব মুসলমানকে মানবতা, উদারতা ও শান্তিকামিতা শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি সারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম ও শ্রেষ্ঠ উম্মত মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব নষ্ট করার পাঁয়তারা চলছে খুব সুকৌশলে। তাই বিশ্বব্যাপী ইহুদি ী খিৃষ্টানরা ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদেরকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী বানাতে আগ্রহী। তারা কৌশলে মুসলমানদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে আইএস, জেএমবি, আনসারুল্লাহ সহ অনেক জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী দলকে। তাদের অপতৎপরতায় আজ শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম ও শ্রেষ্ঠ জাতি মুসলমানদের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। সন্ত্রাসের কারণে হত্যার শিকার হয়েছে পাকিস্তানে স্কুল শিশু, জাপানে প্রতিবন্ধী। ফ্রান্সে ২৫ টন ভারী ট্রাকের চাপে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ৮৪ জন নির্মমভাবে নিহত হয়েছে ইমাম, মুয়ায্যিন, পুরোহিত, আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ, দরবারের খাদেমসহ অসংখ্য মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। তাই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কারা তাদের স্বরূপ উন্মোচন ও বিধান সম্পর্কে আলোচনা করে দেশের মানুষকে সতর্ক করে দেয়া এখন সময়ের দাবী। সে দাবীর নিরিখে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে জনগণকে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য এ প্রয়াস।

ইসলাম বনাম জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ
ইসলাম ও জঙ্গিবাদ পরস্পর বিপরীত। ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের লেশমাত্র সর্ম্পকও নেই। ইসলাম মানে শান্তি আর জঙ্গিবাদ মানে যুদ্ধ। ফার্সি জঙ্গ হতে তা উদ্ভুত। জঙ্গি অর্থ যুদ্ধপ্রিয়, অশান্তিদাতা। কাজেই শান্তি ও অশান্তি এক হতে পারে না। ইদানিং প্রিন্ট মিডিয়াতে ইসলামী জঙ্গিবাদ নামে যে শব্দ প্রয়োগ করা হয় তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাই ইসলামী জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বলা যায় না। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ অর্থ মুসলমানের মাঝে যথার্থ ফুটে উঠে। মুসলমান শান্তিপ্রিয় হয় এবং অপরকে শান্তি দান করে। প্রকৃত অর্থে ইসলামের শান্তি নিহিত আছে। তাই এ দীন-ইসলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে প্রেমপ্রীতি, সৌহার্দ্যবোধ, শান্তি, নিরাপত্তা ও সহিঞ্চুতার সাথে বসবাসের শিক্ষা দিয়ে থাকে।

ইসলাম বিদ্বেষী কতিপয় লেখক অন্যায়ভাবে প্রচার করেছে যে, ইসলাম তরবারির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে; অথচ এ ধরণের উক্তি ডাহা মিথ্যা। একজন সত্যিকার মুসলমান হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হতে পারেন। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে-
الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ والمؤمن من امنه الناس فى د ماءهم واموالهم
মুসলমান ওই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে মুসলমানেরা নিরাপদ থাকে। আর মুমিন ব্যক্তি, যাকে মানুষেরা তাদের জান-মালের ব্যাপারে আমানতদার মনে করে।

পরমতসহিঞ্চুতা বা পরধর্মের প্রতি উদারতার যে অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রহমাতুল্লিল আলামীন নবী দেখিয়েছেন, তা পৃথিবীর অন্য কোনো মতাদর্শেই পরিদৃষ্ট হয় না। প্রফেসর রামদেব বলেন- ‘ভ্রান্তিমূলকভাবে বলা হয়ে থাকে যে, তরবারির মাধ্যমেই ইসলাম প্রচারিত হয়েছে; অথচ প্রতিষ্ঠিত সত্য কথা যে, ইসলামের প্রচারে কখনো তরবারী ব্যবহৃত হয়নি।’ ঐতিহাসিক ডোজিও অনুরূপ মন্তব্য করে বলেন-প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণকারী এক রহস্য হিসেবে ধরা পড়ে যে, ইসলামের নতুন ধর্ম কারো উপর জোর করে আরোপ করা হয়নি। বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা তো দূরে থাক, অপরের ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও অন্য ধর্মের প্রবর্তকদের প্রতিও সামান্যতম কটুক্তি করা ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ইসলামের অর্থ
ইসলাম শব্দটি মাসদার। এটির অর্থ নিরাপত্তা প্রদান করা। নিজের দীন ও জান-মালের বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার বলা-মুসিবত থেকে রেহাই দেওয়া। ইসলামের বিধি-বিধান কবুল ও বিশ্বাস করে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করাকে ইসলাম বলে।

জঙ্গিবাদ ও জিহাদের মধ্যে পার্থক্য
জিহাদ ইসলামি পরিভাষা। অর্থ- চেষ্টা করা, শক্তি ব্যয় করা, শক্তি বা সামর্থ্য।
শরীয়তের পরিভাষায়-সত্য ধর্মের প্রতি আহবান করা এবং এ আহবান অগ্রাহ্যকারীর সাথে যুদ্ধ করা।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশরীরে বা পরামর্শদানে বা আর্থিক সহযোগিতায় কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালানোকে জিহাদ বলে।

আল্লামা ইবন হুম্মাম বলেন- আল্লাহর বাণী প্রচার করার প্রচেষ্টাই জিহাদ। মুসলিমগণ যখন ধর্মশত্র“ কর্তৃক আগ্রাসনের শিকার হয়, আক্রান্ত হয়, মুসলিম উম্মাহর সংহতি ও ইসলামী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়, তখন জিহাদ আবশ্যক হয়ে যায়। অহেতুক স্বধর্ম বা ভিন ধর্মের লোক হত্যা করাকে জিহাদ বলা যায় না; এটি জঙ্গিবাদ যা মানুষের রক্তপাত ঘটায়। ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিভ্রান্তরাই তাদের অযৌক্তিক ও সমর্থনহীন চিন্তাধারাকে স্বাভাবিক রাস্তায় প্রচার-প্রসারে ব্যর্থ হবার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস এবং বিদ্রোহিতার আশ্রয় নিয়ে বাস্তবায়নের কর্মসূচিই মূলতঃ জঙ্গিবাদ।

ইসলামের শিক্ষা হল কোন কাফিরও যদি প্রাণের ভয়ে কিংবা বানোয়াটি করে যুদ্ধকালীন কালেমা পাঠ করতে নিজেকে মুসলমান হওয়ার দাবী করে এবং ইমান প্রকাশ করে এমন ব্যক্তিকেও হত্যা করা নিষেধ। জোর করে মানুষকে মুসলমান বানানোর উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটানো জিহাদ নয়। কারণ জিহাদে সুনির্দিষ্ট কতগুলো শর্ত রয়েছে। যথা-মুসলিম কোন নেতা বা বাদশার নেতৃত্বে হওয়া, পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র মজুদ থাকা, মুসলমানদের সুরক্ষিত রাষ্ট্র থাকা ও কাফিরদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার মত সৈন্য-সামন্ত থাকা ইত্যাদি।

সন্ত্রাসবাদ
ইংরেজি টেরোরিজম, আরবিতে الارهابية (আল- ইরহাবিয়্যা) এবং বাংলায় সন্ত্রাসবাদ যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন তা সমাজের একটি দুষ্ট প্রকৃতির মানুষের চরম দুশমন ইবলীসের উর্বর মস্তিস্ক থেকে আবিস্কৃত। সন্ত্রাস শব্দ ‘ত্রাস’ থেকে উদ্ভুত। ত্রাস হল- ভয়, শংকা, ভীতিকর। আর সন্ত্রাস হল আতঙ্কগ্রস্থ, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। সন্ত্রাসিত- সন্ত্রাসযুক্ত সন্ত্রস্ত। আতঙ্ক, সন্ত্রাস; ফার্সিতে দহিস্তে গরদি। ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, প্রাণী, বা বস্তু সঙ্গবদ্ধভাবে ভয় দেখিয়ে বশ মানানোর নীতি সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসের আরবী প্রতিশব্দ হলো ‘ইরহাব’ অর্থাৎ কাউকে ভয় দেখানো, সন্ত্রস্ত করে তোলা।

পরিভাষিক অর্থ সন্ত্রাস হল- কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাতœক ও ত্রাসজনক পথ বেছে নেয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য সংঘবদ্ধভাবে ভয় দেখিয়ে বশ মানানোর নীতি অবলম্বন করা।

মূলত ক্রোধ, লোভ, সমাজ ও স্বীয় সত্তায় বিশ্বাসের অভাব এবং এরূপ চরিত্রগত কিছু কিছু মনস্তাত্বিক দুর্বলতার মনোবিকার থেকেই সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয়।

তা যথা সময়োপযোগী সূক্ষ্মভাবে মূলোৎপাটন করা না হলে গোটা সমাজই ক্যান্সারের মত গ্রাস করে ফেলে। ফলে শান্তিময় সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সন্ত্রাস মোকাবেলায় দু’টো উদাহরণ আমাদের নিকট সমুজ্জ্বল;

এক. প্রবলতর রোমক সাম্রাজ্য চালিত সংঘবদ্ধ সরকারী সন্ত্রাসের মুখে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর প্রকৃত অনুসারীগণের অহিংস সংগ্রাম।

দুই. রোমক ও পার্সিক সাম্রাজের বিশ্বব্যাপী সংঘবদ্ধ সমাজ সমগ্রব্যাপী সন্ত্রাসের মোকাবলোয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীগণের আত্মরক্ষামূলক সীমিত শক্তি প্রয়োগ ব্যাপকতর পর্যায়ে অহিংস সর্বব্যাপী সৃষ্টি প্রেমভিত্তিক সন্ত্রাস নির্মূলমূলক প্রচেষ্টা।

সন্ত্রাস নির্মূল করার পদ্ধতি
সন্ত্রাস বন্ধের জন্য সন্ত্রাসীকেই নির্মূল করে ফেলা আজকের সন্ত্রাস বিরোধী প্রচেষ্টার এ প্রবণতা ভ্রান্ত বলে মনে হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস কোন সাফল্যজনক স্ট্র্যাটেজী হতে পারে না। বিশেষ করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ যদি সমাজে বিস্তার লাভ করে; যেমনটি ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সময়ের সমাজের সন্ত্রাসী নির্র্মূলে মাধ্যমে সন্ত্রাস বন্ধের পন্থা অবলম্বন করলে পুরো সমাজকেই প্রায় নির্মূল করে ফেলতে হবে। সীমিত সংখ্যক ভাল লোক রেখে সমাজের বাদ বাকী সকলকে হত্যা করা হবে সমাজেরই সর্বনাশ। সীমিত সংখ্যক ভাল লোক হলেও সাধারণত সমাজ চলতে পারে না।

গোত্র ভিত্তিক বা মধ্যবিত্ত সমাজে সন্ত্রাসীদের পাইকারী মৃত্যুদণ্ড বা জেল দেয়া হলে, তা তেমন কার্যকর হয় না। কারণ, এমন সমাজে রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার টান ও শ্রেণীগত নৈকট্যের কারণে প্রায় সব সময় দেখা যাবে গ্রেপ্তারকৃত সন্ত্রাসীর আত্মীয়স্বজন সরকারের কোন না কোন পর্যায়ে সমাসীন থাকেন। ফলে এদের আত্মীয় কোন সন্ত্রাসীর সাজা হলে এরা সাধারণত তদবীর করতে চায়। আর তাতে দমনমূলক সাজার প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়। প্রচেষ্টা সার্থক যদিও হয় কোন ক্ষেত্রে, তাহলে তার ফলে সেক্ষেত্রে এ সন্ত্রাসীর আত্মীয়স্বজনদের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়। তাদেরও সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমে প্রভাবিত হবার উপক্রম করে। এসব কারণেই সন্ত্রাস দমনমূলক ব্যবস্থাকে যত অল্পসময়ের জন্য সম্ভব, একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে সীমিত রেখে সন্ত্রাস নির্মূলমূলক স্ট্র্যাটেজী’র দিকে জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আদর্শে তা-ই প্রতীয়মান।

আত্মশুদ্ধিমূলক তরীকাসমূহের প্রসার
সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য সন্ত্রাসের উৎসরূপ মনোবিকারমূলক চরিত্রগত দুর্বলতা দূরীকরণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বদান তাঁর ঐ আদর্শের একটি দিক। এজন্য প্রবৃত্তির শুদ্ধি বা তাযকিয়াতুন্নাফস আজকের প্রচলিত পরিভাষায় যাকে বিশ্বনবীর তাসাউফ বলে, তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কুরআন শরীফে এ নফস তাযকিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে- قد افلح من تزكي যে প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করেছে সে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।

সন্ত্রাস ও সন্ত্রাস নির্মূলমূলক সফল স্ট্র্যাটেজী’র কেন্দ্রীয় বিষয় হতে হবে প্রবৃত্তির শুদ্ধিমূলক নানা পদ্ধতিগত কর্মকাণ্ড। সমাজ মুসলমান অধ্যুসিত সমাজ হলে আর কথা নেই। স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা-দীক্ষা আর আচরণ পদ্ধতি থেকে নেয়া নানা উপাদান সমন্বিত-উপস্থাপিত ‘তাযকিয়া’ বা তাসাউফের যেসব বিভিন্ন বিশুদ্ধ পদ্ধতি বা তরীকা রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপক প্রচার প্রসার ও প্রয়োগ হবে সমাজে সন্ত্রাস নির্মূলমূলক আদর্শ ‘স্ট্র্যাটেজী’ প্রয়োগের প্রধান কাজ। সমাজটি মুসলমান-প্রধান না হলে, সেখানেও এসব পদ্ধতির বিষয়বস্তু এবং প্রক্রিয়াগত পদ্ধতিকে ধর্মীয় বিষয় হিসেবে যদি নাও হয়- সমাজ মনস্তাত্ত্বিক, সংশোধন-সংস্কারমূলক সাংস্কৃতিক এক প্রচেষ্টা হিসেবেই তার প্রচলন করা যেতে পারে।

এই আদর্শ স্ট্র্যাটেজী’র অংশ হিসেবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের মন থেকে লোভ, ক্রোধ, ও ঘৃণা, হীনমন্যতা এবং অন্যের প্রতি বিশ্বাসের অভাবের মত নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা দূর করতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আদর্শ প্রচারে ব্রত হতে হবে। ‘দুনিয়া’ তথা বস্তুগত সুযোগ সুবিধার আকর্ষণ তথা ‘লোভ’ যে পাপ তথা অপরাধের ঊৎস, তা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন। তাঁর উচ্চারিত শেখানো কুরআন শরীফেও তা জানানো হয়েছে। সূরা ‘তাকাসুর’ এ। الهاكم التكاثر অর্থাৎ তোমাদেরকে ভুলিয়ে বসেছে প্রাচুর্যতা।
সন্ত্রাসের উৎসমূলরূপ এ ‘লোভ’ দূর করার জন্য এই আদর্শ স্ট্র্যাটেজী’র এক দিক।

সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আদর্শ
হযরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন সারা জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ। তাই ইহকালেও সকল মানুষ যেন সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, শান্ত-স্নিগ্ধ এ পৃথিবীতে বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। গুটি কয়েক দুর্বৃত্ত দুরাচারের জন্য সমাজের সকল শান্তি প্রিয় মানুষের জীবন যাতে দুর্বিসহ হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য তিনি ছিলেন সর্বদাই সচেতন। তাই এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তিনি প্রয়োজনীয় কল্পনাতীতভাবে কঠোর হয়েছেন। দুনিয়া থেকে যত অনাচার, অন্যায় অত্যাচার, সন্ত্রাস সবই দূর করার জন্য তিনি শক্ত হাতে কঠোরভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। নবূওয়াত প্রকাশের পরে বটেই, পূর্বেও তিনি সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন সন্ত্রাস নির্মূল করতে।

তাই আমরা দেখতে পাই- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে হিলফুল ফুজুলের মাধ্যমে মক্কার সন্ত্রাস বন্ধ করেছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ সংগঠনের মাধ্যমে যুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়েছেন। উক্ত সংগঠনের ১নং শর্তে বর্ণিত ছিল “আল্লাহর কসম! মক্কা নগরীতে কারো উপর অত্যাচার হলে আমরা সবাই মিলে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সাহায্য করব। চাই সে উচু শ্রেণীর হোক, বা নীচু শ্রেণীর, স্থানীয় হোক বা বিদেশী হোক, অত্যাচারিতের প্রাপ্য যতক্ষণ পর্যন্ত আদায় হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এভাবেই থাকবো।”

হত্যাকাণ্ড জঘন্যতম অপরাধ
কুরআনে করীমে অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলোতে হত্যাকান্ড ও সন্ত্রাসের ভয়ারহ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
ِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এই যে, তাদেরকে গুণে-গুণে হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে, তাদের একদিকের হাত অপরদিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটা দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।

হত্যা ও সন্ত্রাস সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ بَعْدَ ذَلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ
আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম যে, যদি কেউ কাউকে হত্যা করে নরহত্যা কিংবা দুনিয়ার ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করলো। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে, সে যেন সব মানুষেরই প্রাণ রক্ষা করলো। তাদের কাছে তো এসেছিল আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে, তারপরও তাদের মধ্যে অনেকেই দুনিয়ায় সীমালংঘনকারী রয়ে গেল।

আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার সাজা জাহান্নাম। সে সেখানে অনন্তকাল তাতে থাকবে। তার উপর আল্লাহ ক্রোধান্বিত হবেন আর তার উপর অভিশাপ দেবেন। আর তিনি তার জন্য তৈরি করে রেখেছেন মহাশাস্তি।

আর সে সব জীবন যা আল্লাহ তোমাদের উপর হারাম করেছেন, অন্যায়ভাবে (শরীয়তের বিধান পালনার্থে ব্যতিত) হত্যা করবে না। এসব এমন যা তিনি তোমাদের প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ দিয়েছেন। তোমরা যেন জ্ঞান খাটিয়ে কাজ কর।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ব-মানবতার জান-মাল বিনাশ ও হত্যাযজ্ঞের কুফল ও নিষেধাজ্ঞা অবহিত করতে গিয়ে বিদায় হজ্বের দিন বলেন-ان دماءكم و اموالكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا
নিশ্চয় তোমাদের প্রাণ ও তোমাদের সম্পদ তোমাদের উপর এরূপ সম্মানিত, যেমন তোমাদের আজকের এ দিন সম্মানিত।

উকুল ও উরায়না গোত্রের লোকেরা মদিনায় হিজরত করলে তাদের পেট ফুলে যায়, চেহারা হলুদ বর্ণের হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মহানবী তাদেরকে সাদকার উটের দুধ ও প্রশ্রাব পান করতে বললেন। তারা তা পান করার পর সুস্থ হয়ে গেলে রাখাল হত্যা করে ওই উটগুলো লুঠ করে নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। নবীজি ওই সন্ত্রাসীদের চোখ ফুটো করে মুসলা তথা হাত-পা কেটে হত্যার নির্দেশ দিলেন।

বনু নযীরের লোকেরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করার কারণে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাদের খেজুর গাছ কেটে আগুন লাগিয়ে ভিটা-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে খায়বর ও সিরিয়াতে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যুদ্ধ চলাকালে অমুসলিম মহিলা ছাড়াও অমুসলিমদের শিশু-সন্তানদের হত্যা করার নিষেধাজ্ঞাও ইসলামের মানবতাধর্মী সোনালী কানুনের অন্যতম। এদিকে রহমতের নবীর যুদ্ধ-নীতির উদারতাও দেখুন, অপর দিকে দেখুন জিহাদের নামে কলেমা পড়া সন্ত্রাসীদের বীরত্বের আস্ফালন। হায়! তাদের যদি রাসূলের এসব বাণীর প্রতি যৎকিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ সৃষ্টি হত। যুদ্ধ অবস্থায় যেখানে শিশু ও নারীদেরকে রেহাই দিয়েছেন সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় তাদেরকে হত্যা করা জঘন্যতম হারাম।
নারী, বয়োবৃদ্ধ, আলেম, পীর-মাশায়েখ, মুসল্লী যে-কোন মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ।
ইমাম মুসলিম হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি পত্রের কথা উল্লেখ করেন। পত্রে তিনি লিখেছেন- নিশ্চয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুশমনদের শিশু-সন্তানদের হত্যা করতেন না। অতএব, তুমিও শিশুদের হত্যা করবে না।

হযরত উসামা বিন যায়দ বিন হারেসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ‘হেরকা’ নামক স্থানের দিকে জিহাদের জন্য পাঠান; যারা ছিল ‘জুহাইনা’ গোত্রের একটি শাখা। সেখানে আমরা সকলে পৌঁছে গেলাম। প্রচন্ড যুদ্ধের পর তাদের পরাভূত করলাম। আমি ও অপর এক আনসারী সাহাবী একত্রে সে গোত্রের এক ব্যাক্তিকে আক্রমণ করে বসলাম। তখন সে আমাদের হতে কালেমা শুনে পড়তে লাগল। তা শুনে সরে গেল। কিন্তু আমি তীর মেরে তাকে হত্যা করে ফেললাম। আমরা চলে এলাম। পরবর্তীতে নবীর কাছে ঘটনাটি পৌছলে বললেন, হে উসামা! তুমি কি তাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা সত্ত্বেও হত্যা করেছ? তিনি বারংবার এই কথাগুলোই বলতে রইলেন আর আমি আফসোস করছিলাম, হায়! আমি যদি আজকের দিনের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ না করে থাকতাম! বর্ণনা এভাবে এসেছে-

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে ডেকে এনে জানতে চাইলেন, তুমি একে কেন হত্যা করেছ? তিনি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুল! সে মুসলমানদের কষ্ঠ দিয়েছে। কিছু সাহাবীর নাম উল্লেখ করে বলেন, অমুককে অমুককে সে হত্যা করেছে। আমি তার উপর আক্রমণ করি। সে যখন তরবারী দেখল, তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- কিয়ামতের দিন যখন লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ কলেমাটি প্রত্যাগত হবে, তখন তুমি তার জবাব কি দিবে? তিনি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি পুনরায় বললেন, কিয়ামতের দিন যখন লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ কলেমাটি প্রত্যাগত হবে, তখন তুমি তার কি জবাব দিবে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম এই কথা বলতে রইলেন, কিয়ামতের দিন যখন লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ কলেমাটি প্রত্যাগত হবে, তখন তুমি তার জবাব দিবে?

হযরত মিকদাদ বিন আস্ওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার মতামতের অপেক্ষায় আছি। যুদ্ধ ময়দানে আমি যদি কোন কাফিরের মোকাবেলা করি আর সে আমার হাত কেটে নেয় কিন্তু আমি যখন তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হই, সে কোন বৃক্ষের আশ্রয়ে এসে বলতে থাকে- আমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুসলমান হয়ে গেলাম। তবে আমি তাকে এ কালেমা পড়ার পর হত্যা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি তাকে হত্যা করতে পার না। আমি আরজ করলাম ইয়া রাসূলল্লাহ! সে তো আমার হাত কেটে নেওয়ার পর কালেমা পড়েছে। তাহলে আমি কি তাকে হত্যা করতে পারি না? তিনি বললেন, তুমি তাকে হত্যা করতে পার না। তুমি যদি তাকে হত্যা কর তবে সে তোমার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যে মর্যাদায় তুমি তাকে হত্যা করার পূর্বে ছিলে। তুমি হয়ে যাবে সে মর্যাদায়, যে মর্যাদায় সে ছিল কালেমা পড়ার পূর্বে অর্থাৎ কুফরের উপর।

সন্ত্রাসীদের প্রকারভেদ
সন্ত্রাসী চার প্রকার সূরা মায়িদায় বর্ণিত আয়াতের মর্ম থেকে বুঝা যায়:
ক. শুধু হত্যাকাণ্ড চালায়, তাদের সাজা মৃত্যুদণ্ড।
খ. হত্যা করতঃ ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। তাদের শাস্তি শূলিতে চড়ায়ে মৃত্যু দণ্ড।
গ. কাউকে আঘাত না করে কেবল মাল-সম্পদ লুঠ করে। তাদের শাস্তি ডান হাত ও বাম হাত কর্তন করা।
ঘ. যারা রাস্তা ঘাটে ত্রাস সৃষ্টি করে। মাল লুট ও হত্যাকাণ্ড করে না, তাদের শাস্তি বন্ধি করে রাখা।

সন্ত্রাসীদের তাওবা
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর যমানায় হারেছা নামী এক সন্ত্রাসী ছিল। সে বসরায় হত্যাকাণ্ড চালাত। আল্লাহ পাক তাকে তাওবা করার তাওফিক দান করেছেন। একদা যে কয়েকজন বসরার নেতার আশ্রয় নিল। কেউ তাকে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে নিয়ে যেতে রাজি হননি। অবশেষে সাঈদ বিন কায়ূম তাকে নিয়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর নিকট হাজির হয়। সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- হে খলিফা! যদি কোন সন্ত্রাসী আপনার নিকট এসে তাওবা করে ক্ষমা চায় তবে আপনি তাকে কি ক্ষমা করবেন? তিনি ফয়সালা দিলেন- যে সন্ত্রাসী ধরা পড়ার পূর্বে আত্মসমর্পণ করে তাওবা করে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে; যদিও শ্রেষ্ঠ ডাকাত হারেছা হয়। তখন হারেছাকে ইশারা করা হল। আত্মগোপন থেকে বের হয়ে হারেছা তাওবা করে আত্মসমর্úণ করলো। হযরত আলী তাকে ক্ষমা করে দিলেন। পরবর্তীতে তিনি একজন ধার্মিক ও একনিষ্ঠ মুমিন হয়ে যান।

আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা করে দিয়েছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। শুধু তা নয় মক্কা বিজয়ের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যারা আবূ সুফিয়ানের আশ্রয়ে থাকবে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করা হবে।
খ) তায়েফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আঘাতকারী আবু আবদকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
গ) যে ইহুদি মহিলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
অর্থাৎ যারা ক্ষমা চাইলো এবং তাওবা করলো তাদের কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে দিয়েছেন।

সন্তাসীদেরকে হত্যা করা বিষয়ে ফতোয়া
সন্ত্রাসী চক্রের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিয়ে আল্লামা যাহেদ আল কাওছারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি ইমাম আযমের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। ইমাম আযম আবু হানিফা বলেন, বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী চক্রের সাথে যুদ্ধ কর। তারা কুফরীতে রয়েছে বিধায় নয়; বরং তারা বিদ্রোহী। আর তাদের হত্যা করা অত্যাবশ্যক। তারা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা বিস্তারে দায়ী। সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে নেককার ও সৎ মানুষের সঙ্গ নেওয়া। আর যদি হঠাৎ এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তবে সমাজকে নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারের সাথে একাত্ম হতে হবে, কস্মিণকালেও সন্ত্রাসী বিদ্রোহীদের সঙ্গে থাকা যাবে না। এমনিতেই তো সমাজে কিছু লোক যেমন রয়েছে ফিতনা সৃষ্টিকারী অত্যাচারী, অপর দিকে তেমনি আবার সৎ ও ন্যায়পরায়ণও। এসব সৎ ন্যায়-নীতিবান লোকেরাই সে সব পথভ্রষ্ট বিপথগামীদের বিরুদ্ধে আপনাকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। লোকেদের সিংহভাগই সশস্ত্র বিদ্রোহীতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে এমন পরিস্থিতিতে সত্যপন্থীদের উচিত সে সব বিদ্রোহীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। আর তাদের বাদ দিয়ে অপর লোকদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা কোথাও হিজরত করে চলে যেতে আর নিশ্চয় আমার পৃথিবী সুপ্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই ইবাদত করবে।

ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, আবু জাফর তাহাভী, সারাখসী, ইমাম মাওয়ার্দী, বুরহান উদ্দীন মুরগিনানী, ইমাম ইবনে কুদামা, নববী, আবুল বারাকাত নাসাফী, ইমাম আব্দুর রহমান জরিবী প্রমুখ মুজতাহিদ ও ফিকহবিদগণ ফাতওয়া দিয়েছেন- মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ, হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যা মোটেই বৈধ নয়।

পরিশিষ্ট
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ রুখে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সমাজকে অশান্তি, অস্বস্থি ও বিশৃংখলা থেকে রক্ষা করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। তাই যার যার অবস্থান থেকে সে কর্তব্য পালন করা জরুরী। হাদিসে পাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
من رأى مِنْكُم مُنْكرا فليغيره بِيَدِهِ إِن اسْتَطَاعَ فَإِن لم يسْتَطع فبلسانه فَإِن لم يسْتَطع فبقلبه وَذَلِكَ أَضْعَف الْإِيمَان
তোমাদের মধ্যে যে কোন মন্দ কাজ দেখবে তার উচিত তা যথাসাধ্য হাত দ্বারা প্রতিহত করা, যদি তা সম্ভব না হয় মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করা, আর যদি তা ও না হয় তবে তা অন্তর থেকে ঘৃনা করবে। আর এটা হচ্ছে দূর্বল ঈমানের পরিচয়।

তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় আওতাধীনদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করা কর্তব্য।
সে কর্তব্যবোধ সম্পর্কে মহানবী সর্বসাধারণের জন্য একসূত্র বর্ণনা করেছেন- كلكم رَاع وكلكم مسئول عَن رَعيته তোমরা প্রত্যেকে পরিচালক, প্রত্যেকে তার আওতাধীন ব্যক্তিদের সম্পর্কে জবাবদিহী থাকবে। এ সূত্রানুপাতে মা-বাবা তার সন্তানকে, সর্দার তার সমাজের মানুষকে, মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রি সবাই স্বীয় নেতৃতাধীনদের কে সৎ ও হেদায়াতের পথে পরিচালিত করা গুরু দায়িত্ব। নতুবা আল্লাহর নিকট জবাবদিহী করতে হবে। কিতাবুস সানিয়াতে এক হাদিস বর্ণিত রয়েছে- কিয়ামতের দিন পাপীকে জাহান্নামে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হলে, সে বলবে হে আল্লাহ! আমি পাপ করেছি, কিন্তু যে আমাকে তা থেকে বাধা দেয়নি, সে কুকর্ম থেকে বাধা দিলে আজ আমাকে জাহান্নামে যেতে হতো না। আমি তাকে দেখতে চাই। তখন সে মাতাব্বরকে সামনে আনা হলে পাপী তার গলা ধরে ধাক্কা দিয়ে বলবে আমি তাকেও নিয়ে যাব। অবশেষে সে নেতাকেও জাহান্নামে যেতে হবে। প্রত্যেক আপন ক্ষমতা বলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিহত করলে তা অচিরে নির্মূল হবে। দেশ-জাতি শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে।

আত্মহত্যা হারাম ও জগণ্য পাপ। যারা তরুনদের মগজ দোলাই করে জান্নাতের প্রলোভন দেখিয়ে আত্মঘাতি হামলার জন্য উস্কিয়ে দেয়, তারা নিজের হত্যার পথ বেছে নেই তাদের জন্য জান্নাত হারাম।

হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড় থেকে গড়ায়ে হত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে যাবে। যে ব্যক্তি কোন হাতিয়ার দ্বারা নিজেকে হত্যা করলো সে জাহান্নামে যাবে। যে ব্যক্তি নিজে বিষ পান করে মারা যায় সেও জাহান্নামে যাবে। [বোখারী শরীফ, চিকিৎসা অধ্যায়]

=============

। আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী, বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইমান।
। নুরুল ইসলাম মানিক, সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম, ড.এ.কে. এম. ইয়াকুব হোসাইন’র প্রবন্ধ ‘পরমত সহিষ্ঞুতা ও বিশ্বশান্তি রাসূলল্লাহ দ. এর আদর্শ’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সং, এপ্রিল, ২০০৯, পৃষ্ঠা. ৮২।
। মমতাজ উদ্দীন দেওবন্দী, শরহে আকায়েদে নাসাফী, উর্দূ তরজমা, এমদাদিয়া লাইব্রেরী,ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩০২।
। শরহে বেকায়া, জিহাদ অধ্যায়।
। মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত, কিতাবুল জিহাদ।
। মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ কারণ ও প্রতিকার, ইমাম, প্রথম ব্যাচ স্মারক, ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ইং, পৃষ্ঠা-৭।
। নুরুল ইসলাম মানিক, সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম, প্রফেসর ড. আহমদ আনিসুর রহমানের প্রবন্ধ ‘সন্ত্রাস নির্মূলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আর্দশ।’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংখ্যা, এপ্রিল,২০০৯, পৃষ্ঠা. ৫৩।
। নুরুল ইসলাম মানিক, সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ১জুন ১৯৮৫, পৃ. ৪১৩
। আল কুরআন, সূরা মায়িদা:৩৩।
। আল কুরআন, সূরা মায়িদা:৩২।
। আল কুরআন, সূরা নিসা:৯৩।
। আল কুরআন, সূরা আনআম:১৫১।
। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী, তাফসীরে নাঈমী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪২৭পৃষ্ঠা।
। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী, তাফসীরে নাঈমী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪৩৬ পৃষ্ঠা।
। মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আলখমীস, শরহে ফিকহ আকবর, মাকতাবাতুল ফুরকান, আলইমারাতুল আরাবীয়্যা, ১৯৯৯খ্রি. ১ম খণ্ড, পৃ.১৩১। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী, তাফসীরে নাঈমী ও অন্যান্য।
। আব্দুর রহমান বিন হাসান, আলমাতলাবুল হামীদ ফী বয়ানে মাকাসিদিত তাওহীদ, দারুল হিদায়া, ১৯৯১খ্রি. ১ম খণ্ড, পৃ.২৫৮।

লেখক: অধ্যক্ষ-আল আমিন বারীয়া কামিল মডেল মাদরাসা।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment