১) সুবিখ্যাত দুররুল মুখতার ৩য় খন্ডের المرتد অধ্যায়ে কারামাতে আওলিয়া শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছেঃ
يَاحَاضِرُ يَا نَاظِرُ لَيْسَ بِكُفْرٍ অর্থাৎ হে হাযির, হে নাযির, বলে সম্বোধন করা কুফর হিসেবে গণ্য নয়। উপরোক্ত উক্তির ব্যাখ্যায় ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখিত আছেঃ
فَاِنِّ الْحُضُوْرَ بِمَعْنَى الْعِلْمِ شَائِعٌ مَا يَكُوْنُ مِنْ نَّجْوى ثَلَثَةٍ اِلَّهُوَرَابِعُهُمْ وَالنَّاظِرُ بِمَعْنَى الرُّوْيَةِ اَلَمْ يَعْلَمْ بِاَنَّ اللهَ يَرَى فَالْمَعْنى يَاعَالِمُ مَنْيَّرى
অর্থাৎ এর কারণ হলো হুযুর (حضور) শব্দটি জ্ঞান অর্থে বহুল প্রচলিত। কুরআন শরীফে আছেঃ তিন জনের মধ্যে গোপনীয়ভাবে যা কিছু পরামর্শ হয়ে থাকে আল্লাহ তাআলা ওদেরই চতুর্থজন হিসেবে বিদ্যমান থাকেন । আর نظر নযর শব্দের অর্থ হচ্ছে দেখা। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, কেন, সে জানে না যে, আল্লাহ দেখেন? সুতরাং, ইয়া হাযিরু! ইয়া নাযিরু! শব্দ দুইটির অর্থ হলো হে জ্ঞানী! হে দ্রষ্টা! অতএব, এ উক্তি কুফর হতে পারে না।
দুররুল মুখতার গ্রন্থে, প্রথম খন্ডের كيفية الصلوة শীর্ষক অধ্যায়ে আছেঃ
وَيَقْصِدَ بِاَلْفَاظِ التَّشَهُّدِ الْاِنْشَاءَ كَاَنَّهُ يُحىِّ عَلَى اللهِ وَيُسَلِّمُ عَلَى نَبِيِّه نَفْسِه
অর্থাৎ নামাযে আত্তাহিয়াত বা তাশাহুদ এর শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় নামাযীর এ নিয়ত থাকা চাই যে, কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন, তিনি নিজেই যেন আপন প্রতিপালকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছেন ও স্বয়ং নবী আলাইহিস সালামের প্রতি সালাম আরয করছেন।
এ ইবারতের তাৎপর্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছেঃ
اَىْ لَايَقْصِدُ الْاَخْبَارَ وَالْحِكَايَةَ عَمَّا وَقَعَ فِى الْمِعْرَاجِ مِنْهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَمِنْ رَّبِّه وَمِنَ الْمَلَئِكَةِ
অর্থাৎ তাশাহুদ পাঠের সময় নামাযীর যেন এ নিয়ত না হয় যে, তিনি শুধু মাত্র মিরাজের অলৌকিক ঘটনাটি স্মরণ করে, সে সময় মহাপ্রভু আল্লাহ, হুযুর আলাইহিস সালাম ও ফিরিশতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কথোপকথন এর বাক্য গুলোই আওড়িয়ে যাচ্ছেন। বরং তার নিয়ত হবে কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন ।
স্বনামখ্যাত ফকীহগণের উপরোল্লিখিত ইবারতসমূহ থেকে জানা যায় যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে হাযির-নাযির জ্ঞান করা বা বলা কুফর নয়, আর তাশাহুদ পাঠের সময় হুযুর আলাইহিস সালামকে হাযির-নাযির জেনেই সালাম আরয করা চাই। এ তাশাহুদ প্রসঙ্গে ফকীহগণের আরও অনেক বক্তব্য পেশ করা হবে।
সু-প্রসিদ্ধ মজমাউন বরকাত গ্রন্থে শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) বলেছেন- হুযুর আলাইহিস সালাম নিজ উম্মতের যাবতীয় অবস্থা ও
আমল সম্পর্কে আবগত এবং তার মহান দরবারে উপস্থিত সকলেই ফয়েয প্রদানকারী ও হাযির-নাযির।
শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) سلوك اقرب السبل بالتوجه الى سيد الرسل নামক পুস্তিকায় বলেন- উলামায়ে উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শ ও বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, হুযুর আলাইহিস সালাম প্রকৃত জীবনেই (কোনরূপ রূপক ও ব্যবহারিক অর্থে যে জীবন, তা নয়) স্থায়ীভাবি বিরাজমান ও বহাল তবীয়তে আছেন । তিনি উম্মতের বিশিষ্ট কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞাত ও সেগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীরূপে বিদ্যমান তথা হাযির-নাযির। তিনি হকীকত অন্বেষনকারী ও মহান দরবারে নবুয়াতির শরণাপন্নদের ফয়েযদাতা ও মুরুব্বীরূপে বিদ্যমান আছেন।
শাইখ মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) শরহে ফুতুহুল গায়ব গ্রন্থের ৩৩৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- নবীগণ (আলাইহিস সালামকে) পার্থিব প্রকৃত জীবনেই জীবিত শাশ্বত জীবন সহকারে বিদ্যমান ও কর্মতৎপর আছেন । এ ব্যপারে কারো দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই ।
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাত এর باب مَايُقَالُ عِنْدَ مَنْ حَضَرَبُ الْمَوْتَ শীর্ষক অধ্যায়ের শেষে উল্লেখিত আছেঃ
وَلَاتُبَاعِدُ عَنِ الْاَوْلِيَاءِ حَيْثُ طُوِ يَتُ لَهُمُ الْاَرْضُ وَحَصَلَ لَهُمْ اَبْدَ ان ٌمُكْتَسِبَةَ مُتَعَدِّدَةٌ وَجَدُوْ هَا فِىْ اَمَا كِنَ مُخْتَلِفَةٍ فِىْ اَنٍ وَاحِدٍ
অর্থাৎ ওলীগণ একই মুহূর্তে কয়েক জায়গায় বিচরণ করতে পারে। একই সময়ে তারা একাধিক শরীরের অধিকারী হতে পারেন।
শিফা শরীফে আছেঃ
اِنْ لَّمْ يَكُنْ فِىِ الْبَيْتِ اَحَدٌ فَقُلِ السَّلَامُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِىُّ وَرَحْمَةَ اللهِ وَبَرْكَاتُهُ
যে ঘরে কেউ থাকে না সে ঘরে (প্রবেশ করার সময়) বলবেন হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আপনার উপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক!
এ উক্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বনামখ্যাত মোল্লা আলী কারী (রহঃ) শরহে শিফা গ্রন্থে বলেছেনঃ
لِاَنَّ رُوْحَ النَّبِىِّ عَلَيْهِ السَّلَامُ حَاضِرٌ فِىْ بُيُوْتِ اَهْلِ الْاِسْلَامِ
কেননা নবী আলাইহিস সালাম এর পবিত্র রূহ মোবারক মুসলমানদের ঘরে ঘরে বিদ্যমান আছেন ।
শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) স্ব-রচিত মদারেজুন নবুয়াত গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- হুযুর আলাইহিস সালামকে স্মরণ করুন, তার প্রতি দরুদ পেশ করুন, তার যিকর করার সময় এমনভাবে অবস্থান করুন যেন তিনি আপনার সামনে স্ব-শরীরে জীবিতাবস্থায় উপস্থিত আছেন, আর আপনি তাকে দেখছেন। আদব মর্যাদা ও শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ন রেখে ভীত ও লজ্জিত থাকুন এবং এ ধারণা পোষণ করবেন যে, নিশ্চয় হুযুর পুর নুর আলাইহিস সালাম আপনার কথাবার্তা শুনছেন। কেননা তিনি খোদার গুণাবলীতে গুণান্বিত। আল্লাহর একটি গুণ হচ্ছে আমি (আল্লহ) আমার স্মরণকারীর সঙ্গে সহাবস্থান করি ।
ইমাম ইবনুল হাজ্জ مدخل গ্রন্থে ও ইমাম কুসতালানী (রঃ) مواهب গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ২য় পরিচ্ছেদে زيارة قبره شريف শীর্ষক বর্ণনায় লিখেছেনঃ
وَقَدْ قَالَ عُلَمَاءُ نَالَا فَرْقَ بَيْنَ مَوْتِه وَحَيو تِه عَلَيْهِ السَّلَامُ فِىْ مُشَاهِدَ تِه لِاُمَّتِهِ وَمَعرِ فَتِه بِاَحْوَ الِهِمْ وَنِيَّا تِهِمْ وَعَزَائِمِهِمْ وَخَوَاطِرِ هِمْ وَذلِكَ جَلِىٌّ عِنْدَهُ لَاخَفَاءَبِه
আমাদের সু-বিখ্যাত উলামায়ে কিরাম বলেন যে, হুযুর আলাইহিস সালামের জীবন ও ওফাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি নিজ উম্মতকে দেখেন, তাদের অবস্থা, নিয়ত, ইচ্ছা ও মনের কথা ইত্যাদি জানেন। এগুলো তার কাছে সম্পূর্ণরূপে সুস্পষ্ট কোনরূপ অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতার অবকাশ নেই এখানে।
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতে মোল্লা আলী কারী (রহঃ) বলেনঃ-
وَقَالَ الْغَزَ الِىْ سَلِّمْ عَلَيْهِ اِذَا دَخَلْتَ فِى الْمَسْجِدِ
فَاِنَّهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ يَحْضُرُ فِى الْمَسَجِدِ
ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেছেন, আপনি যখন মসজিদে প্রবেশ করবেন, তখন হুযুর আলাইহিস সালামকে সশ্রদ্ধ সালাম দিবেন। কারণ তিনি মসজিদসমূহে বিদ্যমান আছেন।
কাযী আরায (রহঃ) প্রণীত শিফা শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ নসীমুর রিয়ায এর ৩য় খণ্ডের শেষে উল্লেখিত আছে- আম্বিয়ায়ে কিরাম (আলাইহিস সালাম)শারীরিক ও বাহ্যিক দিক থেকে মানবীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন তবে, আভ্যন্তরীণ ও রূহানী শক্তির দিক থেকে ফিরিশতাদের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ কারণেই তাঁরা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তসমূহ দেখতে পান, আসমানের চিড়চিড় আওয়াজ শোনেন এবং হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) তাদের নিকট অবতরণের ইচ্ছা পোষণ করতেই তার সুঘ্রাণ পেয়ে যান।
সুপ্রসিদ্ধ দালায়েলুল খায়রাত নামক গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখিত আছেঃ
হুযুর আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলঃ আপনার থেকে দূরে অবস্থানকারী ও পরবর্তীকালে ধারাদামে আগমনকররীদের দরূদ পাঠ আপনার দৃষ্টিতে কি রকম হবে? ইরশাদ করেনঃ আন্তরিক অকৃত্রিম ভালবাসা সহকারে দরূদ পাঠকারীদের দরূদ আমি নিজেই শুনি এবং তাদেরকেও চিনি । আর যাদের অন্তরে আমার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা নেই তাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয় ।
কাযী আরায (রহঃ) এ শিফা শরীফের ২য় খণ্ডে আছঃ-
عَنْ عَلْقَمَةَ قَالَ اِذَ ادَخَلْتُ الْمَسْجِدَ اَقُولُ السَّلَامُ عَلَيْكَ اَيُّهَاالنَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرْ كَاتُهُ
হযরত আলকামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, যখন আমি মসজিদে প্রবেশ করি তখন বলি হে নবী । (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)আপনার প্রতি সালাম এবং আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। এ হাদীছটির সমর্থন পাওয়া যায় সুবিখ্যাত আবু দাউদ ইবনে মাজা হাদীছ গ্রন্থদ্বয়ের بات الدعاء عند دخول المسجد শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছ থেকেও।
মদারেজুন নবুওয়াত গ্রন্থের ৪৫০ পৃষ্ঠায় ২য় খণ্ডের ৪র্থ ভাগের حيات انبياء শীর্ষক পরিচ্ছেদে উল্লেখিত আছে- এরপর যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তাআলা হুযুর আলাইহিস সালাম এর পবিত্র শরীরে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন ও এমন এক শক্তি দান করেছেন, যে তিনি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেখানে ইচ্ছা করেন সেখানে স্ব-শরীরে বা অনুরূপ কোন শরীর ধারণ করে অনায়াসে গমন করতে পারেন, কবরের মধ্যে হোক বা আসমানের উপর হোক এ ধরনের কথা সঠিক ও বাস্তবসম্মত। তবে সর্বাবস্থায় কবরের সাথে বিশেষ সম্পর্কে বজায় থাকে।
শাইখ শিহাবুদ্দিন সুহরওয়ার্দী (রহঃ) রচিত সুপ্রসিদ্ধ আওয়ারিফুর মা আরিফ গ্রন্থের অনুবাদ গ্রন্থ মিসবাহুল হিদায়েত এর ১৬৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- অতএব বান্দা যেমন আল্লাহ তাআলাকে সর্বাবস্থায় গুপ্ত ও ব্যক্ত যাবতীয় বিষয়ে অবহিত জ্ঞান করে থাকে, হুযুর আলাইহিস সালামকেও তদ্রূপ জাহিরী ও বাতিনী উভয় দিক থেকে হাযির জ্ঞান করা বাঞ্ছনীয়; যাতে তাঁর আকৃতি বা সুরত দেখার ধারনা, হার-হামিশা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও তার দরবারের আদব রক্ষার দলীলরূপে পরিগনিত হয়, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন দিক থেকে তার বিরুদ্ধাচরনে লজ্জাবোধ হয় এবং তার পবিত্র সহচর্যের আদব রক্ষা করার গৌরব লাভের সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।
সু-প্রসিদ্ধ ফিকহ শাস্ত্র বিশারদ ও উলামায়ে উম্মত এর উপরোক্ত উক্তি সমূহ থেকে হুযুর আলাইহিস সালামের হাযির-নাযির হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হল। এখন আমি আপনাদেরকে জানাতে চাই, একজন নামাজীর নামাজ পড়ার সময় হুজুর আলাইহিস সালাম এর সম্পর্কে অন্তরে কি ধারনা পোষন কর উচিত। এ প্রসঙ্গে আমি অত্র পরিচ্ছেদের প্রারম্ভে সুবিখ্যাত গ্রন্থ দুররুল মুখতার ও শামী থেকে উদ্ধৃত পেশ করছি। অন্যান্য বুজুর্গানের দ্বীনের আরও কিছু বক্তব্য শুনুন এবং নিজ নিজ ঈমানকে তাজা করুন।
আশআতুল লমআত গ্রন্থের কিতাবুস সালাত এর তাশাহুদ অধ্যায়ে ও মাদারেজুন নবুয়াত গ্রন্থ ১ম খন্ডের ১৩৫ পৃষ্টায় ৫ম অধ্যায়ে হুযুর আলাইহিস সালাম এর ফযায়েল এর বর্ণনা প্রসঙ্গে শাইখ আবদুর হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) বলেছেন-
কোন কোন আরিফ ব্যাক্তি বলেছেন- তাশাহুদে আসসালামু আলাইকুম আইয়ুহাননবী বলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের) কে সম্বোধন করার রীতির এ জন্যই প্রচলন করা হয়েছে যে, হাকীকতে মুহাম্মদ্দীয় (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম এর মৌল সও্বা) সৃষ্টিকুলের অনু-পরমানুতে এমনকি সম্ভবপর প্রত্যেক কিছুতেই ব্যাপৃত। সুতরাং হুজুর আলাইহিস সালাম নামাযীগনের সও্বার মধ্যে বিদ্যমান ও হাযির আছেন। নামাযীর এ বিষয়ে সচেতন হওয়া বা এ বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী না হওয়াই বাঞ্চনীয়, যাতে নামাযী নৈকটের নূর লাভে ও মারেফতের গুপ্ত রহস্যাবলী উন্মোচনে সফলকাম হতে পারে।
সুবিখ্যাত ইহয়াউল উলুম গ্রন্থ ১ম খন্ডের ৪র্থ অধ্যায়ে ৩য় পরিচ্ছেদে নামাযের বাতেনী শর্তাবলীর বর্ননা প্রসঙ্গে ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন-
وَلَحْضِرْ فِىْ قَلْبِكَ النَّبِىُّ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَشَخْصَهُ الْكَرِيْمُوَقُلْ اَسَّلَامُ عَلَيْكَ اَيُّهَاا لنَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرْكَاتُهُ
নবী আলাইহিস সালাম তথা তার পবিত্র সও্বাকে নিজ অন্তরে হাযির জ্ঞান করবেন ও বলবেন আসসালামু আলাইকা আইয়ুহাননাবীউ ওয়া রহমতুল্লাহি ওায়া বারাকাতুহু। (হে নবী আপনার উপর শান্তি রহমত ও বরকতের অমৃতধারা বর্ষিত হোক। (মিরকাত গ্রন্থের তাশাহুদ শীর্ষক অধ্যায়েও এ রকম উক্তি বর্ণিত আছে- مسك الختام নামক গ্রন্থের ২৪৩ পৃষ্ঠায়ও ওহাবীমতাবলী নবাব সিদ্দিক হুসেন খান ভূপালী সে একই কথা লিখেছেন যা আমি ইতোপূর্বে আশআতুল লমআত এর বরাত দিয়ে তাশাহুদ প্রসঙ্গে লিখেছি যে, নামাযীর তাশাহুদ পাঠের সময় হুযুর আলাইহিস সলামকে হাযির-নাযির জেনেই সালাম করা চাই। তিনি উক্ত গ্রন্থে নিম্নোল্লিখিত দুটি পংক্তি সংযোজন করেছেনঃ-
প্রেমের রাস্তায় দূরের বা কাছের কোন ঠিকানা নেই। আমি তোমাকে দেখি ও দোয়া করি।
আল্লামা শাইখ মুজাদ্দিদ (রহঃ) বলেনঃ-
নামাযে হুযুর আলাইহিস সালামকে সম্বোধন করা হয়েছে। এটা যেন এ কথারই ইঙ্গিত বহ যে, আল্লাহ তার হাবীবের উম্মতদের মধ্যে নামাযীদের অবস্থা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম) এর কাছে এমনভাবে উদ্ভাসিত করেছেন, যেন তিনি তাদের মধ্যে উপস্থিত থেকেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন, তাদের আমল সমূহ অনুধাবন করছেন। এ সম্বোধনের আরও একটি কারণ হচ্ছে তার এই উপস্থিতির ধারনা অন্তরে অতিমাত্রায় বিনয় ও নম্রভাব সৃষ্টি করে।
হাযির-নাযির এর এ মাসআলার সহিত ফিকাহ শাস্ত্রের কয়েকটি মাসায়েলের সমাধানও সম্পৃক্ত। যেমন ফকীহগণ বলেন স্বামী যদি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে থাকে আর স্ত্রী রয়েছে পশ্চিম প্রান্তে। এমতাবস্থায় স্ত্রী একটি স্ন্তান প্রসব করল এবং স্বামী সেই শিশুটি তার বলে দাবী করল। তাহলে শিশুটি তারই সাব্যস্ত হবে। কারণ স্বামী আল্লাহ ওলী হতে পারেন এবং কেরামতের বদৌলতে স্ত্রীর কাছে পৌছতে পারেন। ফতওয়ায়ে শামী ২য় খণ্ডের ثبوت النسب অধ্যায় দ্রষ্টব্য ।
ফতওয়ায়ে শামী ৩য় খণ্ডের অধ্যায়ে কারামাতে আওলিয়া বিষয়ক র্ব্ণনায় উল্লেখিত আছেঃ
এ দূরত্ব অতিক্রম করাটা সে একই কেরামতের অন্তর্ভুক্ত। এটা এজন্য সম্ভবপর যে হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেছেন, আমার জন্য পৃথিবীকে সঙ্কুচিত করে দেয়া হয়েছিল। এতে ফকহিগণের নিম্নোক্ত মাসআলাটিরও সমাধান হয়ে যায়। মাসআলাটি হলঃ পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত অবস্থানকারী কোন ব্যাক্তি যদি পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানকারী কোন মহিলাকে বিবাহ করেন এবং সে স্ত্রীর সন্তান ভূমিষ্ট হয় তাহলে শিশুটি উক্ত স্বামীর বলে গণ্য হবে। তাতারখানিয়া নামক গ্রন্থে আছে যে, এ মাসআলাটিও কেরামত এর বৈধতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
সে একই জায়গায় শামীতে আরও উল্লেখিত আছেঃ
সেটাই যা ইমাম নাসাফী (রহঃ) একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কথিত আছে যে কাবা শরীফ কোন এক ওলীর সহিত সাক্ষাত করার জন্য গমনাগমন করে-এ কথ বলাটা জায়েয হবে কিনা? এর উত্তরে তিনি বলেছেন আওলিয়া কিরামের দ্বারা কেরামত হিসেবে অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমধর্মী কার্যাবলী সম্পাদন আহলে সুন্নাতের মতে জায়েয।
এ উদ্ধৃতি থেকে জানা গেল যে, পবিত্র কাবা মুয়াজ্জমাও আওলিয়া কিরামের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে ঘুরাঘুরি করে থাকে ।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে সুরা মুলক এর শেষে উল্লেখিত আছেঃ
قَالَ الْاِمَامُ الْغَزَالِىُّ وَالرَّسُوْلُ عَلَيْهِ السَّلَامَ لَهُ الْخِيَارُ فِيْ طَوَ افِ الْعَالَمِ مَعَ اَرْوَاحِ الصَّحَابَةِ لَقَدْرَاَهُ كَثِيْرٌ مِنَ الْاَوْلِياءِ
ইমাম গাযযালী বলেছেন সাহাবায়ে কিরামের রূহসমেত হুযুর আলাইহিস সালামের জগতে পরিভ্রমণের ইখতিয়ার আছে, বিধায় অনেক আওলিয়া কিরাম তাকে দেখেছেন।
انتباه الاذكياء فى حياة الاولياء নামক গ্রন্থের ৭ পৃষ্ঠায় আল্লামা জালালুদ্দিন সয়ুতী (রহঃ) বলেন-
উম্মতের বিবিধ কর্ম-কাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি রাখা তাদের পাপরাশির ক্ষমা প্রার্থনা করা তাদেরকে বালা মাসিবত থেকে রক্ষা করার জন্য দুআ করা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আনাগোনা করা ও বরকত দান করা এবং নিজ উম্মতের কোন নেক বান্দার ওফাত হলে তার জানাযাতে অংশ গ্রহণ এগুলোই হচ্ছে হুযুর আলাইহিস সালাম এর সখের কাজ। কোন কোন হাদীছ থেকেও এসব কথার সমর্থন পাওয়া যায়।
ইমাম গাযযালী (রহঃ) المنقذمن الضلال নামক গ্রন্থে বলেছেনঃ-
ঐশী নূরে আলোকিত অন্তর বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ জাগ্রত অবস্থায় নবী ও ফিরিশতাগণকে দেখতে পান, তাদের সাথে কথাবার্তাও বলেন। সয়ুতী (রহঃ) বলেন,
اِنِ اعْتَقَدَالنَّاسُ اَنَّ رُوْحَهُ وَمِثَالَهُ فِىْ وَقْتِ قْتِ قِرَاءَةِ الْمَوْلِدِ وَخَتْمِ رَمْضَانَ وَقِرَ اءَةِ الْقِصَائِدِ يَحْضُرُ جَازَ
যদি কেউ বিশ্বাস পোষণ করে যে, হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র রূহ মোবারক ও তার জিসমে মিছাল মীলাদ পাঠের সময়, রমযানে খতমে কুরআনের সময় এবং নাত পাঠ করার সময় উপস্থিত হন, তবে এ বিশ্বাস পোষণ করা জায়েয।
মওলবী আবদুল হাই সাহেব তার রচিত تر اويح الجنان بتشر يح حكم شرب الدخان নমক রিসালায় লিখেছেনঃ জনৈক ব্যক্তি নাত পাঠ করতো এবং হুক্কাও পান করতো। সে একদিন স্বপ্নে দেখল যে নবী করীম আলাইহিস সালাম তাকে বলছেন যখন তুমি মীলাদ শরীফ পাঠ কর তখন আমি মাহফিলে উপস্থিত হই। কিন্তু যখনই হুক্কা আনা হয় তখন কালবিলম্ব না করে মাহফিল থেকে ফিরে যাই।
এসব উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হল যে, জগতের অণু-পরমাণুর প্রতিও হুযুর আলাইহিস সালাম ও সার্বক্ষণিক দৃষ্টি নিবন্ধ রয়েছে। আর, নামায, তিলাওয়াত কুরআন, মাহফিলে মীলাদ শরীফ ও নাত পাঠের মাহফিলে বিশেষ করে পুণ্যাত্মাদের নামাযে জানাযায় স্ব-শরীরে তিনি তাশরীফ আনয়ন করে থাকেন।
তাফসীরে রূহুল বয়ান ২৬ পারা সুরা ফতহ এর اِنَّا اَرْ سَلْنكَ شَاهِدًا আয়াত এ ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ- যেহেতু হুযুর আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি, সেহেতু তিনিই আল্লাহর একত্বের সাক্ষী, সে সব বস্তুরও অবলোকনকারী, যেগুলি অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বের সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে এসেছে। যেমন মানবাত্মা, জীবাত্মা শারীরিক কাঠামো, খনিজ পদার্থ, বৃক্ষরাজি, পশু-পক্ষী, ফিরিশতা, মানুষ ইত্যিাদি। সুতরাং খোদা তাআলার সেসব গুপ্ত ভেদ ও বিস্ময়কর ব্যাপারগুলোও যেগুলির রহস্য উন্মোচন অন্য কোন মাখলুকের জন্য সম্ভবপর নয়, তার কাছে রহস্যাবৃত ও অনুদঘাটিত থাকার কোন অবকাশ থাকে না। সে একই জায়গায় আরও কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বলা হয়েছেঃ-
তিনি দেখেছেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টি তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ভুলের কারণে বেহেশত থেকে তার অপসারণ এবং পরে তার তওবা গৃহীত হওয়ার যাবতীয় ঘটনাবলী। শেষ পর্যন্ত সেই আদম আলাইহিস সালামকে কেন্দ্র করে যা কিছু আবর্তিত হয়েছে সবই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখেছেন। তিনি আরো দেখেছেন শয়তানের সৃষ্টি ও যা কিছু তাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। এ থেকে বোঝা গেল যে দৃশ্যমান জগতে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম) অভিব্যক্তির পূর্বেই প্রত্যেক ব্যক্তি ও বস্তুর যাবতীয় অবস্থা তিনি অবলোকন করেছেন।
আরও কিছু দূর অগ্রসর হয়ে উক্ত রূহুল বয়ানের স্বনামধন্য লেখক সে একই বর্ণনায় আরও বলেছেনঃ-
কোন কোন বুযুর্গানে দ্বীন বলেন প্রত্যেক পুণ্যাত্মার সাথে হুযুর আলাইহিস সালামের পবিত্র রূহ মোবারক অবস্থান করে। رقيب عنيد শব্দদ্বয় দ্বার ইহাই বোঝানো হয়েছে, যে সময় রূহে মুহাম্মাদীর স্থায়ী তাওজ্জুহ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে অন্যত্র সরে গেল তখনই তিনি ভুল করে বসলেন এবং তার ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়েছে। একটি হাদীছে উল্লেখিত আছে যে, যখন কোন ব্যভিচারকারী অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হয়, তখন তার নিকট থেকে ঈমান বের হয়ে যায়। উক্ত তাফসীরে রূহুল বয়ানে এজায়গায় বলা হয়েছে, এখানে ঈমান বলতে হুযুর পাকের দৃষ্টিকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে মুমিনবান্দা কোন ভাল কাজ করেন তা হুযুর আলাইহিস সালাম এর কৃপা দৃষ্টির বরকতেই সম্পন্ন করেন। যে পাপ কাজ করে হুযুরের দৃষ্টি অপসারণের ফলশ্রুতিতে সেই পাপ কর্ম সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ থেকে হুযুর আলাইহিস সালামের হাযির-নাযির হওয়ার বিষয়াটি সুন্দনভাবে প্রতিভাত হল।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) স্বরচিত কসিদায়ে নুমান নামক প্রশংসা মূলক কাব্যগ্রন্থে বলেছেনঃ
وَاِذَاسَمِعْتُ فَعَنْكَ قَوْ لًا طَيِّبًا – وَاِذَانَظَرْتُ فَلَااَرَى اشلَّاكَ
অর্থাৎ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম) কে সম্বোধন করে বলছেন হে নবী! যখনই আমি কিছু শুনি শুধু আপনার প্রশংসাই শুনি আর যখন কোনদিকে তাকাই তখন আপনি ছাড়া আর কিছুই আমার দৃষ্টিগোচর হয় না।
ইমাম সাহেব (রহঃ) কুফাতে অবস্থান করে চারিদিকে হুযুর আলাইহিস সালামকে দেখতে পান । -সুত্রঃ জাআল হক ১ম খন্ড-