*কুর’আনে উদ্ধৃত ‘আহলে বাইত’ শব্দের ব্যবহার (পোষ্ট-১)*

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: আ’ল ও আসহা’ব (রা.)-বৃন্দের পক্ষে জবাব শীর্ষক ওয়েবসাইট

বঙ্গানুবাদক: এডমিন

আহল্ কিংবা আহলে বাইত যখন কোনো পুরুষের উদ্দেশ্যে সম্বন্ধ করা হয়, তখন তা সর্বদা তাঁর পরিবারকেই বোঝায়, যা প্রধানত তাঁর স্ত্রী। এমন কী কুর’আনেও আহল/আহলে বাইত শব্দগুলো কোনো ব্যক্তির স্ত্রীকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা কুর’আনের কয়েকটি উদাহরণ থেকে এটা প্রমাণ করবো।

উদাহরণ-১:

وَٱسْتَبَقَا ٱلْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِن دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى ٱلْبَابِ قَالَتْ مَا جَزَآءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوۤءًا إِلاَّ أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ.

অর্থ: এবং তারা উভয়ে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো এবং স্ত্রীলোকটা তাঁর জামা পেছন থেকে ছিঁড়ে ফেল্লো আর তারা উভয়েই স্ত্রীলোকটার স্বামীকে দরজার নিকট পেয়েছিলো। (স্ত্রীলোকটা) বল্লো, ‘কী শাস্তি হতে পারে তার, যে তোমার গৃহিণীর (আহলি’র) সাথে কুকর্ম কামনা করে, কিন্তু এ যে, তাকে কারাগারে বন্দী করা হোক কিংবা কষ্টদায়ক শাস্তি।’ [শিয়াপন্থী শাকির সাহেবের তাফসীরটি সুন্নী তাফসীরে নূরুল ইরফানেরই অনুরূপ; কুর’আন ১২/২৫]

কুর’আনের উপরোক্ত আয়াতে আযীযের স্ত্রীকে “আহলি” বলা হয়েছে, এমন কী শিয়া তাফসীরও এটা নিশ্চিত করেছে।

কেলেঙ্কারি থেকে (স্ত্রীলোকটির) নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা এবং তার কামুক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার জন্য পয়গাম্বর ইঊসুফ (আলাইহিস্ সালাম)-কে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছা তাকে গ্রাস করেছিলো। একটি ভালোমানুষী চেহারা ধারণ করে সে তার স্বামীর দিকে সরাসরি তাকায় এবং ইঊসুফ (আলাইহিস্ সালাম)-কে তার বিরুদ্ধে কুকর্মের অভিপ্রায়ের জন্যে অভিযুক্ত করে এবং এর শাস্তিস্বরূপ জেলখানা বা কঠিন শাস্তি চায়। আয়াতটি বলে: “কী শাস্তি হতে পারে তার, যে তোমার গৃহিণীর (আহলি’র) সাথে কুকর্ম কামনা করে, কিন্তু এ যে, তাকে কারাগারে বন্দী করা হোক কিংবা কষ্টদায়ক শাস্তি।” [পবিত্র কুর’আনের জ্যোতি/Light of the Holy Qur’an; আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কামাল ফাগিহ ঈমানী ও এক দল শিয়া মুসলিম পণ্ডিত কৃত তাফসীর, ১২/২৫]

উদাহরণ-২:

وَحَرَّمْنَا عَلَيْهِ ٱلْمَرَاضِعَ مِن قَبْلُ فَقَالَتْ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ أَهْلِ بَيْتٍ يَكْفُلُونَهُ لَكُمْ وَهُمْ لَهُ نَاصِحُونَ.

অর্থ: এবং আমি পূর্ব থেকেই সমস্ত ধাত্রীকে তার (মানে মূসা আলাইহিস্ সালামের) জন্যে হারাম করে দিয়েছিলাম যতোক্ষণ না (তার বোন এলো এবং) বল্লো, “আমি তোমাদেরকে কি এমন পরিবারের (আহলে বাইতের) সন্ধান দেবো, যারা তোমাদের এ শিশুকে লালনপালন করবে এবং তারা তার মঙ্গলকামী?” [নূরুল ইরফান, ২৮/১২]

এমন কী ওপরের আয়াতে পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর মাকেও আহলে বাইত বলা হয়েছে, আর তা এ কারণে নয় যে তিনি একজন নবীর মা ছিলেন, বরং এ কারণে যে তিনি পয়গাম্বর ইমরান (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রী ছিলেন। আর শিয়া পণ্ডিত আক্বা-পূয়্যা মাহদী যাঁর তাফসীরটি বহুলপ্রচারিত শিয়া ওয়েবসাইট al-islam.org কর্তৃক উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি ও তাঁর মতো কিছু লোক এই আয়াতটিকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন। তাঁরা মনে করেন যে এখানে পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর মাকে আহলে বাইত বলা হয়েছে, কেননা তিনি একজন নবীর মা ছিলেন। না, এটা ভুল উপলব্ধি, কেননা পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা ফেরাউনের সৈন্যদের উদ্দেশ্যেই ছিলো। যদি পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন ওই মহিলাকে পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর মা হওয়ার কারণে ‘আহলে বাইত’ বলে সম্বোধন করতেন, তাহলে সেখানকার লোকেরা অবশ্যই তাঁকে প্রশ্ন করতো যে কে তাঁর সন্তানের মা আর কেন তিনি শিশুটিকে নদীতে ভাসিয়েছিলেন? এবং এরপর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতো।

একটি ভিন্ন শিয়া তাফসীরগ্রন্থে (ওপরের) অনুরূপ বলা হয়েছে:

“(মূসা আলাইহিস্ সালামের বোনের এ বক্তব্যে) ফেরাউনের লোকেরা খুশি হয় এবং তাঁর সাথে ওই মহিলার কাছে চলতে আরম্ভ করে। মূসা আলাইহিস্ সালামের বোন যিনি নিজেকে অপরিচিত ও আগন্তুক হিসেবে প্রদর্শন করেছিলেন, তিনি শিশুর (মানে পয়গাম্বর মূসা আলাইহিস্ সালামের) মাকে বিষয়টি সম্পর্কে জানান।” [পবিত্র কুর’আনের জ্যোতি/Light of the Holy Qur’an; আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কামাল ফাগিহ ঈমানী ও এক দল শিয়া মুসলিম পণ্ডিত কৃত তাফসীর, ২০/৪০ – إِذْ تَمْشِيۤ أُخْتُكَ فَتَقُولُ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ مَن يَكْفُلُهُ فَرَجَعْنَاكَ إِلَىٰ أُمِّكَ كَيْ تَقَرَّ عَيْنُها وَلاَ تَحْزَنَ وَقَتَلْتَ نَفْساً فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ ٱلْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُوناً فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِيۤ أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَىٰ قَدَرٍ يٰمُوسَىٰ]

আর মানুষেরা যদি তাঁদের সাধারণ জ্ঞান/বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যবহার করেন, তবে তাঁরা এই আয়াতটি হতে সহজেই বুঝতে পারবেন যে, পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন কোনোভাবেই মূসা (আলাইহিস্ সালাম) ও তাঁর মায়ের মধ্যে কোনো সম্পর্কের ইঙ্গিত দেননি। যদি তিনি তা করতেন, তাহলে তিনি মহাবিপদে পড়তেন। কিন্তু তিনি মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর মাকে “আহলে বাইত” বলে সম্বোধন করেছিলেন স্রেফ এ কারণে যে তিনি একজন ব্যক্তির (তথা পয়গাম্বর ইমরান আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রী ছিলেন।

এটা সম্ভব যে শিয়াদের দ্বারা উত্থাপিত অযৌক্তিক দাবিগুলোর অকাট্য ও যৌক্তিক জবাব পাঠের পরে তাঁরা তাঁদের তত্ত্বগুলো হতে ইউ-টার্ন/ডিগবাজি খাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তাঁরা বলতে পারেন যে এই আয়াতে একটি গোটা পরিবারকে সম্বোধন করা হয়েছে, শুধুমাত্র একজন মহিলাকে নয়। এমতাবস্থায় এ ধরনের অপযুক্তির জবাব আমরা কুর’আন থেকেই দেবো। কেননা সর্বোত্তম পন্থা হলো কুর’আনের দ্বারা কুর’আনকে ব্যাখ্যা করা। এটা এ কারণে যে, কুরআন তার কোনো এক জায়গায় যা ইঙ্গিত করে, তা তার অন্য জায়গায় স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে এবং কোনো এক জায়গায় সংক্ষেপে যা বলে তা অন্য জায়গায় বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়।

কুর’আন মজীদ ঘোষণা করে:

ٱنْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ ٱلآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ.

অর্থ: দেখো, আমি কীভাবে বিভিন্ন প্রকারে আয়াতগুলো বিবৃত করছি, যাতে কখনো তাদের বোধশক্তির উদয় হয়। [আল-কুর’আন, ৬/৬৫, নূরুল ইরফান]

অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে:

وَلَقَدْ صَرَّفْنَا لِلنَّاسِ فِي هَـٰذَا ٱلْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ فَأَبَىٰ أَكْثَرُ ٱلنَّاسِ إِلاَّ كُفُوراً.

অর্থ: এবং নিশ্চয় আমি মানুষের জন্যে এ কুর’আনের মধ্যে প্রত্যেক প্রকারের উপমা বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছি। অতঃপর অধিকাংশ মানুষ অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া অন্য কিছু মানলো না। [আল-কুর’আন, ১৭/৮৯; নূরুল ইরফান]

কুর’আন থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে এ ঘটনায় একটি গোটা পরিবারের প্রয়োজন ছিলো না, বরং শুধুমাত্র একজন (ধাত্রী) মহিলারই প্রয়োজন ছিলো যিনি শিশুটিকে লালন-পালন করতে সক্ষম। তাহলে কেন পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন তাঁর কথায় একটি সম্পূর্ণ পরিবারকে বোঝাবেন? তাছাড়া, কুর’আনের আরেকটি আয়াতে এই বিভ্রান্তি নিরসনে আরো স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে, যা দ্বারা বোঝা যায় পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন কি একটি সম্পূর্ণ পরিবারের কথা বলেছিলেন, না “আহলে বায়ত” শব্দটি দ্বারা কেবলমাত্র একজন মহিলাকে বুঝিয়েছিলেন?

পাক কালামে এরশাদ হয়েছে:

إِذْ تَمْشِيۤ أُخْتُكَ فَتَقُولُ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ مَن يَكْفُلُهُ.

অর্থ: তোমার (মূসার) বোন চল্লো (তাদের কাছে), অতঃপর বল্লো, “আমি কি তোমাদেরকে তারই কথা বলে দেবো, যে এ শিশুর প্রতিপালন করবে?” [আল-কুর’আন, ২০/৪০; নূরুল ইরফান]

শিয়া তাফসীরবিদবর্গও অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা করেন:

“ফেরাউনের লোকদেরকে (মূসা আলাইহিস্ সালামের) বোন জিজ্ঞেস করেন তিনি কি এমন কোনো ‘নারী’র সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবেন যিনি শিশুটিকে প্রতিপালন করতে সক্ষম? আয়াতটি আরো বলে, ‘আমি কি তোমাদেরকে তার কাছে পরিচালিত করবো, যিনি তাকে লালনপালন করবেন?’ হয়তো তিনি (মানে বোন) আরো যোগ করেছিলেন যে এই ‘মহিলার’ বুকের দুধ জারি ছিলো যা তিনি (বোনটি) নিশ্চিত জানতেন ওই শিশু গ্রহণ করবেন।” [পবিত্র কুর’আনের জ্যোতি/Light of the Holy Qur’an; আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কামাল ফাগিহ ঈমানী ও এক দল শিয়া মুসলিম পণ্ডিত কৃত তাফসীর, ২০/৪০]

অনলাইনে প্রচারিত শিয়া ওয়েবসাইট Al-Islam.org, যেটাতে পূয়্যা/এম,এ, আলীর খাঁটি শিয়া তাফসীর রয়েছে, তাতে বলা হয়: যখন শিশুটিকে ফেরাউনের পরিবার (নদী থেকে) তুলে এনেছিলো এবং তারা শিশুটিকে ভালবাসে বলে মনে হয়েছিলো, তখন তিনি (বোন) তাদের সামনে হাজির হন এবং শিশুটির জন্য একজন ভালো “ধাত্রী” আনার প্রতিশ্রুতি দেন।

একই কথা বলা হয়েছে আরেকটি শিয়া তাফসীরগ্রন্থে যার শিরোনাম ‘তাফসীরে নমুনা’ ৭ম খণ্ড, ৩৫৯ পৃষ্ঠা।

এমন কী সুন্নী তাফসীরবিদবৃন্দও একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

তিনি (বোন) তখন বলেন, “আমি কি তোমাদের এমন ‘কাউকে’ দেখাবো যিনি তার (শিশুর) যত্ন নেবেন?” তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তিনি তাদের কাছে শিশুর ‘মাকে’ নিয়ে আসেন আর শিশু তাঁর বুকের দুধ পান (আরম্ভ) করেন। [তাফসীরে জালালাইন, ২০/৪০]

তিনি (বোন) বুঝিয়েছিলেন, “আমি কি তোমাদেরকে এমন ‘কারো’ কাছে নিয়ে যাবো যিনি তাকে (শিশুকে) তোমাদের জন্যে লালনপালন করতে পারবেন একটি (নির্দিষ্ট) মজুরির ভিত্তিতে?” অতঃপর তিনি তাঁকে (মানে শিশুকে) নিয়ে চল্লেন আর তারা তাঁর (মানে বোনের) সাথে গেলো শিশুর আসল মায়ের কাছে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২০/৪০]

কুর’আন নিজেই এই ধরনের ভুল বোঝাবুঝির উত্তর দেয়, যেখানে এটা পরিষ্কার করে যে পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর বোন কোনো একজন মহিলাকেই “কাউকে” বলে উল্লেখ করেছেন… কুর’আন নিজেই নিজের সেরা ভাষ্যকার। ঐশীগ্রন্থটি অধ্যয়নে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে আমরা দেখতে পাই এ কথাটি কতোখানি সত্য! কুর’আনের অনুচ্ছেদগুলোর একটি যত্নশীল তুলনা এবং সেগুলোর সংযোজন ও সমন্বয় সাধন অনেক অসুবিধা দূর করে দেয়।

অধিকন্তু, যদি যুক্তির খাতিরে আমরা একমতও হই যে এতে একটা গোটা পরিবারের কথা বলা হয়েছিলো, তবুও কেউ এই সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারবেন না যে পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর মা এতে (মানে আহলে বাইত শব্দে) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন; আর তা সন্তানের (মানে মূসা আলাইহিস্ সালামের) মা হওয়ার কারণে নয়, বরং পয়গাম্বর ইমরান (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রী হওয়ার কারণেই, যা ইতিপূর্বে আমরা ব্যাখ্যা করেছি।

উদাহরণ-৩:

فَلَمَّا قَضَىٰ مُوسَى ٱلأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ آنَسَ مِن جَانِبِ ٱلطُّورِ نَاراً قَالَ لأَهْلِهِ ٱمْكُثُوۤاْ إِنِّيۤ آنَسْتُ نَاراً لَّعَلِّيۤ آتِيكُمْ مِّنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ جَذْوَةٍ مِّنَ ٱلنَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ.

অর্থ: অতঃপর যখন মূসা আপন (চুক্তির) মেয়াদ পূরণ করে দিলো এবং তাঁর নিয়োগকর্তাকে ছেড়ে আপন বিবিকে (আহলিহি) নিয়ে যাত্রা করলো, তখন (তার পথের ওপর) ‘তূর’ (সিনাই) পর্বতের দিক থেকে এক আগুন দেখতে পেলো। আপন পরিবার (আহলি)-কে বল্লো, ‘তোমরা এখানে অপেক্ষা করো, তূর পর্বতের দিক থেকে এক আগুন আমার নজরে পড়েছে। সম্ভবতঃ আমি সেখান থেকে কিছু খবর নিয়ে আসতে পারি, অথবা তোমাদের জন্যে কোনো অঙ্গার নিয়ে আসবো যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পারো।’ [শিয়াপন্থী অনুবাদক সারওয়ার, আল-কুর’আন ২৮/২৯]

ওপরের আয়াতের অনুবাদেও শিয়া অনুবাদক হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রীকে “আহল” বলে উল্লেখ করেছেন।

إِذْ قَالَ مُوسَىٰ لأَهْلِهِ إِنِّيۤ آنَسْتُ نَاراً سَآتِيكُمْ مِّنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ آتِيكُمْ بِشِهَابٍ قَبَسٍ لَّعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ.

অর্থ: (স্মরণ করুন সে ঘটনা) যখন মূসা (আলাইহিস্ সালাম) নিজের ‘স্ত্রীকে’ বল্লেন, ‘আমি এক আগুন দেখতে পেয়েছি (অথবা আমি আগুনে এক ঝলক ভালোবাসা ও ভালোলাগা অনুভব করেছি)। এ থেকে আমি তাড়াতাড়িই সুসংবাদ নিয়ে আসবো (যার জন্যে আমরা বহুদিন ধরে মরুভূমি ও জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি)। অথবা আমি (তোমার জন্যে ওখান থেকেও) কিছু জ্বলন্ত আগুন নিয়ে আসবো যাতে করে তুমিও (এর তাপ থেকে) উষ্ণতা অনুভব করতে পারো।’ [ড: তাহিরুল কাদরী কৃত (বাংলা) ইরফানুল কুর’আন, ২৭/৭]

শিয়া তাফসীরসমূহ:

তাফসীরে মজমু’আয়ে বয়ান গ্রন্থে বিবৃত হয় –

قال الزجاج: العامل في إذ أذكر أي أذكر في قصة موسى إذ قال لأهله أي امرأته وهي بنت شعيب.

অর্থ: আল-যাজাজ বলেন, অর্থাৎ মনে রাখবেন মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর ঘটনায় যখন তিনি তাঁর আহল্ (إِذْ قَالَ مُوسَىٰ لأَهْلِهِ) তথা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন এবং তিনি ছিলেন পয়গাম্বর শুয়াইব (আলাইহিস্ সালাম)-এর কন্যা। [তাফসীরে মজমু’আয়ে বয়ান, সূরাহ নমল, ৭ম আয়াতের ব্যাখ্যা]

“যখন তাঁর (মানে মূসা আলাইহিস্ সালামের) জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মনে উদয় হলো, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলেন।” [তাফসীরুল কুর’আন, প্রণেতা: জা’ফর হাসান, প্রতিষ্ঠাতা: জামেআ ইমামিয়া, ৩য় খণ্ড, ২৪৩ পৃষ্ঠা, সূরাহ-২০, আয়াত-১০]

যদিও কিছু শিয়াপন্থী তাফসীরকারক এমন একটি উপমা দিয়েছেন যা ইসলামী ইতিহাসের প্রামাণিক উৎসগুলো দ্বারা সমর্থিত নয় এবং এটা শুধুমাত্র খ্রীষ্টান সূত্রের উপর ভিত্তি করেই দেয়া হয়েছে এ মর্মে যে হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর সাথে তাঁর দুই পুত্রও ছিলেন, তবুও তাঁরা অস্বীকার করেন না যে তাঁর “স্ত্রী”-ও তাঁর সাথে ছিলেন যখন তিনি ভ্রমণ করছিলেন। আর এই আয়াতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে সম্বোধন করেছিলেন। তাই যদি কেউ অস্বীকার করার চেষ্টা করে যে কোনো নবী (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রী তাঁর আহল-এর অংশ নন কারণ তাঁকে (হয়তো ভবিষ্যতে) তালাক দেয়া হতে পারে, তাহলে সেই ব্যক্তি কুর’আনের ওই আয়াতগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবে, যেখানে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর “স্ত্রীবৃন্দ”কে “আহল/আহলে বাইত” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর যদি হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর সন্তানবৃন্দ (ওই সময়ে) তাঁর সাথে থাকেনও এবং তিনি তাঁদের সাথে ভ্রমণও করেন, তবুও তিনি যখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সম্বোধন করেছিলেন তখন তিনি “আহল” শব্দটি ব্যবহারই করতেন না যদি তাঁর স্ত্রী তাঁর “আহল” তথা পরিবারের অংশ না হতেন। তাছাড়া, হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর পুত্রদের কেউই তাঁর পরে ইমাম বা নবী হননি। তাই শিয়াবর্গ হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রীর জন্য যে উপমা ব্যবহার করার চেষ্টা করেন এ মর্মে যে তিনি নবীদের মা হওয়ার কারণে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাও এখানে রদ হয়ে গেছে।

আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আয়াতটি থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের স্ত্রীমণ্ডলী তাঁদেরই আহলে বাইত।

উদাহরণ-৪:

إِلاَّ آلَ لُوطٍ إِنَّا لَمُنَجُّوهُمْ أَجْمَعِينَ إِلاَّ ٱمْرَأَتَهُ قَدَّرْنَآ إِنَّهَا لَمِنَ ٱلْغَابِرِينَ.

অর্থ: কিন্তু লূতের পরিবারবর্গ (আ’ল); তাদের সবাইকে আমরা রক্ষা করবো; ব্যতিক্রম শুধু তার স্ত্রী, যার (ভাগ্যে) পেছনে পড়ে থাকার সর্বনাশ (বিধানকৃত)। [শিয়াপন্থী অনুবাদক সারওয়ার, কুর’আন, ১৫/৫৯-৬০]

এই আয়াতে “ব্যতিক্রম শুধু তার স্ত্রী” মর্মে বাক্যটি অর্থবোধক হতো না, যদি স্ত্রীলোকটি পয়গাম্বর লূত (আলাইহিস্ সালাম)-এর পরিবার (আ’ল) না হতো। নতুবা হযরত লূত (আলাইহিস্ সালাম)-এর স্ত্রী যে তাঁর (মানে লূত আলাইহিস্ সালামের) পরিবারের রক্ষা পাওয়ার বিষয়টির একটি ব্যতিক্রম তা আল্লাহকে কেন স্পষ্ট করতে হতো?

আর মনে রাখবেন, আমরা ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধে আরবী ব্যাকরণবিদদের এমন উদ্ধৃতি দিয়েছি যা’তে তাঁরা বলেছেন যে আহল্ (أهل) এবং আ’ল (آل) একই অর্থবোধক।

এমন কী একটি শিয়া তাফসীরগ্রন্থও একই কথা স্বীকার করেছে যে পয়গাম্বর লূত (আলাইহিস্ সালাম)-এর পরিবারে তাঁর স্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত ছিল:

“আয়াতটি ঘোষণা করে, ‘কিন্তু লূতের পরিবারের সবাইকে আমরা রক্ষা করবো।’ তবে আরবী – إِلاَّ آلَ لُوطٍ – (কিন্তু লূতের পরিবার) মর্মে বাক্যটিতে – أَجْمَعِينَ – (সবাইকে) শব্দটি যুক্ত করে জোর দেয়া হয়েছে, যার দরুন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাঁর পরিবারের সকল সদস্য এমন কী তাঁর পথভ্রষ্ট স্ত্রীও, যে কুফফারদের সাথে সহযোগিতা করেছিলো; আর হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে ইব্রাহীমের সচেতনতার সূত্রে ফেরেশতাবৃন্দ অবিলম্বে স্ত্রীলোকটিকে নিয়মের ব্যতিক্রম হিসেবে নির্ধারণ করেন, এবং বলেন, ‘তার স্ত্রী ব্যতিরেকে, যার সম্পর্কে আমরা বিধান করেছিলাম সে যেনো পেছনে থেকে যায় (শাস্তিস্বরূপ)।” [পবিত্র কুর’আনের জ্যোতি/Light of the Holy Qur’an; আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কামাল ফাগিহ ঈমানী ও এক দল শিয়া মুসলিম পণ্ডিত কৃত তাফসীর, কুর’আন, ১৫/৬০ আয়াতের ব্যাখ্যায়]

(চলবে)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment