*হিজরী নববর্ষে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন প্রসঙ্গে শরঈ দলিল

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

বিগত ২০২১ সালে এই বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম, অথচ ফেইসবুকে কেউ কেউ আমাদেরকে এ মর্মে দলিল প্রদর্শন করতে বলেছেন যে, ইতিপূর্বে কোন্ কোন্ বযূর্গ আলেম এ রকম করেছেন। সত্যি আফসোস! এরা ইসলামী ফিক্বাহ তথা বিধিবিধান শাস্ত্রের উসূল বা মূলনীতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাই নিচে এ নিয়ে আলোকপাত করলাম।

উসূল/মূলনীতিগত ক্বায়দা বা নিয়ম:

প্রথমেই জানা আবশ্যক যে, ইসলামী শরীয়তের বিধান মোতাবেক সকল বস্তু (বা বিষয়ের) আসল বা মূল মোবাহ, অর্থাৎ, বৈধ। যথা – কাজী খাঁন, দুর্রে মুখতার ইত্যাদি ফেক্বাহ’র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে:

أن الأصل في الأشياء الإباحة.

অর্থ: সকল বস্তুর মূল বৈধ বা হালাল। আল্লাহর কিতাবে বা রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর সুন্নাহতে নিষেধাজ্ঞা দ্বারাই কেবল এই বৈধতা রহিত হতে পারে। শায়খ ইঊসুফ ক্বারাদাউয়ী সাহেব এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এর সপক্ষে শরঈ দলিল উপস্থাপন করেছেন তাঁর অনলাইন সাইটে

সার সংক্ষেপ হলো, ক্বুর’আন মজীদ, হাদীস শরীফ, ইজমায়ে উম্মত ও ক্বিয়াস দ্বারা যেসব বিষয় হারাম ঘোষিত হয়নি, সেগুলো বৈধ এবং উদ্দেশ্যভেদে সওয়াব ও পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত। সৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্মসমূহ সওয়াবের উৎস হবে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্মসমূহ গুনাহের উৎস হবে। যথা – হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান – إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ – নিশ্চয় কর্মসমূহ নিয়্যত তথা উদ্দেশ্য দ্বারা বিবেচিত। [ইমাম নববী কৃত হাদীসে আরবাঈন গ্রন্থ, ১ নং হাদীস]।

এমতাবস্থায় যাঁরা কোনো বিষয়কে জায়েয বলেন, তাঁদের শরীয়তের দলিল প্রদর্শন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যাঁরা হারাম দাবি করেন, তাঁদেরই কেবল দলিল প্রদর্শন করা আবশ্যক হয়। [এ ব্যাপারে শায়খ তাহিরুল কাদেরী সাহেবের ‘মিলাদুণ্নবী (দ:)’ বইটির সাম্প্রতিক কয়েকটি পর্বে আলোচনা করা হয়েছে]

শরঈ দলিল:

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ ٱللَّهِ.

অর্থ: তাদেরকে (মানুষদেরকে) আল্লাহর দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিন। [সূরা ইবরাহীম, ৫ আয়াত]

এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী হযরত মূসা (আ:)-এর প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছেন যেনো তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। “আল্লাহর দিনগুলো” হলো সে সব দিন যা’তে বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল বা এমন সব দিন যেগুলোতে আল্লাহ্ পাক তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি তাঁরই বড় নেয়ামত তথা আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন।

‘আল্লাহর দিনগুলোর’ উপরোক্ত ব্যাখ্যার পক্ষে কুরআন মজীদ সাক্ষ্য দেয়, যেখানে হযরত মূসা (আ:)-কে উদ্ধৃত করা হয়েছে:

وَإِذْ نَجَّيْنَٰكُم مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوۤءَ ٱلْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَآءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَآءَكُمْ وَفِي ذَٰلِكُمْ بَلاۤءٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَظِيمٌ.

অর্খ: “আর যখন মূসা (আ:) আপন সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, স্মরণ করো তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে, যখন তিনি তোমাদেরকে ফিরআউনী সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিতো এবং তোমাদের পুত্রদের যবেহ্ করতো ও তোমাদের কন্যাদেরকে জীবিত রাখতো; এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের মহা অনুগ্রহ রয়েছে” (সুরা ইব্রাহীম, ৩ নং আয়াত)।

আল্লাহ্ তা’লার উপরোল্লিখিত আয়াতের সারমর্ম অনুযায়ী, হযরত মূসা (আ:)-এর জাতি যেদিন ফিরআউন হতে মুক্তি লাভ করেন সেদিনটি “আল্লাহর দিন” হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। অতএব, ‘আল্লাহর দিন‘গুলো স্মরণীয় করে রাখতে এবং সেগুলোকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মবদ্ধভাবে পালন করতে এই উম্মতের সময়কালে যে হিজরী সাল চালু করা হয়েছে, যে সালের গণনা দ্বারা আমরা মীলাদুন্নবী (দ:) দিবস, রোযা, হজ্জ্ব, দুই ঈদ, শবে ক্বদর, শবে মে’রাজ, শবে বর’আত, আশুরা, আহলে বায়ত-আসহাব (রা:) ও আউলিয়া কেরাম (রহ:)’এর বেসাল বার্ষিকী/উরস ইত্যাদি ‘আল্লাহর প্রিয় দিবস’ পালন করে থাকি, সেই নে’আমতপূর্ণ সালের শুরুতে মানুষের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন অবশ্যই জায়েয ও সওয়াবদায়ক। বিশেষ করে মুসলমান তরুণ সমাজ নিজেদের এই ঐতিহ্যবাহী সাল গণনা য়েখানে ভুলতে বসেছেন, সেখানে এটাকে বেশি বেশি স্মরণ করিয়ে দেয়া আরো বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা আরো বলবো, ফেইসবুকে কারো কারো কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে আসুন আমরা সবাই হিজরী বর্ষকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করি এবং মানুষের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় করে তুলি। আল্লাহ তৌফীক্ব/সামর্থ্য দিন, আমীন।

ফেইসবুকে অপপ্রচারকারীদের জবাবে –

পথভ্রষ্টদের চামচাগুলো একটাই ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাচ্ছে যে, কোনো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিনে কারো বাবা মারা গেলে সেদিনটির প্রতিটি বার্ষিকীতে কি কেউ শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন? আরে বেয়াকুব, কোনো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিন হলো আম তথা সাধারণ/সার্বিক। আর কারো আত্মীয় মারা যাওয়ার বিষয়টি হলো খাস তথা সুনির্দিষ্ট। কারো ’খাস’ কোনো কারণে ’আম’ বিষয় নাকচ হয়ে যায় না! যেমন (ঈদে) মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিবসে কারো বাবা মারা গেলে ওই দিনের উদযাপন নাকচ হয়ে যায় না। দ্বিতীয়তঃ ১লা মুহর্রম হিজরী বর্ষের আরম্ভ; আর ১০ই মুহর্রম আশুরা। আশুরার দিন কারবালার বিষাদময় ঘটনায় ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাত হয়েছিলো। কিন্তু সেটা তো ১০ দিন পরে! এর সাথে ১লা তারিখের সম্বন্ধ কোথায়? জালিয়াতিরও তো একটা সীমা থাকা উচিৎ! উপরন্তু, আমি ইতিপূর্বের পোস্টে বলেছি যে আমরা সুন্নী মুসলমান সমাজ হিজরী নববর্ষে উল্লাস করি না, বরং স্রেফ মুসলমানদের প্রতি শুভ কামনা ব্যক্ত করি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও জোরজবরদস্তি এটাকে উল্লাস প্রকাশের দিন হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস একমাত্র এজেন্ডাধারী মোনাফেক্ব রাফেযীচক্রই পেতে পারে! অতএব, এদের প্রতারণার ফাঁদে কেউ পা দেবেন না।

*সমাপ্ত*

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment