মূল: আ’ল ও আসহা’ব (রা.)-বৃন্দের পক্ষে জবাব শীর্ষক ওয়েবসাইট
বঙ্গানুবাদক: এডমিন
(পাল্টা যুক্তি) – أَفَأَمِنَ أَهْلُ ٱلْقُرَىٰ أَن يَأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا بَيَٰتاً وَهُمْ نَآئِمُونَ – অর্থ: তবে কি জনপদসমূহের অধিবাসীরা এ ভয় করে না যে তাদের ওপর আমার শাস্তি রাতে আসবে যখন তারা নিদ্রারত থাকবে? [শিয়াপন্থী অনুবাদক শাকির, কুর’আন, ৭/৯৭; সুন্নী নূরুল ইরফান তাফসীরেরই অনুরূপ]
আহলুল কুর’আ অর্থ জনপদ/শহরসমূহের মানুষেরা। উপরোক্ত আয়াতে মানুষদের উল্লেখ করা হলেও জনপদ/শহরসমূহ তথাপিও বহুবচন। আপনার ওপরের কথানুসারে তাহলে এতে উল্লেখিত শহরসমূহ (বহুবচন)-কে অবশ্যই শহর (একবচন) হতে হবে।
জবাব:
এই যুক্তি যাঁরা উত্থাপন করেছেন তাঁদের মৌলিক ব্যাকরণগত দক্ষতা নেই, যার কারণে তাঁরা এই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করেন।
কুর’আনের ৩৩/৩৩ আয়াতে ‘বাইত/গৃহ’ শব্দটি একবচন, কারণ এটা একক ব্যক্তির (অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারের কথা উল্লেখ করে। অথচ ওপরের উদাহরণে শহরগুলো বহুবচন, কেননা এটা কেবল একটা শহর নয়, বিভিন্ন শহরের লোকদের কথা উল্লেখ করে। এ কারণেই কুর’আনের ৩৩/৩৩ আয়াতে আপনি আহলে বুয়ূত নয়, বরং “আহলে বাইত” খুঁজে পান।
অপযুক্তি-৪:
স্ত্রীবৃন্দ এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেত্রে আপনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আহলে বাইত বলতে পারেন, কিন্তু ‘আহলুল বাইত’ বলতে পারবেন না। বিশেষ্য (إسم) বা সর্বনাম (الضّمائر) বাইত শব্দের সাথে সংযুক্ত হলে ‘আল’ (ال) ব্যবহার করা হয় না। “রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আহলে বাইত” এবং “আহলুল বাইত”-এর মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
জবাব:
এটা একটা মনগড়া নিয়ম যা সম্পূর্ণ ভুল। নিচে কিছু হাদীস পেশ করা হলো যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীবৃন্দ (রা.)-কে বাইত (بيت) শব্দের সাথে ‘আল’ (ال) যুক্ত করে সম্বোধন করেছেন।
এই হাদীস মুসলিম শরীফ গ্রন্থে বর্ণিত:
قَالَ أَنَسٌ وَشَهِدْتُ وَلِيمَةَ زَيْنَبَ فَأَشْبَعَ النَّاسَ خُبْزًا وَلَحْمًا وَكَانَ يَبْعَثُنِي فَأَدْعُو النَّاسَ فَلَمَّا فَرَغَ قَامَ وَتَبِعْتُهُ فَتَخَلَّفَ رَجُلاَنِ اسْتَأْنَسَ بِهِمَا الْحَدِيثُ لَمْ يَخْرُجَا فَجَعَلَ يَمُرُّ عَلَى نِسَائِهِ فَيُسَلِّمُ عَلَى كُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ ” سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ كَيْفَ أَنْتُمْ يَا أَهْلَ الْبَيْتِ ” . فَيَقُولُونَ بِخَيْرٍ.
অর্থ: হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি নিজে যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-এর ওয়ালীমাহ অনুষ্ঠানে ছিলাম। সে অনুষ্ঠানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের তৃপ্তি সহকারে রুটি ও মাংস আহার করিয়েছিলেন। সে ওয়ালীমার দা’ওয়াত দেয়ার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যখন ওয়ালীমার কাজ শেষ করে উঠলেন আমিও তাঁর পেছন পেছন চললাম। তখনো দু’জন লোক ঘরে কথাবার্তায় ব্যস্ত রইলো, তারা বের হলো না। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রী (রা.)-বৃন্দের কাছে গেলেন এবং প্রত্যেককেই ’আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে পরিবারসদস্যরা (আহলুল বাইত/أَهْلُ الْبَيْتِ)! তোমরা কেমন আছো? উত্তরে প্রত্যেকেই বলেন, “আমরা ভাল আছি।” [মুসলিম শরীফ, কিতাব-৮, হাদীস নং-৩৩২৮]
মন্তব্য: আমরা এখানে একটি সুস্পষ্ট হাদীস শরীফ পাই যা’তে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীমণ্ডলী (রা.)-কে ’আহলুল বাইত’ বলা হয়েছে।
মুসলিম শরীফ হাদীসগ্রন্থ হতে আরেকটি উদাহরণ নিম্নরূপ:
وحدثنا زهير بن حرب وإسحاق بن إبراهيم. كلاهما عن جرير. قال زهير: حدثنا جرير عن منصور، عن إبراهيم. قال: قلت للأسود: هل سألت أم المؤمنين عما يكره أن ينتبذ فيه؟ قال: نعم. قلت: يا أم المؤمنين! أخبريني عما نهى عنه رسول الله صلى الله عليه وسلم أن ينتبذ فيه. قالت: نهانا، أهل البيت، أن ننتبذ في الدباء والمزفت.
অর্থ: ইব্রাহীম (রা.) বর্ণনা করেছেন: আমি আসওয়াদ (রা.)-কে বল্লাম তিনি মু’মিনদের মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কিনা (কোন্ পাত্রে) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাবীয/মদ প্রস্তুত অপছন্দ করেছেন। তিনি (আসওয়াদ) বললেন: হ্যাঁ; আমি জিজ্ঞেস করলাম: মু’মিনদের মা, আমাকে সেসব পাত্র সম্পর্কে অবহিত করুন যেগুলোতে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাবীয প্রস্তুত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি (হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) (উত্তরে) বল্লেন: তিনি আমাদেরকে মানে তাঁর পরিবারের সদস্যদের [আহলুল বাইতকে] লাউ বা বার্নিশ করা পাত্রে নাবীয প্রস্তুত করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি: আপনার কি মনে আছে সবুজ কলস, এবং (অন্য) কলস? তিনি (উত্তরে) বলেন: আমি যা শুনেছি তা তোমাকে বর্ণনা করলাম। আমি কি তোমাকে তা বর্ণনা করবো যা আমি শুনিনি? [সহীহ মুসলিম, কিতাব-২৩, আন্তর্জাতিক নম্বর-৪৯১৮]
মন্তব্য: ওপরের হাদীসে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীবৃন্দকে আহলুল বাইত (রা.) বলা হয়েছে, যদিও তাঁরা আলাদা আলাদা গৃহে বসবাস করতেন। এটা এ কারণে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক তাঁর সকল স্ত্রীর প্রতিই নিষেধাজ্ঞাটি দেয়া হয়েছিলো।
সহীহ বুখারী: আন্তর্জাতিক নম্বর ৩৩৭০:
حَدَّثَنَا قَيْسُ بْنُ حَفْصٍ، وَمُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، قَالاَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ، حَدَّثَنَا أَبُو قُرَّةَ، مُسْلِمُ بْنُ سَالِمٍ الْهَمْدَانِيُّ قَالَ حَدَّثَنِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عِيسَى، سَمِعَ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ أَبِي لَيْلَى، قَالَ لَقِيَنِي كَعْبُ بْنُ عُجْرَةَ فَقَالَ أَلاَ أُهْدِي لَكَ هَدِيَّةً سَمِعْتُهَا مِنَ النَّبِيِّ، صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ بَلَى، فَأَهْدِهَا لِي. فَقَالَ سَأَلْنَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ الصَّلاَةُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ عَلَّمَنَا كَيْفَ نُسَلِّمُ. قَالَ “ قُولُوا اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ ”.
অর্থ: কায়স ইবনু হাফস ও মূসা ইবনু ইসমাঈল (রহঃ) … আবদুর রাহমান ইবনু আবূ লায়লা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কা’আব ইবনু উজরা (রাঃ) আমার সাথে দেখা করে বললেন, আমি কি আপনাকে এমন একটি হাদীয়া দেবো না যা আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি? আমি বললাম, হাঁ, আপনি আমাকে সে হাদীয়াটি দিন। তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনাদের উপর অর্থাৎ আহলে বাইতের উপর কীভাবে দরূদ পাঠ করতে হবে? কেননা, আল্লাহ তো (কেবল) আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা কীভাবে আপনার উপর সালাম প্রেরণ করবো। তিনি বললেন, তোমরা এভাবে বলো, “হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিবারসদস্যদের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেরূপ আপনি পয়গাম্বর ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর পরিবারসদস্যদের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিবারসদস্যদের উপর তেমনি বরকত দান করুন যেমনি আপনি বরকত দান করেছেন ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এবং ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর পরিবারসদস্যদের উপর। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অতি মর্যাদার অধিকারী।
মন্তব্য: এই বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই যে সাহাবা (রা.)-বৃন্দ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তাঁরা কীভাবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আহলে বাইত (রা.)-কে সালাত-সালাম জানাবেন।
সহীহ মুসলিম, কিতাব-৪, হাদীস-৮০৭:
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ نُمَيْرٍ، حَدَّثَنَا رَوْحٌ، وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ نَافِعٍ، ح وَحَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، ء وَاللَّفْظُ لَهُ ء قَالَ أَخْبَرَنَا رَوْحٌ، عَنْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَمْرِو بْنِ سُلَيْمٍ، أَخْبَرَنِي أَبُو حُمَيْدٍ السَّاعِدِيُّ، أَنَّهُمْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ نُصَلِّي عَلَيْكَ قَالَ “ قُولُوا اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ ” .
অর্থ: তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা কীভাবে আপনার প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বল্লেন, তোমরা বোলো: “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর স্ত্রীবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানদের প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করুন, যেমনটি আপনি পয়গাম্বর ইব্রাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর আ’লের (মানে পরিবারসদস্যদের) প্রতি প্রেরণ করেছিলেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর স্ত্রীবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানদের প্রতি বরকত/আশীর্বাদ দান করুন, যেভাবে আপনি পয়গাম্বর ইব্রাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর পরিবারসদস্যদেরকে বরকত দান করেছিলেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত।”
মন্তব্য: এর পূর্ববর্তী বর্ণনায় যদিও প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে তাঁর এবং তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি সালাত-সালাম ও বরকত পাঠাতে হয়, কিন্তু এখানে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিবালোকের মতো স্পষ্ট আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে তাঁর স্ত্রীমণ্ডলী (রা.) এবং তাঁর বংশধরবৃন্দ (রা.) সম্মিলিতভাবে তাঁর পরিবার গঠন করেন, যা ব্যক্ত করতেই ‘আহলুল বাইত’ শব্দটি হাদীসসমূহে ব্যবহার করা হয়েছে।
অপযুক্তি-৫:
(আল-কুর’আন ৩৩/৩৩ প্রসঙ্গে) আরবী ‘ইন্নামা’ (إِنَّمَا) শব্দটি (অর্থাৎ, সত্যি অথবা শুধুমাত্র) অনন্য পার্থক্য জ্ঞাপন করে। এই অনন্য পার্থক্যের ওপর জোর দিতে ‘ইউযহিবা’ (يُذْهِبَ) তথা ‘দূরীভূতকরণ’ ক্রিয়াপদের দ্বিতীয় কর্ম ‘আনকুম’ (তোমাদের থেকে – عَنكُـمُ) শব্দটিকে প্রথম কর্ম ‘রিজস্’ (رِّجْسَ) তথা ‘অপবিত্রতা’ শব্দের আগে উল্লেখ করা হয়েছে। আরো জোর দেয়ার জন্যে ‘আহলুল বাইত’ (أَهْلَ ٱلْبَيْتِ) শব্দটিকে ‘আনকুম’ (তোমাদের থেকে) সর্বনামের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। পুরো বাক্যাংশের ব্যাকরণগত কাঠামো ইঙ্গিত করে যে এটা একটা অনন্য বিশেষত্ব বা পার্থক্য যা শুধুমাত্র আহলে বাইতকে দেয়া হয়েছে, অন্য সকলকে এ থেকে বাদ দিয়ে।
অতএব, দাবি এ মর্মে উত্থাপিত হয়েছে যে “ইন্নামা” শব্দটি শুধুমাত্র আহলে বাইতের (রা.) বেলাতেই আল্লাহর পরিশুদ্ধির ইচ্ছাকে সীমাবদ্ধ করেছে। তাই আল্লাহ যাঁদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান তাঁরা হলেন আহলে বাইত (রা.)। শিয়াবর্গ যুক্তি দেখায় যে আয়াতটি যদি কেবলমাত্র প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদেরই সম্বোধন করে থাকে, তাহলে ‘আহলে কিসা’ও কীভাবে পরিশুদ্ধ হলো? কেননা ‘ইন্নামা’ শব্দটি “সীমিতকারক,” আর তাই এটা দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাকে শুধুমাত্র নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের পবিত্রকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।
জবাব:
এটা শিয়াদের দ্বারা প্রায়শই পুনরাবৃত্ত অপযুক্তি; তাই আমরা এই বিষয়টি আরো ভালো এবং পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্যে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। ব্যাখ্যা শুরু করার আগে সম্পূর্ণ আয়াতটি (কুর’আন ৩৩:৩৩) উদ্ধৃত করা যাক:
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلاَ تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ ٱلْجَاهِلِيَّةِ ٱلأُولَىٰ وَأَقِمْنَ ٱلصَّلاَةَ وَآتِينَ ٱلزَّكَـاةَ وَأَطِعْنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُـمُ ٱلرِّجْسَ أَهْلَ ٱلْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيـراً.
অর্থ: আর নিজেদের গৃহসমূহে অবস্থান করো এবং বে-পর্দা থেকো না যেমনটি পূর্ববর্তী যুগের পর্দাহীনতা; আর নামায কায়েম রাখো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করো। হে নবীর পরিবারবর্গ (আহলে বাইত) – আল্লাহ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে প্রত্যেক অপবিত্রতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে অতীব পরিচ্ছন্ন (তাতহীর) করে দেবেন। [কুর’আন, ৩৩/৩৩; নূরুল ইরফান]
প্রত্যুত্তর-১:
শিয়া গোষ্ঠী অপযুক্তি দেখায় যে (ওপরের আয়াতের) দ্বিতীয় অংশটি একটি পৃথক আয়াত যা এর আগে বা পরে যা আছে তার সাথে যুক্ত নয়; এবং এমতাবস্থায় প্রশ্ন দাঁড়ায়: এটা কি ব্যাকরণগতভাবে সঠিক যুক্তি? আয়াতের দ্বিতীয় অংশ কি এটাকে ঘিরে থাকা প্রসঙ্গ থেকে স্বতন্ত্র হতে পারে?
আমরা আয়াতে করীমার দুটো অংশকে বিভক্ত করেছি সাধারণ ফণ্ট ও বোল্ড করা ফন্ট দ্বারা; আর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আয়াতুল তাতহীর শীর্ষক দ্বিতীয়াংশটির সূচনা হয়েছে ‘ইন্নামা’ শব্দ দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ‘তাতহীরান্’ শব্দ দিয়ে।
এক্ষণে আমরা প্রশ্ন করছি, কোনো স্বতন্ত্র বাক্য যা এর আগে বা পরে কোনো কিছুর সাথে যুক্ত নয়, তা কি ‘ইন্নামা’ শব্দ দ্বারা আরম্ভ হতে পারে? আরবী ভাষায় ‘ইন্নামা’ (إِنَّمَا) শব্দটির ‘আদত-হাসর’ (أداة حصر) শীর্ষক (নির্দিষ্টকরণ) কর্মের পরিচিতি রয়েছে। এর মানে এটা সীমিত বা নির্দিষ্ট করে, অর্থকে সীমিত/নির্দিষ্ট করে।
শাস্ত্রীয় আরব ভাষাবিদ যেমন আল-ফার্রা এবং ইবনে ফারিস ‘আল-বাহরুল-মুহীত’ গ্রন্থে বলেছেন:
قال الفراء: ولا يكون ابتداء إلا ردا على أمر، ولا يكون ابتداء كلام. قال ابن فارس: والذي قاله الفراء صحيح وحجته: {إنما الولاء لمن أعتق}. قلت: ينبغي أن يكون الرد لأمر محقق أو مقدر، وإلا لورد عليه {إنما الأعمال بالنيات} ونحوه. من أحسن ما يستدل به أنها للحصر: قوله تعالى: {إنما يتقبل الله من المتقين}؛ لأنه لم يتقبل من أخيه، فلو كان يتقبل من غير المتقين لم يجز الرد على الأخ بذلك، ولو كان المانع من عدم القبول فوات معنى في المتقرب به لا في الفاعل لم يحسن ذلك، فكأنه قال: استوينا في الفعل وانحصر القبول في بعلة التقوى.
অর্থাৎ, ভাষাবিদবৃন্দ বলেন যে “ইন্নামা” একটি বাক্য শুরু করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না, যদি না এটা তার আগে যা এসেছে তার সাথে যুক্ত না হয়; এটা শুধু বাক্যের শুরুতে ব্যবহৃত হতে পারে যদি এটা অন্য কিছুর প্রত্যুত্তরে হয়। অন্যথায়, এটা কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সরল সমগ্রতা বোঝায়।
ভাষাবিদবৃন্দের মতানুসারে এটা এ কারণে যে ‘ইন্নামা’ (إِنَّمَا) শব্দটি দুটি কাজ করে, যা নিম্নরূপ:
১. মা’ আন্ নাফিয়্যাহ – ما النافية; এবং
২. ইল্লাল্ ইসতিছনায়্যিইয়্যাহ – إلا الإستثنائية;
যেখানে “মা” (ما)-এর রয়েছে নেতিকরণের কাজ, এবং “ইল্লা” (إلا)-এর একটি ব্যতিক্রম করার কাজ রয়েছে।
নিচে একটি বাক্যের সূচনায় পূর্বের কোনো প্রসঙ্গের সাথে সংযুক্তি ছাড়াই ‘ইন্নামা’ শব্দটি ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো:
إنما خلق الله الشمس
উচ্চারণ: ইন্নামা খালাক্বাল্লাহুশ্ শামসা।
অনুবাদ: আল্লাহ শুধুমাত্র সূর্য সৃষ্টি করেছেন।
আপনারা যেমনটি দেখতে পাচ্ছেন যে এই অর্থটি ভুল। কেননা আমরা সবাই বিশ্বাস করি আল্লাহ সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন ঠিক, তবে ওপরের বাক্যটি বোঝায় আল্লাহ শুধুমাত্র সূর্যকেই সৃষ্টি করেছেন; এই কথাটি ধর্মদ্রোহিতা, কারণ আমরা জানি আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং শুধু সূর্য নয়।
কারণ আমরা আগেই বলেছি “ইন্নামা”-এর একটি সীমিতকরণের কার্য রয়েছে এবং আমাদের ক্ষেত্রে এটি আল্লাহর সৃষ্টিকে শুধুমাত্র সূর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে এবং যেমনটি আমরা বলেছি “ইন্নামা” আরবী ভাষায় দুটি হাতিয়ারের কাজ করে এবং সেগুলো হলো ‘মা’ (ما – নেতিকরণ), এবং “ইল্লা” (إلا – ব্যতিক্রম)।
তাই আমরা যেনো এ কথা বলছি:
ما خلق الله إلا الشمس
উচ্চারণ: মা খালাক্বাল্লাহু ইল্লাশ্ শামসা।
অর্থ: আল্লাহ কখনো সৃষ্টি করেননি, সূর্য ব্যতিরেকে।
ওপরে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ‘মা’ (ما) কীভাবে নেতিকরণের কাজ করে, আর তা ‘কখনো নয়’ অর্থ জ্ঞাপন করে। এতে ব্যক্ত হয় আল্লাহ কখনো কোনো কিছু সৃষ্টি করেননি; অতঃপর আসে অপর হাতিয়ার ‘ইল্লা’ (إلا) যা ব্যতিক্রম অর্থ জ্ঞাপন করে। কেননা এটা ব্যতিক্রমের কাজ করে যা দ্বারা সূর্যকে ব্যতিক্রম নির্ধারণ করে। তাই এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহতায়ালা কখনোই কোনো কিছু সৃষ্টি করেননি, ব্যতিক্রম শুধু সূর্য। এ কথাটি স্পষ্ট ধর্মদ্রোহিতা।
এই কারণেই আমরা বেশিরভাগ বাক্যের শুরুতে “ইন্নামা” হাতিয়ারটি ব্যবহার করতে পারি না, কারণ এটা অর্থকে সীমাবদ্ধ করে এবং সম্পূর্ণতা বোঝায়, যদি না আমরা এটাকে একটা প্রসঙ্গের অংশ হিসেবে ব্যবহার করি, যেমনটি কোনো বিপথগামী মু’তাযেলীকে উত্তর দিতে গিয়ে আমরা নিচের যে উদাহরণ প্রদর্শন করি।
মুতাযিলাপন্থী বলে থাকে: আল্লাহ কুর‘আন ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন।
এর কারণ হলো, তারা (মুতাযিলাপন্থী গোষ্ঠী) বিশ্বাস করে যে কুর’আনকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা চিরন্তন নয়, আর এটা মুসলমানদের ধর্মমতে একটি ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস। তাই এই ক্ষেত্রে আমরা “ইন্নামা” (إِنَّمَا) ব্যবহার করে তার উত্তর দিতে পারি, ঠিক যেভাবে এটা ব্যবহার করা হয়েছিল ওপরে। আমরা (উত্তরে) বলি:
إنما خلق الله الشمس
উচ্চারণ: ইন্নামা খালাক্বাল্লাহুশ্ শামসা।
অনুবাদ: আল্লাহ শুধুমাত্র সূর্য সৃষ্টি করেছেন।
এই উপলক্ষে আমরা আমাদের কথা “ইন্নামা” দিয়ে শুরু করলেও এটা আর আগের মত ভ্রষ্ট ধর্মদ্রোহীমূলক অর্থ ধারণ করে না; কারণ আমরা আগেই বলেছি যে “ইন্নামা” হাতিয়ারটি ব্যবহার করা হলে এর আগে যে অর্থ বা প্রসঙ্গ এসেছিলো তার সাথে তাকে যুক্ত করতে হবে। আমাদের দ্বারা মু’তাযেলীর যুক্তির খণ্ডনের প্রেক্ষাপটে তাই এর অর্থ দাঁড়াবে:
“আল্লাহ শুধুমাত্র সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন।” (ওই পথভ্রষ্টের উল্লেখিত দুটি বিষয়ের মধ্যে কেবল একটির প্রতি স্বীকৃতি এতে রয়েছে; কুর’আনও সৃষ্ট মর্মে তার দাবি এ বাক্যে নাকচ হয়েছে)
তাই মূলত আমরা তাকে বলছি, সে যা দাবি করেছে তা ভুল এবং সে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে (কুর’আন ও সূর্য) তা থেকে আল্লাহ কেবল সূর্যকেই সৃষ্টি করেছেন এবং এভাবেই “ইন্নামা” শব্দটি তার আগে যে প্রসঙ্গ এসেছে তার সাথে সম্পর্কিত।
(চলবে)