প্রসঙ্গঃ [কোরআন ঘোষিত “মহাবিজয়” বাস্তবায়িত, নবী করীম [ﷺ]-এঁর অতুলনীয় ক্ষমা প্রদর্শন। কা’বার মূর্তিসমূহের পতন, বায়তুল্লাহর ছাদে হযরত বিলালের আযানের কেবলা কোন দিকে ছিল!]
পবিত্র মক্কা বিজয় ৮ম হিজরীর রমযান মাসে সংগঠিত হয়। এই চূড়ান্ত বিজয়ের পটভূমিকা ধাপেধাপে সূচিত হয়েছিল। নবী করীম [ﷺ]-এঁর হিজরত ছিল প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ ছিল বদরের যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধে প্রথম সংঘর্ষেই কুরাইশদের পরাজয় ও মুসলমানদের বিজয়ে একটি বিশাল শক্তি হিসাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ওহোদ, খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধের ফলাফল কোরাইশদের বিরুদ্ধেই গিয়েছিল। সর্বশেষ হোদায়বিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষর করে কুরাইশরা দশ বৎসরের জন্য পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে থাকার দস্তখৎ লিখে দিয়ে আসলো। যদি সে সময় তারা বাধা না দিয়ে নবী করীম [ﷺ] ও মুসলমানদেরকে ওমরাহ পালন করার সুযোগ দিত, তা হলে পরাজয়মূলক সন্ধি করার দরকার হতো না।
সন্ধি করার কূটনৈতিক পরাজয় বুঝতে পেরে তারা তা ভঙ্গ করার চেষ্টা করতে লাগলো। সন্ধিশর্ত ভঙ্গ করার ফলেই নবী করীম [ﷺ] মক্কা আক্রমণ করার সুযোগ পান এবং পরিকল্পনা তৈরী করেন। সুতরাং হিজরত থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ধাপেই কোরাইশরা নিজেদের পটভূমিকা নিজেরাই তৈরী করেছিল। অপরদিকে ধাপে ধাপে নবীজী [ﷺ] বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা ছিল খোদায়ী গায়েবী মদদ।
যুদ্ধের কারণঃ
৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কোরা গামীমে নাযিলকৃত “মহান বিজয়ের” সুসংবাদবাহী আল্লাহর ভবিষ্যৎবানী (সূরা ফাত্হ-২) ৮ম হিজরীতে মক্কাবিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করলো। হোদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা ছিল এই যে, মক্কা সংলগ্ন বনু বকর গোত্র কোরাইশদের আশ্রয়ে থাকবে এবং মদীনা সংলগ্ন বনু খোজাআ গোত্র মুসলমানদের আশ্রয়ে থাকবে। এদের যে কোন গোত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকে মূল আশ্রয়দাতার বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে গন্য করা হবে। সন্ধির কিছুদিন পরেই কোরাইশরা মক্কা সংলগ্ন বনু বকরকে উস্কিয়ে দিয়ে মদীনা সংলগ্ন খোজাআর উপর আক্রমণ চালায়। বনু খোজাআ নবী করীম [ﷺ]-এঁর দরবারে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানায়। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে। কোরাইশ অধিপতি আবু সুফিয়ান পরিস্থিতির অবনতি উপলব্ধি করতে পেরে মদীনায় গমন করে। সে নতুন করে চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব করলে নবী করীম [ﷺ] তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।
ঐ উদ্দেশ্যে মদীনায় এসে আবু সুফিয়ান নিজ কন্যা উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে হাবীবার (رضي الله عنها) ঘরে গিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিছানায় বসতেই হযরত উম্মে হাবীবা (رضي الله عنها) বলে উঠেন- “আল্লাহর দোস্ত যে বিছানায় আরাম করেন – সেখানে আল্লাহর দুশমন বসতে পারে না।” পিতাকে নবীর দুশমন বলা নবী প্রেমেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একথা বলেই তিনি পিতাকে বিছানা থেকে তুলে দিলেন।
[এ ছিল সে যুগের নবীপ্রেমের নিদর্শন। বর্তমানে নবীজী [ﷺ] এঁর দুশমনদের সাথে বসতে সুন্নি মুসলমানরা লজ্জাবোধ করে না। এক শ্রেণীর মুসলমান নামদারীরা নবী করীম [ﷺ]-কে বড় ভাই বলে এবং আল্লাহর সম্মুখে তাঁর সম্মান মুচি-চামারের মত বলে মন্তব্য করে। অথচ এদের নামের পিছনে “রহমাতুল্লাহি আলাইহে” শব্দ ব্যবহার করতেও একশ্রেণীর পীর মাশায়েখরা কুন্ঠিত হয়না। এসব পীরেরা ওহাবীদের সাথে আপোষ করে চলে। শেষ পর্যন্ত তারা বাতিল দলে মিশে যায়। নবীজীর দুশমনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা ঈমানেরই অংশ। (সূরা মুজাদালা-২৮ পারা)]
অভিযানের প্রস্তুতিঃ
আবু সুফিয়ান উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মক্কায় ফিরে আসে। এদিকে নবী করীম [ﷺ] অতি গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। একজন বদরী সাহাবী হযরত হাতেব ইবনে আবু বোলতাআ (رضي الله عنه) মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি আঁচ করতে পেরে মক্কায় অবস্থিত তাঁর সন্তানাদির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য মক্কায় অবস্থিত তাঁর এক বন্ধুর কাছে গোপনে একটি পত্র লেখেন এবং একজন গায়িকা মহিলার মাধ্যমে তা মক্কায় প্রেরণ করেন। গোপন ওহীর মাধ্যমে নবী করীম [ﷺ] এই সংবাদ পেয়ে হযরত আলী (رضي الله عنه), হযরত যোবাইর (رضي الله عنه) ও হযরত মিকদাদ (رضي الله عنه)- এই তিনজনকে উক্ত পত্র ছিনিয়ে আনতে পাঠালেন। হুযুর [ﷺ] ইলমে গায়েবের মাধ্যমে একথাও বলে দিলেন যে, উক্ত মহিলাকে তোমরা “রওযাখাক” নামক স্থানে গিয়ে পাবে। [সহীহ বুখারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদিস নং ৩৬৯৪]
তাঁরা ঘোড়া ছুটিয়ে উক্ত স্থানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন এবং ধমক দেয়ার পর সে চুলের খোপা থেকে উক্ত গোপন চিঠিটি বের করে দিল। সাহাবীত্রয় হুযুর [ﷺ]-এর গায়েবী ইলমের পরিচয় পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। হযরত হাতেব (رضي الله عنه) তাঁর এই অসর্তকতার জন্য নবী করীম [ﷺ]-এঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে দয়াল নবী [ﷺ] তাঁকে ক্ষমা করে দেন। এ উপলক্ষে নবী করীম [ﷺ] বদরী সাহাবীগণ সর্ম্পকে আল্লাহ্ তায়ালার রেজামন্দিও সংবাদ দেন। একারণেই সকল বদরী সাহাবী (৩১৩ জন) জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত।
এছাড়াও হোদায়বিয়ার চৌদ্দশত সাহাবীও জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত। মূলতঃ সকল সাহাবীই জান্নাতি। হুযুর [ﷺ] এরশাদ করেছেন- “আমাকে দর্শনকারী কোন মুসলমাকেই জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না” (হাদীস)। তন্মধ্যে ১০ জন আশারা মোবাশশারা হিসাবে সবিশেষ পরিচিত। ঈমানের চোখে নবী দর্শনই জান্নাতের গ্যারান্টি। একজন সাহাবীর বিরুদ্ধে কটুক্তি মানে নবীজীকে কটুক্তি করা। আহলে সুন্নাতের মতে সাহাবীগণের সমালোচনা করা হারাম।
নবী করীম [ﷺ] ৮ম হিজরীতে গোপনে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে রমযানের ২ তারিখে মক্কার দিকে রওনা হন। আসলাম, গিফার, মোযায়না, জুহাইনা, আশজা, সোলায়ম সহ বিভিন্ন গোত্র ও আনসার মোহাজেরীন মিলিয়ে দশটি গোত্র নিয়ে মক্কার দিকে চললেন। পথিমধ্যে জোহফা নামক স্থানে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) ও তাঁর পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাত হলো। তাঁরা হিযরত করে মদীনা শরীফ আসছিলেন। তাঁরাও সাথে ফিরে চললেন। পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে- যেখানে হযরত আমেনা (رضي الله عنها)-এঁর মাযার শরীফ অবস্থিত- সেখানে হুযুর [ﷺ]-এঁর আর এক চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেছ এবং তাঁর পুত্র জাফর নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতে মুসলমান হয়ে সৈন্যদলে যোগ দিলেন।
মক্কার নিকটবর্তী এলাকা কোদায়দ নামক স্থানে পৌঁছে নবী করীম [ﷺ] সৈন্যদলকে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত করলেন এবং প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক পতাকা প্রদান করলেন। এটা ছিল নবী করীম [ﷺ]-এঁর যুদ্ধ পরিচালনার আসল কৌশল। স্মরণযোগ্য, এই কেদায়েদ নামক স্থানেই উম্মে মা’বাদের গৃহ। নবী করীম [ﷺ] হিজরতের সময় এখানে এসে প্রথম বিশ্রাম নেন এবং ছাগীর শুকনা বাঁটে দুধের নহর প্রবাহিত করেন।
ওদিকে আবু সুফিয়ানের মদীনা মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই মক্কার কোরাইশরা উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছিল। কিন্তু নবী করীম [ﷺ]-এঁর অভিযানের বিষয়ে তারা বিন্দু বিসর্গও জানতে পারেনি। তাই তারা খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তাদের সর্দার আবু সুফিয়ান ইবনে হরবকে মদীনার দিকে এই বলে পাঠালো – যদি মুহাম্মদ [ﷺ] অভিযানে এসেই পড়েন – তবে সে যেন মক্কাবাসীদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আসে।
আবু সুফিয়ান হাকিম ও বোদাইল নামক দুজন সঙ্গী নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলো। “মাররুয যাহরান” নামক স্থানে এসে আবু সুফিয়ান ইসলামী লস্কর দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। পাহারাদার সাহাবীদের হাতে আবু সুফিয়ান ও সঙ্গীরা বন্দী হয়ে রাসূলের দরবারে নীত হয়। এ অবস্থায় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন (رضي الله عنه)। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর পূর্বকৃত সব গুনাহ ও অপরাধ মাফ হয়ে যায়। শিয়ারা সাহাবী বিদ্বেষী। তাই তারা গোমরাহ ও বাতিল। বর্তমানে জামাআতে ইসলামীরাও সাহাবী বিদ্বেষী দল। শিয়ারা আবু সুফিয়ানের গোটা পরিবারকে গালাগাল করে থাকে- অথচ নবীজী [ﷺ] তাঁকে সাহাবীর সম্মান দিয়েছেন। তাঁরা নবীজীরও দুশমন।
ইসলামী কাফেলা কোদায়দ থেকে পুনঃ রওনা দেয়ার সময় নবী করীম [ﷺ] তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-কে বললেন, “আপনি আবু সুফিয়ানকে পাহাড়ের টিলার উপরে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর শৌর্যবীর্য দেখিয়ে দিন।” নবী করীম [ﷺ] ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে দশ হাজার মশাল জ্বালিয়ে রওনা দিলেন। আবু সুফিয়ান সুসজ্জিত পৃথক পৃথক মুসলিম বাহিনী দেখছিল – আর শিউরে উঠছিল। নবী করীম [ﷺ] অতীতের সব ব্যথা ভুলে গিয়ে ঘোষনা করলেন – “যারা আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নেবে – তারা নিরাপদ, যারা আপন আপন ঘরে বিনা অস্ত্রে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করবে – তারাও নিরাপদ এবং যারা আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে – তারাও নিরাপদ।” এভাবে আবু সুফিয়ানকে সম্মানিত করা হলো।
মক্কার ছয়জন পুরুষ ও চারজন মহিলাকে এই ঘোষণার আওতা বহির্ভূত রাখা হলো। এই বলে নবী করীম [ﷺ] সৈন্য বাহিনীকে বিভিন্ন পথে মক্কায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিলেন। আক্রান্ত না হলে যেন আক্রমণ না করা হয় – সে নির্দেশও দিলেন। আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মক্কাবাসীকে নিরাপত্তার ঘোষনা শুনিয়ে দিলেন। হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (رضي الله عنه)-এর বাহিনীকে বাধা দেয়ার ফলে সামান্য কিছু সংঘর্ষ হয়। এতে বনু বকর ও বনু হোযায়ল গোত্রের ২৩/২৪ জন লোক নিহত হয়। প্রায় বিনা বাধায় নবী করীম [ﷺ] মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কাবাসীগণ এখন হুযুরের হাতে বন্দী। মক্কা বিজয় সমাপ্ত হলো – তাদের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে।
এই সেই মক্কাভূমি – যেখানকার লোকেরা ষড়যন্ত্র করে ১৩টি বছর নবী করীম [ﷺ] ও মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন পরিচালনা করেছিল। শেষ পর্যন্ত নবী করীম [ﷺ] জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ। রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন [ﷺ] অতি বিনয় ও শুকরিয়ার সাথে মক্কায় প্রবেশ করেছেন আর জবানে পাকে উচ্চারণ করছেন,
جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
“জা- আল হক্ব ওয়া যাহাক্বাল বাতিল; ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুকা।” – সত্য সমাগত, অসত্য দূরীভূত; নিঃসন্দেহে অসত্য দূরীভূত হওয়ারই যোগ্য” (আল কোরআন, সুরা বনি ইসরাইলঃ ৮১)। এ ঘটনা ১৭ই রমযানের। আজ চিরদিনের জন্য মক্কাভূমি মূর্তি উপাসনা থেকে মুক্ত হলো। নবীজী [ﷺ] এঁর ইলমে গায়েবের ঘোষণা “কিয়ামত পর্যন্ত মক্কায় আর মূর্তিপূজা হবে না।”
পরদিন সকালে নবী করীম [ﷺ] মক্কাবাসীকে একত্রিত করে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন – “তোমরা আজ আমার নিকট কি ধরণের আচরণ প্রত্যাশা করো?” সকলে একবাক্যে বললো, “দয়ার আচরণ – নিকটাত্মীয়ের আচরণ।” রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন [ﷺ] ঘোষণা করলেন – “যাও, তোমরা সব মুক্ত। তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অভিযোগ নেই।”
ক্ষমার এই ঘোষণা শুনে উপস্থিত লোকেরা চিৎকার করে বলে উঠলো – “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” – আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতুলনীয় ক্ষমার এই দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন বিজয়ী শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি। এভাবে মক্কার অধিকাংশ লোকই মুসলমান হয়ে গেলো। কিছু লোক তখনও মুশরিক থেকে গেলো। নবীজী [ﷺ] জবরদস্তি করে কাউকে মুসলমান বানাননি – তারই প্রমাণ হলো এটি।
এদিকে নবী করীম [ﷺ]-এঁর এই অভূতপূর্ব ক্ষমা ঘোষণায় মদীনায় আনসার বাহিনী আশংকা করতে লাগলেন - হয়তো নবী করীম [ﷺ] আর মদীনায় ফেরত যাবেন না। জন্মভূমিতেই তিনি স্থায়ীভাবে থেকে যাবেন। তাঁদের মনের ভাব বুঝতে পেরে নবী করীম [ﷺ] ঘোষণা করলেন, “হে আনসারগণ! আমি জীবনেও তোমাদের সাথে – মরণেও তোমাদের সাথে থাকবো।” (বেদায়া)
কতিপয় ঘটনাঃ
(ক) মূর্তি নিধনঃ নবী করীম [ﷺ] খানায়ে কা’বার ভিতরে প্রবেশ করে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপিত দেখতে পেলেন। তিনি হাতের লাঠি দ্বারা একটি একটি করে মূর্তিকে টোকা দিতেই নিচের মূর্তিগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলো- অথচ এগুলো পেরাগ দিয়ে শক্ত করে দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছিল। এতদিন আল্লাহর ঘর মূর্তিভর্তি ছিল। আজ আল্লাহ তাঁর হাবীবকে দিয়ে তাঁর ঘর মূর্তিমুক্ত করে পবিত্র করলেন। এটাই ছিল আল্লাহর ইচ্ছা। প্রতিমা নিধন ছিল নবী করীম [ﷺ]-এঁর মিশন। কিন্তু আমরা তাঁর উম্মত হয়েও আজ শুরু করেছি স্থানে স্থানে প্রতিমা স্থাপন। আফসোস! উপরের মূর্তিগুলো ভাঙ্গার জন্য হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে তাঁর কাঁধে তুলে নিলেন। এখানে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল – যাতে নবীজীর প্রকৃত ওজন হযরত আলী (رضي الله عنه) প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
(খ) চাবি প্রদানঃ এতদিন পর্যন্ত খানায়ে কা’বার দরজার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল ওসমান ইবনে তালহা নামক জনৈক কোরাইশের উপর। সে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার দরজা খুলতো। নবী করীম [ﷺ] মক্কী জীবনে একদিন লোকদের সাথে খানায়ে কা’বার ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে ওসমান হুযুরকে বাধা দিয়েছিল। নবী করীম [ﷺ] ধৈর্য্য ধরে সেদিন মন্তব্য করেছিলেন- “হে ওসমান! আজ তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ, হয়তো এমন একদিন আসবে – যখন তোমার হাতের চাবিখানা আমার হাতে আসবে এবং আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দেবো।” সুবহানাল্লাহ!
তখন ওসমান বলেছিল, তা হলে কেবল কোরাইশদের ধ্বংস ও অপমানের মাধ্যমেই তা হতে পারে। নবী করীম [ﷺ] উত্তরে তখন বলেছিলেন – “না, বরং কোরাইশগণ সে সময় নতুন জীবন লাভ করবে এবং সম্মানিত হবে” (বেদারা নেহায়া)।
মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম [ﷺ] সেই ওসমানকে ডেকে এনে খানায়ে কা’বার চাবি হস্তান্তর করতে বললেন। ওসমান নীরবে ঘর থেকে চাবি এনে নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতে তুলে দিলেন। দয়াল নবীজী [ﷺ] চাবিখানা ওসমানের হাতে ফেরত দিয়ে বলরেন – “নাও ! এ চাবি তোমার ও তোমার বংশের লোকদের হাতে চিরদিন থাকবে – যদি না কোন যালেম তা ছিনিয়ে নেয়।” ওসমান নবী করীম [ﷺ]-এর পূর্বের ভবিষ্যৎবানী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হতে দেখে অবাক হয়ে যায়। এটাও ছিল নবী করীম [ﷺ]-এর নবুয়তের প্রমাণবহ ইলমে গায়েব। ওয়াহাবী সম্প্রদায় তবুও হুযুরের ইলমে গায়েব আতায়ী অস্বীকার করেই চলছে।
(গ) হযরত বেলাল (رضي الله عنه) এঁর আযানের কেবলাঃ
নবী করীম [ﷺ] হযরত বেলাল (رضي الله عنه) কে খানায়ে কা’বার ছাদে উঠে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। হযরত বেলাল (رضي الله عنه) ছাদে উঠে আরয করলেন- “ইয়া রাসুলাল্লাহ্! [ﷺ] মদীনায় থাকতে কেবলামূখী হয়ে আযান দিতাম। এখন তো কা’বা আমার নীচে, কোন দিকে ফিরে এখন আযান দেবো?” নবী করীম [ﷺ] নিজের দিকে ইশারা করে বললেন- “আমার দিকে।” মোহাদ্দেসীনে কেরাম এই হাদীসের তাৎপর্য এভাবে বর্ণনা করেছেন: “কেবলার অবর্তমানে নবী করীম [ﷺ]-এঁর পবিত্র সত্ত্বাই কেবলা। কেননা, তিনি কা’বারও কা’বা।” (যিকরে জামীল)
উর্দূ কবি বলেন:
روۓ همارا سوۓكعبه روۓ كعبه سوۓ محمد
كعبه كا كعبه روۓمحمد صلى الله عليه وسلم
“মোদের কপাল কা’বার দিকে, কা’বা ঝুঁকে নবীর পানে,
কা’বার কা’বা প্রিয় মুহাম্মদ, শত দরূদ তাঁরই শানে।” -লেখক
বিঃদ্রঃ ইবনু আবি মোলায়কার বর্ণনায় কা’বার ছাদে শুধু আযান দেয়ার কথা উল্লেখ আছে (বেদায়া ৪র্থ, ২৯৪ পৃষ্ঠা)।
(ঘ) ইকরামার ইসলাম গ্রহণঃ
মক্কা বিজয়ের সময় নবী করীম [ﷺ] এর ঘোষণা মতো যাদেরকে ক্ষমা করা হয়নি, তাদের মধ্যে আবু জাহলের পুত্র ইকরামা অন্যতম। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যার ঘোষণা করা হয়। ইকরামার কানে যখন এ ঘোষণা পৌঁছাল তখন সে মক্কার সীমানা অতিক্রম করে ইয়েমেনের দিকে পালানোর জন্য দ্রুত ঘোড়া ছুটালো।
ইতিমধ্যে ইকরামার স্ত্রী উম্মু হাকীম আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাসহ প্রায় দশজন মহিলা নবী করীম [ﷺ] এর ক্যাম্পে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হল। ক্যাম্পে নবী করীম [ﷺ] এর দুজন স্ত্রী, তাঁর মেয়ে ফাতিমা এবং আবদুল মুত্তালিব এর পরিবারের কয়েকজন মহিলা (رضي الله عنهم) তখন নবী করীম [ﷺ] এর সাথে ছিলেন। উপস্থিত মহিলাদের দলটির মধ্যে কেবল হিন্দাই কথা বলবে বলে স্থির করে তারা এসেছিলো। উহুদের সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য হিন্দা অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত ছিলো। নবী করীম [ﷺ] এর কাছে সে নিজের মুখ ঢেকে হাজির হল।
নিজেকে আড়াল রেখে হিন্দা বলে চলল- “আল্লাহর রাসূল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি ইসলামকে নিজের মনোনীত দীন হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। আপনি সম্পর্কের দিক থেকে আমার নিকটাত্মীয়। আমি আপনার কাছে এজন্য ক্ষমা ও উত্তম ব্যবহারের আশা করছি। আজ থেকে আমি নিজেকে বিশ্বাসী মুমিনদের একজন বলে ঘোষনা করছি। যে আল্লাহ্ সত্য মিশনসহ আপনাকে পাঠিয়েছেন, তা দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করি।”
এ কথা বলার পর হিন্দা নিজের মুখ থেকে নিকাব সরিয়ে ফেলে বলল “আমি হিন্দা বিনত্ উৎবা, ইয়া রাসূলাল্লাহ”।
নবী করীম [ﷺ] তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
হিন্দা বলে চললেন “আল্লাহর শপথ হে আল্লাহর রাসূল, আজকের আগে পৃথিবীর কোন ঘর আমার কাছে আপনার ঘরের চেয়ে অপছন্দনীয় ছিল না, আর আজ এখন এই মুহূর্ত থেকে পৃথিবীর কোন ঘর আপনার ঘরের চেয়ে প্রিয় আর মর্যাদাপূর্ণ নেই।”
এবার আকস্মিকভাবেই উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ইসলামে প্রবেশের ঘোষনা দিয়ে বললেন, “ইয়া ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি ইকরামাকে পেলে হত্যা করবেন এই ভয়ে সে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন এর দিকে চলে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন।” নবী করীম [ﷺ] অঙ্গীকার করে বললেন, “সে নিরাপদ”।
উম্মু হাকীম এক মুহূর্তও দেরী করলেন না, তখনই বেরিয়ে পড়লেন ইকরামার খোঁজে ইয়েমেনের পথে। তার সাথে একজন গ্রীক কৃতদাসকে নিলেন নিজ নিরাপত্তার জন্য। পথিমধ্যে তারা যখন নির্জন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সে দাসটি জোর করে তাকে শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করলো। কিন্তু উম্মু হাকীম কৌশলে তাকে কোন আরব লোকালয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন। লোকালয়ে পৌঁছানোর পরই উম্মু হাকীম সেখানকার অধিবাসীদের সব জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। তারা দ্রুত তার সাহায্যে এগিয়ে এল এবং গ্রীক কৃতদাসটিকে বেঁধে ফেলে তাদের কাছে বন্দী করে রেখে দিল। উম্মু হাকীম এবার একাই বেরিয়ে পড়লেন ইয়েমেনের পথে ইকরামার খোঁজে। দূরের পথ, রাত-দিন দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে অবশেষে তিনি লোহিত সাগরের তীরে তিহামা নামের একটি এলাকায় ইকরামার দেখা পেলেন। ইকরামা তখন সাগর পাড়ি দেবার জন্য একজন মুসলিম নাবিকের সাথে বাদানুবাদ করছিল।
ইতিমধ্যেই দুজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন উম্মু হাকীম। বললেন, “আমার চাচাতো ভাই (আত্মীয়তার দিক দিয়ে এরা দুজন চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন), আজ আমি আপনার কাছে এসেছি সেই অনন্য সাধারণ, সবচেয়ে সঠিক পথের দিশারী আর সব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ইবন্ আদুল্লাহর কাছ থেকে। আমি তাঁর কাছে আপনার জন্য নিরাপত্তা চেয়েছি, তিনি তা দিয়েছেন। এখন আপনি আর নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবেন না।”
ইকরামা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেল, এতদূরে তার স্ত্রীর একাকী উপস্থিতিতে। মুহম্মাদ, যাঁর সাথে তার এত শত্রুতা, যিনি তাকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষনা করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা; সে নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে স্ত্রীকে বলল, “তুমি কি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছ?” উম্মু হাকীম উত্তর করলেন, “হ্যাঁ, আমি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছি এবং তিনি নিজেই আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।” ইকরামা ফিরে চলল মক্কার পথে। পথে উম্মু হাকীম সেই গৃক ভৃত্যের কথা স্বামীকে জানালেন। ভয়াবহ ক্রোধে জ্বলে উঠল ইকরামা, সরাসরি সে এলাকায় গিয়ে ভৃত্যটিকে হত্যা করল এবং আবার এগিয়ে চলল মক্কার পথে। নবী করীম [ﷺ] তার মক্কায় প্রবেশের আগেই সাহাবীদের ডেকে ঘোষণা দিলেন, “ইকরামাহ্ ইবন্ আবী জাহল তোমাদের মধ্যে মুসলিম এবং মুহাজির হয়ে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গাল দিও না, কেননা মৃতকে গাল দিলে তা তাদের কাছে পৌঁছায় না।”
কিছুক্ষণের মধ্যে ইকরামা সেখানে প্রবেশ করল যেখানে নবী করীম [ﷺ] বসে ছিলেন। নবীজী উষ্ণ আলিঙ্গনে ইকরামাকে স্বাগত জানালেন। ইকরামা বলল, “ইয়া রাসুল্লাল্লাহ [ﷺ], উম্মু হাকীম আমাকে জানিয়েছে যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।” নবীজী বললেন, “হ্যাঁ, সে সত্য বলেছে, তুমি নিরাপদ।” একথা শুনে ইকরামা আদবের সাথে জানতে চাইলো, “আপনি মানুষকে কিসের দিকে ডাকছেন?” নবীজী উত্তরে বললেন, “আমি তোমাকে আহ্বান জানাচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দেবার জন্য, সালাত কায়েম করার জন্য, যাকাত আদায় করার জন্য এবং ইসলামের অন্যান্য বিধিনিষেধগুলো মেনে চলার জন্য।”
ইকরামা বলে উঠলো, “আল্লাহর শপথ, আপনি কেবলমাত্র তার দিকেই ডাকছেন যা সত্য এবং আপনি কেবলমাত্র সৎকাজেরই আদেশ দান করছেন। আপনার মিশন শুরু করার আগেও আপনি আমাদেরই মাঝে ছিলেন এবং তখন আপনি কথায় ছিলেন সবচেয়ে সত্যবাদী এবং কাজে ছিলেন সবচেয়ে সঠিক।” ইকরামা নবী করীম [ﷺ] এর দিকে তার হাত প্রসারিত করে দিল এবং বলে চলল, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল”। এরপর বলল, “ইয়া রাসূল্লাল্লাহ, আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্রুতা এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো তিনি ক্ষমা করে দেন।”
নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, “হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্রুতা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে তার জন্যও তাকে ক্ষমা করে দাও।”
ইকরামার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “আল্লাহর শপথ হে রাসূল, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহর পথের শত্রুতার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুণ আমি ব্যয় করব আল্লাহর পথে, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর পথে করব।”
ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরামা যে ওয়াদা নবী করীম [ﷺ] এর সাথে করেছিলেন, প্রতিটি ওয়াদা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য ভীষণ কঠোর ও দৃঢ় ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর যতগুলো যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে তার প্রতিটিতেই তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অকুতোভয় প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে। হযরত উমর (رضي الله عنه) এর খিলাফতকালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হন। সে যুদ্ধে ৩ লক্ষ রোমান বাহিনীর বিপরীতে মাত্র ৩০ হাজার মুসলিম সৈন্য ৬ দিনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন খালিদ বিন ওয়ালিদ এর নেতৃত্বে। নবী করীম [ﷺ] এর ক্ষমার তুলনা হয় না।
(ঙ) ফোযালার মনের গোপণ কথাঃ
মক্কা বিজয়ের পর একবার নবী করীম [ﷺ] কা’বা শরীফ তাওয়াফ করছিলেন। ফোযালা ইবনে ওমাইর নামীয় জনৈক কোরাইশ নবী করীম [ﷺ]-কে একা পেয়ে তাঁকে শহীদ করার বদনিয়তে সেও তাওয়াফ করতে লাগলো এবং সুযোগ খুঁজতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে নবী করীম [ﷺ]-এঁর অতি নিকটে এসে পড়লো। নবী করীম [ﷺ] তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ফোযালা?” সে জবাব দিল, হ্যাঁ। নবী করীম [ﷺ] পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি মনে মনে কি ভাবছ?” সে থতমত খেয়ে বললো, “কই না তো! কিছুই ভাবছি না, বরং আমি মনে মনে আল্লাহর যিকির করছি।” তার একথা শুনে নবী করীম [ﷺ] রহস্যের হাসি হাসলেন এবং শুধু এতটুকুন বললেন “আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।” একথা বলেই নবী করীম [ﷺ] তার বুকে পবিত্র হাত স্থাপন করলেন। সাথে সাথে ফোযালার মনের কুচিন্তা দুর হয়ে গেল। ফোযালা বলেনঃ “ নবী করীম [ﷺ] আমার বুক থেকে হাত উঠিয়ে নেয়ার পর বর্তমানে আমার মনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে আমার নিকট নবী করীম [ﷺ]-এঁর চেয়ে বেশী প্রিয় আর কেহই নেই।” (মাওয়াহিব) একেই বলে ফায়যে ইনয়েকাছি।
(চ) হযরত কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه)-এর ইসলাম গ্রহণ এবং নবীজী [ﷺ]-এঁর শানে একটি প্রশংসামূলক কবিতা পাঠ, বিনিময়ে চাঁদর মোবারক দানঃ
মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম [ﷺ] ৮ম হিজরীর শাওয়াল ও যিলক্বদ মাসে হুনায়ন ও তায়েফ জয় করে ২ মাস ১৬ দিন পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ৯ম হিজরীর রজব মাসে তিনি তাবুক অভিযানে বের হন। নবীজী [ﷺ]-এঁর তাবুক অভিযানে যাওয়ার পূর্বে মক্কার কবি কা’ব ইবনে যোহাইর মদীনায় এসে মুসলমান হয়ে যান। পূর্বে তিনি নবীজী [ﷺ]-এঁর বিরুদ্ধে অনেক ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। কিভাবে তিনি মুসলমান হলেন, তার একটি চমকপ্রদ ঘটনা আছে। এখানে সংক্ষেপে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করা হলো।
কা’ব এবং বুজাইর তাঁরা ছিলেন দু’ভাই। তাদের পিতার নাম যোহাইর। মক্কার বাসিন্দা তাঁরা। পিতা যোহাইর আহলে কিতাব পন্ডিতদের মজলিশে উঠাবসা করতো। সে পন্ডিতদের মুখে শুনেছিল “শেষ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে।” ইতিমধ্যে সে স্বপ্নে দেখলো, আকাশ থেকে একটি রশি নিচের দিকে নেমে আসছে। সে ঐ রশিটি ধরতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। যোহাইর তার দুই ছেলে কা’ব ও বুজাইরকে ডেকে বললো “শেষ যামানার নবীর আবির্ভাবের সময় আমি পাব না, যা স্বপ্নে দেখেছি, কিন্তু তোমরা তাঁকে পেলে অবশ্যই ঈমান আনবে।”
ইত্যবসরে কা’ব উঁচু স্তরের কবি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। মক্কার অন্যান্য কবিদের ন্যায় তিনিও প্রথম দিকে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। নবী করীম [ﷺ] মক্কা জয় করার সময় ঘোষণা করেছিলেন, “মক্কাবাসী সকলে মাফ পাবে কিন্তু যেসব কবি আমার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছে, তাদেরকে কতল করা হবে।”
মক্কা বিজয়ের পর ইকরামা, কা’ব প্রমুখ কবিগণ গা ঢাকা দেয়। কা’ব এর ভাই বুজাইর মক্কা বিজয়ের পর মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ভাই কা’বকে পত্র লিখে অভয় দেন যে, কেউ মুসলমান হয়ে গেলে সে ঘোর শত্রু হলেও নবী করীম [ﷺ] তাকে ক্ষমা করে দেন। সুতরাং তুমি এসে মুসলমান হয়ে যাও।
ভাই বুজাইর এর পত্র পেয়ে কা’ব একটি দীর্ঘ ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করে ভাইকে গালাগাল করে পত্র প্রেরণ করলো। বুজাইর (رضي الله عنه) ভাই কা’ব এর পত্র পেয়ে নবী করীম [ﷺ]-কে শুনান। নবী করীম [ﷺ] পত্র শুনে এরশাদ করেন, “যে কেউ কা’বকে পাবে, সে যেন তাকে কতল করে ফেলে।”
এই ঘোষণা শুনে কা’ব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। পৃথিবী তার কাছে সঙ্কুচিত বলে মনে হলো। তিনি গোপনে মদীনায় এসে নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতে হাত রেখে বললেন “কা’ব ইবনে যোহাইর যদি খালেছ দিলে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে আপনি কি তাকে ক্ষমা করবেন? যদি ক্ষমা করেন তাহলে আমি তাকে আপনার খেদমতে হাযির করে দেবো।” নবী করীম [ﷺ] বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি আত্মপরিচয় দিয়ে সাথে সাথে কলেমা শরীফ পাঠ করে মুসলমান হয়ে যান।
কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه) তাৎক্ষনিকভাবে নবী করীম [ﷺ]-এঁর শানে একটি কবিতা রচনা করে তা পাঠ করে নবীজী [ﷺ] কে শুনান। দীর্ঘ কবিতাটির শুরু ছিল “বানাত সোয়াদো।” কবিতার শেষাংশে তিনি নবীজী [ﷺ] এঁর শানে বললেনঃ
اِنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ-مَهَنَدُ مِّنْ سُيُوَّفِ اللهِ مَسْلُوْلَ-
অর্থঃ- “নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল [ﷺ] আপনাদমস্তক এমন একটি নুর, যার মাধ্যমে সবকিছু আলোকিত হয়। তিনি আল্লাহর তীক্ষ্ম তরবারী সমূহের মধ্যে বিশ্বখ্যাত একটি হিন্দুস্তানী তরবারী।”
হযরত কা’ব (رضي الله عنه)-এর উক্ত পংক্তিটি শুনে নবী করীম [ﷺ] ভাবাবেগে এত আপ্লুত হয়ে উঠেন যে, তিনি তাঁর গায়ের মূল্যবান ইয়ামানী চাঁদরখানা কা’বের গায়ে জড়িয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে এই পবিত্র চাঁদরখানা কিনে নেয়ার জন্য হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) দশ হাজার মুদ্রা দিতে চাইলেন। হযরত কা’ব ইবনে যোহাইর (رضي الله عنه) বললেন, নবী করীম [ﷺ]-এঁর চাঁদরখানা অন্য কাউকে দেয়ার মত বদান্যতা আমি দেখাবো না। হযরত কা’ব (رضي الله عنه)-এর ইন্তিকালের পর হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) বিশ হাজার মুদ্রার বিনিময়ে ঐ চাঁদর মোবারক তাঁর উত্তরাধিকারীগণের নিকট থেকে সংগ্রহ করে নেন এবং নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখেন। ঐ পবিত্র চাঁদরখানা বংশ পরম্পরায় বাদশাহগণের হেফাযতে সংরক্ষিত হতে হতে অবশেষে তুর্কী খলিফাগণের হেফাযতে আসে এবং অদ্যাবধি উক্ত চাঁদরখানা তুরস্কে সরকারী হেফাযতে রয়েছে।
এখানে দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ:
(১) নবী করীম [ﷺ]-এঁর উপস্থিতিতে কা’ব তাঁকে “আপাদমস্তক নুর” বলে সম্বোধন করেছেন। এতে খুশী হয়ে নবী করীম [ﷺ] কা’বকে পুরস্কৃত করেছেন। এমনিভাবে যাঁরা নবী করীম [ﷺ]-কে “আপাদমস্তক নুর” বলে বিশ্বাস করবে, তারাও নবী করীম [ﷺ]-এঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে থাকবে। আর যারা মাটির মানুষ বলবে তারা নবীজী [ﷺ] এঁর অসন্তোষ পেতে থাকবে।
(২) আল্লাহর প্রিয় রাসূল [ﷺ]-এঁর শানে উত্তম না’ত পেশ করা হলে তাঁকে সম্মানিত করা নবীজিরই সুন্নাত। এজন্যই মোশাআরা প্রতিযোগিতায় উত্তম কবিতা “না’তিয়া কালাম” পাঠকারীকে উপহার দিয়ে সম্মানিত করার রেওয়ায এখনো প্রচলিত রয়েছে।