৮ম অধ্যায়ঃ কবর বাসীর পরস্পর সাক্ষাৎ, জীবিত ও মৃতদের মিলন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কবরবাসী দুই প্রকার। এক প্রকার হলো আযাবপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় প্রকার হলো শান্তিপ্রাপ্ত। আযাবপ্রাপ্ত রূহ্সমূহ আযাব  ভোগ করতে থাকবে। পরস্পর সাক্ষাতের সুযোগ তারা পাবে না। আর শান্তিপ্রাপ্ত রূহ্সমূহ মুক্ত ও আযাদ। তারা পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবে এবং একত্রিতও হতে পারবে। তারা কবরে দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজনদের  সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করে থাকে। তারা  নিজ  আমল  অনুযায়ী উপরস্থ কবরবাসীদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে। আল্লাহ্- রাসুলের পূর্ণ অনুগত বান্দারা  নবীগণ, সিদ্দীকগন, শহীদগণ এবং  অলীগনের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে। তাই আল্লাহ্পাক কোরআন মজিদের ছুরা নিছা ৬৯ আয়াতে এরশাদ করেন-
وَمَن يُطِعِ اللّهَ وَالرَّسُولَ فَأُوْلَـئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ  أُولَـئِكَ رَفِيقًا
অর্থঃ  “যারা আল্লাহ্ ও রাসুলের পূর্ন অনুগত, তারা আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেক্কার অলীগণের সাথী হবে। তাঁরাই হলেন  উত্তম সাথী”।

ব্যাখ্যাঃ উক্ত সান্নিধ্য পাবে দুনিয়ায়, কবরে, হাশরে ও জান্নাতে। কেননা, যে যাকে ভালবাসে, সে তার সাথী হবে বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে।

(উক্ত আয়াতের শানে নুযুল হলো-সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন-ইয়া রাসুল্লাল্লাহ্! আমরা তো দুনিয়ায় আপনার নিত্যসঙ্গী, কিন্তু বিদায় হওয়ার পর আপনি উচ্চ মাকামে অবস্থান করবেন। তখন আপনার সান্নিধ্য থেকে তো আমরা বঞ্চিত হয়ে যাবো। তাঁদের শানেই উক্ত আয়াতখানা নাযিল হয়। নুযুল খাস হলেও হুকুম আম ও ব্যাপক। অর্থাৎ – প্রত্যেক অনুগত বান্দাদেরই এই সৌভাগ্য নসীব হবে (সোব্হানাল্লাহ্!)।

কবরবাসীদের পরস্পর দেখা সাক্ষাতের প্রমাণাদিঃ
=========
(১) ইমাম তিরমিযি আবু  ছায়ীদ খুদরী (রাঃ) এবং হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন-
قال رسول اللّٰہ ﷺ حسنوا  اکفان موتاکم فانھم یتباھون ویتزاورون فی قبورھم وفی صحیح مسلم، عن جابر بن عبد اللّٰہ رضی اللّٰہ عنہ قال رسول اللّٰہ ﷺ اذا  کفن احدکم اخاہ فلیحسن کفنہ ۔
অর্থঃ  “রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ  করেছেন-  তোমরা তোমাদের মৃত  ব্যক্তিদেরকে উত্তম কাফন পরিধান করাইও। কেননা, তারা কবরে পরস্পর গৌরব করে এবং পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ করে”।

মুসলিম  শরীফে হযরত জাবের (রাঃ) -এর বর্ণনা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে  “যখন তোমাদের কেউ অপর মুসলিম ভাইকে কাফন পরিধান করায়- তখন যেন উত্তম কাফনের ব্যবস্থা করে” (মুসলিম)।

(২) জীবিতব্যক্তিদের রূহ্ মৃতব্যক্তিদের রূহের সাথে স্বপ্নযোগে পরস্পর সাক্ষাৎ করা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন,
بلغنی ان ارواح الاحیاء والاموات تلتقی فی المنام ۔ فیتساء لون  بینھم فیمسک اللّٰہ ارواح الموتی یرسل ارواح الاحیاء الی اجسادھا۔
অর্থঃ “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)  বলেন- আমার কাছে এ মর্মে হাদীস পৌঁছেছে যে, জীবিতদের রূহ্ মৃতদের রূহের সাথে স্বপ্নযোগে  মিলিত হয়। তারা পরস্পর  খবরাখবর আদান প্রদান করে। অতঃপর আল্লাহ্পাক মৃতদের রূহ্ নিজের কাছে রেখে দেন এবং জীবিতদের রূহ্ দেহের মধ্যে ছেড়ে দেন” (ইবনে মান্দা সুত্রে বর্ণিত)।

(৩) ইবনে আবি হাতেম বলেন,
قال فی تفسیرہ یتوفاھا فی منامھا فیلتقی روح و الحی روح المیت فیتذا کرون ویتعارفون ۔  قال فترجع روح الحی الی جسدہ فی  الدنیا الی بقیتۃ اجلھا وترید روح المیت ان ترجع الی جسدہ فتبس
অর্থঃ “ইবনে আবি  হাতেম ছুরা  যুমার ৪২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- ”আল্লাহ্পাক  ঘুমন্ত অবস্থায় নিদ্রিত ব্যক্তির রূহ্ নিজের কাছে টেনে নেন। এমতাবস্থায় নিদ্রিত ব্যক্তির  রূহ্ মৃত ব্যক্তির রূহের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং পরস্পর আলোচনা ও পরিচয় করে। তারপর নিদ্রিত ব্যক্তির রূহ্ তার শরীরে ফিরে আসে মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় পর্য্যন্ত। আর মৃতব্যক্তির রূহ্ তার শরীরে ফিরে আসতে চায়- কিন্তু তাকে আসতে দেয়া হয় না”। নিম্নে দলীল দেখুন।

উল্লেখ্য-ছুরা যুমার ৪২  নম্বর আয়াতে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন-
اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى
অর্থাৎ- “আল্লাহ্পাক দুই প্রকারে মানুষের রূহ্ কেড়ে নেন।  এক প্রকার হলো মউতের মাধ্যমে। দ্বিতীয় প্রকার হলো নিদ্রার মাধ্যমে। মউতের মাধ্যমে কেড়ে নেয়া রূহ্ তার কাছে রেখে দেন- আর নিদ্রার মাধ্যমে হরনকৃত রূহ্ পূনঃ শরীরে ফেরত দেন নিদ্দিষ্ট সময় পর্য্যন্ত”।

ব্যাখ্যাঃ  উক্ত আয়াত ও তার তাফসীরে প্রমানিত হয়েছে- জীবিতরা নিদ্রার  মাধ্যমে  রূহানীভাবে মৃতরূহের সাথে মিলিত হয়।  তাদের মধ্যে দেখা- সাক্ষাৎ, কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনা হয়। এভাবেই নিদ্রার মাধ্যমে রূহে রূহে সাক্ষাত ঘটে। ইহাই বিধির সাধারণ বিধান।

কিন্তু নবীগণ ও অলীগণ জাগ্রত অবস্থায়ই কবরবাসীর সাথে কথাবার্তা বলতে পারেন। ইহার অসংখ্য নযীর রয়েছে। যেমনঃ হযরত ইছা আলাইহিস সালাম  ও আমাদের  প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য কবরবাসীর সাথে আলাপ  করেছেন বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে। আল্লাহর অলীগণের মধ্যে হযরত  গাউসে পাক, হযরত বিশির হাফী- প্রমূখ অলীগণ মৃতদের সাথে আলোচনা করে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।  মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) -এর ঘটনা পূর্ব অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।

যারা মৃত ব্যক্তিদের বরযখী হায়াত ও শ্রবন-দর্শন শক্তি অস্বীকার করে- তাদের জন্য বর্ণিত  হাদীসখানা পথপ্রদর্শক হতে পারে। ভ্রান্ত দলের লোকেরা বলে- সব মানুষই মরে পঁচে গলে মাটির সাথে মিশে যায়। দেখুন- ইসমাঈল দেহলভীর তাকভীয়াতুল ঈমান। সে নবীজীকেও মৃত এবং পঁচা গলা  লাশ বলেছে।  (নাউযুবিল্লাহ্)। আমাদের দেশের ইসমাঈল ভক্তরাও একই ধারনা পোষণ করে।

(৪) “শহীদানরা  জীবিত এবং  আল্লাহর নিকট রিযিকপ্রাপ্ত-   তাঁরা পরবর্তী আগমনকারীদেরকে সুসংবাদ প্রদান করেন”। এই তিনটি গুণ প্রমান করে- তাঁরা পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ করেন, কথাবার্তা বলেন এবং  ভবিষ্যতে আগমনকারীদের জন্য শুভ সংবাদ বিনিময় করেন। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاء عِندَ رَبِّهِمْ  يُرْزَقُونَ – فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُواْ بِهِم مِّنْ خَلْفِهِمْ أَلاَّ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
অর্থঃ “আল্লাহর রাস্তায় শহীদগণকে মৃত বলে  মুখে উচ্চারণ করাতো দূরের কথা- তাদেরকে মৃত বলে মনে মনে ধারনাও করো না; বরং তারা জীবিত, আল্লাহর নিকট রিযিকপ্রাপ্ত, আল্লাহ্  তাঁদেরকে যে মর্যাদা  দিয়েছেন- তাতে তারা আনন্দিত এবং   এখনও (পরবর্তী) যারা তাদের সাথে মিলিত হয়নি- তাদের জন্য  শহীদগণ সুসংবাদ দান করেন” (ছুরা আলে ইমরান- ১৬৯-১৭০)।

এখানে يَسْتَبْشِرُونَ শব্দটির অর্থ শহীদগণ  কর্তৃক জীবিত লোকদের নিকট শুভ সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয়া। সুতরাং يَتباشِرُونَ শব্দটির অর্থ  হবে- “পরস্পর শুভ সংবাদ  বিনিময় করা”। জীবিত ও শাহাদাতপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে এভাবে আলাপ আলোচনা ও  ভাব বিনিময় হয়ে থাকে। (কিতাবুর রূহ্ পৃঃ ৪৭)।

(৬) প্রখ্যাত বুযর্গ ও  শরিয়তের  ইমাম হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ) বলেন-
رایت سفیان الثوری فی النوم فقلت ما فعل اللّٰہ بک قال لقیت محمد ﷺ وحاز بہ
অর্থঃ “হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ)  বলেনঃ আমি স্বপ্নযোগে ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) কে দেখে জিজ্ঞেস করলাম- আল্লাহ্ তায়ালা আপনার সাথে কিরূপ  ব্যবহার করেছেন? সুফিয়ান ছাওরী বললেন- আমি হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে মিলিত হয়েছি। ” (মৃত্যুর পর ইহাই শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার)।

(৭) প্রখ্যাত বুযর্গ ছখর ইবনে রাশেদ (রহঃ) বলেন-
رأیت عبد اللّٰہ بن مبارک فی النوم بعد موتہ فقلت الیس قمت؟ قال بلی قلت فما صنع اللّٰہ بکَ قال غفرلی مغخفرۃ احاطت بکل ذنب۔
অর্থঃ ছখর  ইবনে রাশেদ (রহঃ) বলেন-  আমি আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ) কে তাঁর ইন্তিকালের পর স্বপ্নযোগে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস   করলাম- ”আপনি কি মৃত্যুর পর জাগ্রত হননি? তিনি বললেন- হ্যাঁ, জাগ্রত হয়েছি। আমি  পূনঃ জিজ্ঞেস করলাম- আল্লাহ্পাক আপনার সাথে কিরূপ আচরন করেছেন? আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ) বললেন- আল্লাহ্পাক আমাকে এমনভাবে মাফ করে দিয়েছেন- যা আমার যাবতীয় গুনাহ্কে ঢেকে ফেলেছে। ”

ব্যাখ্যাঃ অত্র ঘটনায় “আপনি কি সজাগ হন নি?” বাক্য দ্বারা পবিত্র হাদীসের একটি শব্দের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। শব্দটি হলোঃ
نعم کنومۃ العروس
অর্থাৎ- কবরে মুনকার নকীর ফেরেস্তাদ্বয় তিনটি প্রশ্ন করবে। মোমেনগণ যখন তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবে- তখন মুনকার নকীর বলবে-“দুলা দুলহানের মত নিদ্রা  যাও, আপনজন ছাড়া তোমাকে কেউ সজাগ করবেনা”।

আর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ) -এর জবাবের দ্বারা বুঝা গেল- তাঁর প্রিয়জন ছিলেন   দোজাহানের বাদশাহ্ নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম। তিনিই তাঁকে  সজাগ করেছেন। সোব্হানাল্লাহ্।

৮। মুসমি’- ইবনে আছেম (রহঃ) বলেন-
رأیت عاصما الجحدری فی منامی بعد موتہ بسنتین فقلت الیس قد مت ؟ قال بلی قلت واین انت ؟ قال انا واللّہ فی روضۃ من ریاض الجنۃ ۔ انا ونفرمن اصحابی نجتمع کل لیلۃ جمعت وصبیحتھا الی بکر بن عبد اللّٰہ  المزنی فنتلقی اخبارکم قلت اجسامکم ام رواحکم؟ قال ھیھات بلیت الاجسام وانما نتلقی الارواح۔
অর্থঃ মুসমি’ বলেন- আমি আছেম জুহ্দারীকে  তাঁর ইনতিকালের দু’বৎসর পর স্বপ্নে  দেখে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কি ইনতিকাল করেন নি? আছেম  (রহঃ) বললেন- হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কোথায় অবস্থান করছেন?  আছেম (রহঃ) বললেন- আল্লাহর শপথ, আমি এখন বেহেস্তের বাগান সমূহের একটি বাগানে (রওযায়) অবস্থান করছি। আমি এবং আমার কতিপয় সাথী প্রত্যেক শুক্রবার  রাত্রে এবং ভোরে আবু  বকর ইবনে আবদুল্লাহ্ মুযানীর কাছে একত্রিত হই  এবং তোমাদের  খবরাখবর নিয়ে আলোচনা করি। আমি  (মুসমি’) জিজ্ঞেস করলাম- সশরীরে উপস্থিতি- না কি রূহানী উপস্থিতি? আছেম (রহঃ) বললেন- হায়! আমাদের শরীর তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে-  আমরা রূহানী ছুরতে  একত্রিত হই”। (কিতাবুর রূহ্)। (এতে বুঝা যায়-শরীর পঁচে যায়। কিন্তু হাদীসে এর বিপরীত অবস্থা প্রমাণিত হয়- জলিল)

বিঃ দ্রঃ নয় শ্রেণীর লোকের শরীর কবরে  পঁচেনা। তন্মধ্যে- নবীগণ, শহীদগণ,  হাফেযুল কোরআন, মোয়ায্যিন, গর্ভকালে মৃত্যু বরণকারিণী, প্লেগ রোগে মৃত্যু বরণকারী, পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণকারী এবং আল্লাহর অলীগণ অন্যতম (হাদীস)। মৃত্যুর পর নেক্কার লোকেরা জান্নাতে বিচরণ করেন- কিন্তু সেখানে থাকেন না।

৯। সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম (রাঃ) ও হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ) -এর ঘটনাঃ

“তাবেয়ী হযরত সায়ীদ ইবনে মুসাইয়েব (রাঃ) বর্ণনা করেন- হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম (রাঃ) এবং হযরত সালমান ফারছী (রাঃ) পরস্পর সাক্ষাৎ করে একজন অন্যজনকে বললেন- আপনি আমার  আগে ইন্তিকাল করলে আল্লাহ্ আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন- তা আমাকে  জানাবেন। এভাবে উভয়েই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন।  দ্বিতীয়জন জিজ্ঞেস করলেন- জীবিত ও মৃতরা কি পরস্পর দেখা  সাক্ষাৎ করতে পারে? অপরজন বললেন- হ্যাঁ, নেককার লোকদের রূহ্ জান্নাতের যথায় ইচ্ছা  ভ্রমণ করতে পারেন। অতঃপর একজনের ইনতিকাল হলে তাঁকে স্বপ্নে দেখে অপরজন কিছু জিজ্ঞেস করলেন।  তিনি বললেন- আল্লাহর উপর তাওয়াককাল  করুন এবং সুসংবাদ গ্রহণ করুন। তাওয়াককালের মত এত মূল্যবান বস্তু আর কিছু দেখিনি”। তাবেয়ীর বর্ণনা সত্য। (কিতাবুর রূহ্)।

নোটঃ আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম এবং সালমান ফারছি- উভয়েই পূর্বে ইহুদী ধর্মে ছিলেন। পরে মুসলমান হয়ে ডাবল পুরস্কার লাভ করেন।

১০। হযরত ওমর (রাঃ)-এর ঘটনাঃ

আমের ইবনে আবদুল মোত্তালিব (রাঃ) বলেন- আমার মনে ইচ্ছা জাগলো- হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যেন আমি স্বপ্নে দেখি। তারপর তিনি বলেন-
فما رأیتہ الاعند قرب حول قرأیتہ یمسح العرق عن جبینہ وھو یقول ھذا اوان فراغی ۔
অর্থঃ ”আমের (রাঃ) বলেন- আমি হযরত ওমর (রাঃ) কে শাহাদাতের এক বৎসর পর স্বপ্নে দেখলাম- তিনি কপালের ঘাম মুছছেন আর বলছেন- এই মাত্র আমি জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত হলাম”। (কিতাবুর রূহ্)।

ব্যাখ্যাঃ পরকাল ইহকাল থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ইন্টারনেট সিস্টেমে যেভাবে দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সাথে ছবির মাধ্যমে দেখা সাক্ষাৎ ও খবরাখবর আদান প্রদান  করা হয়-   অনুরূপভাবে  দুনিয়া ও আখেরাতবাসীরাও কুদরতি ইন্টানেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারেন  এবং খবরাখবর আদান প্রদান করতে পারেন। আল্লাহ্ যেন আমাদের সকলকে সে রূহানী ক্ষমতা  দান করেন। হযরত ওমরের ন্যায় ন্যায়পরায়ন খলিফার যদি হিসাব নিকাশ দিতে এক  বৎসর সময়  লাগে- তাহলে আমাদের নেতাদের অবস্থা এবং আমাদের অবস্থা কি হবে?

(১১) দ্বিতীয় ওমর  নামে খ্যাত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযিয (রহঃ) ইবনে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান -এর ঘটনাঃ

উমাইয়া বংশের খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযিয  (রাঃ)- যিনি প্রথম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ এবং দ্বিতীয় ওমর (রাঃ) নামে খ্যাত- তাঁর ইনতিকালের পর (১০১ হিঃ) মুসলিমা ইবনে আবদুল মালেক তাঁকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- হে আমিরুল মোমেনীন, আমি যদি জানতে পারতাম- আপনার  ইন্তিকালের পর আপনার বর্তমান অবস্থা কেমন? উত্তরে ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রাঃ) বললেন-
قال یا مسلمۃ ھذا اوان فراغی واللّٰہ مااسترحت الا الاٰن ۔ قال قلت فاین انت یا امیر المؤمنین قال مع ائمۃ الھدی فی جنۃ عدن۔
অর্থঃ “হে মুসলিমা, এই মাত্র অবসর হলাম। আল্লাহর শপথ, এতদিন বিশ্রাম নিতে পারিনি- এইমাত্র বিশ্রাম নিচ্ছি। মুসলিমা  বলেন- আমি পুনরায় জিজ্ঞেস  করলাম-  হে আমিরুল মোমেনীন, এখন আপনার অবস্থান কোথায়? হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রাঃ) বললেন-  হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণের সাথে জান্নাতুল আদনে আছি। ” (কিতাবুর রূহ্)।

১২। ইবনে ছিরীন  (রহঃ) -এর ঘটনাঃ (১১০ হিঃ ইন্তিকাল)

স্বপ্ন বিশারদ মুহাম্মদ ইবনে ছিরীন (রহঃ)। তিনি ইবনে ছিরীন নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর ইনতিকালের পর তাঁর জনৈক ঘনিষ্ট বন্ধু তাঁকে  খুশী অবস্থায় দেখতে পেলেন।  জিজ্ঞেস করলেন- হে বন্ধু ইবনে ছিরীন, আপনাকে তো সন্তোষজনক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। বলুন, হযরত হাসান বসরি (রহঃ) -এর অবস্থা কেমন? ইবনে  ছিরীন (রহঃ) বললেন- তাঁর মর্তবা আমার উপরে সত্তরগুণ বেশী। বন্ধু বললেন- আমরা তো মনে করতাম- আপনিই তাঁর চেয়ে উত্তম। উনি কি কাজের জন্য এত মর্যাদা পেলেন? ইবনে ছিরীন  বললেন-  بطول حزنہ۔ অর্থাৎ- “তাঁর দীর্ঘ বিষাদের কারণে”।

ব্যাখ্যাঃ হযরত হাসান বসরির মা ছিলেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম -এর বিবি  হযরত উম্মে  সালমা (রাঃ) -এর ঘরের কাজের মেয়ে বা খাদেমা। হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) নবীপত্মীগণের মধ্যে সর্বশেষ ইনতিকাল  করেন ৬১  হিজরীর কারবালার ঘটনার পরে। নবী পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে হযরত হাসান বসরি  (রহঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং হযরত আলী (রাঃ) -এর হাতে বায়আত হয়েছিলেন। তাঁর মহিলা মুরিদ ছিলেন তাপসী রাবেয়া বসরিয়া রাহমাতুল্লাহি  আলাইহা। হযরত হাসান বসরি (রহঃ) সদা-সর্বদা পরকালের  চিন্তায় চিন্তাযুক্ত থাকতেন।  তাই ইবনে ছিরীন -এর উপর তাঁর এত বেশী মর্যাদা। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে- ইবনে ছিরীন এবং হাসান বসরি (রহঃ) উভয়েই তখন ইনতিকালপ্রাপ্ত। মাযারে তাঁদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ হতো এবং   একজন অন্যজনের অবস্থা জানতেন। তাই দুনিয়াবাসী বন্ধুকে ইবনে ছিরীন উক্ত সংবাদ দিয়েছিলেন। বুঝা গেল- কবরবাসীরা পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ করেন এবং স্বপ্নযোগে দুনিয়াবাসীকে পরকালের গায়েবী সংবাদ দেন। সুতরাং উত্তম কাফন পরানো উচিৎ।

১৩। হযরত রাবেয়া বসরিয়া (রহঃ) -এর ঘটনাঃ

হযরত রাবেয়া বসরিয়া (রহঃ) ছিলেন হযরত হাসান বসরি রহমতুল্লাহের মহিলা  মুরিদ। তাঁর ইবাদত বন্দেগী এবং নবীপ্রেম ছিল কিংবদন্তি তুল্য। পাহাড় পর্বত জঙ্গল ছিল তাঁর চারণভূমি। তিনি ছিলেন চির কুমারী। বাইতুল মোকাদ্দাসে পাহাড়ের গভীর গুহায় তাঁর মাযার অবস্থিত। আমি অধম লেখক ১৯৯৯ সালে বাইতুল মোকাদ্দাস  সফরকালে তাঁর কথিত মাযার যিয়ারতের সৌভাগ্য লাভ করেছি।

“হযরত রাবেয়া বসরিয়ার ইনতিকালের পর তাঁর এক মহিলা বান্ধবী তাঁকে স্বপ্নে দেখতে  পেলেন। হযরত রাবেয়া বসরিয়ার গায়ে ছিল তখন রেশমী ও মখমলের পোষাক। অথচ ইনতিকালের  পর তাঁকে কাফন পরিধান করানো হয়েছিল পশমী ইজার ও ওড়না দ্বারা। এ অবস্থা দেখে বান্ধবী জিজ্ঞেস করলেন- এর কারণ কী এবং ঐ কাফনের কাপড় কোথায়? হযরত রাবেয়া বসরিয়া (রহঃ)  জওয়াব দিলেন- আল্লাহর শপথ, কাফনের ঐ পশমী পোষাক আমার থেকে খুলে নিয়ে সীলগালা করে ইল্লিয়্যিনে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে এবং তার পরিবর্তে জান্নাতী রেশমী ও মখমলের পোষাক আমাকে পরানো হয়েছে- যা তুমি  এখন দেখতে পাচ্ছো। কিয়ামতের  দিনে আমার ঐ পোষাকের ছাওয়াব আমাকে পূর্ণভাবে  প্রদান করা  হবে। ” (কিতাবুর রূহ্)। ওহাবী নেতা হয়ে এত সুন্দর কথা !

বিঃ দ্রঃ আল্লাহর অলীগনের কাফনের কাপড়ের সন্মান আল্লাহর কাছে এত প্রিয় যে, তা ইল্লিয়্যিনে যতœ করে রাখা হয়েছে এবং পরকালে  তার পূর্ণ সম্মান প্রদান করা হবে।  কেননা, অলী-আল্লাহ্গণের সব কিছুই আল্লাহর  উদ্দেশ্যে করা হয়। হায়! হযরত রাবেয়া বসরিয়ার ঐ কাফনের পোষাকের সম্মান যদি আমাদের ভাগ্যে জুটতো- তাহলে কতইনা খোশ নসীব হতাম! ভাগ্যবান লোকেরাই কবরবাসীদের সাথে স্বপ্নযোগে বা কাশ্ফযোগে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। আয়না পরিষ্কার হলে যেমন নিজের ছবি আয়নাতে দেখতে পায়- অনুরূপভাবে  বিশুদ্ধ রূহের আয়নাতেও  কবরবাসীর রূহ্ প্রতিবিম্বিত হয়। ”ঐ রূহ্ এই রূহের আয়নাতে প্রতিবিম্বিত হয়”। (শরহে মাকাসেদ)

(১৪) এক আবেদ যুবকের ঘটনাঃ

ইবনে দাউদ নামে জনৈক বুযর্গ বর্ণনা করেন- আমরা একটি কাফেলায় আবাদান শহরে ছিলাম। তখন সময় ছিল ভীষণ গরমকাল। আমাদের  নিকট কুফাবাসী জনৈক এবাদতগুযার যুবক আগমন করলো। অতিরিক্ত গরমে যুবকটি মৃত্যু বরণ করলো।  আমরা বললাম- একটু ঠাণ্ডা পড়–ক,  তখন এই যুবককে দাফনের ব্যবস্থা করবো। ইবনে দাউদ বলেন- এই কথা বলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখি- আমি যেন কোন এক কবরস্তানে আছি। সেখানে একটি গম্বুজ দেখতে পেলাম। গম্বুজটি ছিল উজ্জ্বল মনিমুক্তা খচিত। গম্বুজের সৌন্দর্য ঝলমল করছে। আমি একদৃষ্টিতে উক্ত গম্বুজের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখতে পেলাম- এক খুবসূরত যুবতী মেয়ে উক্ত গম্বুজ হতে বের হয়ে আমার কাছে এসে বললো- দয়া করে এই যুবককে যোহর নামায পর্য্যন্ত আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবেন না।

ইবনে দাউদ বলেন- এই স্বপ্ন দেখে আমি ঘাবড়িয়ে সজাগ হয়ে গেলাম এবং তাড়াতাড়ি করে উক্ত যুবকের লাশ ঐ জায়গায় দাফন করার ব্যবস্থা করলাম- যেখানে গম্বুজ ও  সুন্দরী যুবতীকে স্বপ্নে  দেখেছিলাম। ” (কিতাবুর রূহ্)।

ব্যাখ্যাঃ যুবকের  ঈমান ও ইবাদতের  বিনিময়ে আল্লাহ্পাক তার  জন্য জান্নাতে মনিমুক্তার প্রাসাদ তৈয়ার করে রেখেছেন এবং ঐ সুন্দরী যুবতী মহিলা ছিল হুর।  উক্ত ঘটনায় বুঝা গেল- ইবাদতকারীর ইন্তিকালের পর জান্নাতী হুরগণ তার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তাই অযৌক্তিক বিলম্ব না করে যথাশীঘ্র দাফন করা উত্তম- যেমন বিবাহের   পর বাসরে দিতে অযৌক্তিক বিলম্ব করা অনুচিত।

(১৫) আমের ইবনে আব্দে কয়েছ এবং আবুল আ’লা ইবনে মিছকিন -এর ঘটনাঃ

আবদুল  মালেক ইবনে  আত্তাব লাইছী মিশরী (১৭৫হিঃ) ছিলেন যুগের ইমাম, হাফিযুল হাদীস ও ফিকাহ্ বিশারদ। তিনি বলেন- “আমের ইবনে আবদে কয়েছকে আমি স্বপ্নে দেখলাম। জিজ্ঞেস  করলাম- আপনি দুনিয়ার কোন্ আমলকে উত্তম  পেয়েছেন? আমের  বললেন- যে আমলের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতাম- উহাই উত্তম আমল।

(১৬) অন্য একটি ঘটনাঃ ইয়াযিদ ইবনে হারুন বলেন- আমি স্বপ্নযোগে আবুল  আ’লা ইবনে মিছকিনকে দেখতে পেলাম।  জিজ্ঞেস করলাম- আপনার রব আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? আবুল আ’লা জওয়াব দিলেন- আমাকে  ক্ষমা করে দিয়েছেন। ইয়াযিদ ইবনে হারূন পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন-কিসের বিনিময়ে ক্ষমা করলেন? আবুল আ’লা বললেন-
بالصوم والصلواۃ۔
অর্থাৎ- ”নামায রোযার বিনিময়ে আমাকে ক্ষমা করা হয়েছে। ” (রূহ্)

ব্যাখ্যাঃ বুঝা গেল- মোমিনবান্দা নামায রোযা করলে আল্লাহ্পাক তাকে ক্ষমা করে দেন।  জগতবাসী ও কবরবাসীর মধ্যে এই  যোগাযোগ স্বপ্নযোগে,  কাশ্ফযোগে ও রূহানীভাবে কিয়ামত পর্য্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কবরবাসীদের এই সংবাদ সত্য, পরজগতের নেয়ামত সত্য। বাস্তবে কবরবাসীগণ সব কিছু দেখেন এবং স্বপ্নযোগে দুনিয়াবাসীকে সতর্ক করেন। আমাদের উচিৎ- নবীজীর গায়েবী ইলেম ও অলীগনের কাশ্ফ বিশ্বাস করা। কেননা, নবী করিম (ﷺ) হাদীস শরীফে গায়েবী জগতের  যে সংবাদ দিয়ে গেছেন-  আল্লাহর অলীগণের বাস্তব অভিজ্ঞতা তার সত্যতা প্রমাণ  করে। আল্লাহ্ আমাদেরকে নামায রোযায় মনোযোগী করুন। আমীন!

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment