আলবানী সাহেবের বক্তব্য : কিছু পর্যালোচনা
আমাদের জানামতে হযরত ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটিকে ছয়জন শীর্ষ মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন।
১. ইবনে খুযায়মা,
২. ইবনে হিব্বান,
৩, হাকেম আবু আব্দুল্লাহ,
৪. ইবনুস সাকান,
৫. হাফেয যাহাবী,
৬. ইবনুল মুলাক্কিন,
৫. হাফেয যাহাবী, আল বাদরুল মুনীর গ্রন্থকার।
এছাড়া যারা এটিকে হাসান আখ্যা দিয়েছেন তারা হলেন :
৭. ইমাম তিরমিযী।
৮. মুহিয়ুস সুন্নাহ বাগাবী, তার ‘শারহুস সুন্নাহ’য় (নং ৬৪২)
৯. আবু বকর আল হাযেমী, তার আল ইতিবার গ্রন্থে,
১০. ইবনে সাইয়্যেদুন্নাস, তার তিরমিযীর ভাষ্যে।
এটিকে ছাবিত বা প্রমাণিত বলেছেন একজন। তিনি হলেন,
১১. ইমাম ইবনুল মুনযির।
এটিকে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসের তুলনায় মজবুত আখ্যা দিয়েছেন তিনজন। তারা হলেন,
১২. আবু সুলায়মান খাত্তাবী। তিনি বলেছেন, حديث وائل أثبت من هذا ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটি এটির (আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীসের) চেয়ে মজবুত।
১৩. ইবনুল জাওযী।
১৪. আমীর ইয়ামানী। তার বক্তব্য সরাসরি এমন না হলেও তার আলোচনা থেকে তাই বোঝা যায়। (দ্র. সুবুলুস সালাম, সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ)
এছাড়া ১৫. ইমাম নববী ও ১৬.যুরকানী দুজনের দৃষ্টিতে এটির সনদ জায়্যিদ বা উৎকৃষ্ট। কারণ তারা আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটির সনদকে জায়্যিদ বা উৎকৃষ্ট বলেছেন। আবার ইমাম নববী রহ. বলেছেন, দুটি মতের একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে না। তার এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে যুরকানী তার আলোচনা শেষ করেছেন। (দ্র. শারহুল মাওয়াহিব) বোঝা গেল, উভয় হাদীস তাদের দৃষ্টিতে সমমানের ছিল।
আরেকজন শীর্ষ মুহাদ্দিস হাফেজ জিয়া আলমাকদিসী। তিনি তার আল মুখতারা নামক হাদীসগ্রন্থে শরীক বর্ণিত একাধিক হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, إسناده حسنএর সনদ হাসান। আর একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন,إسناده صحيح এর সনদ সহীহ। (দ্র. নং ১০৫৭, এটি ইয়াযীদ ইবনে হারুন শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন।)
সেই সঙ্গে ইমাম তিরমিযী খাত্তাবী, বাগাবী, আমীর ইয়ামানী ও শাওকানী প্রমুখ যে বলেছেন, ‘এ হাদীস অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত’ সে হিসাবে বলা চলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মতে এ হাদীসটি সহীহ বা হাসান মান সম্পন্ন।
কিন্তু এতসব আলেমের মতামতকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আলবানী সাহেব মিশকাত শরীফ ও সহীহ ইবনে খুযায়মার টিকায় দাবি করেছেন, এটি জয়ীফ বা দুর্বল। আর আসলু সিফাতিস সালাহ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রা. ও ইবনে উমর রা. বর্ণিত হাদীস দুটির আলোচনা শেষে তিনি বলেছেন,
وقد عارضها أحاديث لا يصح شيء منها ونحن نسوقها للتنبيه عليها ولئلا يغتر به من لا علم له
অর্থাৎ এ হাদীসদুটির বিপরীতে কিছু হাদীস রয়েছে। যার কোনটিই সহীহ নয়। আমরা সেগুলো উল্লেখ করছি সতর্ক করার জন্য এবং যাতে এলেম সম্পর্কে বেখবর ব্যক্তিরা এর ধোকায় না পড়ে সে জন্য।
মস্ত বড় দাবি! এ দাবির অনিবার্য ফল হলো ইমাম তিরমিযীসহ পূর্বোল্লিখিত শীর্ষ মুহাদ্দিসগণ সকলে ধোঁকার শিকার হয়েছেন। যেমন, ধোঁকায় পড়েছেন ইমাম আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাক রহ. সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম ও ফকীহ। এমন দাবি করা একজন আলেমের পক্ষে শোভনীয় কি না সে প্রশ্নে না গিয়ে আমরা এ দাবির পক্ষে পেশকৃত যুক্তি ও তার পর্যালোচনা তুলে ধরছি।
পূর্বোক্ত গ্রন্থে ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
وهذا سند ضعيف ، وقد اختلفوا فيه ؛ فقد حسنه الترمذي ، وقال الحاكم : ” احتج مسلم بشريك ” . ووافقه الذهبي . وليس كما قالا ؛ فإن شريكاً لم يحتج به مسلم ، وإنما روى له في المتابعات ؛ كما صرح به غير واحد من المحققين ، ومنهم الذهبي نفسه في ” الميزان “
অর্থাৎ এটি জয়ীফ সনদ। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন। আর হাকেম বলেছেন, শরীক (বর্ণিত হাদীস) দ্বারা মুসলিম রহ. প্রমাণ পেশ করেছেন। যাহাবীও তার (হাকেমের) সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাদের কথা ঠিক নয়। মুসলিম রহ. শরীকের হাদীস প্রমাণস্বরূপ পেশ করেননি। সমর্থক বর্ণনারূপে পেশ করেছেন মাত্র। একাধিক মুহাক্কিক (তাত্ত্বিক) আলেম একথা স্পষ্ট করে বলেছেন। তন্মধ্যে যাহাবী নিজেও আল মীযান গ্রন্থে। (আসলু সিফাতিস সালাহ, ২/৭১৫)
এ ব্যাপারে অধমের আরজ হলো :
হাকেমের ন্যায় ইবনুল জাওযীও বলেছেন, ইমাম মুসলিম শরীকের বর্ণনাকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করেছেন। এজন্য মুগলতায়ী রহ. ইকমাল গ্রন্থে বলেছেন, فينظر এটা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। আমাদের জানামতে মুসলিম শরীফে ১০৩৯-১০২ ও ২২৫৬-২ নম্বরে উদ্ধৃত শরীক কর্তৃক বর্ণিত হাদীসদুটি প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত হয়েছে।
তাছাড়া এ হাদীসটিকে তো আরো অনেকে সহীহ বা হাসান মনে করেছেন বা বলেছেন। আলবানী সাহেব এখানে এত কার্পণ্য করলেন কেন? নিজের পক্ষের দলিল হলে তো কে কি বলেছেন খুঁটে খুঁটে তা বের করে আনেন। কিন্তু এখানে প্রকাশ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্তব্যগুলো তিনি এড়িয়ে গেলেন কেন? তার মতের পক্ষে নয় তাই?
এরপর তিনি লিখেছেন,
وكثيراً ما يقع الحاكم – ويتبعه الذهبي في ” تلخيصه ” – في هذا الوهم ؛ فيصححان كل حديث يرويه شريك على شرط مسلم
অর্থাৎ অনেক স্থানেই হাকেম ও তার অনুসরণে যাহাবী তার তালখীসুল মুসতাদরাক গ্রন্থে এ ভুলের শিকার হয়েছেন। শরীক কর্তৃক বর্ণিত (মুসতাদরাকে উদ্ধৃত) সব হাদীসকেই তারা মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। (প্রাগুক্ত)
কিন্তু আমাদের ধারণা যদি সত্য হয় এবং পেছনে উল্লেখকৃত নম্বর দুটির হাদীস দুটি যদি প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে, হাকেমের এক্ষেত্রে একটি ভুলও হয় নি। আর যদি তার ভুল হয়েই থাকে তাতেই বা সমস্যা কী? তিনি ছাড়াও তো অনেকেই এই হাদীসকে সহীহ মনে করতেন। তাছাড়া হাকেমের এ ধরনের ভুল তো শরীক ছাড়া অন্য অনেকের বর্ণনার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কিন্তু আলবানী সাহেব সেকথা বলছেন না কেন? সেটা কি তার পক্ষের দলিল ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি সম্পর্কে হাকেমের সহীহ বলাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য? কারণ আমাদের জানামতে ঐ হাদীসটিকে হাকেম ছাড়া অন্য কেউ সহীহ বলেন নি।
এরপর তিনি লিখেছেন,
وأما الدارقطني ؛ فقال :” تفرد به يزيد عن شَرِيك ، ولم يحدث به عن عاصم بن كُلَيب غير شريك ، وشريك : ليس بالقوي فيما يتفرد به ” . وهذا هو الحق ؛ فقد اتفقوا كلهم على أن الحديث مما تفرد به شريك دون أصحاب عاصم ، وممن صرح بذلك غير الدارقطني : الترمذي ، والبيهقي ، بل قال يزيد بن هارون :” إن شريكاً لم يرو عن عاصم غير هذا الحديث ” .
অর্থাৎ ‘দারাকুতনী রহ. বলেছেন, ‘এ হাদীসটি শরীক থেকে শুধু ইয়াযীদ (ইবনে হারুনই) বর্ণনা করেছেন। আর আসেম ইবনে কুলায়ব থেকে শরীক ছাড়া অন্য কেউ এটি বর্ণনা করেননি। আর নিঃসঙ্গ বর্ণনার ক্ষেত্রে শরীক মজবুত নন।’
এটিই সত্য কথা। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি আসেমের শাগরেদদের মধ্যে শরীকই একাকী বর্ণনা করেছেন। দারাকুতনী ছাড়া তিরমিযী ও বায়হাকী সুস্পষ্ট করে এ কথা বলেছেন। বরং ইয়াযীদ ইবনে হারুন এ কথাও বলেছেন যে, এ হাদীসটি ছাড়া শরীক আসেম থেকে অন্য কোন হাদীস বর্ণনা করেন নি।’ (প্রাগুক্ত, ২/৭১৫)
এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য:
ক. ইয়াযীদ ইবনে হারুন শরীক থেকে একা বর্ণনা করেছেন, একথা ঠিক নয়। সহীহ ইবনে খুযায়মায় সাহল ইবনে হারুনও শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন। (দ্র. হাদীস নং ৬২৯)
খ. ‘আসেম ইবনে কুলায়ব থেকে শরীক একা বর্ণনা করেছেন’ তিরমিযী প্রমুখের এ কথার উদ্দেশ্য হলো, অবিচ্ছিন্ন সূত্রে কেবল তিনিই বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনার সমর্থক আরো যে দুটি বর্ণনা রয়েছে তার একটি মুরসাল, অপরটি মুনকাতি। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত হলো, মুরসাল ও মুনকাতি বর্ণনাও সমর্থকরূপে পেশ করা যায়। এ দুটি বর্ণনা আরো পরে আসছে। তাছাড়া শরীকের বর্ণনার সত্যতার সাক্ষী (শাহেদ) হিসাবে আছে হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীসটি। সুতরাং শরীককে নিঃসঙ্গ বলাটা মোটেও ঠিক নয়।
গ. ইয়াযীদ যে বলেছেন, ‘এ হাদীসটি ছাড়া শরীক অন্য কোন হাদীস আসেম থেকে বর্ণনা করেন নি’ কথাটি আদৌ সঠিক নয়। আলবানী সাহেবের মতো বিস্তর ঘাটাঘাটি করা মানুষের পক্ষে এমন কথা উদ্ধৃত করা বড়ই আশ্চর্যের বলে মনে হয়। আসেম থেকে শরীক যে আরো অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলো এখানে উল্লেখ করতে গেলে এ পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি পাবে, তাই তিনটি হাদীস সম্পর্কে শুধু হাদীসগ্রন্থের নাম ও হাদীস নম্বর উল্লেখ করা হলো।
১.আবু দাউদ (৭২৮), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর, (৯৬)।
২.মুসনাদে আহমদ (১৮৮৪৭), আবু দাউদ (৭২৯), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর (৮৬১)।
৩.মুসনাদে আহমদ(১৮৮৬৮, ১৮৮৬৯), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর (১০২)।
এরপর আলবানী সাহেব লিখেছেন,
وشريك سيئ الحفظ عند جمهور علماء الحديث ، وبعضهم صرح بأنه كان قد اختلط ؛ فلذلك لا يحتج به إذا تفرد ، ولا سيما إذا خالف غيره من الثقات الحفاظ
অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ হাদীসবিদের দৃষ্টিতে শরীক ছিলেন দুর্বল স্মৃতির অধিকারী। তাদের কেউ কেউ তো স্পষ্ট বলেছেন, তার স্মৃতি-বিভ্রাট ঘটেছিল। তাই তিনি যখন এককভাবে কোন হাদীস বর্ণনা করেন সেটা প্রমাণস্বরূপ পেশ করা যাবে না। বিশেষত যদি তিনি বিশ্বস্ত ও হাফেযে হাদীসগণের বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা করে থাকেন। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)
এ হলো আলবানী সাহেবের দাবি। মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য ও কর্মপন্থার সঙ্গে এ দাবির কোন মিল নেই। আলবানীভক্তরা হয়তো চোখ বুঁজেই তার দাবিকে শতভাগ সত্য মনে করবেন। কিন্তু পেছনে একবার তাকিয়ে দেখুন, কত বিরাট সংখ্যক শীর্ষ হাদীসবিদ শরীকের হাদীসটিকে হয় সহীহ না হয় হাসান আখ্যা দিয়েছেন। আমি মনে করি আলবানী সাহেবের দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য উক্ত সংখ্যাই যথেষ্ট। তদুপরি শরীক সম্পর্কে রিজালশাস্ত্রের প-িতগণের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো।
ইমাম আহমদ ও ইবনে মাঈন বলেছেন, صدوق ثقة তিনি সত্যনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। ইবনে মাঈন আরো বলেছেন, ثقة ثقةতিনি বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত। নাসাঈ বলেছেন, ليس به بأس তার মধ্যে অসুবিধার কিছু নেই। আবু দাউদ বলেছেন, ثقة يخطئ على الأعمش তিনি বিশ্বস্ত, তবে আমাশের হাদীসে ভুল করতেন। উল্লেখ্য, আলোচ্য হাদীসটি আমাশ থেকে বর্ণিত নয়। আবু ইসহাক আল হারবী তার তারীখ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। ইবনে শাহীন তার ছিকাত গ্রন্থে বলেছেন, ثقة ثقة তিনি বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত। আহমদ আল ইজলী বলেছেন, كوفي ثقة وكان حسن الحديث তিনি কুফার অধিবাসী, বিশ্বস্ত ও উত্তম হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। আবু হাতেম রাযীকে জিজ্ঞেস করা হলো, আবুল আহওয়াস (বুখারী ও মুসলিমের রাবী) ও শরীক এ দুজনের মধ্যে ভাল কে ? তিনি বললেন, আমার দৃষ্টিতে শরীকই ভালো। شريك صدوق قد كان له أغاليط শরীক সাদুক বা সত্যনিষ্ঠ, অবশ্য তার কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও রয়েছে। আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, তিনি ইসরাঈল (বুখারী-মুসলিমের রাবী) এর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখতেন। আর তার তুলনায় ইসরাঈলের ভুল হতো কম। ইবনে সাদ বলেছেন, كان ثقة مأمونا كثير الحديث وكان يغلط كثيرا তিনি বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ছিলেন। বহু হাদীসের অধিকারী। তিনি অনেক ভুল করতেন। ইয়াকুব ইবনে শায়বা বলেন, ثقة صدوق صحيح الكتاب رديئ الحفظ مضطربه তিনি বিশ্বস্ত ও সত্যনিষ্ঠ, তার কিতাব ছিল সহীহ বা বিশুদ্ধ, তার স্মৃতিশক্তি ছিল খারাপ, তাতে স্থিরতা ছিল না। (তারীখে বাগদাদ)
যারা বলেছেন, তিনি অনেক ভুল করতেন তাঁর সেসব ভুলের পরিমাণ কি ছিল, ইবনে আদী’র কথায় তারও তথ্য মেলে। তিনি বলেছেন, الغالب على حديثه الصحة والاستواء তার বর্ণনায় সঠিক ও বিশুদ্ধের সংখ্যাই বেশি।
এসব ভুল তার কোন কোন উস্তাদ থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে ঘটেছে? আবু দাউদ বলেছেন আমাশের নাম। এছাড়া কুফার অন্যান্য মুহাদ্দিস থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, شريك أعلم بحديث الكوفيين من سفيان الثوري অর্থাৎ শরীক কুফাবাসীদের হাদীস সুফিয়ান ছাওরীর চেয়েও বেশি ভাল জানতেন।
বোঝা গেল, ভুলগুলো তিনি কুফার বাইরের উস্তাদগণ থেকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে করতেন। উল্লেখ্য যে, শরীক এ হাদীসটি কুফাবাসী মুহাদ্দিস আসেম থেকে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এতে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়।
আরো একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। তা হলো, এ ভুলগুলো তার জীবনে কখন ঘটেছিল। শুরু থেকেই তিনি স্মৃতিদুর্বল ছিলেন, না পরবর্তীকালে এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সালিহ ইবনে মুহাম্মদ বলেছেন, صدوق لما ولى القضاء تغير حفظه তিনি সাদুক ছিলেন। বিচারকের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তার স্মৃতিতে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। ইবনে হিব্বান তো আরো স্পষ্ট করে বলেছেন,
ولى القضاء بواسط سنة خمسين ومائة ثم ولى الكوفة ومات بها سنة سبع وسبعين ومائة وكان في آخر عمره يخطئ فيما روى وتغير عليه حفظه فسماع المتقدمين الذين سمعوا منه بواسط ليس فيه تخليط مثل يزيد بن هارون وإسحاق الأزرق وسماع المتأخرين عنه بالكوفة فيه أوهام كثيرة.
অর্থাৎ তিনি ১৫০ হি. সনে ওয়াসিতের বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর কুফার বিচারক হয়েছিলেন, এবং সেখানেই তিনি ১৭৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। শেষ বয়সে তিনি যেসব হাদীস বর্ণনা করতেন তাতে ভুল করতেন। তখন তার স্মৃতিও বদলে যায়। তাই কুফার কাজী হওয়ার পূর্বেই ওয়াসিতে যারা তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন, তাতে কোন বিভ্রাট ছিল না। যেমন, ইয়াযীদ ইবনে হারুন ও ইসহাক আল আযরাক। আর যারা এরপরে কুফায় শুনেছেন, সেখানে ভুল ছিল অনেক।
হাফেয ইবনে হাজারও তাকরীব গ্রন্থে বলেছেন, صدوق يخطئ كثيرا تغير حفظه بعد ما ولى قضاء الكوفة অর্থাৎ সাদূক, ভুল করতেন বেশি, কুফার কাজী নিযুক্ত হওয়ার পর তার স্মৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। যাহাবীর মতেও তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি তাকে من تكلم فيه وهو موثق (যারা সমালোচিত অথচ বিশ্বস্ত) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আল মুগনী গ্রন্থে যাহাবী বলেছেন, صدوق সাদুক।
আধুনিক কালের দুজন গবেষক ইবনে হিব্বানের এমতটিই পছন্দ করেছেন। একজন হলেন, আলাউদ্দীন আলী রেজা ‘আল ইগতিবাত বিমান রুমিয়া মিনার রুওয়াতি বিল ইখতিলাত’ গ্রন্থের (কৃত সিবতু ইবনিল আজমী) টীকায়, অপরজন হলেন ড. রিফয়াত ফাওযী আলাঈ কৃত আল মুখতালিতীন গ্রন্থের টীকায়।
অবাক হওয়ার বিষয় হলো, আলবানী সাহেব নিজেও অন্যত্র এই শরীক কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, إسناده حسن এর সনদ হাসান। কিন্তু এটা ছিল আমীন জোরে বলার হাদীস। তার পক্ষের, তাই। (দ্র. আসলু সিফাতিস সালাহ, জোরে আমীন বলার আলোচনা) একই গ্রন্থে অন্যত্র শরীকের একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, إسناده جيد এর সনদ উৎকৃষ্ট। (দ্র. ঊতীতু মিযমারান মিন মাযামীরি আলি দাউদ: হাদীসটির আলোচনা।) এ যেন তার মর্জি, যখন যাকে ইচ্ছা বিশ্বস্ত আখ্যা দেবেন, আবার সময়মতো দুর্বল সাব্যস্ত করবেন।
উল্লেখ্য যে, এ হাদীসটি ইয়াযীদ ইবনে হারুনই: যিনি ওয়াসিত নিবাসী ছিলেন: শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বানের ভাষ্যমতে শরীকের স্মৃতিতে পরিবর্তন আসার আগেই তিনি তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। অথচ এ হাদীসকেই আলবানী সাহেব জয়ীফ বা দুর্বল বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। শরীক সম্পর্কে এ আলোচনা ভাল করে পড়–ন আর ভাবুন, লা-মাযহাবী বন্ধুদের ভাষায় যুগশ্রেষ্ঠ প্রকৃত মুহাদ্দিস সাহেব যা বলেছেন, তার সঙ্গে হাদীসবিদগণের বক্তব্যের মিল কতটুকু।
আরেকটি কথা হলো, আলবানী সাহেব যে বলেছেন, ‘বিশেষত যদি বিশ্বস্ত ও হাফেযে হাদীসগণের বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা করে থাকেন’। এ কথাটি তিনি এখানে কেন জুড়ে দিয়েছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। শরীক এখানে কোন হাফেযে হাদীসের বিপরীত বর্ণনা করেন নি।
আলবানী সাহেব আরো লিখেছেন,
فقد روى جمع منهم عن عاصم بإسناده هذا عن وائل صفة صلاته صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وليس فيها ما ذكره شريك .
অর্থাৎ তাদের অনেকে আসিম থেকে একই সনদে ওয়াইল রা. থেকে রাসূল সা. নামাযের বিবরণমূলক হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু শরীক যা উল্লেখ করেছেন সেখানে তা নেই। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)
ভাল কথা, কিন্তু এ আপত্তি শুধু এখানে কেন? বুকে হাত বাঁধার হাদীস মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈল সুফিয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে অনেক গবেষক বলেছিলেন, মুআম্মাল এমনিতেই জয়ীফ, আবার সুফিয়ানের শাগরেদদের মধ্যে এই বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ। কিন্তু সেখানে আপনি তা কর্ণপাত করেন নি। কারণ সেটি ছিল পক্ষের হাদীস। আবার হাঁটুর আগে হাত রাখা সংক্রান্ত ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি দারাওয়ার্দী একাই উবাইদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। উবায়দুল্লাহ থেকে দারাওয়ার্দীর বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ ও নাসাঈ প্রমুখের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আপনি সেটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। শুধু কি তাই? আপনি সেখানে এই নীতিও আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, وليس من شرط الحديث الصحيح أن لا ينفرد بعض رواته والا لما سلم لنا كثير من الأحاديث الصحيحة অর্থাৎ হাদীস সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে এমন শর্ত নেই যে, এর কোন বর্ণনাকারী এককভাবে বর্ণনা করতে পারবে না। এমনটি হলে অনেক সহীহ হাদীসই রক্ষা পাবে না। (প্রাগুক্ত, ২/৭২১)
এসব কথা কি এখানে দিব্যি ভুলে গেছেন?
তিনি আরো লিখেছেন,
على أنه قد رواه غيره عن عاصم عن أبيه عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مرسلاً ؛ لم يذكر وائلاً .أخرجه أبو داود ، والطحاوي ، والبيهقي عن شَقيق أبي ليث قال : ثني عاصم به .لكن شقيق : مجهول لا يعرف – كما قال الذهبي وغيره – .
অর্থাৎ অধিকন্তু শরীক ব্যতীত অন্য বর্ণনাকারী আসিমের সূত্রে তদীয় পিতা থেকে, তিনি নবী সা. থেকে এটি বর্ণনা করেছেন মুরসাল (সূত্রবিচ্ছিন্ন) রূপে, ওয়াইল রা. এর উল্লেখ ছাড়া। আবু দাউদ, তাহাবী ও বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন শাকীক আবু লায়ছের সূত্রে। তিনি বলেছেন, আসিম আমার নিকট এভাবেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে শাকীক মাজহুল বা অজ্ঞাত, যেমনটি বলেছেন যাহাবীসহ কেউ কেউ। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)
আমাদের বক্তব্য হলো, শাকীক অজ্ঞাত, সুতরাং তার বর্ণনাকে শরীকের বর্ণনার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে শরীকের বর্ণনাকে নাকচ করার সুযোগ কোথায়? কথাটি তো এভাবেও বলা যেত যে, এ মুরসাল বর্ণনাটিও শরীকের বর্ণনার সমর্থন যোগায়। কারণ সমর্থনের জন্য রাবীর অজ্ঞাত হওয়া বা সূত্র বিচ্ছিন্নতা কোনটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত এমনই।
শেষকথা তিনি লিখেছেন,
وله طريق أخرى معلولة عند أبي داود ، والبيهقي أيضاً عن عبد الجبار بن وائل عن أبيه مرفوعاً بمعناه وهذا منقطع بين عبد الجبار وأبيه ، فإنه لم يسمع منه
অর্থাৎ এর আরেকটি সনদ আছে। সেটিও মা’লুল বা দোষযুক্ত। আবু দাউদ ও বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন আব্দুল জব্বার ইবনে ওয়াইল থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে নবী সা. থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটি সূত্রবিচ্ছিন্ন। কারণ আব্দুল জব্বার তার পিতা থেকে হাদীস শোনেন নি। (প্রাগুক্ত)
লক্ষ করুন, এ বর্ণনাটির সকল রাবী বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। দোষ শুধু এতটুকু, সাহাবী ওয়াইল রা. এর ছেলে আব্দুল জব্বার পিতার কাছ থেকে হাদীস শোনেন নি। তার পরও তিনি পিতা থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। বোঝা গেল, মাঝখানে অন্য কেউ আছেন, যার কাছ থেকে তিনি হাদীসটি শুনেছেন। ব্যাস, শুধু এই দোষের কারণে এটি শরীকের বর্ণনার সমর্থকরূপেও উল্লেখিত হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে!
আলবানী সাহেবের এ বক্তব্য বড়ই আশ্চর্যের। কারণ প্রথমত, সূত্রবিচ্ছিন্ন বর্ণনাকে শর্তসাপেক্ষে পূর্ববর্তী ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের অধিকাংশই প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করেছেন। (দ্র. আবু দাউদ কৃত রিসালা আবী দাউদ ইলা আহলি মাক্কাহ ও ইবনে আব্দুল বার কৃত আত তামহীদের ভূমিকা।)
ইমাম বুখারী ও তার যুগের ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিস অবশ্য এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করেছেন। আর সেটাও শুধু এই সাবধানতার জন্য যে, পাছে না জানি কোন ভেজাল লোক মাঝখানে ঢুকে থাকে। আর জানা কথা যে, সাহাবীগণের ছেলেদের যুগে ভেজাল লোকের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তাছাড়া আব্দুল জব্বার পিতার কাছ থেকে হাদীস শোনার সুযোগ না পেলেও পিতার হাদীসগুলো তিনি তার বড় ভাই আলকামা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে শুনেছেন। এসব ভেবেই হয়তো দারাকুতনী আব্দুল জব্বারের একটি হাদীস যা তিনি পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। (দ্র. আসসুনান, ১/৩৩৫)
দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই, সূত্র বিচ্ছিন্নতার কারণে এটি জয়ীফ বা দুর্বল, তথাপি অন্য আরেকটি হাদীসের সমর্থক হওয়ার ক্ষেত্রে তো কোন সমস্যা নেই। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত হলো জয়ীফ হাদীসও সমর্থকরূপে পেশ করা যায়। আলবানী সাহেবের মতো মানুষের কাছে এটা অজানা থাকার কথা নয়। কারণ তিনি নিজেই ইরওয়া গ্রন্থে ২৩১৭ নং হাদীসটি প্রসঙ্গে বলেছেন, وله شاهد مرفوع এর সমর্থক একটি মারফূ হাদীস আছে। অতঃপর তিনি আব্দুল জব্বার কর্তৃক তদীয় পিতার সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘আছছামারুল মুসতাতাব ফী ফিকহিস সুন্নাতি ওয়াল কিতাব’ গ্রন্থে আব্দুল জব্বারের এমন একটি সনদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,
وإسناده حسن إلا أن فيه انقطاعا لأن عبد الجبار ثبت عنه في (صحيح مسلم ) أنه قال : كنت غلاما لا أعقل صلاة أبي
অর্থাৎ এ হাদীসটির সনদ হাসান। তবে এতে সূত্রবিচ্ছিন্নতা রয়েছে। কেননা (সহীহ মুসলিমে) আব্দুল জব্বারের বাচনিক বিধৃত হয়েছে যে, আমি ছোট ছিলাম, বাবার নামায বুঝতাম না। (দ্র. পৃ. ১৫৪)
এখানে তিনি কত সুন্দর সনদটি হাসান তবে … বলে উল্লেখ করলেন। আর হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার হাদীসটিকে প্রথমেই মা’লুল (দোষযুক্ত দুর্বল) বলে নাকচ করে দিলেন।
আলবানী সাহেবের একটি বড় ভুলও এখানে ধরা পড়েছে। তিনি আব্দুল জব্বারের এই শেষোক্ত বক্তব্যটিকে সহীহ মুসলিমের দিকে সম্পর্কিত করেছেন। অথচ এটি মুসলিম শরীফে নেই। আছে আবু দাউদ (৭২৩) ইবনে খুযায়মা (৯০৫), তাহাবী (১৫৩৪), ইবনে হিব্বান (১৮৬২), ও তাবারানীর আল মুজামুল কাবীর (৬১) গ্রন্থে।
‘আমি ছোট ছিলাম’ আব্দুল জব্বারের এ উক্তির সনদ সহীহ। যেমনটি বলেছেন শোয়াইব আরনাউত ও আলবানী সাহেব। ইমাম বুখারীসহ অনেকে যে বলেছেন, ‘আব্দুল জব্বার মার্তৃগর্ভে থাকাকালে তার পিতার ইন্তেকাল হয়’ সেটা এই উক্তি দ্বারা নাকচ হয়ে যায়। একারণে তাহযীবুল কামালে মিযযী ও জামিউত তাহসীলে আলাঈ রহ. জোর দিয়ে বলেছেন, বুখারী প্রমুখের বক্তব্য সঠিক নয়। আসলে ইমাম বুখারী মুহাম্মদ ইবনে হুজর এর কথার উপর ভিত্তি করেই ঐ বক্তব্য দিয়েছেন। (দ্র. আততারীখুল কাবীর) অথচ মুহাম্মদ ইবনে হুজর ছিলেন জয়ীফ বা দুর্বল। দুর্বল রাবীর কথায় বিশ্বস্ত রাবীর মতামতকে উপেক্ষা করার এও একটি নজীর। ইমাম বুখারী নিজেও তার ‘তারীখে’ ফিতর ইবনে খালীফার বরাত দিয়ে আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল জব্বার বলেছেন, আমি পিতাকে বলতে শুনেছি। কিন্তু বুখারী ও ইবনে হিব্বান এ কথাটিও নাকচ করে দিয়েছেন।
হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীস:
এ হাদীস সম্পর্কে আলবানী সাহেব বলেছেন,
قال الدارقطني والبيهقي : ” تفرد به العلاء بن إسماعيل ” . قلت : وهو مجهول ؛ كما قال ابن القيم (১/৮১) ، وكذلك قال البيهقي – على ما في ” التلخيص “
অর্থাৎ দারাকুতনী ও বায়হাকী বলেছেন, এ হাদীসটি বর্ণনার ব্যাপারে আলা ইবনে ইসমাঈল নিঃসঙ্গ। আমি (আলবানী সাহেব) বলব, তিনি ছিলেন মাজহূল বা অজ্ঞাত। যেমনটি বলেছেন ইবনুল কায়্যিম এবং বায়হাকীও তাই বলেছেন। তালখীস গ্রন্থ থেকে সেটা জানা গেছে।
বায়হাকীও মাজহূল বলেছেন: একথাটি আলবানী সাহেবের বোঝার ভুল। আত তালখীসুল হাবীর গ্রন্থের উপস্থাপনা থেকে এ ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। ঐ মন্তব্য আসলে ইবনে হাজার আসকালানীর, বায়হাকীর নয়। তবু তো শোকর, আলবানী সাহেব সেই গ্রন্থের বরাতেই কথাটি উল্লেখ করেছেন, যে গ্রন্থে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী সাহেব তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থে এবং শামসুল হক আযীমাবাদী সাহেব ‘আওনুল মাবুদ’ গ্রন্থে তালখীস গ্রন্থের বরাত ছাড়াই বলে দিয়েছেন, বায়হাকী তাকে মাজহূল বলেছেন!!
অবশ্য আলবানী সাহেবের ব্যাপারে একটু বেশি আশ্চর্য এজন্য লাগে যে, বায়হাকী’র গ্রন্থাবলি তার সামনে। তিনি সেগুলো ঘাটাঘাটিও করেছেন বিস্তর। বায়হাকীর কোন গ্রন্থে তিনি ঐ মন্তব্য অবশ্যই দেখতে পাননি। তারপরও কেন এত শৈথিল্য তা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
আমাদের জানামতে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের কেউই আলা ইবনে ইসমাঈলকে মাজহূল বলেন নি। বরং হাকেম তার আল মুসতাদরাক গ্রন্থে আলা’র এ হাদীসকে বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ আখ্যা দিয়ে জানান দিয়েছেন, আলা তার নিকট পরিচিত। এদিকে আলা থেকে হাদীস বর্ণনাকারী তিনজন মুহাদ্দিসের নাম পাওয়া গেছে। ১. আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ আদ দূরী, (হাকেম, দারাকুতনী, বায়হাকী) ২. মুহাম্মদ ইবনে আইয়্যূব (দ্র. ইবনে মানদাহ কৃত ফাতহুল বাব ফিল কুনা ওয়াল আলকাব, নং ১৯৪৭, ৩. ইবনে আবূ খায়ছামা। এই তৃতীয়জন তার আত তারীখুল কাবীরে (নং ৮১) বলেছেন,
حدثنا العلاء بن إسماعيل الكوفي أبو الحسن منزله بفيد نا حفص بن غياث فذكر حديث الباب
অর্থাৎ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন আলা ইবনে ইসমাঈল আলকূফী আবুল হাসান। তার নিবাস ছিল ফায়দ (মক্কা ও কুফার মধ্যবর্তী একটি প্রসিদ্ধ এলাকা।) তিনি বলেছেন, হাফস ইবনে গিয়াস আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, …। অতঃপর তিনি এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবু খায়ছামা শুধু তার সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনাই করেন নি। সেই সঙ্গে আলা কোথায় বসবাস করতেন তাও উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায়, তিনি তাকে ভালোভাবেই চিনতেন জানতেন। সুতরাং এমন ব্যক্তি অজ্ঞাত হয় কীভাবে? দারাকুতনী ও বায়হাকী তার হাদীস উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু তাকে মাজহূল বা অজ্ঞাত বলেন নি।
এরপর আলবানী সাহেব লিখেছেন,
وأما قول الحاكم والذهبي : إنه ” حديث صحيح على شرط الشيخين ” فمنكر من القول ، لم يسبقهما ، ولم يتابعهما عليه أحد .
অর্থাৎ হাকেম ও যাহাবী যে বলেছেন, এটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ, এটা অশোভন কথা। তাদের পূর্বেও কেউ এমন কথা বলেন নি। তাদের পরেও কেউ এটা সমর্থন করেন নি। (আসলু সিফাতিস সালাহ, ২/৭১৭)
অথচ আলবানী সাহেবের বিভিন্ন গ্রন্থে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে তিনি হাকেমের সহীহ বলাকে লুফে নিয়েছেন। সেখানেও হাকেমের আগে পরে কেউ উক্ত হাদীসকে সহীহ বলেন নি। ইবনে উমর রা.এর হাদীসটির কথাই ধরুন, যেটাকে আলবানী সাহেব তার মতের স্বপক্ষে দলিল হিসাবে পেশ করেছেন। সে হাদীসকেও হাকেম ছাড়া কেউ সহীহ বলেন নি। সামনে এ সম্পর্কে আলোচনা আসছে। অথচ আলবানী সাহেব হাকেমের উদ্ধৃতি থেকে জোর দিয়ে বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। তাহলে এখানে তিনি হাকেমের উপর এত ক্ষিপ্ত হলেন কেন? এ হাদীসটি তার মতের বিপক্ষে গেছে তাই?
এরপর তিনি লিখেছেন,
وقال الحافظ في ترجمة العلاء هذا من ” اللسان ” : ” وقد خالفه عمر بن حفص بن غياث ، وهو من أثبت الناس في أبيه ؛ فرواه عن أبيه عن الأعمش عن إبراهيم عن علقمة وغيره عن عمر موقوفاً عليه . وهذا هو المحفوظ ” .
অর্থাৎ হাফেজ (ইবনে হাজার) লিসানুল মীযান গ্রন্থে এই আলা’র জীবনীতে বলেছেন, হাফস ইবনে গিয়াসের ছেলে উমর: যিনি তার পিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য: তার (আলা’র) থেকে ব্যতিক্রম বর্ণনা করেছেন। তিনি তার পিতার সূত্রে আ’মাশ থেকে, তিনি ইবরাহীম নাখায়ীর সূত্রে আলকামা প্রমুখ থেকে উমর রা.এর নিজস্ব আমলরূপে এটি বর্ণনা করেছেন। আর এটাই হলো সঠিক বর্ণনা। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৭)
আমরা বলব, এ দুটি বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন দুটি হাদীস। এর একটিকে অপরটির মোকাবেলায় দাঁড় করানো উচিৎ নয়।
পরিশেষে তিনি বলেছেন,
على أن حديث أنس لو صح ؛ ليس فيه التصريح أنه صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كان يضع ركبتيه قبل يديه ، وإنما فيه سَبْقُ الركبتين اليدين فقط ، وقد يمكن أن يكون هذا السبق في حركتهما لا في وضعهما – كما قال ابن حزم رحمه الله – .
অর্থাৎ অধিকন্তু আনাস রা. বর্ণিত হাদীসটি যদি সহীহও হয়, তথাপি এতে স্পষ্ট বলা হয় নি যে, নবী সা. হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখতেন। সেখানে এতটুকু বলা হয়েছে, তাঁর হাঁটু আগে যেত। এমনও তো হতে পারে, মাটিতে রাখার সময় নয়, নড়াচড়ার সময় হাঁটু আগে যেত। যেমনটি বলেছেন ইবনে হাযম রহ.। (প্রাগুক্ত)
এ বড়ই আশ্চর্যের কথা। নড়াচড়ার সময় হাঁটু আগে যাবে কি করে? যারা বলেন, হাঁটুর পূর্বে হাত রাখবে তারা তো হাত মাটিতে রাখার পর হাঁটু হেলিয়ে থাকেন। সুতরাং সেটা আগে যাওয়ার সুরত কী? হাঁটু তো আর কাপড়ের আচল নয় যে, এমনিতেই নড়াচড়া করবে।
তাছাড়া শুধু ইবনে হাযমের উপর নির্ভর করলেন কেন? দারাকুতনী, হাকেম ও বায়হাকী প্রমুখকে একটু জিজ্ঞেস করুন, তারা হাদীসটির কি অর্থ বুঝেছেন এবং কোন বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ সেটি উদ্ধৃত করেছেন?