ইসহাক ইবনে রাহুয়ার মাযহাব
মারওয়াযী তাঁর উক্ত গ্রন্থে পরিষ্কার লিখেছেন,
قال إسحاق: ينهض على صدور قدميه ويعتمد بيديه على الأرض، فإن لم يقدر أن يعتمد على يديه وصدور قدميه جلس، ثم اعتمد على يديه وقام.(رقم ২২৬)
অর্থাৎ ইসহাক বলেছেন, উভয় হাত দ্বারা মাটিতে ভর দেবে, এবং পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যাবে। যদি মাটিতে ভর দিয়েও পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে বসে পড়বে, পরে হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (নং ২২৬)
আলবানী সাহেব যে মাঝে মধ্যে ভুল বরাত দেন এটি তার একটি প্রমাণ।
ইসহাক রহ. যে বৈঠক না করার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন, সে কথা শুধু মারওয়াযীই বলেন নি। ইবনুল মুনযির রহ. (মৃত্যু ৩১৮ হি.) তার আল আওসাত গ্রন্থে (৩/১১৫) ও ইমাম বাগাবী রহ. তাঁর শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থে (৩/১৬৫) একই কথা বলেছেন।
বড়ই আশ্চর্য লাগে, কোনরূপ তাহকীক ছাড়া আসাদুল্লাহ গালিব তার ছালাতুর রাসূল ছাঃ গ্রন্থে (পৃ. ১১৫) ও মুযাফফর বিন মুহসিন তার জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ ছাঃ এর ছালাত গ্রন্থে (পৃ. ২৭৩) আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত ইসহাক রহ.এর পূর্বোক্ত বক্তব্যটি উল্লেখ করে দিয়েছেন।
শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম রহ.এর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য :
আরবের প্রথম ও প্রধান মুফতী তৎসঙ্গে প্রধান বিচারপতি খ্যাতনামা আলেম শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম রহ. (মৃত্যু ১৩৮৯ হি.) এবং সেই সঙ্গে শায়খ সালিহ উছায়মীনের তথ্যপূর্ণ ও প্রমাণভিত্তিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই পর্যালোচনার ইতি টানছি। তাদের বক্তব্যে পাঠক মহোদয় অন্যান্য উপকারী কথার পাশাপাশি আলবানী সাহেবের সে প্রশ্ন ও আপত্তির জবাবও পেয়ে যাবেন, যা তিনি ইবনুল কায়্যিম রহ. এর বক্তব্য না বুঝেই তার উপর উত্থাপন করে বসেছেন। শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম লিখেছেন :
فإِن الجماعة من الصحابة الذين رووا صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم كأَبي حميد الذي كان أَوعى لهذا، وكذلك سائر الصحابة الذين رووا(৩) لم يذكروا هذه الجلسة. ولا يقال هنا أَنها من باب الزيادة التي انفرد بها الثقة، فإِن مثل هذا الشيء المتكرر في اليوم والليلة خمس مرات خمسة عشر عامًا لا يتصور أَن يحفظه واحد والبقية لا يحفظون. أَما لو كانت واقعة واحدة لتصور فيها. الحاصل أَنهم جماعة وعدد كثير لا يحفظون صلاة الرسول كل يوم خمس مرات ويحفظ الواحد!. هذا من البعيد جدًا أَو الممتنع.) فتاوى ورسائل محمد بن إبراهيم آل الشيخ، رقم: ৫৫৮)
অর্থাৎ বিরাট সংখ্যক সাহাবা যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বিশেষত আবু হুমায়দ রা. যিনি খুব বেশি তা মনে রেখেছেন, এছাড়া অন্যান্য সকল সাহাবী, যারা এতদবিষয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের কেউই এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন নি। এখানে একথা বলার সুযোগ নেই যে, এটা সেই বাড়তি অংশের মতো যা কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি এককভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কেননা এ ধরনের আমল, যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে পনের বছর পর্যন্ত বারবার ঘটতে থাকবে, তা শুধু একজন মনে রাখবেন আর বাকিরা কেউই মনে রাখবেন না, এটা কল্পনাও করা যায় না। হ্যাঁ, ঘটনা যদি শুধু একবার ঘটতো তবে এটা ভাবতে অসুবিধা হতো না। সারকথা, এত বিরাট সংখ্যক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের এ আমল মনে রাখবেন না, শুধু একজন মনে রাখবেন, এটা দুস্কর বা প্রায় অসম্ভব। (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল, শায়ক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়েখ, নামায অধ্যায়, নং ৫৫৮)
একইভাবে শায়খ মুহাম্মদ সালিহ উছায়মীন রহ. তার ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম গ্রন্থে (এটির বাংলা অনুবাদও প্রকাশ পেয়েছে) বলেছেন, এ মাসআলাটিতে বিদ্বানদের তিন ধরনের মত পাওয়া যায়। এক. উক্ত বৈঠক সর্বদাই মুস্তাহাব। দুই. কখনোই মুস্তাহাব নয়। তিন. উল্লিখিত দুটি মতের মাঝামাঝি মত। অর্থাৎ সরাসরি দাঁড়াতে যাদের কষ্ট হয় তারা বৈঠক করবে। আর যাদের কষ্ট না হয় তারা করবে না। মুগনী গ্রন্থকার (ইবনে কুদামা রহ.) এটিকে মধ্যপন্থী মত আখ্যা দিয়েছেন। আর মালেক ইবনুর হুওয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসটিকে রাসূল সা. এর বৃদ্ধকালীন আমল হিসাবে গণ্য করেছেন। শায়খ উছায়মীন বলেন,
وهذا القول هو الذي أميل إليه أخيراً وذلك لأن مالك بن الحويرث قدم على النبي صلى الله عليه وسلم وهو يتجهز في غزوة تبوك والنبي صلى الله عليه وسلم فى ذلك الوقت قد كبر وبدأ به الضعف،
অবশেষে আমি এমতটিই গ্রহণ করেছি। কেননা মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. এমন সময়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেছিলেন, যখন তিনি তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর এসময় তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এবং তার শারীরিক দুর্বলতাও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এরপর শায়খ এই শারীরিক দুর্বলতার কিছু প্রমাণ তুলে ধরে বলেন,
ويؤيد ذلك أن في حديث مالك بن الحويرث ذكر الاعتماد على الأرض، والاعتماد على الشيء إنما يكون عند الحاجة إليه
অর্থাৎ উক্ত দুর্বলতা এর দ্বারাও সমর্থিত হয় যে, মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসে মাটির উপর ভর করার উল্লেখ এসেছে। আর প্রয়োজনের মুহূর্তেই কেবল কোন কিছুর উপর ভর দেওয়া হয়ে থাকে। (নং ২৫৩)
উলামায়ে কেরামের এসব বক্তব্য সামনে রেখে আলবানী সাহেবের বক্তব্যগুলো একটু ভেবে দেখুন। সেই সঙ্গে তামামুল মিন্নাহ গ্রন্থে তার যে চূড়ান্ত বক্তব্য এসেছে সেটি আরো বেশি করে ভেবে দেখুন। তিনি বলেছেন,
وإذ الأمر كذلك فيجب الاهتمام بهذه الجلسة والمواظبة عليها رجالا ونساء وعدم الالتفات إلى من يدعي أنه صلى الله عليه وسلم فعلها لمرض أوسن لأن ذلك يعني أن الصحابة ما كانوا يفرقون بين ما يفعله صلى الله عليه وسلم تعبدا وما يفعله لحاجة وهذا باطل بداهة
অর্থাৎ বিষয়টি যখন এমন, তাই এই বৈঠকটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং সদা সর্বদা আমল করা অত্যাবশ্যক। চাই পুরুষ হোক বা নারী। সেই সঙ্গে যারা দাবি করেন যে, নবী সা. অসুস্থতা বা প্রয়োজনের তাগিদে এমনটি করেছিলেন, তাদের কথায় কর্ণপাত না করা চাই। কেননা এর অর্থ দাঁড়ায় সাহাবীগণ এ পার্থক্যটিও করতে পারতেন না যে, কোনটি তিনি ইবাদত হিসাবে করেছেন আর কোনটি প্রয়োজনের খাতিরে। আর একথা সুস্পষ্ট বাতিল। (দ্র. ১/২১২)
এ বাড়াবাড়িরই শিকার হয়েছেন আমাদের দেশের কিছু লোক। মুযাফফর বিন মুহসিন কৃত জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায গ্রন্থটিতে এ মাসআলাটিও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আমাদের উদ্ধৃত তিনটি দলিল উল্লেখ করা হয় নি। কিছু দুর্বল বর্ণনা এনে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এমনিভাবে মুরাদ বিন আমজাদ কৃত ‘প্রচলিত ভুল বনাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত আদায়ের পদ্ধতি’ গ্রন্থ ও আসাদুল্লাহ গালিব কৃত ‘ছালাতুর রাসূল (ছা.)’ গ্রন্থে একই পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে।