ইমাম আহমদের মাযহাব
ইমাম আহমদের মাযহাব ও আমল নিয়েও আলবানী সাহেব সত্য গোপন করেছেন। তিনি শুধু খাল্লালের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে দাবি করেছেন যে, ইমাম আহমদ ফিরে এসেছেন। খাল্লাল তো সরাসরি ইমাম আহমদের শিষ্য নন। আলবানী সাহেব এক্ষেত্রে ইমাম আহমদের শিষ্যবৃন্দ ও তার মাযহাবের সংকলকগণের বক্তব্য সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন।
ইমাম আহমদের সকল ছাত্র যারা তার মাসায়েল সংকলন করেছেন, যেমন, ইমাম আবু দাউদ, ইসহাক ইবনে মানসুর আলকাওসাজ, ইবনে হানী, আলআছরাম আবুবকর ও ইমাম আহমদের ছেলে আব্দুল্লাহ, তারা সকলেই তাঁর মত ও মাযহাব এটাই উল্লেখ করেছেন যে, এ বৈঠক করবে না। ইমাম আহমদের মাযহাবের সংকলকগণও তাই লিখে গেছেন। ইমাম আহমদ যদি এ মাসআলা থেকে ফিরে আসতেন তাহলে তার সরাসরি শিষ্যরা এবং তার মাযহাবের সংকলকরা তা কি জানতেন না?
ইমাম আবু দাউদ বলেন: سمعت أحمد يقول : ينهض على صدور القدمين لا يقعد অর্থাৎ আমি আহমদকে বলতে শুনেছি, পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, বসবে না। (১/৫৩) ইসহাক আলকাওসাজ বলেন, قال : وفي الركعة الأولى والثالثة ينهض على صدور قدميه অর্থাৎ ইমাম আহমদ বলেছেন, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতের পর পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (নং ২২৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বলেন,
قال أبي : واذهب انا الى حديث رفاعة …قال ابي بلغني ان حماد بن زيد كان يذهب الى حديث رفاعة والى ما روى عن عبد الله بن مسعود وغيره من اصحاب النبي صلى الله عليه وسلم انهم كانوا ينهضون على صدور اقدامهم اذهب الى هذا
আমার পিতা বলেছেন, আমার মত রিফাআর হাদীস অনুযায়ী। তিনি আরো বলেন, আমি শুনেছি, হাম্মাদ ইবনে যায়েদও উক্ত হাদীস এবং তৎসঙ্গে ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবী সম্পর্কে যে কথা বর্ণিত আছে যে, তাঁরা পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন, সে অনুযায়ী আমল করতেন। আমিও এ অনুযায়ী আমল করি। (১/৮২)
তিনি আরো বলেছেন, وكذا قال داود بن قيس وافق ابن عجلان ‘রিফাআর হাদীসটি শুধু মুহাম্মদ ইবনে আজলানই ইয়াহয়া ইবনে খাল্লাদের সূত্রে বর্ণনা করেন নি, বরং দাউদ ইবনে কায়সও একইভাবে এটি বর্ণনা করেছেন।’ (মাসায়েলে আহমদ লি আব্দুল্লাহ, ১/৮১)
ইসহাক আল কাওসাজ আল মারওয়াযী সংকলিত ‘মাসাইলে ইমাম আহমাদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থের টীকায় টীকাকার লিখেছেন:
نقل عنه نحوها عبد الله في مسائله ص৮২ (২৮৭، ২৮৮)، وابن هانئ في مسائله ১/৫৪ (২৫৯)، وأبو داود في مسائله ص৩৫. والصحيح من المذهب: موافق لهذه الرواية، حيث إن المصلي إذا قام من السجدة الثانية لا يجلس جلسة الاستراحة، بل يقوم على صدور قدميه معتمداً على ركبتيه إلا أن يشق عليه، فيعتمد بالأرض. قال ابن الزاغوني: هو المختار عن جماعة المشايخ. وروي عن أحمد: أنه يجلس جلسة الاستراحة، اختاره الخلال، وقال: إن أحمد رجع عن الأول، وقيل: يجلس جلسة الاستراحة من كان ضعيفاً، اختاره القاضي وابن قدامة وغيرهما الخ
অর্থাৎ ইমাম আহমদ থেকে অনুরূপ উল্লেখ করেছেন আব্দুল্লাহ (ইবনে আহমদ) তার মাসায়েলে (পৃ.৮২, নং ২৮৭,২৮৮), ইবনে হানী তার মাসায়েলে, (১/৫৪, নং ২৫৯) ও আবু দাউদ তার মাসায়েলে (পৃ.৩৫)। ইমাম আহমদের সহীহ মাযহাব এসব বর্ণনা অনুসারেই। অর্থাৎ মুসল্লী দ্বিতীয় সেজদা থেকে ওঠার পর বিশ্রামের বৈঠকটি করবে না, বরং উভয় পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এ সময় দুই হাতের ভর থাকবে হাঁটুর উপর। তবে যদি কষ্ট হয় তবে মাটিতে হাত রেখে ভর দিয়ে উঠবে। ইবনুয যাগুনী (আবুল হাসান আলী ইবনে উবায়দুল্লাহ আল বাগদাদী, মৃত্যু ৫২৭ হি.) বলেছেন, এ মাযহাবের মাশায়েখগণের নিকট এটাই পছন্দনীয় মত।
ইমাম আহমদ থেকে ঐ বৈঠকের পক্ষেও একটি বর্ণনা আছে, খাল্লাল সেটি গ্রহণ করেছেন, এবং বলেছেন, আহমদ এ মতের দিকেই ফিরে এসেছেন। ইমাম আহমদ থেকে আরেকটি বর্ণনা হলো দুর্বল ব্যক্তি এ বৈঠক করবে। আলকাযী ও ইবনে কুদামা এটিই অবলম্বন করেছেন। (২/৫৬৬)
আলবানী সাহেব তার ‘আসলু সিফাতিস সালাহ’ গ্রন্থে ইমাম আহমদের এসব সরাসরি শিষ্যের বর্ণনা উপেক্ষা করে লিখেছেন:
وعن أحمد نحوه في ” التحقيق ” (১/১১১) وهو الأحرى به لما عرف عنه من الحرص على اتباع السنة التي لا معارض لها . وقد قال ابن هانئ في ” مسائله عن الإمام أحمد ” (১/৫৭) : ” رأيت أبا عبد الله ربما يتوكأ على يديه إذا قام في الركعة الأخيرة ، وربما استوى جالساً ، ثم ينهض . وهو اختيار الإمام إسحاق بن راهويه ؛ فقد قال في “مسائل المروزي ” : ” مضت السنة من النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن يعتمد على يديه ويقوم ؛ شيخاً كان أو شاباً ” . واستحبه الإمام ابن حزم وهو الصواب لعدم ثبوت ما يعارض هذه السنة وكل ما جاء مما يخالفها لا يثبت ؛الخ
অর্থাৎ ইমাম আহমদ থেকে তাহকীক গ্রন্থে (১/১১১) অনুরূপ বর্ণিত আছে। তিনি এর অধিক উপযুক্তও বটেন। কেননা যে সব সুন্নাহর কোন বিপরীত বর্ণনা নেই, সেসব সুন্নাহর অনুসরণে তাঁর অতীব আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। ইবনে হানীও ইমাম আহমদ থেকে সংগৃহীত মাসাইলে উল্লেখ করেছেন যে, আমি আবু আব্দুল্লাহ (আহমদ) কে দেখেছি, কখনও কখনও তিনি শেষ রাকাতে উভয় হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। আবার কখনও কখনও সোজা বসে যেতেন। অতঃপর উঠতেন। (১/৫৭) ইসহাকও এটাই পছন্দ করেছেন। মারওয়াযী সংকলিত মাসাইলে তিনি বলেছেন, নবী সা. থেকে এ সুন্নাহই চলে আসছে যে, বৃদ্ধ যুবক সকলেই হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবে। ইবনে হাযমও এটিকে মুস্তাহাব মনে করতেন। আর এটাই সঠিক। কেননা এ সুন্নাহর বিপরীত কোন কিছু প্রমাণিত নেই। এর বিপরীত যা কিছুই এসেছে তার কোনটিই প্রমাণযোগ্য নয়। (৩/৮১৭, ৮১৮)
আলবানী সাহেব সিফাতু সালাতিন নবী স. (নবী সা. এর ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি) গ্রন্থেও ইসহাক রহ.এর অনুরূপ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। শেষে বলেছেন, দেখুন আল ইরওয়া, ২/৮২, ৮৩। অথচ সেখানে ইসহাক রহ.এর বক্তব্য নেই। (দ্র. নবী সা. এর ছলাত …, পৃ. ১৫৩)
আলবানী সাহেব এখানেও অনেক বিষয় গোপন করে গেছেন। ইমাম আহমদের মাযহাব প্রমাণ করার জন্য তিনি প্রথমত ইবনুল জাওযীর আত তাহকীক গ্রন্থের বরাত উল্লেখ করেছেন। অথচ তাহকীক গ্রন্থে বলা হয়েছে:
الْمُسْتَحبّ أَن ينْهض من السُّجُود عَلَى صُدُور قَدَمَيْهِ مُعْتَمدًا عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَعنهُ أَنه يجلس جلْسَة الإستراحة عَلَى قَدَمَيْهِ وأليتيه ) رقم ৫৯৭)
অর্থাৎ মুস্তাহাব হলো হাঁটুর উপর হাতের ভর রেখে পায়ের উপর ভর দিয়ে সেজদা থেকে উঠবে। ইমাম আহমদ থেকে একটি বর্ণনা এও আছে যে, উভয় পা ও নিতম্বের উপর বিশ্রামের জন্য বসে পড়বে। (আত তাহকীক, নং ৫৯৭)
লক্ষ করুন, তাহকীক গ্রন্থে ইবনুল জাওযী ইমাম আহমদের মূল মাযহাব হিসাবে বৈঠক না করার কথাই উল্লেখ করেছেন। আর বৈঠক করার পক্ষে ইমাম আহমদের একটি মত থাকার কথা বলেছেন। অথচ আলবানী সাহেব প্রথম ও মূল মতটির কথা সম্পূর্ণ গোপন করে গেছেন।
ইমাম আহমদের মাযহাব প্রমাণের জন্য তিনি দ্বিতীয়ত দাবি করেছেন যে, ‘বিরোধপূর্ণ নয় এমন সুন্নাহর অনুসরণের প্রতি তাঁর যে অতীব আগ্রহ লক্ষ করা গেছে সে হিসাবে এর উপর আমল করার তিনিই সর্বাধিক উপযুক্ত।’ এখানে আলবানী সাহেব মাযহাব বর্ণনার ক্ষেত্রে কেয়াস ও যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ইমাম আহমদের যারা সরাসরি শিষ্য ছিলেন এবং যারা তার মাসাইল সংকলন করেছেন তারা সকলেই তার মত এটাই উল্লেখ করেছেন যে, এ বৈঠকটি করবে না। পরবর্তীকালে হাম্বলী মাযহাবের বড় বড় মনীষীবৃন্দও এটাকেই তাঁর মাযহাব আখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং এখানে এদিক-সেদিকের কথা বলে কোন লাভ নেই।
তাছাড়া ইমাম আহমদ সম্পর্কে তাঁর উপরিউক্ত মন্তব্য অন্যান্য মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদাকে খাটো করে কি না তাও ভাববার বিষয়। ইমাম আহমদ থেকে বৈঠক না করার মতটি যখন অকাট্য ভাবে প্রমাণিত, আর আলবানী সাহেবের দাবি অনুযায়ী তিনি সুন্নাহর অনুসরণে অতীব আগ্রহী ছিলেন, তাহলে তো একথা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, মূল সুন্নাহ হলো বৈঠক না করা। অন্যথায় ইমাম আহমদ এটি অবলম্বন করতেন না।
এরপর আলবানী সাহেব ইবনে হানীর মাসাইল গ্রন্থের উদ্ধৃতি টেনেছেন। সেখানেও তিনি সত্য গোপন করেছেন। কারণ ইবনে হানীর যে বক্তব্য তিনি উল্লেখ করেছেন তার পূর্বেই ইবনে হানী লিখেছেন, ইমাম আহমদ বলেছেন,
لا ينهض على يديه إلا أن يكون شيخا كبيرا فينهض على يديه وينهض على صدور قدميه (رقم ২৫৯)
বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি ছাড়া কেউ হাতের উপর ভর দিয়ে উঠবে না। পায়ের উপর ভর দিয়েই উঠে দাঁড়াবে। (নং ২৫৯)
এরপর ২৬০ নম্বরে আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত অংশটুকু উল্লেখ করা হয়েছে। আলবানী সাহেব কেন ইমাম আহমদের উক্তিটি গোপন করে গেলেন তা বোধ করি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত অংশটুকুর সঙ্গে ইমাম আহমদের পূর্বের বক্তব্য ও ফতোয়ার মধ্যে কোন বৈপরিত্ব নেই। কারণ আহমদ রহ.তো বলেছেন, বয়োবৃদ্ধের জন্য এমন করার সুযোগ আছে। ইবনে হানী (জন্ম ২২৮ হি. মৃত্যু ২৭৫ হি.) ইমাম আহমদকে বার্ধক্য অবস্থাতেই পেয়েছিলেন। ইমাম আহমদ ২৪১ হি. সনে ইন্তেকাল করেছিলেন। তাই ইবনে হানী যদি কখনও কখনও তাকে এ বৈঠক করতে এবং হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে দেখে থাকেন তাতে তো বৈঠক না করার ব্যাপারে ইমাম আহমদের উল্লিখিত ফতোয়াটি আরো মজবুতভাবে প্রমাণিত হয়। কেননা বার্ধক্য বয়সেও তিনি সব সময় নয়, বরং মাঝেমধ্যে তাও আবার শেষ রাকাতে ওঠার সময় এ বৈঠক করতেন।
এরপর তিনি ইসহাক রহ. সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি এ মতটি অবলম্বন করেছেন। ‘এ মতটি’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন সেটা তিনিই জানেন। কিন্তু এর প্রমাণ হিসাবে তিনি মারওয়াযী সংকলিত মাসাইল এর উদ্ধৃতি টেনে যে কথাটি বলেছেন তাতে বৈঠক সম্পর্কে কোন কথা এমনকি ইশারা ইঙ্গিতও নেই। সেখানে শুধু হাতের উপর ভর দিয়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে। এমন তো হতে পারে, উক্ত উদ্ধৃতি অনুসারে তার মত হচ্ছে বৈঠক না করেই হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে পড়বে। অধিকন্তু উদ্ধৃত অংশটুকু আমরা বহু খোঁজাখুঁজি করেও মারওয়াযীর উক্ত গ্রন্থে পাই নি। পেয়েছি তার বিপরীত কথা।