بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ – وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ – يَا لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ – مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ – هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ – خُذُوهُ فَغُلُّوهُ – ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ – ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ – إِنَّهُ كَانَ لَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ – وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ – فَلَيْسَ لَهُ الْيَوْمَ هَاهُنَا حَمِيمٌ – وَلَا طَعَامٌ إِلَّا مِنْ غِسْلِينٍ – لَا يَأْكُلُهُ إِلَّا الْخَاطِئُونَ-
অনুবাদ: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) এবং ওই ব্যক্তি, যার আপন আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, ‘হায় কোন মতে আমাকে আমার আমলনামা না দেয়া হতো! এবং আমি না জানতাম যে, আমার হিসাব কি? হায়, আমার মৃত্যুই যদি (কিস্সার) শেষ হতো । আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসল না। আমার সমস্ত ক্ষমতা শেষ হয়ে গেল।’ (ফেরেশতাদের প্রতি নির্দেশ হবে) তাকে ধর। অতঃপর তার গলায় বেড়ি পড়িয়ে দাও। অতঃপর তাকে জ্বলন্ত আগুনে ধ্বসিয়ে দাও। অতঃপর এমন শিকলে, যার দৈর্ঘ্য সত্তর হাত, তাকে শৃঙ্খলিত করে দাও। নিশ্চয় সে মহান আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করত না। এবং মিসকিনকে খাদ্য দানের প্রতি উৎসাহ দিত না। সুতরাং আজ এখানে তার কোন বন্ধু নেই। এবং কোন খাদ্য নাই, ক্ষত-নিঃসৃত পূঁজ ব্যতীত। তা আহার করবে কেবল পাপীগণই। [২৫-৩৭ নং আয়াত, সূরা আল হাক্বক্বাহ]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِه الخِ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন- আয়াতে বর্ণিত অবস্থা কাফির-মুশরিকদেরই করুণ পরিণতি হবে। তাদের উভয় হাত পেছনের দিকে বন্দী অবস্থায় থাকবে আর বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে। এটা তাদের চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবার নিশ্চিত লক্ষণ। এর প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে চরম হতাশা ও হা-হুতাশ শুরু হবে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে এই বলে, ‘হায়! আমার যদি হিসাব-নিকাশের খবরই না থাকত! এমনি হিসাব জানার চেয়ে না জানাই উত্তম ছিল। আমার উপর যদি এমন স্থায়ী মৃত্যু এসে যেত, যার পরে জীবনই পাওয়া না যায়। তবে আমি এ লাঞ্চনা ও শাস্তি দেখতাম না।’ (সুবহানাল্লাহ)
আলোচ্য আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষই পাঠ করার যোগ্যতা অর্জন করবে। একারণে, প্রতিটি লোকই নিজের আমলনামা পাঠ করে মর্ম বুঝে ফেলবে। আর মৃত্যুবরণের পর প্রত্যেক মানুষের ভাষা হবে আরবি। তাই আমলনামা লিপিবদ্ধ হবে আরবিতে এবং তা পাঠ করে মর্মোদ্ধার করতে কষ্ট হবে না। এজন্য পরকালীন জীবনের প্রথম স্তর ‘কবর’ এর মধ্যে ‘মুনকার-নাকীরের’ সাওয়াল-জাওয়াব এবং আখিরাতের হিসাব-নিকাশ সবই আরবিতে হবে। আর জান্নাতীগণের ভাষা হবে আরবি। অতএব প্রতীয়মান হল আল্লাহর কুদরতের সালতানাতের সরকারী ভাষা হল আরবি। হাদীসে নববী শরীফে এরশাদ হয়েছে, عن ابن عباس رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم احبوا العرب لثلاث لانى عربى والقرأن عربى وكلام اهل الجنة عربى-(رواه البيهقى)
অর্থাৎ সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রসুলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা তিন কারণে আরব (এ আরবি ভাষা)কে ভালবাস। প্রথমত, আমি নবী আরবি ভাষাভাষি, দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এবং তৃতীয়ত, বেহেশতবাসীগণের ভাষা আরবি। [বায়হাকী শরীফ]
অতএব আরবি ভাষাকে কোন অজুহাতে মুমিনগণের উপেক্ষা করার সুযোগ নেই; বরং আরবি ভাষাকে ভালবাসা ও আরবি চর্চায় উদ্বুদ্ধ হওয়া ঈমানী চেতনায় উজ্জিবীত হওয়ার লক্ষণ। পক্ষান্তরে, বিদেশী ভাষা হিসাবে আখ্যায়িত করে আরবি চর্চায় অবজ্ঞা-অনাগ্রহ প্রদর্শন করা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের নমুনা।
مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ – هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ
উপরোক্ত আয়াত দু’টির ব্যাখ্যায় তাফসীরশাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন, প্রথমোক্ত আয়াতে উল্লেখিত আফসোস-আক্ষেপ ও অনুশোচনা কেয়ামতের ময়দানে কাফির বেদ্বীনরাই করবে। কেননা, তাদের সঞ্চিত সম্পদ কবরে-হাশরে কেয়ামতের দিনে তাদের জন্য কোনরূপ উপকার-সুফল বয়ে আনবে না। কারণ তারা আল্লাহ-রাসুল-আখেরাতের উপর ঈমান আনয়ন করে নি। তাই জাগতিক জনকল্যাণমূলক কাজে তাদের ব্যয় করা সম্পদ আর দুনিয়ায় রেখে যাওয়া সঞ্চয় তাদের নাজাতের জন্য কোন প্রকার সহায়ক হবে না। যেমন, অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّار
অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা কাফের, তাদের সম্পদ এবং সন্তানাদি আল্লাহর আযাব থেকে তাদেরকে কখনো কোনরূপ রক্ষা করতে পারবে না। তারাই জাহান্নামের ইন্ধন। [আলে ইমরান]
“সুরা লাহাবে এরশাদ হয়েছে, مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ অর্থাৎ অভিশপ্ত আবু লাহাব চিরতরে ধ্বংশ হল। তার সম্পদ এবং সারা জীবনের আয়-উপার্জন তাকে কোন প্রকারে রক্ষা করল না।
পক্ষান্তরে, মুমিনগণের সম্পদ দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে এবং নাজাতের বড় অবলম্বন হবে। জাগতিক জীবনে তাদের আদায়কৃত যাকাত-ফিতরা-কুরবানী এবং নফল সদক্বাহ-খায়রাত-দান-দক্ষিণা আর সন্তান-সন্ততিসহ ওয়ারিছগণের জন্য রেখে যাওয়া মিরাছ তাদের জান্নাত লাভের জন্য বড় ও কার্যকর অবলম্বন হবে। যেমন,কুরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে, الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ –
অর্থাৎ যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে রাতে ও দিনে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে (অর্থাৎ সর্বাবস্থায়) তাদের জন্য রয়েছে প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের নিকট এবং তাদের জন্য থাকবে না কোনরূপ ভয়-ভীতি আর তারা পেরেশানও হবে না। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا অর্থাৎ তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য সম্পদ ব্যয়সহ যে সব সৎকর্ম তোমরা আগে সম্পন্ন কর তা তোমরা প্রাপ্ত হবে আল্লাহর নিকট অধিকতর উত্তমরূপে এবং মহাপ্রতিদান হিসেবে। [সুরা মুয্যাম্মিল] উপরোক্ত আয়াত দু’টির মর্মালোকে প্রমাণিত হয়-মুমিনের সম্পদ উভয় জাহানে তাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে।
মুফাসসেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন, আরবি পরিভাষায় سلطان শব্দের অর্থ ক্ষমতা ও আধিপত্য। তাই রাষ্ট্রকে সালতানাত এবং রাষ্ট্রনায়ক কে সুলতান বলা হয়। মর্মার্থ এ যে, ‘দুনিয়াতে অন্যদের উপর আমার ক্ষমতা ও আধিপত্য ছিল। আমি সবার বড় একজন। আজ সেই রাজত্ব ও প্রাধান্য কোন কাজে আসল না।’ سلطان এর অপর অর্থ প্রমাণ-সনদও হতে পারে। তখন অর্থ হবে, ‘হায়! আজ আযাব হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমার হাতে কোন সনদ নেই। দুনিয়ার সকল প্রকার ক্ষমতা-কর্তৃত্ব আখেরাতে আল্লাহর দরবারে কোনরূপ উপকার বয়ে আনল না।’ কারণ, তারা আল্লাহ-রাসুল- আখেরাতের উপর ঈমান আনয়ন করে নি। তাই প্রমাণিত হল, ঈমানই দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে সকল প্রকার শান্তি,সমৃদ্ধি ও নাজাতের একমাত্র মূল ভিত্তি।
পরিশেষে, মহান আল্লাহর আলিশান দরবারে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সকল মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।