بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
الْحَاقَّةُ (১) مَا الْحَاقَّةُ (২) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحَاقَّةُ (৩) كَذَّبَتْ ثَمُودُ وَعَادٌ بِالْقَارِعَةِ (৪) فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ (৫) وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوا بِرِيحٍ صَرْصَرٍ عَاتِيَةٍ (৬) سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا فَتَرَى الْقَوْمَ فِيهَا صَرْعَى كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ (৭) فَهَلْ تَرَى لَهُمْ مِنْ بَاقِيَةٍ (৮) وَجَاءَ فِرْعَوْنُ وَمَنْ قَبْلَهُ وَالْمُؤْتَفِكَاتُ بِالْخَاطِئَةِ (৯) فَعَصَوْا رَسُولَ رَبِّهِمْ فَأَخَذَهُمْ أَخْذَةً رَابِيَةً (১০) إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ (১১) لِنَجْعَلَهَا لَكُمْ تَذْكِرَةً وَتَعِيَهَا أُذُنٌ وَاعِيَةٌ
অনুবাদ: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) তা সত্যই ঘটমান। (অর্থাৎ কেয়ামত) কেমনই তা ঘটমান এবং (ওহে রাসূল!) আপনি কি জেনেছেন তা কেমন সত্য ঘটমান। সামুদ ও আদ কঠোর কষ্টদায়ককে (অর্থাৎ কেয়ামত ) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে । অতঃপর সামুদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে সীমাতিক্রমকারী বিকট শব্দ দ্বারা। এবং আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে অতি বিকটভাবে গর্জনকারী প্রচৃ বায়ু দ্বারা। তা তাদের উপর সজোরে প্রবাহিত করেছিলেন সাত রাত আট দিন লাগাতার । অতঃপর ওইসব লোককে সেগুলোতে আপনি দেখবেন ভূপাতিত। যেন তারা খেজুর গাছের পতিত কান্ড। অতঃপর আপনি কি তাদের মধ্যে কাউকেও অবশিষ্ট দেখতে পাচ্ছেন? (অর্থাৎ না) এবং ফেরআউন ও তার পূর্ববর্তীরা এবং উল্টিয়ে দেয়া জনপদ বাসীরা গুরুতর অপরাধ সম্পন্ন করলো। অতএব তারা তাদের প্রতিপালকের (প্রেরিত) রাসূলকে অমান্য করলো। ফলে তিনি তাদেরকে কঠোর হস্তে পাকড়াও করলেন। নিশ্চয় যখন জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহন করিয়েছি। যাতে এ ঘটনা তোমাদের জন্য স্মরণীয় বিষয় এবং সংরক্ষণকারী কান যেন (উপদেশরূপে) সেটাকে সংরক্ষন করে।
[সূরা আল হাক্বক্বাহ, ১-১২ নম্বর আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
الْحَاقَّةُ – مَا الْحَاقَّة
উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন আল হাক্বক্বাহ বলে কেয়ামতকে বুঝানো হয়েছে। মহাপ্রলয় কেয়ামত হওয়ার সত্যতা, বাস্তবতা, নিশ্চয়তা এবং এর বিভীষিকাময় ও ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহকে কোরআনে কারীমের বিভিন্ন সূরায় বিভিন্ন আয়াতে অনেক নামে নামকরণ করত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা “তাগাবুন” এর নয় নম্বর আয়াতে কেয়ামত দিবসকে يوم الجمع তথা একত্রিত হওয়ার দিবস এবং يوم التغابن তথা লোকসানের দিবস নামে নামকরণ করা হয়েছে । يوم الجمع বা একত্রিত হওয়ার দিবস এ কারণে যে, সেদিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল জি¦ন এবং মানবকে হিসেব- নিকাশের জন্য একত্রিত করা হবে।
আর আরবি পরিভাষায় التغابن শব্দটি غبن মূল বর্ণ থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ লোকসান। আর্থিক লোকসান উভয়কে غبن বলা হয়। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মুফরাদাতুল কুরআনে বলেন আর্থিক লোকসান জ্ঞাপন করার জন্য এই শব্দটি রূপে ব্যবহৃত হয়। এবং মত ও বুদ্ধির লোকসান জ্ঞাপন করার জন্য باب سمع থেকে ব্যবহৃত হয়। التغابن শব্দটি আভিধানিক দিক দিয়ে দুই তরফা কাজের জন্য বলা হয় অর্থাৎ একজন অন্যজনের এবং অন্যজন তার লোকসান করবে অথবা তার লোকসান প্রকাশ করবে। সহীহ বুখারী শরীফের রেওয়ায়াতে রাসূলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন – যে ব্যক্তির কাছে কারও কোন পাওনা থাকে, তার উচিত দুনিয়াতেই তা পরিশোধ করা অথবা মাফ করিয়ে নিয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া নতুবা কেয়ামতের দিন দিনার-দিরহাম থাকবে না। কারো কোন দাবী থাকলে তা, সে ব্যক্তির সৎকর্ম দিয়ে পরিশোধ করা হবে। সৎকর্ম শেষ হয়ে গেলে পাওনাদারের পাপসমূহ প্রাপ্য পরিমাণ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (তাফসীরে মাযহারী শরীফ)।
মুফাস্সেরীন সরদার সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুমা ও অন্যান্য তাফসীর বিশারদ কেয়ামতকে লোকসানের দিবস বলার উপরোক্ত কারণই বর্ণনা করেছেন। আবার অনেকের মতে- সেদিন কেবল কাফের পাপাচারী ও হতভাগ্যরাই লোকসান অনুভব করবে না। বরং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণও এভাবে লোকসান অনুভব করবে যে, হায়! আমরা যদি আরো বেশি সৎকর্ম করতাম, তবে জান্নাতের সুউচ্চ মর্তবা লাভ করতাম। সেদিন প্রত্যেকেই জীবনে সেই সময়ের পরিতাপ করবে যা অযথা ব্যয় করেছে।
হাদীসে পাকে এরশাদ হয়েছে- من جلس مجلسا لم يذكر الله كان عليه حسرة يوم القيامة
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন মজলিসে বসে এবং সমগ্র মজলিসে আল্লাহকে স্মরণ না করে কেয়ামতের দিন সেই মজলিস তার জন্য পরিতাপের কারণ হবে।
তাফসীরে কুরতুবি শরীফে রয়েছে প্রত্যেক মু‘মিনও সেদিন সৎকর্মে ত্রুটির কারণে স্বীয় লোকসান অনুভব করবে। সূরা মারইাম শরীফে কেয়ামতের নাম يوم الحسرة তথা পরিতাপের দিবস নামে নামকরণ করা হয়েছে। তারই অনুরূপ সূরা তাগাবুনে يوم التغابن তথা লোকসানের দিবস বলে নামকরণ করা হয়েছে।
আলোচ্য সূরা আল হাক্বক্বাহ্ শরীফে কেয়ামত দিবসকে “আল হাক্বক্বাহ” ক্বারেয়াহ’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। حَاقَّةُ শব্দের এক অর্থ সত্য এবং দ্বিতীয় অর্থ অপরাপর বিষয়কে সত্য প্রতিপন্নকারী। কেয়ামতের জন্য এই শব্দটি উভয় অর্থে প্রযোজ্য হয়। কেননা, কেয়ামত নিজেও সত্য, এর বাস্তবতা প্রমাণিত ও নিশ্চিত এবং কেয়ামত মু‘মিনগণের জান্নাত আর কাফেরদের জন্য জাহান্নাম প্রতিপন্ন করে। এখানে কেয়ামতের এ নাম উল্লেখ করে বারবার প্রশ্ন করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কেয়ামত সকল প্রকার অনুমাণের উর্ধ্বে এবং বিস্ময়কররূপে ভয়াবহ।قارعة শব্দটির অর্থ খটখট শব্দকারী। কেয়ামত যেহেতু সব মানুষকে অস্থির ও ব্যাকুল করে দিবে এবং সমগ্র আকাশ পৃথিবীকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে তাই এ কেقارعة বলা হয়েছে। কেয়ামতের আরো অসংখ্য নাম রয়েছে। পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং হাদীসে নববী শরীফের রেওয়ায়াতে যা দ্বারা মহান আল্লাহ কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার সত্যতা, বাস্তবতা এবং এর ভয়ংকর বিষয়াবলী বিশ^বাসীর সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে উপস্থাপন করেছেন। এর উপর ঈমান আনায়ন করা ফরজ আর এসবের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা কিংবা কেয়ামতকে অস্বীকার করা কুফরি।
كَذَّبَتْ ثَمُودُ وَعَادٌ بِالْقَارِعَةِ-الخ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন পূর্ববর্তী অবাধ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে ছামূদ সম্প্রদায় অন্যতম। তাদের নিকট প্রেরিত আল্লাহর নবী সায়্যেদুনা হযরত ছালেহ আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলল-“এ পাহাড়ের বিশাল প্রস্তর খৃ থেকে আমাদের সম্মুখে আপনি যদি একটি জীবন্ত উষ্ট্রি বের করে দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা আপনাকে সত্য নবী বলে মানতে রাজী আছি। হযরত ছালেহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, তোমাদের চাহিদা মোতাবেক মু‘জেযা প্রদর্শনের পরেও তোমরা যদি ঈমান আনতে দ্বিধা প্রকাশ কর, তাহলে কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে তোমাদের উপর আযাব নেমে আসবে, তোমরা সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও তারা নিজেদের হঠকারিতা থেকে বিরত হল না। মহান আল্লাহ তাঁর অপরিসীম কুদরতে তাদের চাহিদা মোতাবেক মু‘জেযা প্রকাশ করলেন। বিশাল প্রস্তরখৃ বিদীর্ণ হয়ে তাদের কথিত গুণাবলী সম্পন্ন উষ্ট্রি আত্মপ্রকাশ করল। আল্লাহ তায়ালা হুকুম দিলেন যে, এ উষ্ট্রিকে কেউ যেন কোনরূপ কষ্ট-ক্লেশ না দেয়। যদি এরূপ করা হয় তবে তোমাদের প্রতি আযাব নাযিল হয়ে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করল, উষ্ট্রিকে হত্যা করল। তখন আল্লাহ তাদেরকে কঠোরভাবে পাকড়াও করলেন। হযরত ছালেহ আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গী মু‘মিনগণ নিরাপদে রক্ষা পেলেন। আর অন্যরা হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালামের ভয়াবহ ও বিকট গর্জনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে- فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ অর্থাৎ অতঃপর ছামুদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে সীমাতিক্রমকারী বিকট শব্দ দ্বারা। (সুবহানাল্লাহ)
আর উপরিউরক্ত আয়াতে উল্লেখিত দ্বিতীয় অবাধ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায় হলো আ‘দ। তাদের নিকট প্রেরিত আল্লাহর নবী সাইয়্যেদুনা হযরত হুদ আলাইহিস সালাম তাদেরকে ঈমানের দা‘ওয়াত দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করল। তিনি তাদেরকে সতর্ক করে বলেলন যে, পয়গাম পৌঁছানোর জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে, তা আমি তোমাদের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছায়েছি। অতএব তোমাদের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে যে, তোমাদের উপর আল্লাহর আযাব ও গযব নাযিল হবে। তোমরা সমূলে নিপাত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
কিন্তু হতভাগ্য আ‘দ সম্প্রদায় হযরত হুদ আলাইহিস সালামের কোন কথায় কর্ণপাত করল না। তারা নিজেদের হঠকারিতা ও অবাধ্যতার উপর অবিচল রইল। অবশেষে প্রচৃ ঝড়-তুফানরূপে আল্লাহর আযাব নেমে এল। সাতদিন আট রাত অবধি ঝড়-তুফান বইতে লাগল। বাড়ি-ঘর ধ্বসে গেল, গাছ-পালা উপড়ে গেল, গৃহ ছাদ উড়ে গেল, মানুষ ও জীবজন্তু সকলে শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে নিক্ষিপ্ত হল। এভাবে দীর্ঘাকার ও সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী শক্তিশালী আদ সম্প্রদায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর মহান আল্লাহ তাঁর চিরন্তন বিধান অনুযায়ী হযরত হুদ আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গী মু‘মিনগণকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নিরাপদে রক্ষা করলেন।
উপরিউক্ত বর্ণনালোকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের শানে অমাননা-অবাধ্যতা প্রদর্শন-ই আ‘দ-ছামুদসহ সকল পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়সমূহের ধ্বংস হওয়ার একমাত্র কারণ।
মহান আল্লাহর এ পরম সত্যকে অনুধাবন করে সকলকে আমল করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।