আরশ আল্লাহর বাসস্থান নয়; বাসস্থানের কথা অমুসলিমেরা বলে। আল্লাহুস সামাদ, তিনি বাসস্থান থেকে অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির উপর ক্ষমতাবান।
পবিত্র কুরআন বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআনের পরতে পরতে রয়েছে আরবী অলংকার শাস্ত্রের উচ্চাঙ্গিক প্রয়োগ। আল-কুরআনের মতো এতো উচ্চাঙ্গিক ও ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ কিতাব পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জ্ঞান, দীর্ঘ অনুশীলন ও প্রায় সতেরটি বিষয়ের উপর ব্যাপক দক্ষতা।
পৃথিবীতে ইসলামের শুরু থেকে কিছু বড় বড় আলেম কুরআনের বুঝ অর্জনের পিছে তাদের জীবন ব্যয় করেছেন। কুরআনের তাফসীর লিখেছেন, কুরআন থেকে সংকলিত মাসআলার গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, কুরআনের শব্দের অভিধান রচনা করেছেন, কুরআনের গ্রাম্যাটিকাল প্রয়োগের চুল-চেরা বিশ্লেষণ করেছেন, কুরআন অবতীর্ণের পেক্ষাপট বা শানে নুজুল আলোচনা করেছেন এবং কুরআনের অলংকার শাস্ত্রের উপর বিস্তর কিতাব লিখেছেন। যারা কুরআনের উপর এই অসামান্য খেদমতের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে ঋণী করেছেন, তাদেরকে আমরা মুফাসসির বা কুরআনের ব্যাখ্যাকার হিসেবে জানি। পবিত্র কুরআনের প্রকৃত বুঝ অর্জনে আমরা মুফাসসিরগণের শরণাপন্ন হয়ে থাকি। মুফাসসিরগণের পাশাপাশি আরবী অভিধান প্রণেতা ও ভাষাবিদগণের বক্তব্য কুরআন বুঝতে সহায়ক।
আরবী ভাষার উচ্চাঙ্গিক প্রয়োগ বুঝতে অবশ্যই আরবী অভিধান ও ভাষাবিদদের বক্তব্য আমাদেরকে সামনে রাখতে হবে। ইসলামী আকিদার ক্ষেত্রে মুজাসসিমা (যারা আল্লাহ তায়ালা দেহ ও অঙ্গা-প্রতঙ্গ সাব্যস্ত করে) ও মুয়াত্তিলা (যারা আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করে) আবির্ভাব ছিলো একটি ভয়ংকর অধ্যায়। তাবেয়ীনগণের যুগেই এই ফেতনা দু’টির আবির্ভাব ও প্রসার হয়েছিলো। সালাফে-সালেহীনের যুগেই আকিদার অঙ্গনে ভয়ংকর ফেতনা দু’টি জেকে বসেছিলো।
ইমাম আবু হানিফা রহ. এ সম্পর্কে বলেন,
“أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه
অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে।
যথা-
১. জাহাম ইবনে সাফওয়ানের মতবাদ যে ছিলো মুয়াত্তিলা (আল্লাহর গুণ অস্বীকারকারী )।
২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতবাদ যে ছিলো মুশাববিহা (আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য প্রদানকারী)।
[তারীখে বাগদাদ, খ., ১৩, পৃ., ১৬৪]
বর্তমান সময়ের সালাফী ও আহলে হাদীসরা মূলত: পূর্ববর্তী ভ্রান্ত মতবাদ মুজাসসিমা ও কাররামিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস লালন করছে। পূর্ববর্তী বাতিল আকিদাগুলোকে নুতন নামে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সালাফী আকিদা নতুন কোন আকিদা নয়। এটি মুশাববিহা ও কাররামিয়াদের মতবাদই অনুলিপি। অনেক ক্ষেত্রে এরা কাররামিয়াদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে।
কাররামিয়াদের দু’টি বাতিল আকিদা হলোঃ
১. তারা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট দিক সাব্যস্ত করে অর্থাৎ তাদের মতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপরের দিক বা মাথার দিকে রয়েছেন। একে তারা উলু বলে থাকে।
২. আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন। তাদের কেউ কেউ বলে আল্লাহ তায়ালা আরশে এমনভাবে বসেছেন যে, আরশের চার আঙ্গুল পরিমাণ খালি রয়েছে। এই চার আঙ্গুল পরিমাণ খালি জায়গায় আল্লাহ তায়ালা নিজের পাশে রাসূল স. কে বসাবেন।
মুজাসসিমারা তাদের এই বাতিল আকিদা দু’টি প্রমানের জন্য কিছু দুর্বল ও জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়েছে। সেই সাথে কুরআনের কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে।
পবিত্র কুরআনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকে। সাধারণ মানুষকে বলে যে, কুরআনে এটা আছে। অথচ সে কুরআনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।
আজকের আলোচনায় আমরা সালাফীদের একটি বহুল প্রচলিত দলিল সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সালাফীদের ব্যাপক অপব্যাখ্যার শিকার পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত শব্দ ‘ইস্তেওয়া’ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
অর্থাৎঃ “দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন”।
এই আয়াত ব্যবহার করে বাতিল আকিদার কিছু লোক বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন নাউযুবিল্লাহ। এধরনের বাতিল বক্তব্যের সাথে এই আয়াতের কোন দূরতমত সম্পর্ক নেই। যারা এধরনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে মানুষের আকিদা নষ্ট করার চেষ্টা করছেে তাদের ব্যপারে সচেতন হওয়া আবশ্যক।
ইস্তেওয়া সম্পর্কে সাধারণ কিছু কথাঃ
০১. আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। ইস্তেওয়ার সাথে অব্যয় পদ (ইলা, আলা) ইত্যাদির ব্যবহারের পার্থক্যের সাথে সাথে অর্থের পরিবর্তন হয়।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, “ইস্তেওয়া আলা”- এর অর্থ বিশ্লেষণ করা।
০২. পবিত্র কুরআনের বিখ্যাত তাফসীরসমূহে “ইস্তেওয়া আলা”- এর দু’টি অর্থ করা হয়েছে।
যথা-
১- কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
২- মর্যাদাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ হলো, পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
০৩. আমার ক্ষুদ্র তাহকীক অনুযায়ী, পৃথিবী বিখ্যাত কোন তাফসীরে পবিত্র কুরআনের সূরা ত্ব-হা বা অন্য আয়াতের ইস্তেওয়ার অর্থ বসা, সমাসীন হওয়া, অধিষ্ঠিত হওয়া, অধিষ্ঠান গ্রহণ করা ইত্যাদি অর্থ করা হয়নি।
আরবী ভাষায় সমাসীন হওয়া বা বসার আরবী হলো, জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد)।
বিখ্যাত কোন তাফসীরে ইস্তেওয়ার এই বসার অর্থ করা হয়নি।
০৪. আমরা এখানে ধারাবাহিকভাবে বিখ্যাত মুফাসসিরদের বক্তব্য উল্লেখ করবো যারা তাদের তাফসীরসমূহে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
০৫. ইস্তেওয়ার একটি ভ্রান্ত ও বাতিল অর্থ হলো, বসা বা সমাসীন হওয়া। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এ ধরনের বাতিল বিশ্বাস ইমানের জন্য ভয়ংকর।
আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া অবশ্যই কুফুরী।
সুতরাং এ ধরনের ইমান বিধ্বংসী বিশ্বাস থেকে দূরে থাকতে হবে। কুরআনের কোন বাংলা অনুবাদক ভুল করে বা না জেনে এধরনের অর্থ করে থাকতে পারেন। তবে কেউ যদি ইচ্ছা করে এধরনের বাতিল বিশ্বাস রাখে তবে সে অবশ্যই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে ভ্রান্ত ফেরকা মুজাসসিমাদের অন্তুর্ভূক্ত হবে।
০৬. আরবী ভাষার প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ব্যবহারে সমাসীন বা বসার অর্থে কখনও ইস্তেওয়া ব্যবহৃত হয় না। বরং এর জন্য জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد) ব্যবহৃত হয়। আরবী অভিধান অনুযায়ী ইস্তেওয়ার অর্থ বসা করাটাও অপ্রচলিত ও অপ্রসিদ্ধ ব্যবহার গ্রহণ করা হয়। অধিকাংশ অভিধানবিদ তাদের অভিধানে ইস্তেওয়ার এই অপ্রচলিত অর্থটি লেখেননি।
০৭. সালাফে-সালেহীনের কারও থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় ইস্তেওয়ার অর্থ বসা বা সমাসীন হওয়া পাওয়া যায় না। মূলত: ইস্তেওয়ার এই অর্থটি মুজাসসিমা ও কাররামিয়াদের সৃষ্টি।
০৮. সালাফীদের বিখ্যাত ফতোয়ার সাইট ইসলাম ওয়েব এ বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা এর উত্তরে লিখেছেন,
وأما تفسيره بالجلوس فليس مشهورا ولا معروفا عنهم
অর্থাৎঃ “সালাফে-সালেহীন থেকে প্রসিদ্ধ বা পরিচিত কোন বর্ণনায় ইস্তেওয়ার শব্দটি বসা বা সমাসীন হওয়ার অর্থে পাওয়া যায় না।”
ফতোয়ার লিংক:
http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=172147
বিখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে ইস্তেওয়ার অর্থঃ
তাফসীর ↠ ১.
আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:] এর তাফসীর:
বিখ্যাত ভাষাবিদ ও আরবী ব্যাকরণবিদ আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:] তাঁর “গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু” -তে লিখেছেন,
: الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] استوى: استولى” اهـ}
অর্থাৎঃ “সূরা ত্ব-হা এর পাঁচ নং আয়াত: দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। “ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, ইস্তাওলা তথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা”
[সূত্রঃ গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু, পৃষ্ঠা ২৪৩, আলামুল কুতুব।]
তাফসীর ↠ ২.
ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. [মৃত: ৩১০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. তাঁর বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “জামিউল বয়ান” এ ইস্তেওয়া শব্দের বিশ্লেষণ করেছেন। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের বিভিন্ন ব্যাবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এঁর বক্তব্য অনুযায়ী আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার এর অনুগামী অব্যয়ের কারণে এর অর্থের পবির্তন হয়।
ইস্তেওয়ার অনুগামী অব্যয় পদ যখন “ইলা” (إلي) হয়, তখন তিনি এর অর্থ গ্রহণ করেছেন সমুন্নত হওয়া বা উঁচু হওয়া। তিনি স্পষ্টভাষায় লিখেছেন, সমুন্নত হওয়া দ্বারা স্থান বা অবস্থানগত সমুন্নত বা উচু হওয়া উদ্দেশ্য নয়। বরং সমুন্নত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য মর্য়াদা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে সমুন্নত হওয়া।
এ বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম ত্ববারী রহ, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। তিনি উচু বা সমুন্নত হওয়ার দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে, তিনি স্থানগত দিক থেকে উচু বা সমুন্নত হয়েছেন। বরং আল্লাহর সমুন্নত হওযার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মর্যাদাগত সমুন্নত হওয়া।
ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
علا عليها علو ملك وسلطان لا علو انتقال وزوال.اهـ “
অর্থাৎঃ তিনি নিজের কর্তৃত্ব, মালিকানা ও ক্ষমতার দিক থেকে আসমান সমূহের উপর সমুন্নত হয়েছেন। সমুন্নত হওয়া হওয়া দ্বার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া কিংবা এক জায়গা থেকে সরে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়।”
[সূত্রঃ তাফসীরে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৪২৯-৪৩০, তাহকীক, আহমাদ শাকের]
মূল বইয়ের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/TafsirTabariShakir
এছাড়াও ইমাম ত্ববারী রহ. স্পষ্টভাষায় তার তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় আল্লাহ তায়ালাকে ‘দিক’ থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন।
ইমাম ত্ববারী রহ. তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় বলেন,
” لاتحيط به الأوهام ولا تحويه الأقطار و لا تدركه الأبصار “
অর্থাৎঃ “কারও ধ্যান-ধারণা আল্লাহকে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না, কোন দিক আল্লাহকে বেষ্টন করে না, কোন চোখ তাকে অবলোকন করতে পারে না।”
[তারীখে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৩, তাহকীক, মুহাম্মাদ আবুল ফজল ইব্রাহিম]
মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=8541
সুতরাং ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এঁর নিকট আল্লাহ তায়ালা বান্দার ধারণা থেকে উর্ধ্বে।
মানুষ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যেসব কল্পনা করে তিনি তা থেকে পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত দিক থেকে পবিত্র। কোন দিকেই আল্লাহ তায়ালা অবস্থান করেন না। কোন দিকই আল্লাহ তায়ালাকে পরিবেষ্টন করে না। তিনি স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। দুনিয়াতে চর্মচোখে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা অসম্ভব।
তাফসীর ↠ ৩.
ইমাম আবু ইসহাক ঝুজাজ রহ.[মৃত: ৩১১] এর তাফসীর:
ইমাম ঝুজায রহ. আরবী ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ও ভাষাবিদ। ইমাম যাহাবী [মৃত ৭৪৮ হি:] তাঁর সম্পর্কে বলেন,
“তিনি তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ছিলেন”।
[সূত্রঃ সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১৪, পৃ.৩৬০।]
ইমাম ঝুজায রহ. তাঁর “মায়ানিল কুরআন ও ই’রাবুহু” নামক কিতাবে লিখেছেন,
وقالوا: معنى استوى استولى اهـ
অর্থাৎঃ “ইস্তেওয়ার অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা”।
[সূত্রঃ মায়ানিল কুরআন ও ই’রাবুহু, খ., ৩, পৃ., ৩৫০, তাহকীক, ড. আব্দুল জলীল আব্দুহ্।]
মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1404
তাফসীর ↠ ৪.
ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি হানাফী রহ. [মৃত:৩৩৩ হি] এর বক্তব্য:
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিখ্যাত ইমাম ও যুগশ্রেষ্ঠ আকিদাবিশারদ ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী তার যুগশ্রেষ্ঠ তাফসীর “তা’বীলাতু আহলিস সুন্নাহ” নামক কিতাবে লিখেছেন, ইস্তেওয়ার একটি অর্থ হলো কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইস্তেওয়ার আরো দু’টি অর্থ লিখেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতা ও মর্যাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। আরেকটি অর্থ হলো, আরশের মাধ্যমে সৃষ্টিকে পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
[সূত্রঃ তা’বীলাতু আহলিস সুন্নাহ, খ.৭ পৃ.২৬৭, তাহকীক, ড.মাজদী বাছলুম।]
মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/Tafsirmaturidi
তাফসীর ↠ ৫.
হযরত আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক আয-ঝুযাযী রহ. [মৃত:৩৪০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক রহ. বিখ্যাত একজন আরবী ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন। ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন,
“شيخ العربية وتلميذ العلامة أبي إسحاق إبراهيم بن السري الزجاج، وهو منسوب إليه”اهـ
অর্থাৎঃ ” ইমাম আবুল কাসেম আরবী ভাষার শায়খ ছিলেন এবং তিনি ইমাম ঝুযাযের বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন।”।
[সূত্রঃ সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১৫, পৃ.৪৭৫।]
ইমাম আবুল কাসেম ঝুযাযী রহ. তাঁর “ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ”-তে লিখেছেন,
“আল্লাহর দু’টি গুণগত নাম হলো আলী (علي) ও আ’লী (عالي)। এর অর্থ হলো, কোন কিছুর উপর ক্ষমতাধর বা কর্তৃত্ববান। আরবরা বলে থাকে, علا فلان فلانا অর্থাৎ অমুক অন্যের উপর কর্তৃত্ববান বা ক্ষমতাশীল হয়েছে। যেমন কবি বলেছেন,
فلما عَلَونا واستوينا عليهم ** تركناهم صرعى لنسر وكاسرِ
অর্থাৎঃ “আমরা যখন তাদের উপর ক্ষমতাশালী হলাম এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলাম, আমরা তাদের মৃতদেহ গুলোকে শকুন ও বাজপাখীর জন্য রেখে দিলাম”।
[সূত্রঃ ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ, আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক ঝুযাজী রহ., পৃ.১০৯, তাহকীক, আব্দু রব্বিল হুসাইন মোবারক।]
মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1862
তাফসীর ↠ ৬.
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ত্ববরানী (মৃত:৩৬০ হি:) তার তাফসীরে কাবীরে বলেন,
والاستواء: الاستيلاء، ولم يـزل الله سبحانه مستوليا على الأشياء كلها، إلا أن تخصيص العرش لتعظيم شأنه
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ, ইস্তিলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা সদা-সর্বদা সমস্ত বস্তুর উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তবে এখানে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আরশের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে।
[সূত্রঃ আত-তাফসীরুল কাবীর, ইমাম ত্ববরানী, খ., ৩, পৃ., ৩৭২।]
তাফসীর ↠ ৭.
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. [মৃত:৩৭০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর জাসসাস তার বিখ্যাত কিতাব আহকামুল কুরআনে লিখেছেন,
“: قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] قال الحسن: استوى بلطفه وتدبيره، وقيل: استولى.اه
অর্থাৎঃ মহান আল্লাহর বাণী: দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং৫)। ইমাম হাসান বলেন, তিনি নিজের দয়া, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণতা দান করেছেন। এবং কারও মতে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[সূত্রঃ আহকামুল কুরআন, খ.৩, পৃ.৩২৫।]
তাফসীর ↠ ৮.
ইমাম আবুল লায়স সামরকন্দী রহ্ (মৃত:৩৭৫ হি:) এঁর তাফসীর:
ইমাম আবুল লায়স বলেন,
ويقال استوى استولى
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ বলা হয়, ইস্তাওলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[সূত্রঃ তাফসীরে সমরকন্দী বা বাহরুল উলুম, খ.২, পৃ.৩৭৬।]
তাফসীর ↠ ৯.
ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক [মৃত:৪০৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক তার মুশকিলুল হাদীস কিতাবে বলেন,
لأن استواءه على العرش سبحانه ليس على معنى التمكن والاستقرار، بل هو على معنى العلو بالقهر والتدبير وارتفاع الدرجة بالصفة، على الوجه الذي يقتضي مباينة الخلق. اهـ
অর্থাৎঃ আরশের উপর আল্লাহর ইস্তেওয়া দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে তিনি আরশের উপর অবস্থান করেন বা আরশের উপর স্থির হয়েছেন। বরং কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দ্বারা সমুন্নত হওয়া এবং গুণগত মর্যাদা উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক ও ভিন্ন।
[সূত্রঃ মুশকিলুল হাদীস, পৃ., ২২৯।]
তাফসীর ↠ ১০.
ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪২১] এঁর বক্তব্য:
ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. বলেন,
إن كثيرا من متأخري أصحابنا ذهبوا إلى أن الاستواء هو القهر والغلبة
অর্থাৎঃ আমাদের পরবর্তী অনেক আলেম এমত গ্রহণ করেছেন যে, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও প্রতাপ।
[সূত্রঃ আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ., ৩৭২।]
তাফসীর ↠ ১১.
ইমাম আবু মুহাম্মাদ জুয়াইনী (মৃত: ৪৩৮ হি:) এঁর বক্তব্য:
ইমাম জুয়াইনী রহ. বলেন,
“ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ পূর্ণক্ষমতা দ্বারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেষ্টণ করা। এর দ্বারা কখনও আল্লাহর স্থান, দিক, অবস্থানের জায়গা কিংবা সীমা উদ্দশ্যে নয়।”
[সূত্রঃ ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১১০]
তাফসীর ↠ ১২.
ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. [মৃত: ৪৫০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. বলেন,
{ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ } [سورة الأعراف: 54]: فيه قولان: …والثاني: استولى على العرش كما قال الشاعر :
قد استوى بِشْرٌ على العِراقِ ** من غير سَيفٍ ودمٍ مُهراقِ”اهــ
অর্থাৎঃ পবিত্র কুরআনের বাণী: অত:পর আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। [সূরা আ’রাফ, ৫৪]। ইমাম মাওযারদী বলেন, ইস্তেওয়া শব্দের দু’টি অর্থ রয়েছে। …। দ্বিতীয় অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন কবি বলেছেন,
বিশর ইরাকের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন তরবারী চালনা কিংবা রক্তপাত ব্যতীতই।
[সূত্রঃ আন-নুকাতু ওয়াল উয়ূন, খ.২, পৃ.২২৯।]
তাফসীর ↠ ১৩.
ইমাম আবু বকর বাইহাকী রহ. [মৃত: ৪৫৮ হি:] এর বক্তব্য:
ইমাম বাইহাকী রহ. বলেন,
أن الاستواء هو القهر والغلبة، ومعناه أن الرحمن غلب العرش وقهره، وفائدته الإخبار عن قهره مملوكاته، وأنها لم تقهره، وإنما خص العرش بالذكر لأنه أعظم المملوكات، فنبه بالأعلى على الأدنى، قال: والاستواء بمعنى القهر والغلبة شائع في اللغة، كما يقال استوى فلان على الناحية إذا غلب أهلها، وقال الشاعر في بشر بن مروان: قد استوى بشر على العراق * * من غير سيف ودم مهراق. اهـ يريد أنه غلب أهله من غير محاربة
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বজায় রাখা। এর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একে নিজের ক্ণমতার অধীন করেছেন। আয়াতে বিষয়টি উল্লেখের বিশেষ ফায়দা হলো, আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে জানিয়েছেন, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর ক্ণমতার অধীন। এবং তিনি কারও অধীন নন। আর এক্ণেত্রে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। সুতরাং তিনি সবচেয়ে বড় সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সমস্ত ছোট সৃষ্টিও আল্লাহর ক্ণমতা ও কর্তৃত্বের অধীন। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অর্থে ইস্তেওয়া শব্দটির ব্যবহার আরবী ভাষায় ব্যাপক পরিচিত। যেমন বলা হয়, , অমুক উক্ত অন্চলের উপর ইস্তেওয়া করেছে বা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশর ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে কবি বলেন, বিশর ইরাকের উপর নিজের ক্ণমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন রক্তপাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই। এখানে কবি
উদ্দেশ্য নিয়েছেন, কোন যুদ্ধ ছাড়া বিশর ইরাকের মানুষের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[সূত্রঃ আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ., ৪১২।]
তাফসীর ↠ ১৪.
ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪৬৮ হি:] এঁর তাফসীর:
ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. তাঁর আল-ওজীয নামক তাফসীরে লিখেছেন,
{ اسْتَوَى } أي استولى.اهـ
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তাফসীর ↠ ১৫.
ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. [মৃত: ৪৭৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. বলেন,
الاستواء بمعنى الاستيلاء، استوى على العرش أي استولى عليه، يقال استوى فلان على الملك أي استولى عليه
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইস্তাওয়া আলাল আরশ এর অর্থ হলো, আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরবী ভাষায় বলা হয়, অমুক ব্যক্তি দেশে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[সূত্রঃ আল-ওয়াজীয, খ., ২, পৃ., ১৫।]
তাফসীর ↠ ১৬.
ইমাম হুসাইন ইবনে আহমাদ আদ-দামিগানী হানাফী রহ.[মৃত:৪৭৮ হি:] এঁর তাফসীর:
ইমাম দামিগানী রহ. তাঁর ইসলাহুল উজুহ কিতাবে লিখেছেন,
الاستواء بمعنى القهر والقدرة، قوله تعالى في سورة طه: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى }، أي قدر وقهر. اهـ
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও কুদরত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহায় বলেন, “দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ এখানে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, ক্ষমতা ও কুদরত প্রকাশ করা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[সূত্রঃ ইসলাহুল উজুহ, পৃ., ২৫৫।]
তাফসীর ↠ ১৭.
ইমাম আবুল মায়ালী জুয়াইনী রহ. [মৃত: ৪৭৮ হি:] এর বক্তব্য:
ইমাম জুয়াইনী রহ. তার আল-ইরশাদ কিতাবে লিখেছেন,
فإن استدلوا بظاهر قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5]، فالوجه معارضتهم بآي يساعدوننا على تأويلها، منها قوله تعالى: {وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ} [سورة الحديد: 4] وقوله تعالى: {
أَفَمَنْ هُوَ قَآئِمٌ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ} [سورة الرعد: 33] فنسائلهم عن معنى ذلك، فإن حملوه على كونه معنا بالإحاطة والعلم، لم يمتنع منا حمل الاستواء على القهر والغلبة، وذلك شائع في اللغة، إذ العرب تقول استوى فلان على الممالك إذا احتوى على مقاليد الملك واستعلى على الرقاب. وفائدة تخصيص العرش بالذكر أنه اعظم المخلوقات في ظن البرية، فنص عليه تنبيها بذكره على ما دونه. … ثم الاستواء بمعنى الاستقرار بالذات ينبئ عن اضطراب واعوجاج سابق، والتزام ذلك كفر.”اهــ
অর্থাৎঃ যদি মুজাসসিমারা সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিপরীতে সেসব আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো এই আয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তারা এগুলোর ব্যাখ্যা করতে বাধ্য। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যেখানেই থাকো আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন। [সূরা হাদীদ, আযাত নং ৪]। আল্লাহ তায়ালা সূরা রাযাদ এর ৩৩ নং আয়াতে বলেন, তাদের কর্মসমূহ পর্যবেক্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা কি প্রত্যেক নফস বা আত্মার উপর দন্ডায়মান নন? আমরা তাদেরকে এসব আয়াতের অর্থ জিজ্ঞাসা করবো। তারা যদি এসব আয়াত দ্বারা রুপক অর্থ নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা ইলম ও পরিবেষ্টন দ্বারা আমাদের সাথে রয়েছেন, তাহলে আমরাও বলবো, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা বা অধীন করা। আরবী ভাষায় এর ব্যবহার রয়েছে। কেননা আরবরা বলে থাকে, استوى فلان على الممالك অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি দেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জনগণকে নিজের অধীন করেছে।
আল্লাহ তায়ালা আরশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, সৃষ্টির মধ্যে আরশ সবচেযে বড় (Biggest of all the creations)। এটি উল্লেখ করে তিনি বুঝিয়েছেন, অন্যান্য ছোট সৃষ্টিও তার ক্ষমতার অধীন। ….. ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ যদি করা হয়, আল্লাহর সত্ত্বা স্থির (Stable) হয়েছেন বা স্থান গ্রহণ (Taking place) করেছেন, তাহলে এটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে অস্থির (Unstable) বা গতিশীল (Moving) ছিলেন। আর এধরনের অর্থ সুস্পষ্ট কুফুরী।
তাফসীর ↠ ১৮.
বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল হাসান আলী ইবনে ফাজ্জাল আল-মুজাশায়ী [মৃত: ৪৭৯ হি:] তাঁর আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীমে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[সূত্রঃ আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ., ১৭৪-১৭৫।]
তাফসীর ↠ ১৯.
জগৎ বিখ্যাত আরবী ভাষাবিদ ইমাম রাগেব ইসপাহানী [মৃত: ৫০২ হি:] তাঁর “আল-মুফরাদাত” নামক কিতাবে লিখেছেন,
“ومتى عدّي- أي الاستواء – بـ “على” اقتضى معنى الاستيلاء كقوله: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه]”اهــ
অর্থাৎঃ ইস্তেওয়া শব্দটি যখন ‘আলা’ অব্যয় সহ ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ” দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। [সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং-৫]
[সূত্রঃ আল-মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃ., ২৫১।]
তাফসীর ↠ ২০. ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ আল-মুতাওয়াল্লী [মৃত: ৪৭৮ হি:] তার আল-গুনইয়া নামক কিতাবে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[সূত্রঃ আল-গুনিয়া ফি উসুলিদ্দীন, পৃ., ৭৮।]
তাফসীর ↠ ২১.
ইমাম গাজালী রহ. [মৃত: ৫০৫ হি:] তাঁর বিখ্যাত কিতাব ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনে লিখেছেন,
“وليس ذلك إلا بطريق القهر والاستيلاء” اه
অর্থাৎঃ “পবিত্র কুরআনের ইস্তেওয়া মূলত: ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থেই গৃহীত হবে”।
[সূত্রঃ ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ইয়াহইয়াউ উলুমিদ্দীন, খ.১পৃ.১৮৬]
তাফসীর ↠ ২২.
ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী হানাফী রহ. [মৃত: ৫০৮ হি:] তাঁর বিখ্যাত কিতাব “তাবসিরাতুল আদিল্যা”-তে লিখেছেন,
“فعلى هذا يحتمل أن يكون المراد منه: استولى على العرش الذي هو أعظم المخلوقات وتخصيصه بالذكر كان تشريفا له”، ثم قال: وتزييف (بعض) الأشعرية هذا التأويل لمكان أن الاستيلاء يكون بعد الضعف. وهذا لا يتصور في الله تعالى، ونسبتهم هذا التأويل إلى المعتزلة ليس بشىء، لأن أصحابنا أولوا هذا التأويل ولم تختص به المعتزلة. وكون الاستيلاء إن كان في الشاهد عقيب الضعف ولكن لم يكن هذا عبارة عن استيلاء عن ضعف في اللغة، بل ذلك يثبت على وفاق العادة كما يقال علم فلان، وكان ذلك في المخلوقين بعد الجهل، ويقال قدر، وكان ذلك بعد العجز، وهذا الاطلاق جائز في الله تعالى على إرادة تحقق العلم والقدرة بدون سابقة الجهل والعجز، فكذا هذا. “اهــ.
অর্থাৎঃ “ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ারা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় মাখলুক। আরশকে বিশেষভাবে উল্লেখের ফায়দা হলো, আরশের বড়ত্ব প্রকাশ করা। কিছু কিছু আশআরী ইস্তেওয়ার এই ব্যাখ্যাকে এভাবে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে যে, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বারা তো বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে দুর্বল বা কর্তৃত্বহীন ছিলেন। অথচ আল্লাহর ক্ষেত্রে এটি কল্পনাও করা যায় না। কেউ কেউ এ ব্যাখ্যাকে মু’তাজিলাদের দিকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। কেননা বহু আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম এই ব্যাখ্যা করেছেন। এটি শুধু মু’তাজিলাদের ব্যাখ্যা নয়। বাহ্যদৃষ্টিতে আমরা কর্তৃত্বহীন ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে দেখি। কিন্তু আরবী ভাষা কখনও এটি বোঝায় না। বরং এটি সৃষ্টির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ঘটে থাকে। যেমন বলা হয়, অমুক জ্ঞানী হয়েছে। মাখলুকের ক্ষেত্রে পূর্বে মূর্খ থাকলেই কেবল বলা হয় সে জ্ঞান অর্জন করেছে। আমরা বলে থাকি, সে শক্তিশালী হয়েছে। মাখলুক ক্ষমতাহীন অবস্থা থেকে ক্ষমতা অর্জন করলেই কেবল এটা বলা হয়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে ইলম ও কুদরত শব্দ এই শর্তে ব্যবহার করা যায় যে, আল্লাহর ক্ষেত্রে পূর্বে অক্ষমতা বা মূর্খতার কল্পনাও করা যাবে না। একইভাবে ইস্তেওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।”
[সূত্রঃ তাবসিরাতুল আদিল্লাহ, খ., ১, পৃ., ২৪২।]