মহান আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।”
[সূরা জুমু’আহ, আয়াত ৯]।
উপরোক্ত আয়াতে কারিম থেকে জুমুআ’র দিবসের তাৎপর্য সহজেই অনুমেয়। উপরোক্ত অায়াতে কারিমের আলোকে জুমুআ’র নামাজ ফরজ হিসেবে পরিগনিত হয়।
আল্লাহতায়ালা জগৎ সৃষ্টির পূর্ণতা দান করেছিলেন এই দিনে। এই দিনেই হজরত আদম (‘আলাইহিস সালাম) ও হাওয়া (‘আলাইহিস সালাম)-কে জান্নাতে একত্র করেছিলেন এবং এই দিনে মুসলিম উম্মাহ সাপ্তাহিক ঈদ ও ইবাদত উপলক্ষে মসজিদে একত্র হয় বলে দিনটাকে ইয়াওমুল জুমাআ বা জুমার দিন বলা হয়।
হযরত মালেক ইবনে শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত ইবনে সাব্বাক থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) কোনো এক জুমার দিনে বললেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহতায়ালা এই দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।’
আরবি শব্দ জুমুআ-এর অর্থ একত্র হওয়া। শুক্রবারকে বলা হয় ইয়াওমুল জুমাআ বা জুমার দিন।
জুমার নামাজ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।
শুক্রবারের দিন জোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমুআ’র দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।
সপ্তাহের এদিনে জুমুআ’র খতিব উম্মতের যাবতীয় প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে নির্দেশনা ও সমাধানমূলক উপদেশ দেবেন তাঁর খুতবায়।
হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি—এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)।
[সূত্রঃ আবু দাউদ, হা/ ১০৬৭, মুসতাদরেকে হাকেম, হা/ ১০৬২ , আস্-সুনানুল কাবীর, হা/ ৫৫৮৭]।
জুমুআ’ দিবসের তাৎপর্য ও এর অসংখ্য ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে বিস্তারিত জানা যায়। নিম্নে কতিপয় উল্লেখযোগ্য ফজিলত তুলে ধরা হলো-
যেমনঃ
১/
সূর্য উদিত হয় এমন দিনগুলোর মধ্যে জুম’আর দিন হল সর্বোত্তম দিন। এ দিনে যা কিছু ঘটেছিল তা হলঃ
(ক) এই দিনে আদম (আলাইহিস সালাম) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল,
(খ) এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল,
(গ) একই দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল।
[সূত্রঃ মুসলিম, হা/ ৮৫৪]।
(ঘ) এই দিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়েছিল,
(ঙ) এই দিনেই তাঁর রূহ কবজ করা হয়েছিল।
[সূত্রঃ আবু দাউদ, হা/ ১০৪৬]।
(চ) এই দিনে শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে,
(ছ) এই দিনেই কিয়ামত হবে,
(জ) এই দিনেই সকলেই বেহুঁশ হয়ে যাবে।
[সূত্রঃ আবু দাউদ, হা/ ১০৪৭]।
(ঝ) প্রত্যেক নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, পর্বত ও সমুদ্র এই দিনটিকে ভয় করে।
[সূত্রঃ ইবনে মাজাহ, হা/ ১০৮৪, ১০৮৫; মুয়াত্তা, হা/ ৩৬৪]।
২/
উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এটি একটি মহান দিন। এ জুম’আর দিনটিকে সম্মান করার জন্য ইহুদী-নাসারাদের উপর ফরজ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা মতবিরোধ করে এই দিনটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতঃপর ইহুদীরা শনিবারকে আর খ্রিষ্টানরা রবিবারকে তাদের ইবাদতের দিন বানিয়েছিল। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের জন্য শুক্রবারকে মহান দিবস ও ফযীলতের দিন হিসেবে দান করেছেন। আর উম্মতে মুহাম্মদী তা গ্রহন করে নিল।
[সূত্রঃ বুখারী, হা/ ৮৭৬, ইফা, হা/ ৮৩২, আধুনিক, হা/ ৮২৫; মুসলিম, হা/ ৮৫৫]।
৩/
জুম’আর দিন হল সাপ্তাহিক ঈদের দিন।
[সূত্রঃ ইবনে মাজাহ, হা/ ১০৯৮]।
৪/
জুম’আর দিনটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদা সম্পন্ন।
[সূত্রঃ মুসনাদে আহমদ, ৩/৪৩০; ইবনে মাজাহ, হা/ ১০৮৪]।
ঈদ ও আইয়াদঃ হাদিসের আলোকে।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1929541740694595]
_____________
৫/
জুম’আর দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায়, তা-ই তাকে দেওয়া হয়। আর এ সময়টি হল জুম’আর দিন আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত।
[সূত্রঃ বুখারী, হা/ ৯৩৫, ইফা, হা/ ৮৮৮, আধুনিক, হা/ ৮৮২; মুসলিম, হা/ ৮৫২]।
৬/
জুম’আর রাতে বা দিনে যে ব্যক্তি মারা যায় আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন।
[সূত্রঃ তিরমিযী, হা/ ১০৭৮]।
৭/
জান্নাতে প্রতি জুম’আর দিনে জান্নাতীদের হাঁট বসবে। জান্নাতী লোকেরা সেখানে প্রতি সপ্তাহে একত্রিত হবেন। তখন সেখানে এমন মনমুগ্ধকর হাওয়া বইবে, যে হাওয়ায় জান্নাতীদের সৌন্দর্য অনেক গুণে বেড়ে যাবে এবং তাদের স্ত্রীরা তা দেখে অভিভূত হবে। অনুরূপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি স্ত্রীদের বেলায়ও হবে।
[সূত্রঃ মুসলিম, হা/ ২৮৩৩, ৭১/৭৫৩]।
৮/
যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে সুরা কাহফ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য দুই জুম’আর মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেবেন।
[সূত্রঃ জামেউস সাগীর, হা/ ৬৪৭০]।
৯/
সূরা কাহাফ তিলাওয়াত।
[সূত্রঃ আল-হাকিম, ২/৩৯৯; আল-বায়হাকী, ৩/২৪৯]।
যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে।
[সূত্রঃ মুসলিম]।
১০/
প্রত্যেক সপ্তাহে জুম’আর দিন আল্লাহ তায়ালা বেহেশতী বান্দাদের দর্শন দেবেন।
[সূত্রঃ সহীহুত তারগীব]।
১১/
এই দিনে দান খয়রাত করার সওয়াব অন্য দিনের চেয়ে বেশী হয়। ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের দানের সওয়াব যেমন বেশী তেমনি শুক্রবারের দান খয়রাত অন্য দিনের তুলনায় বেশী।
[সূত্রঃ যাদুল মা’আদ]।
১২/
ইবনুল কায়্যিম আরও বলেছেন যে, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের মর্যাদা যেমন, সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুম’আ বারের মর্যাদা ঠিক তেমন। তাছাড়া রমজানের কদরের রাতে যেমন ভাবে দোয়া কবুল হয়, ঠিক তেমনি শুক্রবারের সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও দোয়া কবুল হয়।
[সূত্রঃ যাদুল মা’আদ, ১/৩৯৮]।
• জুমার দিনে অধিক দরূদ পড়ার ফজিলতঃ
إكثار الصلاة على النبي
হযরত আউস বিন আউস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
“তোমাদের দিন সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে মৃত্যু দেওয়া হয়েছে, এই দিনে সিংগায় ফু দেওয়া হবে এবং মহা বিপর্যয়ও (ক্বিয়ামত) ঘটবে এই দিনেই। তাই এই দিনে তোমরা বেশি বেশি আমার উপর দরুদ পাঠ করবে; কেননা তোমাদের দরুদ আমার উপর বখশান হয় জুমুঅার দিনে।”
[সূত্রঃ আবু দাউদ, হা/ ১০৪৭; নাসাঈ, ইবনু মাজা (হা/ ১০৮৫) প্রমুখের বরাতে সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব, মিশকাত আলবানী হা/ ১৩৬১]।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু অানহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ইরশাদ করেন, জুম’আর দিন মসজিদের দরজায় ফিরিশতাগণ অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসেন সে ব্যাক্তির ন্যায় যে একটি মোটাতাজা উট কুরবানি করে। এরপর যে আসে সে ব্যাক্তির ন্যায় যে একটি গাভি কুরবানি করে। তারপর আগমনকারী ব্যাক্তি মুরগি দানকারীর ন্যায়। তারপর আগমনকারী ব্যাক্তি একটি ডিম দানকারীর ন্যায়। তারপর ইমাম যখন বের হন তখন ফিরিশতাগণ তাঁদের দফতর বন্ধ করে দেন এবং মনযোগ সহ খুতবা শুনতে থাকেন।
[সূত্রঃ সহিহ্ আল বুখারি, কিতাবুল জুম’আ, হা/ ৮৮২, সহিহ্ মুসলিম, অধ্যায় জুম’আ, হা/ ১৮৪১, ১৮৬১]।