নবম অধ্যায়ঃ মিলাদুন্নাবী যুগে যুগে
মিলাদুন্নবী উৎসব যুগে যুগেঃ
===========
নবী করিম [ﷺ] নবুয়ত পরবর্তীকালে নিজেই সাহাবীদেরকে নিয়ে নিজের মিলাদ পড়েছেন এবং নিজ জীবনী আলোচনা করেছেন। যেমন- হযরত ইরবায ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) একদিন নবী করিম [ﷺ]-কে তাঁর আদি বৃত্তান্ত বর্ণনা করার জন্য আরয করলে নবী করিম [ﷺ]-এঁরশাদ করেন- “আমি তখনই নবী ছিলাম- যখন আদম (عليه السلام)-এঁর দেহের উপাদান – মাটি ও পানি পৃথক পৃথক অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ আদম সৃষ্টির পূর্বেই আমি নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। আমাকে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) দোয়া করে তাঁর বংশে এনেছেন- সুতরাং আমি তাঁর দোয়ার ফসল। হযরত ঈছা (عليه السلام) তাঁর উম্মতের নিকট আমার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই আমার সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। আমার আম্মা বিবি আমেনা আমার প্রসবকালীন সময়ে যে নূর তাঁর গর্ভ হতে প্রকাশ পেয়ে সুদূর সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত করতে দেখেছিলেন, আমিই সেই নূর” (মিশকাত)।
এভাবে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه), হযরত ওমর (رضي الله عنه), হযরত ওসমান (رضي الله عنه), হযরত আলী (رضي الله عنه) খলিফা চতুষ্টয় নিজ নিজ খেলাফতযুগেও পবিত্র বেলাদত শরীফ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল করতেন এবং মিলাদের ফযিলত বর্ণনা করতেন বলে মক্কা শরীফের তৎকালীন (৯৭৪) বিজ্ঞ মুজতাহিদ আলেম আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী (رحمة الله عليه) স্বীয় রচিত “আন-নি’মাতুল কোবরা আলাল আলম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও অন্যান্য সাহাবীগণ নবীজীর জীবদ্দশায় মিলাদুন্নী মাহফিল করতেন। উদাহরণ স্বরূপ –
১) হযরত আবু আমের আনসারীর মিলাদ মাহফিলঃ
হযরত আবু দারদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করিম [ﷺ]-এঁর সাথে মদিনাবাসী আবু আমেরের (رضي الله عنه) গৃহে গমন করে দেখতে পেলাম- তিনি তাঁর সন্তানাদি ও আত্মীয়স্বজনকে একত্রিত করে নবী করিম [ﷺ]-এঁর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কীত জন্ম বিবরণী শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলছেন যে, “আজই সেই পবিত্র জন্ম তারিখ।” এই মাহফিল দেখে নবী-করিম [ﷺ] খুশী হয়ে তাঁকে সুসংবাদ দিলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য (মিলাদের কারণে) রহমতের অসংখ্য দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাগণ তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছেন” (আল্লামা জালালুদ্দীন সায়ুতির সাবিলূল হুদা ও আল্লামা ইবনে দাহ্ইয়ার আত-তানভীর-৬০৪ হিঃ)। আরবী হাদীসখানা প্রমাণ স্বরূপ হুবহু নিম্নে পেশ করা হলো-
عن أبى الدرداء قال مررت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم الى بيت عامر الانصارى وهو يعلم وقائع ولادته لأبنائه وعشيرته ويقول هذا اليوم فقال النبي صلى الله عليه وسلم أن الله فتح عليك أبواب الرحمة وملائكته يستغفرون لكم (سبيل الهدى لجلال الدين سيوطى _ التنوير)
(মীলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি:) ঈদে মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’ গ্রন্থে এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদে মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হাক্বীক্বতে মুহম্মদী ও মীলাদে আহমদী পৃষ্ঠা- ৩৫৫)
২। হযরত ইবনে আব্বাছ (رضي الله عنه) কর্তৃক মিলাদ মাহফিলঃ
একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) নিজগৃহে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীগণের নিকট নবী করিম [ﷺ]-এঁর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত ঘটনাবলী বয়ান করছিলেন। শ্রোতামন্ডলী শুনতে শুনতে মিলাদুন্নবীর আনন্দ উপভোগ করছিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজীর দরূদ পড়ছিলেন। এমন সময় নবী করিম [ﷺ] সেখানে উপস্থিত হয়ে এরশাদ করলেন, “তোমাদের সকলের প্রতি আমার সুপারিশ ও শাফাআত অবধারিত হয়ে গেল।” (আদ দোররুল মুনাযযাম) সোবহানাল্লাহ! হাদীস শরীফখানা নিম্নে দেওয়া হলো।
عن ابن عباس رضي الله عنهما كان يحدث ذات يوم فى بيته وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم فيبشرون ويحمدون ويصلون إذا جاء النبى صلى الله عليه وسلم وقال حلت لكم شفاعتى (الدر المنظم)
{আল্লামা জালাল উদ্দীন সূয়ুতী (রাহ) এর বিখ্যাত কিতাব “সুবলুল হুদা ফি মাওলেদে মুস্তাফা (ﷺ)“ এ শেষের হাদিস দুটি উল্লেখিত হয়েছে। # দুররুল মুনাযযাম – সপ্তম অধ্যায় – প্রথম পরিচ্ছেদ # ইশবাউল কালাম # হাক্বীকতে মুহম্মদী মীলাদে আহমদী ৩৫৫ পৃষ্ঠা}
৩। হযরত হাসসান (رضي الله عنه) -এঁর কিয়ামসহ মিলাদঃ
সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবী করিম [ﷺ]-এঁর উপস্থিতিতে তাঁর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন এবং অন্যান্য সাহাবীগণ সমবেত হয়ে তা শ্রবন করতেন। (সপ্তম অধ্যায়ে দেখুন)।
কিয়াম করে মিলাদ মাহফিলে নবী করিম [ﷺ]-এঁর প্রশংসামূলক কবিতা ও না’ত পাঠ করা এবং সালাম পেশ করার এটাই বড় দলীল। এরূপ করা সুন্নাত এবং উত্তম বলে মক্কা-মদিনার ৯০ জন উলামাগণ ১২৮৬ হিজরীতে নিম্নোক্ত ফতোয়া দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রেরণ করেছেন।
أعلم أن ذكر مولد النبى صلى الله عليه وسلم وجميع مناقبه وحضور سماعه سنة روى أن حسانا يفاخر قياما من رسول الله صلى الله عليه وسلم بحضرته والناس يجتمعون لسماعه –
অর্থ- “হে মুসলমানগণ! আপনারা জেনে রাখুন যে, মিলাদুন্নবী [ﷺ]-এঁর আলোচনা ও তাঁর সমস্ত শান মান বর্ণনা করা এবং ঐ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া সবই সুন্নাত। বর্ণিত আছে যে, হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) কিয়াম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ [ﷺ]-এঁর পক্ষে হুযুরের উপস্থিতিতে হুযুর [ﷺ]-এঁর গৌরবগাথা পেশ করতেন, আর সাহাবীগণ তা শুনার জন্য একত্রিত হতেন।” (ফতোয়ায়ে হারামাঈন) একজনের কিয়ামই সকলের জন্য দলীল স্বরূপ।
হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه)-এঁর কিয়ামের কাছিদার অংশবিশেষ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ কাছিদায় তিনি রাসূল করীম [ﷺ]-এঁর আজন্ম নির্দোষ ও নিষ্পাপ হওয়া এবং হুযুরের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর আকৃতি বা সুরতে মোহাম্মাদী সৃষ্টির তত্ত্ব পেশ করেছেন। নবী করিম [ﷺ] তাঁর এই কাছিদা শুনে দোয়া করতেন- “হে আল্লাহ! তুমি জিব্রাইলের মাধ্যমে হাসসানকে সাহায্য কর।” অর্থাৎ আমার পক্ষে আমার প্রশংসা বাক্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার তৌফিক দাও। এতে আমার দুশমনগণ ভালভাবে জব্দ হবে।
৪। সুদূর অতীতে মিলাদুন্নবীর চিত্রঃ মাওয়াহিবের বর্ণনা
সুদূর অতীতকালে কিভাবে মুসলমানগণ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতেন- তাঁর একটি বিস্তারিত বর্ণনা আল্লামা শাহাবুদ্দীন কাস্তুলানী (رحمة الله عليه) মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে বিধৃত করেছেন। মিলাদুন্নবী [ﷺ] সমর্থক বিজ্ঞ মোহাক্বেক ওলামায়ে কেরাম এবং ফকিহগণ নিজ নিজ গ্রন্থে দলীল স্বরূপ আল্লামা কাস্তুলানীর (رحمة الله عليه) এই দুর্লভ প্রমানাদি লিপিবদ্ধ করেছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] পালনকারী এবং সমর্থক ওলামা ও নবীপ্রেমিক মুসলমানদের অবগতির জন্য উক্ত মন্তব্য কোটেশন আকারে অনুবাদসহ নিম্নে পেশ করা হলো।
ولا زال أهل الإسلام يحتفلون بشهر مولده عليه السّلام، ويعملون الولائم، ويتصدقون في لياليه بأنواع الصدقات، ويظهرون السرور، ويزيدون في المبرات، ويعتنون بقراءة مولده الكريم، ويظهر عليهم من بركاته كل فضل عميم ومما جرب من جواصه أنه امان فى ذلك العام وبشرى عاجلة بنيل البغية والمرام فرحم الله امرأ اتخذ ليالى شهر مولده المباركة اعيادا (المواهب اللدنية والأنوار المحمدية صفحة ١٩).
অর্থঃ “সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সুদূর অতীতকাল থেকে নবী করিম [ﷺ]-এঁর পবিত্র বেলাদত উপলক্ষে মাসব্যাপী সর্বদা মিলাদ-মাহফিল উদযাপন করতেন। যিয়াফত প্রস্তুত করে তারা লোকদের খাওয়াতেন। মাসব্যাপী দিনগুলোতে বিভিন্ন রকমের সদকা-খয়রাত করতেন এবং শরীয়তসম্মত আনন্দ উৎসব করতেন। উত্তম কাজ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করতেন। তাঁরা পূর্ণমাস শান শওকতের সাথে বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত করতেন- যার বরকতে বরাবরই তাদের উপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহ প্রকাশ পেতো। মিলাদ মাহফিলের বৈশিষ্ট সমূহের মধ্যে এটা পরীক্ষিত বিষয় যে, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের বরকতে ঐ বৎসর আল্লাহর পক্ষ হতে নিরাপত্তা কায়েম থাকে এবং তড়িৎগতিতে তা মনোবাঞ্ছা পূরনের শুভ সংবাদ বহন করে নিয়ে আসে। অতএব- যিনি বা যারা মিলাদুন্নবী মাসের প্রতিটি রাত্রকে ঈদের রাত্রে পরিণত করে রাখবে- তাঁদের উপর আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হবে।”
(মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, মা ছাবাতা বিছছুন্নাহ্)
মিলাদ ও কিয়ামের বিস্তারিত আলোচনা এবং দলীল সমূহ সংশ্লিষ্ট প্রামানিক কিতাবসমূহে অনুসন্ধান করে নিবেন। এছাড়াও মিলাদ কিয়ামের ১৮টি দলীল আরবী এবারতা সহ “মাসিক সুন্নীবার্তা-৯৩” সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে মার্চ ’০৭-এ। বিজ্ঞ আলেমগণ সুন্নীবার্তাটি সংগ্রহ করে দলীলগুলো সংরক্ষণ করতে পারেন।
বিঃ দ্রঃ উপরের আলোচনায় প্রমানিত হলো যে, যুগে যুগে মিলাদুন্নবীর চর্চা চলে আসছে- সীরাতুন্নবীর চর্চা কেহই করেননি। কারণ, সীরাত শব্দের আভিধানিক অর্থ- ভালমন্দ চরিত্র। আর শরিয়তে সীরাতুন্নবীর অর্থ- কাফির ও মুশরিকদের বিরূদ্ধে নবীজীর ৮ বছরের যুদ্ধজীবন। সুতরাং সীরাতুন্নবীতে শাব্দিক ও পারিভাষিক উভয় অর্থেই নবীজীর পুতঃপবিত্র চরিত্র ও সার্বিক জীবনী আলোচনা প্রমাণিত হয় না। ঈদে মিলাদুন্নবীতে নূরে মুহাম্মদী তথা সৃষ্টির আদি থেকে ৬৩ বৎসর পর্যন্ত নবীজীর সার্বিক জীবনের আলোচনা স্থান পায়। সেজন্যই নবী, ওলী, গাউস-কুতুব – সবাই মিলাদুন্নবীর চর্চা করতেন, করছেন এবং করতে থাকবেন। মিলাদের মধ্যেই সীরাত অংশ আছে। যারা শুধু সীরাতুন্নবীর চর্চা করেন, তারা খন্ডিত ৮ বছরের যুদ্ধ জীবন ও নবীজীর ভালমন্দ জীবন আলোচনা করে থাকেন মাত্র। শুধু যুদ্ধ জীবন আলোচনা করতে করতে তারা বর্তমানে জেএমবি হয়ে গেছেন অথবা হরকাতুল জেহাদ করে মুফতী হান্নানের মত বোমাবাজ হয়ে গেছেন। মিলাদুন্নবী পালনকারীরা শান্তিকামী। মিলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আমার লিখিত ঈদে মিলাদুন্নবী ও না’ত লহরী এবং মিলাদ-কিয়ামের বিধান গ্রন্থদ্বয়ে।
(মুফতী আমিমুল ইহছান লিখিত কাওয়া-ঈদুল ফিক্হ ৩৩১ পৃষ্ঠায় সীরাতুন্নবীর সংজ্ঞা দেখুন। তাতে বিভিন্ন গ্রন্থের হাওয়ালা দিয়ে লিখা হয়েছে – সীরাতুন্নবী বলতে নবীজীর ৮ বৎসরের যুদ্ধজীবন বুঝায় এবং ভাল ও মন্দ উভয় চরিত্র বুঝায়। হাবীবে খোদার মধ্যে মন্দ চরিত্র থাকতে পারে না। তাই সীরাতুন্নবী শব্দ ব্যবহার করা উচিৎ নয়। তদুপরি সীরাতুন্নবী মাহফিল নামে কোন অনুষ্ঠান অতীত যুগে ছিল না। তাই এটা নতুন বিদ’আত।