আলহাজ্ব মুফতী এস এম সাকীউল কাউছার
ঘিলাতলা দরবার শরীফ, কুমিল্লা
পবিত্র ঈদুল আজহাকে কোরবানীর ঈদ বলা হয়। কোরবানী অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। ঈদ অর্থ আনন্দ, খুশি। সুতরাং কুরবানীর ঈদ অর্থ উৎসর্গ করার আনন্দ, ত্যাগের খুশি; অর্থাৎ, আল্লাহ’র প্রিয় বান্দাগণ আল্লাহ’র রাস্তায় নিজেদের উপার্জিত অর্থ দ্বারা হালাল পশু ক্রয় করে আল্লাহ’র রাস্তায় কুরবানী দিয়ে পরমানন্দ অনুভব করে থাকেন। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে মুসলীম মিল্লাত এই কুরবানীর মাধ্যমে তা প্রমাণ করে থাকেন। তাছাড়া আরবী ‘কুরবানী’ শব্দটি ‘কুরব’ শব্দ হতে নির্গত হতে পারে। তাহলে এর অর্থ হবে নৈকট্য (আল্লাহ’র সান্নিধ্য)।
ইসলামি পরিভাষায় কুরবানী হলো মহান আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভের আশায় এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যে শরীয়তসম্মত উপায়ে হালাল পশু আল্লাহ’র নামে জবেহ করা।
আল্লাহ’র প্রিয় নবী হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাঁর প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ:)-কে আল্লাহ’র নামে কুরবানী দেয়ার যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এরই স্মৃতিবহ এই পবিত্র কুরবানী।
কুরবানী সম্পর্কিত আল্লাহ’র নির্দেশ
(১) ”এবং প্রত্যেক উম্মতের জন্যে আমি একটি কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যেন তারা আল্লাহ’র নাম নেয় তাঁর প্রদত্ত বাকশক্তিহীন চতুষ্পদ (গৃহপালিত) পশুগুলোর উপর।” (সুরা হজ্জ, ৩৪ আয়াত; তাফসীরে নূরূল এরফান)
(২) ”হে হাবীব (দঃ)! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দান করেছি ‘কাউছার’ (অসংখ্য গুণাবলী)। অতএব, আপনি আপনার প্রভূর জন্যে নামায পড়ুন তথা আরাধনা করুন এবং কুরবানী করুন।” (সুরা কাউছার, ১-২ আয়াত; প্রাগুক্ত তাফসীর)
কুরবানী-সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস
(ক) কুরবানীর দিবসে মানুষের কোনো নেক আমল-ই আল্লাহ’র কাছে এতো প্রিয় নয়, যতোখানি প্রিয় হচ্ছে (কুরবানীর পশুর) রক্ত প্রবাহিত করা।
(খ) কুরবানীর পশুর রক্তের ফোটা মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানী করো।
(গ) কুরবানীর পশুর প্রত্যেক লোমের বদলে একটি করে নেকী বা সওয়াব পাওয়া যায়।
কুরবানী সম্পর্কিত কিছু মাস’আলা
(১) প্রত্যেক স্বনির্ভর মালদার তথা সম্পদের মালিকের প্রতি পশু কুরবানী দেয়া ওয়াজিব। চাই তিনি পুরুষ হোন বা নারী, শহরে বা গ্রামে, মুকীম হোন বা জঙ্গলে বা মরুভূমিতে বসবাসকারী হোন। মালদার ওই ব্যক্তিকে বলা হয়, যিনি কুরবানীর দিনগুলোতে, অর্থাৎ, ১০,১১ ও ১২ই জিলহজ্ব তারিখের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা তার সমপরিমাণ মূল্যের সম্পদের মালিক।
(২) গরু, ছাগল ( খাসি বা ছাগী), উট, দুম্বা, মহিষ ও ভেড়া ইত্যাদি গৃহপালিত চতুষ্পদ হালাল পশু দ্বারা কুরবানী করা বিধেয়। উল্লেখ থাকে যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি খাসি দ্বারা কুরবানী করেছেন। (ইবনে মাজাহ শরীফ)
(৩) ছাগল, ভেড়া একজনের পক্ষে এবং একটি গরু, মহিষ, উট এক হতে ৭ জনের পক্ষে কুরবানী করা যাবে।
(৪) শরিকদারী কুরবানীর গোশত যথাযথভাবে বণ্টন করতে হবে, সর্বসম্মতভাবে ওজন না করে আন্দাজ করে ভাগ করলে কুরবানী হবে না।
(৫) একটি গরুর মধ্যে একাধিক শরিকদাতা একমত হলে একটি অংশ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কুরবানী করা বৈধ।
(৬) কুরবানীর ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এক বছরের ও গরু, মহিষ দুই বছরের এবং উট পাচ বছরের হতে হবে।
(৭) যে সব পশু অন্ধ, খোঁড়া এবং জবেহ করার স্থানে যেতে অক্ষম, লেজ, শিং বা কান কাটা বা ভাঙ্গা, দুর্বল, সেগুলো কুরবানীর জন্যে উপযুক্ত নয়। কুরবানীর জন্যে সুন্দর ও নিখুঁত পশু বাছাই করা উত্তম। লেজ, কান, শিং যদি এক তৃতীয়াংশের কম কাটা থাকে, তাহলে কুরবানী বৈধ হবে। আর এক তৃতীয়াংশের বেশি হলে বৈধ হবে না। অধিকাংশ কাটা থাকলে বৈধ নয় এবং স্বল্পাংশ কাটা থাকলে বৈধ। অধিকাংশ ও স্বল্পাংশ নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতভেদ আছে।
(৮) কোনো ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে নির্দিষ্ট কোনো ছাগল বা গরু নির্ধারিত করে রেখেছিলো। কিন্তু কুরবানীর দিনসমুহ অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে প্রাণীটি কুরবানী করলো না। এমতাবস্থায় উক্ত প্রাণীটি জীবিত সদকা করে দেয়া ওয়াজিব হবে। আর কোনো মালদার ব্যক্তি যদি কুরবানীর উদ্দেশ্যে কোনো প্রাণী ক্রয় না করে এবং কুরবানীর দিনসমুহ অতিবাহিত হয়ে যায়, তবে প্রাণীর মূল্য সদকা করে দেয়া ওয়াজিব হবে।
(৯) কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর ত্রুটি প্রকাশ পেলে ধনী ব্যক্তির জন্যে উক্ত পশু দ্বারা কুরবানী শুদ্ধ হবে না। তবে গরীব ব্যক্তির জন্যে জায়েয হবে।
(১০) কুরবানীর নিয়ম জানা থাকলে নিজেই কুরবানী করতে পারবে। অপারগতায় পরহেজগার (সুন্নী আকীদা-বিশ্বাস পোষণকারী ও নেক আমল পালনকারী) অন্য কাউকে দিয়েও করা যাবে।
(১১) কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরীব-ইয়াতিমকে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে, এবং এক ভাগ নিজের জন্যে রাখা উত্তম (শরীয়তের বিধান মোতাবেক)। অবশ্য নিজস্ব ঘরের লোকজন সংখ্যায় বেশি হলে এক ভাগের বেশিও রাখা যাবে।
(১২) জবেহকারীর জন্যে জবেহের আগে ছুরি ধার দিয়ে নেয়া মুস্তাহাব। পশুকে ধরাশায়ী করে তারপর ছুরি ধার করা মাকরূহ। জবেহ করার সময় মাথাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা মাকরূহ। পশুকে দূরে ধরাশায়ী করে ঠ্যাং ধরে টেনে-হেঁচড়ে জবেহ’র স্থানে নিয়ে আসা মাকরূহ। বরং যেখানে ধরাশায়ী করবে, সেখানেই জবেহ করতে হবে। জবেহ করার পর পশুর ধরফর করা বন্ধ হয়ে না গেলে এবং নিঃশেষিত না হয়ে গেলে তার ঘাড় আলাদা করা এবং চামড়া ছেলানো শুরু করা মাকরূহ। উল্লেখ্য, জবেহের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, যে কাজ করলে পশুর অযথা কষ্ট হয় এবং জবেহের ক্ষেত্রে যে কাজ নিষ্প্রয়োজন, এমন কাজ যদি জবেহ-কালে করা হয়, তাহলে এতে জবেহ মাকরূহ হয়ে যাবে। (সমুদয় ফিকহার কিতাব দ্রষ্টব্য)
কুরবানী করার দোয়া
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া ইলাইকা ইন্না ছালাতি ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়ী ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। লা শারীকালাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা আউয়ালুল মুসলেমিন। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন (ফুলান) ইবনে (ফুলান) (অর্থাৎ যাদের পক্ষে কুরবানী হবে ১ম ফুলানে তার নাম ২য় ফুলানে তার পিতার নাম বলতো হবে) কামা তাকাব্বালতা মিন খলীলেকা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ওয়া হাবীবেকা মুহাম্মাদীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।
সমাপ্ত