বারো আউলিয়া কথাটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষতঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। চট্টগ্রামের আরেক নাম “বারো আউলিয়ার দেশ”। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দু’টি স্হানে বারো আউলিয়ার সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। এর একটি হলো সীতাকুন্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে আবস্হিত পীর বারো আউলিয়ার মাজার। প্রতি বছর ২২ শে মহররম এখানে অত্যন্ত জাঁক-জমকের সাথে বারো আউলিয়ার “উরস” উদযাপিত হয়ে থাকে। উরস উপলক্ষ্যে এখানে গরু-মহিষ-ছাগল প্রভৃতি জবেহ করা হয়ে থাকে। অনুষ্ঠিত হয় ইসলামী জলসা, খতমে কুরআন, মিলাদ-মাহফিল এবং সমাগত ভক্তবৃন্দের মধ্যে তবাররুক বিতরণ করা হয়।
গ্রামের নাম সোনাইছড়ি হলেও সীতাকুন্ড উপজেলার এ এলাকাটি বারো আউলিয়ার মাজার নামে সাধারন্যে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। যদিও এখানে বারো আউলিয়ার অন্তর্গত কোন পীর বা আউলিয়ার মাজার শরীফ নেই। তবে এ স্থানটি বারো আউলিয়ার আস্তানা, খানকাহ, বা সম্মিলনস্হল ছিল বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সুদুর আরব, ইরাক, ইরান বিভিন্ন দেশসমুহ থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য আগত সুফী সাধকগণ এখানে শুভাগমন করতেন। তাঁরা এখানে বসে সকলে মিলে সমবেতভাবে পরামর্শ করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। এবং সেই মুতাবিক দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তেন। এ সকল পীর আউলিয়াগনের কেউ কেউ অনেক সময় এখানে আবস্থান করে নির্জনে আল্লাহ্র ইবাদাত বন্দেগী ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন। ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ জায়গাটি পীর বারো আউলিয়ার মাজার, দরগাহ্ বা আস্তানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
জনশ্রুতি অনুসারে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, হযরত আবদুর রশীদ আল মাদানী (রহঃ) নামে একজন উচ্চস্তরের কামেল অলী আল্লাহ্র মাজার এ স্থানে রয়েছে। যিনি সর্বদা আগন্তুক আউলিয়ায়ে কেরামদের খেদমত ও সোহবতে নিয়োজিত ছিলেন এবং সেখানেই ইবাদাত বন্দেগী ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন।
কথিত আছে যে, ঢাকা ট্রান্ক রোড (বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) মোগল শাসক শাহজাদা শাহ্ শুজার আমলে নির্মিত হয়। তখন এ সড়কটির নাম ছিল ‘শাহ্ শুজা সড়ক’। বহু সংখ্যক হাতি দ্বারা সড়কের নির্মান কাজ চলছিল। কিন্তু এস্থানে এসেই সকল রাজকীয় হাতিগুলো বসে পড়লো। অনেক চেষ্টা করেও মাহুত সেগুলিকে কিছুতেই আর উঠাতে পারছিল না। তখন খোঁজ নিয়ে গেল, সামান্য দুরেই হযরত আবদুর রশীদ আল মাদানী (রহঃ) সাহেব দু’ চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে বসা। কর্মরত লোকজন তাঁর কাছে সবিনয়ে সালাম আরজ করে নিজেদের সমস্যার কথা জানালেন। তিনি তাদেরকে অভয় দিয়ে, আস্তানায় গিয়ে কিছু মান্নত করে আল্লাহ্র কাছে দোয়া চাইতে বল্লেন। কর্মকর্তারা তাঁর হাতে কিছু হাদিয়া পেশ করে, তাঁর কথামত আস্তানায় গিয়ে মহান আল্লাহ্র দরবারে আকুলভাবে প্রার্থনায় মগ্ন হলেন। আর সাথে সাথেই রাজকীয় সকল হাতী উঠে গিয়ে আবার সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলার সুবেদার শাহ্ শুজার পক্ষ থেকে বারো আউলিয়ার আস্তানার নামে লাখেরাজ ১০ দ্রোন ভূ সম্পত্তি ওয়াক্ফ করে দেয়া হয়।
এছাড়া শহর থেকে প্রায় ৯-১০ কিমি দুরে বর্তমান চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বালুছড়া নামক স্হানে বারো আউলিয়ার নামে ১৯৩৩ খৃঃ নির্মিত একটা জামে মসজিদ রয়েছে।
ডঃ গোলাম সাকলায়েন কতৃক লিখিত “বাংলাদেশের সূফী-সাধক” গ্রন্থের ১২৯-১৩০ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রামের “বারো আউলিয়ার” মধ্যে দশ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে। যা নিম্নরুপঃ-
১। সুলতান বায়েযীদ বোস্তামী (রহঃ) – চট্টগ্রাম শহেরর পাঁচ মাইল উত্তরে নাসিরাবাদ পর্বতের চুড়ায়।
২। শেখ ফরীদ (রহঃ) – চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির এক মাইল উত্তরে ষোল শহরে পর্বতের পাদদেশে।
৩। বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহঃ) – চট্টগ্রাম শহরের বকসীর হাটের পাশে (বদরপাতিতে)।
৪। কতল পীর (পীর কতল) (রহঃ) – চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির অর্ন্তগত কাতাল গঞ্জে।
৫। শাহ্ মহসিন আউলিয়া (রহঃ)- আনোয়ারা থানার অর্ন্তগত বটতলী গ্রামে।
৬। শাহ্ পীর (রহঃ) – সাতকানিয়ায়।
৭। শাহ্ উমর (রহঃ) – চকরিয়ায়।
৮। শাহ্ বাদল (রহঃ) – ধুম রেল ষ্টেশনের সন্নিকটে জামালপুরে।
৯। শাহ্ চাঁদ আউলিয়া (রহঃ) – পটিয়া থানার নিকটবর্তী।
১০। শাহ্ জায়েদ (রহঃ) – কান্দেরহাট রেল ষ্টেশনের নিকটবর্তী।
এছাড়া এককালের বাংলদেশের রাজধানী বিক্রমপুরের বড় কেওয়ার গ্রামে ও বারো আউলিয়ার মাজার রয়েছে।(আজ থেকে প্রায় বারো হাজার বছর আগে মহাভারতের যুগে বর্গরাজ্যে যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল তার রাজধানী ছিল বিক্রমপুরে। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকেও এই বিক্রমপুর ছিল বাংলার রাজধানীর মর্যাদায় আভিসিক্ত। বর্তমানে অবশ্য এই বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ জেলার অর্ন্তগত। ১১৭৮ খৃষ্টাব্দে বাবা আদম শহীদ নামে এক মুসলিম দরবেশ বল্লাল সেনকে পরাজিত করে বিক্রমপুরকে মুসলিম রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত করেন। বিক্রমপুরের আবদুল্লাহপুর গ্রামের সিপাহী পাড়ায় এ মহান সাধক ও যোদ্ধার পবিত্র মাজার রয়েছে।
তাঁর সম্মানার্থে বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন আবু জাফর শাহ্’র পুত্র মালিক কাপুর শাহ্ ১৪৮৩ খৃষ্টাব্দে একখানা ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। যা অদ্যাবধি সগৌরবে বিদ্যমান। The Romance Of Eastern Capital, তাওয়ারীখে ঢাকা, মসজিদ নির্দেশকা গ্রন্থে এ মসজিদের বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
১৯৭৪ খৃষ্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানার অন্তর্গত বিক্রমপুরের বড় কেওয়ার গ্রামের তেতুলতলায় একটা প্রাচীন মাজারের সংস্কার কাজ চলছিল। সেখানে একখানা শিলালিপিতে বারোজন আউলিয়ার নাম পাওয়া গেছে। আরবী-ফার্সী ভাষায় ৪২১ হিজরী সনে লিখিত পবিত্র কলেমা -ই- তাইয়্যেবা খচিত এ পাথর খন্ডে বারো আউলিয়াগনের নাম পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত শিলালিপিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বারো জন ধর্ম প্রচারক দরবেশ আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিক্রমপুরের বড় কেওয়ার গ্রামে এসে বসতি স্হাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের নামঃ
১। হযরত শাহ্ সুলতান হুসাইনী (রহঃ) মদীনা থেকে আগত ২। হযরত সুলতান সাব্বির হুসাইনী (রহঃ)
৩। হযরত কবির হাশেমী (রহঃ)
৪। হযরত আল হাসান (রহঃ)
৫। হযরত শায়খ হুসাইন (রহঃ)
৬। হযরত আবুল হাশেম হুসাইনী (রহঃ)
৭। হাফেজ আবু বকর সিদ্দিক
৮। হযরত ইয়াসীন (রহঃ)
৯। হযরত ওবায়েদ ইবনে মুসলিম আসাদী (রহঃ)
১০। হযরত আবদুল হালীম (রহঃ)
১১। হযরত শাহাদাত হুসায়নী (রহঃ)
১২। হযরত আবদুল কাহ্হার বাগদাদী (রহঃ) ।
এঁরা বিক্রমপুরের বিভিন্ন অংশ যেমন – মুন্সীগঞ্জ, স্বরস্বতী, কেওয়ার, মহাকালী,বজ্রযোগিনী, চম্পাতলা রাজবাড়ী, শ্রীপুর ও কার্তিকপুর প্রভৃতি এলাকায় ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন।
তথ্য সুত্রঃ মাসিক তরজুমান রবিউল আউয়াল সংখ্যা ১৪৩০ হিজরী। পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১৫৬-১৫৭।
ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর গ্রামে বারো আউলিয়ার মাযার রয়েছে বলে জানা গেছে। এরা হচ্ছেন –
১। হযরত উড়িয়ান শাহ্ (রহঃ) – ওফাতঃ দ্বাদশ শতাব্দী
২। হযরত ময়েজউদ্দিন কানী শাহ্ (রহঃ) – ওফাতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দী
৩।হযরত লাল শাহ্ (রহঃ) – ওফাতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দী
৪। হযরত কলিম উল্লাহ শাহ্ (রহঃ) – ওফাতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দী
৫। হযরত ময়েজউদ্দিন ইয়ামানী (রহঃ) – ওফাতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দী
৬। হযরত শাহ্ বোখারী বাগদাদী (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
৭। হযরত বুট্টি শাহ্ বাগদাদী (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
৮। হযরত যায়েদ শাহ্ বাগদাদী (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
৯। হযরত জালাল শাহ্ বাগদাদী (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
১০। হযরত মুছি শাহ্ হাক্কানী্ (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
১১। হযরত শাহ্ আলী ছতরী (রহঃ) – ওফাতঃ চতুর্দশ শতাব্দী
১২। হযরত আবদুল্লাহিল কাফী (রহঃ) – ওফাতঃ ষোড়শ শতাব্দী
তথ্য সুত্রঃ চরিতাভিধানঃ বৃহত্তর ফরিদপুর, লেখক- সাঈদা জামান ও মহসিন হোসাইন, প্রকাশকাল- ১৯৯২ খৃষ্টাব্দ।
“বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর গ্রামে একটা প্রাচীন মসজিদ আছে। এটি খুব সম্ভব সুলতানী আমলের শেষদিকে তৈরি হয়েছিল। এই মসজিদে অনেক নুতন কাজ করা হয়েছে। ফলে এর প্রাচীন রুপ বের করা কঠিন। সুলতানী আমলে তৈরি এটি চতুর্থ নয় গম্বুজ মসজিদ।”
তথ্য সুত্রঃ বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি – (দ্বিতীয় খন্ড- মুসলিম যুগ) লেখক- আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, প্রকাশকাল- ২০০৭ খৃষ্টাব্দ, পৃষ্ঠা সংখ্যা-২১৫।
খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকে তরফ রাজ (হবিগঞ্জ) আচক নারায়ণের বিরুদ্ধে সমরাভিযানে হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) এর সঙ্গে ছিলেন বারো জন আউলিয়া।
তাঁরা হলেনঃ
১। হযরত শাহ্ গাজী (রহঃ) -বিষ গ্রাম, (সিলেট) মাজার।
২। হযরত শাহ্ মজলিস আমিন (রহঃ) – উচাইল (সিলেট) নামক স্হানে মাজার।
৩। হযরত শাহ্ ফতেহ গাজী (রহঃ) – মাজার ফতেপুর (সিলেট)।
৪। হযরত সৈয়্যদ শাহ্ সায়েফ মিন্নাত উদ্দীন (রহঃ)- লস্করপুর (সিলেট) মাজার।
৫। হযরত শাহ্ আরেফীন (রহঃ) – মাজার লাউর (সিলেট)।
৬।হযরত শাহ্ তাজ উদ্দীন কুরাইশী (রহঃ) – চৌকী পরগনায় (সিলেট) মাজার।
৭। হযরত শাহ্ রোকন উদ্দীন আসোয়ারী (রহঃ) – মাজার সরাইল, ব্রাক্ষ্মণ বাড়ীয়া।
৮। হযরত শাহ্ বদর (রহঃ) – ভারতের বদরপুরে মাজার।
৯। হযরত শাহ্ মাহমুদ (রহঃ) – উর্দু বাজার, লস্করপুর (সিলেট) মাজার।
১০। হযরত শাহ্ সুলতান (রহঃ) – বদরপুর, (ময়মনসিংহ) মাজার।
১১। হযরত শাহ্ বদর উদ্দীন (রহঃ) – চট্টগ্রামের বকসীর হাটে মাজার।
১২। হযরত সৈয়্যদ আহমদ গিছুদরাজ (রহঃ) খড়মপুর, (আখাউড়া) মাজার।
তরফ বিজয়ের পর হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) তরফের শাসক নিযুক্ত হন। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলাধীন খোয়াই নদী বিধৌত মুড়ারবন্দে তাঁর মাজার রয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহঃ) এর ওফাত হয়।
তথ্য সুত্রঃ সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহঃ)- লেখকঃ এস, এম, ইলিয়াছ।
এছাড়া, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপ-জেলার বারো বাজার নামক স্হানেও বারো আউলিয়ার মাযার রয়েছে।
তথ্য সুত্রঃ বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি – (দ্বিতীয় খন্ড- মুসলিম যুগ) লেখক- আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, প্রকাশকাল- ২০০৭ খৃষ্টাব্দ, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৬৯-৭০, ৮৬।