বারো আউলিয়ার পুণ্য এবং ধন্য ভূমি চট্টগ্রাম। এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর, আউলিয়া, ফকির ও দরবেশদের বদৌলতে। চট্টগ্রামে আগত পীর আউলিয়া ফকির দরবেশদের মধ্যে হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহ) অন্যতম। চট্টগ্রামে তার আগমন সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ১২০০ খৃষ্টাব্দের পরে যে কোন সময় তিনি চট্টগ্রামে আগমন করেন। হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহ) এর মা-বাবা দু’জনই আল্লাহর অলী ছিলেন। উত্তর ভারতের পাকপত্তন নামক স্থানে ৫৮২ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবে তাঁর বাবাকে হারান। পুণ্যাত্মা মা তাঁকে লেখাপড়া করানো এবং ধর্মে অনুরক্ত করার ব্যাপারে তত্পর ছিলেন। ছেলে যাতে পাঁচ ওয়াক্ত নিয়মিত নামাজ আদায় করে সেজন্য তাঁর মা জায়নামাজের নীচে চিনির পুরিয়া রেখে দিতেন। বালক শেখ ফরিদ চিনির লোভে এক ওয়াক্ত নামাজও কাযা করতেন না। একদিন তাঁর মা ভুলবশত জায়নামাজের নীচে চিনির পুরিয়া রাখতে ভুলে যান। তাঁর মা তাঁকে নামাজ আদায় করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন “আমি যথাসময়ে নামাজ আদায় করেছি এবং জায়নামাজের নীচে চিনির পুরিয়া পেয়েছি।” ছেলের হাতে চিনির পুরিয়া দেখে তাঁর মা অবাক হয়ে যান এবং বুঝতে পারেন যে তাঁর ছেলে আল্লাহর কাছ থেকে গায়েবী সাহায্য পেয়েছেন। সেই দিন থেকেই তাঁর মা তাঁকে গঞ্জেশকর বা চিনির আকর বলে ডাকতে শুরু করেন।
হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর শরীয়ত, তরিকত, হাকিকত এবং মারেফত বিদ্যায় শিক্ষা লাভ করেন। তিনি হযরত ওমর ফারুক (রা) এর বংশধর ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ সুলতান মাহমুদ ঘোরীর শাসনামলে সম্ভবত ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে আফগানিস্তান হতে লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধরগণ কিছুদিন লাহোরে বসবাস করার পর ভারতের মূলতানে চলে যান। মূলতানেই তাঁর জন্ম হয়। তিনি মূলতানের বিখ্যাত আউলিয়া বুজুর্গদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহ) মায়ের আদেশে দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবত্ কঠোর সাধনায় মগ্ন ছিলেন। এই দীর্ঘ ৩৬ বছর দুনিয়ার কোন কিছুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। কথিত আছে, তিনি যে স্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাধনায় মগ্ন ছিলেন সে স্থানে আল্লাহর ইচ্ছায় ঝর্ণার সৃষ্টি হয়। সেই ঝর্ণা থেকে এখনো পর্যন্ত অনবরত পানি নির্গত হচ্ছে। এই ঝর্ণাটির নাম দেয়া হয়েছে শেখ ফরিদের চশমা। শত শত বছর ধরে এই ঝর্ণার পানি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে অতি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই ঝর্ণার পানি নেয়ার জন্য এখানে প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ আসেন। চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাসের সমৃদ্ধ সম্পন্ন এই স্থানটিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দর্শনীয় স্থানের রূপ দিয়েছেন।
দিল্লীর সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদের রাজত্বকালেই তাঁর আবির্ভাব হয়। সুলতান নাসির উদ্দিন ১২৪৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ১২৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর সিংহাসন রাজত্ব করেন। তিনি একজন ধর্মভীরু অমায়িক এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তিনি সুলতান হয়েও দরবেশদের মত জীবন-যাপন করতেন এবং অবসর সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফ নকল করে জীবিকানির্বাহ করতেন। দিল্লীর এই সুলতান হযরত শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহ) কে খুব শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করতেন। তাঁর উপদেশ মত রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এমনকি দেশ জয়ের ব্যাপারেও তাঁর কাছে দোয়া প্রার্থনা করতেন। হযরত শেখ গঞ্জেশকর (রহ) পরবর্তীতে দিল্লীর সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবানের কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ছিল। প্রখ্যাত পীর হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ) তাঁর অন্যতম খলিফা ছিলেন। হযরত শেখ খরিদ গঞ্জেশকর (রহ) তাঁর দীর্ঘ জীবনে আল্লাহর সাধনা এবং মানব সেবা করে পরিণত বয়সে ৬৬৬ হিজরীতে দিল্লীতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অসিয়ত করে যান যে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে যেনো হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ) এর আস্তানায় দাফন করা হয়। তাঁর পবিত্র মাজার দিল্লীর নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ) এর মাজার এলাকায় অবস্থিত। তাঁর পবিত্র মাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ জেয়ারত করতে আসেন।