সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহী, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ – ৩ এপ্রিল ১৩২৫) (উর্দু: حضرت شیخ خواجہ سیّد محمد نظام الدّین اولیاء), হযরত নিজামুদ্দিননামেও পরিচিত, হলেন ভারতীয় উপমহাদেশেচিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সূফি সাধক। ভারতে চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মহান সূফি সাধকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর মূল ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী হয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির সাথে মিলিত হয়। এই অনুযায়ী তাঁরা চিশতিয়া তরিকা মৌলিক আধ্যাত্বিক ধারাবহিকতা বা সিলসিলা তৈরী করেছেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, তাঁর পূর্বসূরীদের ন্যায়, প্রেম বা ইশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা বা পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা মানবতার প্রতি ভালবাসার জন্ম দেয়। জিয়াউদ্দির বারানি নামে চৌদ্দ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের উপর তাঁর প্রভাব এমন ছিল যে পার্থিব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্বিকতা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াবী চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে।
• জীবন
নিজামুদ্দিন আউলিয়া উত্তর প্রদেশের (দিল্লীর পূর্বে) বাদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। পাচঁ বছর বয়সে তাঁর পিতা, আহমদ বাদায়ুনি, মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মায়ের (বিবি জুলেখা) সাথে দিল্লীতে চলে আসেন। ষোলতম শতাব্দিতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল মোবারক রচিত আইন-ই-আকবর এ নিজামুদ্দিনের জীবনী উল্লেখ রয়েছে। বিশ বছর বয়সে, নিজামুদ্দিন পাকিস্তানের আজোধানে (বর্তমানে পাকপাত্তান) এ যান এবং সূফি সাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকারের, বাবা ফরিদ নামে অধিক খ্যাত, শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বাবা ফরিদ বর্তমান থাকা অবস্থায় তিনি প্রতি বছর রমজান মাস অতিবাহিত করতে আজোধানে যেতেন। আজোধানে তৃতীয় বার যখন গিয়েছিলেন, বাবা ফরিদ তাঁকে নিজের খলিফাহিসেবে মনোনিত করেছিলেন। এর কিছু দিন পর, যখন নিজামুদ্দিন দিল্লিতে ফিরে আসেন, তিনি বাবা ফরিদের পরলোক গমনের খবর শুনেন। গিয়াসপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আগে, নিজামুদ্দিন দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতেন। তিনি সেখানে তাঁর খানকা, একটি আধ্যাত্বিক স্থান যেখানে সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা হয় এবং তিনি সেখানে অন্যদের আধ্যাত্বিক শিক্ষা প্রদান করতেন, প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তাঁর নিজস্ব আবসস্থল ছিল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই খানকাটি গরিব-ধনীসহ সকল প্রকারের মানুষের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তাঁর অনেক শিষ্য আধ্যাত্বিকতার উচ্চ আসন অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে শেখ নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ চিরাগ-এ-দিল্লি, এবং প্রখ্যাত সূফি/গায়ক এবং দিল্লি সালতানাতের রাজ্যসভার কবি আমির খসরু। তিনি এপ্রিল ৩, ১৩২৫ সালে সকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মাজার, নিজামুদ্দিনের দরগাহ দিল্লিতে অবস্থিত। এবং বর্তমানে স্থাপনাটি ১৫৬২ সালে নির্মিত হয়।
• আধ্যাত্বিকতার ইতিহাস
নিজামুদ্দিন যখন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের নাম প্রথমবারের মত শুনেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বার কি তের বছর এবং তখন থেকেই ফরিদউদ্দিনের প্রতি তাঁর হৃদয়ে সম্মান ও ভালবাসার জন্মাতে থাকে। তিনি তাঁর শিষ্যগণকে বর্ণনা করেন, বাবা ফরিদ এর নাম শুনার পর তার মনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোন সূফি সাধকের নাম শুনে এমনকি তাদের সাথে সাক্ষাতের পরও তাঁর এ অবস্থা হয়নি। আগুনের ফুল্কির মত তার প্রেম বাড়তেই থাকে। যদি তাঁর সহপাঠীরা তারঁ দিয়ে কোন কাজ করাতে চেষ্টা করত তখন তারা বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিত এবং তিনি কখনও কেউ বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিলে সে কাজে মানা করতেন না। তিনি তাঁর জীবনে কারো জন্য এ ধরনের অনুভুতি অনুভব করেননি। বিশ বছর বয়সে পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি বাবা ফরিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর জীবিত জীবনে তিনি বাবা ফরিদের দরবারে তিনবার গিয়েছিলেন।
• শিষ্যগণ
তাঁর প্রায় ৬০০ এর বেশি খলিফা (খলিফা হচ্ছে একজন শিষ্য যাকে বায়াত গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয় এবং স্বীয় মুর্শিদ বা পীরের বংশানুক্রমকে বিস্তার করার দায়িত্ব দেয়া হয়) আছে যারা বিশ্বময় তার আধ্যাত্বিক সাজরাকে বজায় রেখেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত শিষ্যগণ হল:
১. নাসিরুদ্দির চিরাগ দেহলভী
২. আমির খসরু ( তিনি ছিলেন তাঁর পীর বা মূর্শিদের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। তিনি তাঁর মূর্শিদের এতটিই প্রিয় ছিলেন যে একদা নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেন, “যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সাথে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।” তিনি আরো বলেন, কেউ যদি আমার রওজা (সমাধিস্থল) জিয়ারত করতে আসে; তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে তারপর তাঁর রওজা। পীরের পরলোক গমনের কয়েক মাস পর তিনিও পরলোক গমন করেন। তাঁকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মাজার দিল্লী নয়াদিল্লীরনিজামুদ্দিন দরগাহে।)
৩. আখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ
৪. বোরহানুদ্দিন গরীব
৫. জালালুদ্দিন ভান্ডারী
৬. সৈয়দ মাহমুদ কাশকিনাকার
৭. আযান ফকির
• ওরশ
প্রতি বছর রবি সানি ১৭ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ওরশ (মৃত্যুবার্ষিকী) নিজামুদ্দিন দরগাহে পালিত হয় এবং শাওয়াল ১৮ তারিখে আমির খসরুর ওরশও পালিত হয়।