সূরা ফালাক্বঃ আয়াত ১, ২, ৩, ৪, ৫
বল, ‘আমি শরণ লইতেছি ঊষার স্রষ্টার
‘তিনি যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার অনিষ্ট হইতে,
‘অনিষ্ট হইতে রাত্রির অন্ধকারের, যখন উহা গভীর হয়
‘এবং অনিষ্ট হইতে সমস্ত নারীদের, যাহারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়
‘এবং অনিষ্ট হইতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে।’
প্রথমে বলা হয়েছে ‘ক্বুল আঊ’জু বিরব্বিল ফালাক্ব’ (বলো, আমি শরণ নিচ্ছি ঊষার স্রষ্টার)। এখানে ‘আল ফালাক্ব’ অর্থ অন্ধকার বিদীর্ণকারী ঊষালোক। জাবের
তাফসীরে মাযহারী/৬৪৫
ইবনে হাসান, সাঈদ ইবনে যোবায়ের, মুজাহিদ এবং কাতাদা এরকমই বলেছেন। ‘ফালিক্বুল ইসবাহ্’ আয়াতেও শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, ‘ফালাক্ব’ অর্থ বিদীর্ণ করা, ফেঁড়ে ফেলা। যেমন অর্থ গ্রহণ করা হয় ‘ফালিক্বুল হাববি ওয়ান নাওয়া’ আয়াত থেকে। যেমন সবজির বীজ ফেটে অংকুরোদ্গম ঘটে চারার। মেঘ ফেঁড়ে নামে বৃষ্টি। ভূমি বিদীর্ণ করে প্রবাহিত হয় স্রোতস্বিনী। গর্ভাশয় ফুঁড়ে বের হয় শিশু। জুহাক বলেছেন, এর মর্মার্থজ্জ সমগ্র সৃষ্টি। ওয়ালেবীর বর্ণনায় এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন ‘ফালাক্ব’ জাহান্নামের একটি বন্দীশালা। কালাবী বলেছেন, দোজখের একটি উপত্যকা। ইবনে জারীরের বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হোরায়রা বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, নরকের একটি অন্ধ কূপের নাম ‘ফালাক্ব’। ইবনে জারীর ও বায়হাকী লিখেছেন, আবদুল জব্বার খাওলাদী বর্ণনা করেছেন, একবার দামেশকে আমাদের কাছে আগমন করলেন রসুল স. এর একজন শ্রদ্ধেয় সাহাবী। তিনি রা. লোকদেরকে পার্থিব কাজকর্মে অতিরিক্ত মগ্ন হতে দেখে বললেন, এতে এদের কোনো মঙ্গল নেই। এদের সম্মুখে কি ফালাক্ব নেই? জিজ্ঞেস করা হলো, হে মাননীয় রসুল-সহচর! ‘ফালাক্ব’ কী ? বললেন, ফালাক্ব হচ্ছেনরকের একটি কুয়া। ওই কুয়ার মুখ উন্মুক্ত করা হলে তার ভিতর থেকে এমন উত্তপ্ত আগুন বের হবে যে, তার ভয়ে নরক নিজেই আর্তনাদ করে উঠবে।
ইবনে আবী হাতেম ও ইবনে জারীরের বর্ণনায় এসেছে, হজরত কা’ব বলেছেন, আল ফালাক্ব জাহান্নামের একটি গৃহ। ওই গৃহের দরজা যখন খোলা হবে, তখন তার ভয়াবহ উত্তাপ দেখে জাহান্নামবাসীরা ভয়ে চীৎকার করে উঠবে। জায়েদ ইবনে আলী তাঁর পিতৃস্থানীয় ইমাম হোসাইন ইবনে হজরত আলীর বরাত দিয়ে বলেছেন, আল ফালাক্ব হচ্ছেজাহান্নামের তলদেশের একটি কূপ।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘রব্বিল ফালাক্ব’ (ফালাক্বের প্রভুপালনকর্তা)। এরকম বলা হয়েছে একথাটি বুঝাতে যে, জাহান্নাম ও ফালাক্বের যিনি অধিপতি, তিনিই কেবল বাঁচাতে পারেন এদু’টোর ভয়ংকর অকল্যাণ থেকে। কাজেই এদু’টোর অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পেতে চাইলে শরণ গ্রহণ করতে হবে কেবল তাঁর।
পরের আয়াতে (২) বলা হয়েছেজ্জ ‘মিন শাররি মা খলাক্ব’ (তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে)। এখানে ‘মা খলাক্ব’ অর্থ যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টি। এভাবে বক্তব্যটি দাঁড়ায়জ্জ আমি যাবতীয় সৃষ্টির অমঙ্গল থেকে ফালাক্বের মালিকের নিকট আশ্রয় ভিক্ষা চাই। উল্লেখ্য, কোনো সৃষ্টিই অনিষ্টতামুক্ত নয়। আদম অর্থাৎ অনস্তিত্বের কলংক রয়েছে প্রতিটি সৃষ্টির মূলে। তবে ওই কলংক থেকে সৃষ্টি মুক্তি নিতে পারে কেবল আল্লাহ্পাকের জ্যোতিসমžাতের আলোকে আলোকিত হলে। তখন তার অপকর্ষতা রূপান্তরিত হয় উৎকর্ষতায়, যেমন আলোর উদ্ভাস ঘটলে অন্ধকারও হয়ে যায় আলো। যেমন
তাফসীরে মাযহারী/৬৪৬
এক আয়াতে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ্ তখন তার পাপকে পুণ্যে পরিণত করে দেন’। রসুল স. বলেছেন, আমার শয়তান মুসলমান হয়ে গিয়েছে। সে আমাকে ইষ্ট ব্যতীত অনিষ্টের পরামর্শ দেয় না। আল্লামা বায়যাবী লিখেছেন, আল্লাহ্পাক এখানেও কেবল সৃষ্টিজগতের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় যাচনা করতে বলেছেন। আধ্যাত্মিক জগতের উল্লেখ করেননি। কেননা সেখানে কোনো অনিষ্টতাই নেই। সেখানে তো কেবল কল্যাণ আর কল্যাণ। সৃষ্টিজগতের অনিষ্টতা কখনো হয় ইচ্ছাকৃত, যেমন জুলুম, অথবা স্বভাবগত যেমন আগুনের দাহিকাশক্তি, বিষের সংহারক ক্ষমতা।
এরপরের আয়াতে (৩) বলা হয়েছেজ্জ ‘ওয়া মিন শাররি গসিক্বিন ইজা ওয়াক্বাব’ (অনিষ্ট হতে রাত্রির অন্ধকারের, যখন তা গভীর হয়)। ‘গসাক্ব’ এর আভিধানিক অর্থ পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়া, ভরপুর হওয়া। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে ‘ইলা গসাক্বিল লাইলি’ (রাত্রের আঁধার পরিপূর্ণ হওয়া পর্যন্ত)। এভাবে ‘গসাক্বাল আ’ঈন’ অর্থ অশ্রুভরা আঁখি। ‘গসাক্বাল ক্বমার’ অর্থ পূর্ণ চন্দ্রালোক। কামুস অভিধানে লেখা রয়েছে ‘গসিক্ব’ অর্থ চাঁদ, এবং রাত; যখন অপসৃত হয় রক্তিম গোধূলি। ‘গাসাক্বুন’ এবং ‘আগসাক্বুন’ অর্থ অন্ধকার হয়ে যাওয়া।
কোনো কোনো বিদ্বান বলেছেন ‘গসাক্ব’ অর্থ প্রবাহিত হওয়া। এভাবে ‘গসাক্বাল লাইল’ অর্থ রাতের আঁধার ও কুয়াশায় ঘেরা। ‘গসাক্বাল আ’ঈন’ অর্থ অশ্রুপ্রবাহ। ‘গসাক্বাল ক্বমার’ অর্থ চাঁদের দ্রুত অস্তগমন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘গসাক্ব’ অর্থ শীতলতা, যেমন শীতের রাত দিবস অপেক্ষা শীতল। চাঁদ সূর্য অপেক্ষা কোমল। রাত ও চাঁদকে ‘গসাক্ব’ বলা হয় এ জন্যই। এরই ভিত্তিতে চাঁদকে বলে ‘যামহারীর’জ্জ অত্যন্ত শীতল।
এখানে ‘গসাক্ব’ অর্থ হবে চাঁদ। কেননা মাতা মহোদয়া আয়েশার বর্ণনায় এসেছে, এক রাতে রসুল স. আমার হাত ধরলেন এবং চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, আয়েশা! আল্লাহ্র নিকট ওই গসিক্বের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কোরো, যখন তা অস্তগামী হয়। স্বসূত্রে বাগবী।
‘ইজা ওয়াক্বাব’ অর্থ যখন তা গভীর হয়। অর্থাৎ যখন তা হতে থাকে দ্যুতিহীন, অদৃশ্য। বলা বাহুল্য, চাঁদ ক্ষয় হতে থাকে পূর্ণ কিরণ্ময় হওয়ার পর থেকে, পূর্ণিমা রজনী থেকে।
হজরত ইবনে আব্বাস, হাসান বসরী এবং মুজাহিদ বলেছেন ‘গাসাক্ব’ অর্থ রাত্রি। অর্থাৎ রাত্রির আগমনলগ্নে তার অন্ধকার আবৃত করে অপসৃয়মান আলোকে। ইবনে জায়েদ বলেছেন ‘গাসাক্ব’ অর্থ আকাশের নিচের দিকে অপসৃয়মান সপ্তর্ষিমণ্ডল, স্বল্প সময়ের মধ্যে যা চলে যায় অস্তাচলে। কারণ মানুষ বলে থাকে, সপ্তর্ষিমণ্ডলের অস্তগমনকালে প্রকোপ বাড়ে বিপদাপদের। আর সে বিপদ কেটে যায় তার উদয়কালে।
এরপরের আয়াতে (৪) বলা হয়েছেজ্জ ‘ওয়া মিন শাররিন্ নাফ্ফাছাতি ফীল উ’ক্বাদ’ (এবং অনিষ্ট হতে সমস্ত নারীর, যারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়)। এখানকার
তাফসীরে মাযহারী/৬৪৭
‘নাফ্ফাছাতি’ স্ত্রীলিঙ্গের বহুবচনীয় শব্দরূপ। শব্দটির বিশেষ্যপদ এখানে রয়েছে অনুক্ত। অর্থাৎ যাদুকর নর-নারী, যারা মন্ত্রতন্ত্র পাঠ করে এবং রসুল স. এর উপরে যাদু করার সময় সুতায় ফুৎকার দেয়। হজরত আবু উবায়দা বলেছেন, লবীদের নির্দেশে তার কন্যারাই এরকম করেছিলো।
শেষ আয়াতে (৫) বলা হয়েছে ‘ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইজা হাসাদ’ (এবং অনিষ্ট থেকে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে)। এরকম করে বলা হয়েছে এখানে একথাটি বুঝাতে যে, মনের ভিতরের গোপন হিংসা দগ্ধ করে হিংসাকারীকে। কিন্তু অন্যের জন্য তা ক্ষতিকর হয় তখন, যখন সে হিংসা প্রকাশ পায়। অর্থাৎ যখন সে অন্যের উপরে হিংসা চরিতার্থ করে।
উল্লেখ্য ‘তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে’ (আয়াত ২) কথাটির মধ্যে সব ধরনের অনিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। তার পরেও বলা হয়েছে ‘গসিক্ব’ ‘নাফ্ফাছাত’ ও ‘হাসিদ’ এই তিনটি অনিষ্টতার কথা। এর কারণ হল , রসুল স. এর উপরে যে যাদু করা হয়েছিলো তার মধ্যে ওই তিন ধরনের অনিষ্টতাই ছিলো। ছিলো যাদু, প্রতারণা ও হিংসা। আবার ‘হাসিদিন’ ও ‘গাসিক্বিন’ অনির্দিষ্টবাচক এবং ‘আন নাফ্ফাছাতি’ নির্দিষ্টবাচক। এভাবে এখানে তাদেরকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার কারণ হচ্ছে, লবীদের কন্যারা ছিলো নির্দিষ্ট ব্যক্তি। তাই তাদের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় যাচনা করা হয়েছে নির্দিষ্টবাচক শব্দরূপের মাধ্যমে। রসুল স. এর প্রতি হিংসাপোষণকারীরা অসংখ্য। আর তারা সুচিহ্নিতও নয়। তাই তাদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করার প্রার্থনা উপস্থাপন করা হয়েছে অনির্দিষ্টবাচক শব্দরূপের মাধ্যমে।
হজরত উকবা ইবনে আমের বলেছেন, আমি একবার রসুল স. এর পবিত্র সাহচর্যে উপসি’ত হয়ে বললাম, হে আল্লাহ্র প্রিয়তম রসুল! আমি সুরা ইউসুফ ও সুরা হুদ পাঠ করে থাকি। তিনি স. বললেন, আল্লাহ্র সঙ্গে সমžর্ক রক্ষাকারীরূপে সুরা ফালাক্বের মতো আর কিছু নেই। আহমদ, দারেমী, নাসাঈ। আল্লাহ্ই ভালো জানেন।