বৃষ্টি হয়েছে। পিচ্ছিল রাস্তা। একজন পিছলে গেল। আশপাশে সবাই হাসবে। হো-হো করে হাসবে। মিনিট পরে এগোবে। তাও সবাই না। দশে একজন।
বিষয়টা মাথায় রাখুন। এবার স্মৃতিচারণ করি।
তখন নবমে পড়ি। থাকি ভাইয়ের বাসায়। সাথে ঘুমাত বেয়াই। মানে ভাবির ভাই। বছর দুয়েকের ছোট। একদিন চমকে গেলাম। যেন ভূত দেখেছি। ঘটনটা এমন-
দু’দিন বাদ আশুরা। দশ মহরম। গ্রামে যাব। ব্যাগ গুছাচ্ছি। ছেলেটা প্রশ্ন করলো কোথায় যাই, কেন যাই? বললাম, আশুরার কথা। মওলা হুসাইন আলাইহিস সালামের কথা। তাঁর শাহাদাতের কথা। করবালার কথা। শেষে পাপাত্মা-এজিদের কথা। ছেলেটা তখনি চমকে দিল।
– ভাই, এজিদকে দোষ দিয়েন না। এজিদ ওখানে ছিল না। কোনো সহীহ হাদিসে এজিদের দোষ উল্লেখ নেই। এজিদ নির্দোষ। তাকে ‘রহমাতুল্লাহি আলাইহে’ বলা যায়। ইমাম গাজ্জালি এজিদরে মুসলিম বলছে। আবু হানিফা এজিদরে কাফের বলে নি।
সে বলেই চলছে। মিলাদ, মাজার জিয়ারত শিরিক। মাযহাব মানা হারাম। নিজে নিজে কোরান-সহীহ হাদিস পড়তে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে শুনতে শক খেলাম। দুহাজার ভল্টের শক। সে শক আপনাদের একটু দেই।
নামায কোন দিকে পড়েন? পশ্চিম দিকে। পশ্চিম দিকে কেন? ওদিকে কাবা তাই। যদি বলি মদিনা-মুনিব (দ) মক্কায় জন্মান নি। জন্মেছেন পেট্রানগরীতে। সেটা মক্কা-মদিনার দেশে না। অন্য রাস্ট্র জর্ডানে। এবং প্রমাণ করলাম। কো’আনের রেফারেন্স দিলাম। হাদিসের ব্যাখ্যা দিলাম। সেই কোর’আন-হাদিস যা আপনি জানেন, পড়েন। সে ইতিহাসবিদের বই দেখালাম যা সুবিখ্যাত। তখন কি করবেন? এড়াতে পারবেন? শক খাবেন না? আমিও তেমন খেয়েছিলাম।
যা-হোক, ছেলেটার কথায় আসি। তার মুখ চমকাচ্ছে। মজা পাচ্ছে। ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। সেয়ানা-সেয়ানা ভাব। আমাকে বাগে পেয়েছে। কোথায় জেনেছ এসব? জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিল বুক ফুলিয়ে। সে আহালে হাদিস, সালাফি। তারাই একমাত্র সঠিক। বাকি সবাই মুশরিক-বেদাতি-জাহান্নামি।
কসম খোদার। আগে এ নাম শুনি নি। জানতাম না কিছু। তাই উত্তর দেই নি। আস্তে আস্তে জেনেছি পরে।
এবার মূল কথা। পিছলানোর কথা মনে আছে? প্রথমে বলেছি। কখনো ভেবেছেন মানুষ কেন হাসে? একজন কষ্ট পাচ্ছে। অন্যজন হাসছে।
এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যা এমনিতে থাকে, অর্জন করতে হয় না, তাই সহজাত প্রবৃত্তি। যেমন ‘অশিক্ষা’। জন্ম থেকেই কেউ শিক্ষিত না। পরিবেশ, প্রতিষ্ঠান শিক্ষিত করে। সময় লাগে। পরিশ্রম, কষ্ট লাগে। এটা অর্জন।
তো এই যে হাসাহাসি। এটা অমানবিকতা। যেটা এমনিতেই থাকে। মানবতা অর্জন করতে হয়। একটি মানসিক ব্যাখ্যা আছে। বিষয়টা এমন। তুমি পরেছ, আমি দাঁড়িয়ে; আমি সেরা, শক্তিশালী; তুমি পরাজিত। এক প্রকার পাশবিক তৃপ্তি পায় মানুষ।
শিক্ষা মানবতা বিকশিত করে। নম্র, অনুগত করে। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হাসবে না। এগোবে সাহায্য করতে। এটাই সহজাত প্রবৃত্তি আর শিক্ষার পার্থক্য।
এখন ছেলেটার কথা ভাবুন। সে বয়সে ছোট, আমি বড়। আমি পরাজিত। সে বিজয়ী। অবচেতনে আনন্দ পাচ্ছিল। তার ভাবনাটা অনেকটা এমন। আরে পাইছি। শায়েখে ঠিকই কইছে। আমাগো রেফারেন্সের সামনে কেউ খাড়াইতে পারে না।
এদেশের বেশির ভাগ মানুষের অবস্থা, আমার নাইনে থাকা অবস্থার মত। অত বেশি জানে না। প্রায় কিছুই জানে না। তথ্যের শূণ্যতা রয়েছে। ভয়ংকর শূণ্যতা।
এদের সামনে দুই-তিনটা রেফারেন্স ঝাড়ুন। কয়েকটা বইয়ের নাম বলুন। যা সে বাপের জনমে শুনে নি। গলায় জোর রাখুন। বুক ফুলিয়ে দাঁড়ান। দেখবেন সবাই মাথা ঝুকাচ্ছে। ভাববে খাইছে রে! এ তো বিদ্যার জাহাজ। কারণ শূণ্য পাত্রে যাই রাখবেন, রাখা যাবে। ভরা পাত্রে রাখা কষ্টসাধ্য।
তখন আপনি তৃপ্ত হবেন। নিজেকে বিজয়ী ভাববেন। কারণ সামনের সবাই পরাজিত। পিছলে পরা মানুষকে দেখে যেমন হেসেছিলেন, তার পরাজয়ের কারণে।
ভরা নদী। স্রোত বইছে। নদীতে নৌকা ভাসান। স্রোতের বিপরীতে নৌকা আনুন। কষ্টকর, তাই না? অন্যদিকে স্রোতের দিকে নৌকা ঠেলুন। ঠেলতেও হবে না। এমনিতে এগোবে।
এই স্রোতটা হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তি। ইসলাম যাকে বলে ‘নফস’। নফসের দিকে এগোতে থাকুন। শক্তি, পরিশ্রম কিছুই লাগবে না। কারণ শয়তান নিজেই এখানে সাহায্যকর্তা। সে শপথ করেছিল, আমি আদম সন্তানের রগে-রগে দৌড়াবে।
অন্যদিকে স্রোতের বিপরীতে আসুন। কষ্ট করতে হবে। অধ্যাবসায় লাগবে। এটাই নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটাই সবচে বড় জিহাদ। নিজের প্রবৃত্তি, নফসের সাথে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে, পরিশ্রমে সবাই আসবে না। মিস্টার ইবলিস আসতে দিবে না। স্রোতের দিকেই দৌড়াবে।
ওহাবি-সালাফিরা একারণেই জনপ্রিয়। এরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতে সুড়সুড়ি দেয়। মানুষের অহংকার জাগ্রত করে। সালাফিরা নিজেকে সত্যের মানদণ্ড ভাবে। অন্যদিকে ইসলাম বলে আনুগত্য করো। তাকলিদ করো। বিনয়ী হও। মেনে নাও। মনে রাখিও, তুমি আদি-অনাদির সব কিছু জানো না। তুমি মহাবিশ্বের কেন্দ্র না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সালাফি যুবক। যারা কয়েক বছর আগেও কিশোর ছিল। কিশোরেরা ভিন্ন রকম। শরীরে আগুন থাকে। অনেকটা উত্তপ্ত লোহার মত। যেভাবে পেটাবেন আকৃতি নিবে।
আর কিশোরেরা সংগ্রামী হয় অবচেতনে। কারণ সমাজে তাদের স্থান তখনো প্রতিষ্ঠিত না। নিজের স্থান করে নিতে চায়। ব্যতিক্রম কিছু করলেই দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।
সালাফিবাদ নতুন কিছু। মানুষ এদের কথায় অবাক হয়। কিশোরেরা তখন নিজেদের সুপারম্যান ভাবা শুরু করে। নিজেকে বিশেষ কিছু ভাবে।
সে মসজিদের ইমামের ভুল ধরতে পারে। যে পীর সাহেবেরে সবাই সম্মান করে, তাকে গালি দিতে পারে। যে বাবা পকেট খরচের টাকা ঠিক মত দেয় না, তার ভুল ধরা যায়। বলা যায়- কি ধর্ম পালন করো? এসব তো শিরিক-বেদাত। আমি সঠিক। আমি সত্য।
অনেক বকলাম। শেষ করছি। ওহাবি-সালাফিবাদ একটা নেশা। ইয়াবার মতই ভয়ংকর। আমি অন্তত তাই মনে করি। এটি প্লেগ রোগের মতই ছড়িয়ে পরেছে প্রজন্মে। পচে যাচ্ছে প্রজন্ম।
তবুও স্বপ্ন দেখি। কারণ ইসলাম, আহলে সুন্নাত এরকম সমস্যা আগেও দেখেছে। আটশ বছর আগে। আব্বাসী যুগে। ওহাবি-সালাফিদের মত তখন ছিল মুতাজিলা। মুতাজিলা একটা ফেরকা, ভিন্ন সম্প্রদায়। প্রায় দু’শো বছর জ্বালিয়ে মেরেছে।
কিন্তু খোদার রহমত থামে নি। আল্লাহ দু’জনকে পাঠিয়েছিলেন। একজন ইমাম আশয়ারী। অন্যজন ইমাম মাতুরিদী। দুজনেই আমাদের আকাইদের ইমাম।
এ যুগেও কেউ আসবেন। আশায় বুক বেঁধেছি। ইমাম আ’লা হযরত এঁর মতই চূড়ান্ত আঘাত হানবেন বাতিলের দূর্গে।
প্রজন্ম তখন আবার গাইবে গলা ছেড়ে। দু’চোখে থাকবে অশ্রু। বুকে প্রেমের আগুন। যে প্রেমের উৎস মদিনা। বাতাসে থাকবে গুঞ্জন এই সুরের-
ইয়া নবী সালাম আলাইকা
ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা
ইয়া হাবীব সালাম আলাইকা…