ভেড়া চিনেন? ভ্যাঁ ভ্যাঁ ডাকে। বড় বিচিত্র জীব। একটা গর্তে পরেছে। বাকিগুলাও দৌড়াবে। ধুপধাপ পরবে। এটা ভাববে না, গর্তে পরলে মরতেও পারে।
আমরা অনেকটা ভেড়ার মত। হুজুগে মাতাল। ধরুন, সাঈদীর চন্দ্রাভিযান। সাইদী প্রথম বঙ্গদেশী, যে চাঁদে চড়েছে। রকেট লাগে নি। জেলখানা ভাঙেনি। তবুও তিনি চাঁদে। কোনো প্রজেক্টের লাগে নি। বঙ্গবন্ধু স্যাটলাইট লাগে নি। পুরো চাঁদেই তার চেহারা ভেসেছে। খবরটা পেলাম মধ্যরাতে। প্রতিবেশী মহিলা দরজা ধাক্কাচ্ছিল। যার আইকিউ বানরের সমতুল্য। দরজা খুললাম। ভয়ে আছি। এত রাতে কি হল! মহিলা বলে- আসেন! আসেন! দেইখা যান, চাঁদের বুকে তাকান, সাঈদীর চেহারা ভাসমান।
মিনিট তিনেক দেখলাম। কিছুই দেখি না। শুধু গোল চাঁদ। বললাম- আপা যাই। মহিলা ছাড়ে না। জিজ্ঞেস করে কি দেখলাম। বুঝলাম মুক্তি মিলবে না। কিছু বলতেই হবে। আপা! সত্যি তো! পুরাই সাঈদী। জেলে গিয়ে মুটিয়েছে। চিকন চেহারা গোল হয়েছে। চেহারায় নূর (জোছনা) চমকাচ্ছে। জেলে মনে হয় ‘ফেয়ার এণ্ড হ্যাণ্ডসাম’ মাখে। আহা! কি হ্যাণ্ডসাম পুরুষ। দেখেন আপা, সাঈদী টুপি পরে নাই। মাথার টাক দেখা যায়। সাঈদীর মাথায় চুল নেই, জানা ছিল না। একি! আপা! নিচের দিকে তাকান। সাঈদীর দাড়িও নেই। মোছটাও খুঁজে পাচ্ছি না। থাক, দাড়ি-মোছ না থাক। ভ্রু-জোড়াও দেখছি না। আরে! চোখ দুটা কই? নাক-মুখও নেই দেখি! চিন্তা করিয়েন না আপা। টুপি-দাড়ি-মোছ-ভ্রু-চোখ-মুখ ছাড়াও এটা সাঈদী। ডাবের মত গোলগাল সাঈদী। হলফ করে বলছি।
চিন্তা করুন। এই মহিলা সাঈদীর ওয়াজ শুনেছে। শুনেছে অলি-আল্লাহদের ক্ষমতা নেই। মাজারে শামিয়ানা দেয় কেন? মশা কামড়ায় নাকি? সাঈদীর এই টিটকারিও শুনেছে। শুনেছে আউলিয়াগণের কারামত মিথ্যা, ভণ্ডামি। এখন সে মহিলাই চান্দের বুকে সাঈদীরে দেখে। আজব না?
বলেছিলাম ভেড়ার কথা। এদেশের আম-জাম-জনতা এমনি। একটা কিছু শুনলেই হল। হাউকাউ করে উঠবে। জামাত-শিবির এই ‘ভেড়া-নীতি’ কাজে লাগাতে জানে। খুব ভালো ভাবেই জানে। আসুন ধাপে ধাপে জানি।
জামাতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী। সে জানত লোকে শুনবে না। তার দর্শন মানবে না। তাই ইসলামকে ব্যবহার করল। কারণ, ইসলাম একটি নেটওয়ার্ক। নিরবিচ্ছিন্ন চেতনা। জালের মত। পরস্পরের সাথে যুক্ত। একটি সুতা টানলেই হল। বাকিগুলো নড়বে অটোম্যাটিক। এতে সহজেই সমাজে সাড়া পরবে।
কিন্তু মুসলিমেরা সুসমৃদ্ধ জাতি। হাজার বছরের ইতিহাস আছে। এখন মওদুদী ইতিহাস পাবে কই। দশ মাসে তো পয়দা সম্ভব না। তাই বলতে লাগল সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কথা। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এঁর কথা। যারা মুসলিমদের মহাবীর। যাদের শ্রদ্ধা মুসলিমদের হৃদয়ে। বলল, সালাউদ্দিন আইয়ুবী খৃষ্টান মেরেছে। জেরুজালেম দখল করেছে। বলল, খালিদ বিন ওয়ালিদ মুশরেক মেরেছে। জেহাদ করেছে। তোমরাও জেহাদ করো। মুশরেক মারো, জবাই করো, রগ কাটো।
কিন্তু সত্য লুকালো। এটা বলল না, সুলতান সালাউদ্দিন সূফী ছিলেন। গাউসে পাক আব্দুল কাদের জিলানীর প্রেমিক ছিলেন। এটা বলল না, তিনি জেরুজালেম দখলের পর হাজার খৃষ্টান মুক্ত করেছেন। নিজ কোষাগার থেকে অর্থ দিয়েছেন। জেরুজালেম ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলিম সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন। বলল না- তিনি জবাই-হত্যাতে বিশ্বাসী না। তিনি ক্ষমা-মানবতাতে বিশ্বাসী।
বলল না- খালেদ বিন ওয়ালিদ এঁর পুরোকথা। যুদ্ধের ময়দানে তিনি হেলমেট খুঁজছিলেন। হন্য হয়ে খুঁজছিলেন। কারণ হেলমেটের ভেতর মদিনা-মুনিব (দ) এঁর পবিত্র-চুল ছিল। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সে পবিত্র চুলের বরকতেই যুদ্ধ বিজয়ী হন।
এসব তারা বলবে না। এসব তাদের ধর্ম না। একথা আহলে সুন্নাত বা ইসলামের মূল ও প্রকৃতধারা। সূফিধারার কথা। এ ধারায় আছে খোলাফায়ে রাশেদা। সাথে সাথে আহলে বায়েত। তাওহীদের সাথে রেসালাত আছে। ফেকাহ ও মাযহাব আছে। আকাইদের সাথে ফালসাফা (দর্শন) ও কালাম শাস্ত্র আছে। ইবাদতের সাথে ইশক (প্রেম) আছে।
জামাতের ফরমালিন যুক্ত তাওহীদ আছে। রেসালাত নামে মাত্র। খোলাফায়ে রাশেদাকে ঠেকায় পরে মানে। কিন্তু আহলে বায়েত বা নবীবংশ তাদের গাঁ জ্বলা বিষয়। ফেকাহ-মাযহাব-ফালসাফা-কালাম-ইশক তো পুরাই শিরিক। অতএব এরা ইসলামের নামে চলতে লাগল। কিন্তু ভেতরে ছিল এজিদ-ইবনে তাইমিয়া-ইবনে নজদীর বিষাক্ত দাঁত।
তারা বিপ্লব চাইছিল। বিপ্লবটা ইসলামের না। তাদের নব্য ওহাবীবাদের। তাই উস্কানো শুরু হল। সমাজের বিশৃঙ্খলা বাড়ালো। সূফিদের সহস্রাব্দে গড়া সমাজ-নীতি-মূল্যবোধে কুড়াল চালালো। মানুষকে জঙ্গি হবার মন্ত্র দিল। জেহাদ-জেহাদ জিকির উঠাল। আর আম-মানুষ, তারা আর কি করবে! ভেড়ার মতই গর্তে লাফাল। আল-বদর, আল-শামসে নাম লিখাল। হলি আর্টিজেনের আব্রাস হল। বাংলা ভাই হল। শাহ জালালের মাজারে বোমা ফুটালো। আবার, সাঈদীকে চাঁদেও দেখল।
জেহাদ-জেহাদ করা হল। কিন্তু জেহাদের মাল-মশলা দরকার। মাল-মশলা মানে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান সাহিত্য-কবিতা। ওহাবী-জামাইত্তাদের কবি নেই। কি করা যায়? ইতিহাসের মত কবি-কবিতারও রগ কাটল। জেহাদ-জঙ্গি ফিল্টারে ছাঁকতে লাগল কবিদের। কখনো ধরল ইকবালকে, কখনো নজরুলকে। অবশেষে ফররুখকে। কবিদের শুধু জাগরণী রচনাই বেঁছে নিল। কিন্তু সমস্যা এখানেও। ইকবাল হালকা বিদ্রোহী হলেও পুরাই সূফী। নজরুল বিদ্রোহী হলেও সাম্যবাদী। একদিকে লিখেন মুসলিমদের নাত। অন্যদিকে হিন্দুদের কীর্তন। ফররুখ আহমেদ তো গাউসে পাক, নূরে সেরহিন্দ কবিতাও লিখে বসেছে। যাঁরা সূফিদের প্রতিভূ, প্রধান। তাই চাইলেও এদের জামাতি ট্যাগ লাগানো যায় না।
এজন্যই জামাতিরা সাহিত্যক বানানো শুরু করে। ‘ফুলকুঁড়ি’ একটা সংগঠন ছিল, আছে। একসময় ঘরেঘরে এর সদস্য ছিল। কবিতা লিখা, ছবি আঁকা, বিভিন্ন কাজ করত। বাচ্চাদের কাছে টানত, টানে। গোপনে বীজ বপন করে নিজেদের। সুফল তারা পেয়েছে। আজকে এতকিছুর পরেও তারা টিকে আছে। আজকে বেশিরভাগ চটকদার বই, যা ইসলামের নামে মোড়ানো, তা তাদেরই লিখা। ‘বই মেলায়’ একটা বই নিষিদ্ধ হয়েছিল না? এরপর মানুষ ভেড়ার মতই ঝাপিয়ে পরল। সে লেখক যে জামাতের ফসল, তা বুঝনেওয়ালা সবাই বুঝে।
মজার বিষয় হচ্ছে- এরা এরদোগানকে নিয়েও বই লিখে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। অথচ এরদোগান মিলাদুন্নাবী করে। মাজার জিয়ারত করে। পীরের মুরিদ। জামাত এখানেও নিজ রূপে হাজির। এরা ভেল্কিবাজ। যেমন খুশি তেমন সাজে। আবার কৃমিও বলতে পারেন। পাকস্থলীর খাবার খায়। দেহের পুষ্টি চুরি করে। আবার রোগও সৃষ্টি করে।
এরপরে জামাত রাজনীতিতে আসে। ‘ভেড়া জনতা’ ভোট দেয়। জামাত নির্বাচিত হয়। গাড়িতে বাংলার পতাকা লাগায়। এদের লজ্জা বলতে কিছু নেই। দ্বিতীয়ত অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাত দখল করে। শিক্ষাখাতেও আসে। ভার্সিটি কোচিং বাণিজ্য চালু করে। ভার্সিটির ছেলেটা দেশের ভবিষ্যৎ। ভার্সিটি যাবার আগেই জামাতের ফিল্টারে চেতনা ছেঁকে নেয়। সে দেশকে কোথায় টানবে? আপনারাই ভাবুন।
সবকিছুই হল। কিন্তু জামাত তার মূলরূপ দেখাচ্ছিল না। বা পারছিল না। কারণ ভিত্তি নেই। ভিত্তিটা অস্তিত্বের। জোঁকের মত বাঁচছিল এতদিন। মাযহাবি-সুন্নি-সূফিদের রক্ত চুষে-চুষে। ইসলামের সেন্সেটিভ-স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিত না। কিন্তু এরমধ্যেই ঘটনা ঘটল। টাই-শায়েখের আগমন হল। টুকরা (piece) টিভিতে নাটক শুরু হল। ভেড়া জনতাও ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে উঠল।
এই স্রোতটাকে কাজে লাগাল জামাত। সবচে সফল ভাবে। সালাফিরা তাদের জমজ ভাই। আকিদা এক। জঙ্গি দর্শনে বিশ্বাসী। ব্যাস! আর পায় কে! দীর্ঘদিন ধরে তারা নেটওয়ার্ক বানিয়েছে। শিবিরের মাধ্যমে কিশোর-যুবক প্রজন্মকে বেঁধেছিল। এখন সেই বাঁধনে সালাফিবাদের ইঞ্জেকশন ঢুকালো। হুহু করে আহালে হাদিস-সালাফি গজালো। ব্যঙ্গের ছাতার মত। দেখতে সুন্দর, কিন্তু বিষাক্ত।
এটাই জামাতিদের সবচে বড় সফলতা। জামাত-শিবির নামক সংগঠন ধ্বংস হতেও পারে। কিন্তু ওহাবি-সালাফি চেতনা ধ্বংস করা যাবে না। অন্তত এতদ্রুত না। কারণ জামাত-শিবির রাজনৈতিক দল। কিন্তু ওহাবি-সালাফিবাদ মানুষ ধর্মচেতনা হিসেবে নেয়। আর যতই কিছু করুন, ধর্ম ধ্বংস হয় না। তাই একজন সালাফি ঘুমন্ত জামাতি। গণিত তাই বলে।
শেষ কথা। এতক্ষণ অঙ্ক করলাম। এবার ফলাফল বলি। জামাতিরা সফল। পুরাদমে সফল। এরজন্য আমরাই দায়ী। আমাদের ভেড়া প্রবণতা দায়ী। সামনে দিনগুলো হয়ত ভয়ংকর। হয়ত মানুষ ওহাবি-সালাফিবাদকেই ইসলাম ভাববে।
জানি না মুক্তি মিলবে কিনা। ইমাম আ’লা হযরত বলেছিলেন – সুনা জাঙ্গাল রাত আন্ধেরি ছায়ি বাদল কালি হ্যাঁয়; আখোঁ কি কাজল সাফ চুরালে চোর অ্যায়সে বালাকি হ্যাঁয়। অর্থাৎ – এ যুগ হচ্ছে শূণ্য জঙ্গল। আকাশে কালো মেঘ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরসাথে আছে চোরের উপদ্রব। চোর এতই চালাক যে চোখের কাজলও চুরি করে।
আসলেই তাই। ঈমান আপনার-আমার চোখ। চোখের সৌন্দর্য। এ ঈমান জামাতি-ওহাবি-সালাফিরা কখন চুরে করছে, প্রজন্ম তা বুঝতেও পারছে না।
খোদা! এ জাতির ভাগ্য তুমিই জানো।
লিখেছেন – কবি মাহ্দী গালিব