কারবালা শেষ। এজিদ মসনদে। তিন বছরেই মরল। ৬৪ হিজরি, ৬৮৪ সালে। এরপর আসলো ঝড়। এজিদের যে বাহিনী ছিল কারবালায়, সেটার হোতারা মরতে লাগল। যেনতেন মৃত্যু না। মৃত্যুও ভয় পেয়েছে সে মৃত্যুতে। এজিদ অজানা রোগে মরেছে। কিন্তু বাকিদের মৃত্যু- বিশাল বিভীষিকা!
আমর বিন সাদ। সে ছিল সেনাপতি। সে ও তার ছেলের মাথা কাটা হয়। পাঠানো হয় মদিনায়। মুহাম্মদ বিন হানাফিয়ার কাছে। তিনি মওলা হুসাইনের ভাই, সৎভাই।
হাওলা বিন ইয়াজিদ। সে মওলা হুসাইনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করেছিল। তার হাত-পা কেটে শূলে চড়ানো হয়। লাশ জ্বালানো হয়।
শিমার। মওলা হুসাইনের গলায় ছুরি চালিয়েছে। সে স্রেফ দু’ টুকরা হয়। হাকিম বিন তোফায়েল। মওলা হুসাইনকে তীর ছুঁড়েছিল। তার মাথা বর্শার আগায় নাচানো হয়। বাদর নাচের ডুমড়ির মত।
ইবনে জিয়াদ। সব’চে পাপিষ্ঠ। ইয়াজিদের পরে। তার মাথা, দেহ আলাদা করা হয়। দেহ দহন হয় আগুনে। মাথা বর্শার ডগায় কুফায় আসে। কুফা তখন প্রতিশোধের ঘাঁটি। এভাবে আরো অনেক। একজনও পার পায় নি। জানিয়ে রাখি, কুফা ইরাকের শহর। মওলা আলী একে রাজধানী করেছিলেন।
প্রতিশোধটা প্রাণের দাবী। তা নেয়া হয়েছে। কিন্তু কে নিয়েছে? নিশ্চই প্রশ্ন জাগছে? যে করেছে সে মহাবীর। এমনটা ভাবছেন হয়ত। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন। সময়ে জানতে পারবেন।
তার নাম মুখতার সাখাফি। তায়েফে জন্মায়। আরবের একটি প্রদেশে। ৬২২ সালে। পরে কুফায় স্থায়ী হয়। প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ইবনে জিয়াদ তখন কুফার গভর্নর। তার প্রতিপক্ষ ছিল সাখাফি। সাখাফি থাকলে এজিদের হুকুম চলবে না। তাই তাকে জেলে ঢুকানো হয় কৌশলে।
কারবালার ঘটনা শুরু-শেষ হয়। সাখাফি তখন জেলে। অনেক পরে বেরোয়। কূটনীতি খাঁটিয়ে। বেরিয়ে দেখে সব খতম। মওলা হুসাইন শহীদ হয়েছেন। পাল্টেছে খেলাফতের মানচিত্র। সে প্রতিজ্ঞা করে, কারবালার বদলা নিবেই নিবে। তাই করেছিল। ধীরেধীরে দল গুছায়। কিন্তু অ্যাকশনে নামতে-নামতে এজিদ ভূত হয়। বড় বাঁচা বাঁচে। কিন্তু চ্যালা-চামুণ্ডারা নিস্তার পায় নি। একেএকে প্রাপ্য পেয়েছে। যা আগেই লিখেছি।
এখন ভাবুন। নিরপেক্ষ হয়ে ভাবুন। সাখাফিকে মহানায়ক মনে হচ্ছে? সে অন্যায়-অসত্য নিঃশেষকারী। এমনটা ভাবছেন। ভাবাটাই স্বাভাবিক। লিকিন পিকচার আভি বাকি হ্যাঁয়।
জমহুর মানে সিংহভাগ, বেশির ভাগ। ইসলামের, আহলে সুন্নাতের জমহুর ইমামগণের ‘সাখাফি’ কেন্দ্রিক বক্তব্য নেতিবাচক, নেগেটিভ। ইমাম আ’লা হযরতও তাকে ‘মুরতাদ’ বলেছেন। যে আগে মুসলিম ছিল, পরে ঈমান হারা হয়েছে; সেই মুরতাদ। অর্থাৎ- সাখাফির প্রতিশোধ কেন্দ্রিক-কাজ ইতিবাচক। কিন্তু তার শেষজীবন অশুদ্ধ।
কেন! কেন এমন? কারণ, সে শেষ-সময়ে নবুয়ত দাবী করে। শিয়া ভাইদের চেতনা ভিন্ন। তাকে মহাবীর ভাবেন। কিন্তু শিয়াদের ইতিহাস দিয়েই প্রমাণ হয়েছে সাখাফি পথভ্রষ্ট হয়েছিল। তথ্য কমেন্ট বক্সে দিচ্ছি।
আবার হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে ধরুন। কোর’আনে যের-যবর লাগিয়েছে। যা আজকের কোরআনে পাই। হাজ্জাজের আগে যের-জবর ছিল না। সে পাকিস্তান পর্যন্ত ইসলাম ছড়িয়েছিল। বিশাল অবদান। কিন্তু তাকেও মানা হয় না, সাখাফির মত। জমহুর ইমামের মত সে ধর্মচুত্য। এখন চাইলেই যের-যবর সরাতে পারবেন? সম্ভব না। হাজ্জাজ মুসলিম মেরেছে হাজার-হাজার। বেয়াদবি করেছে মসজিদে নববীতে।। এতটাই পাপিষ্ঠ। অতএব, তাকে মানা হচ্ছে না। কিন্তু তার নির্দিষ্ট কাজকে মানা হচ্ছে।
ইসলাম-মুসলিম অবদান অস্বীকার করে না। কিন্তু একটি অবদান ব্যক্তির অন্য অপরাধের বদলা, এক্সচেঞ্জ না। যদি না তওবা করে। সাখাফি-হাজ্জাজের অবদান মানা হয়। নির্দিষ্ট কাজ মানা হয়। কিন্তু তাদের না। কারণ, তারা অস্বীকার করেছে আকাইদ (creed), মৌলিক বিশ্বাসকে। ইসলামের স্তম্ভ, খুঁটিকে।
একই ভাবে কেউ ‘তুলনা মূলক ধর্মতত্ব’ আলোচনা করল। খ্যাতি কামালো। দলেদলে মুসলিম বানালো। কেউ ফেবু-ব্লগে-বইমেলায় রাজ্য উদ্ধার করলো। নাস্তিকের নাভিশ্বাস ওঠাল।
কিন্তু বলল, নবী দোষে-দূর্বলে মানুষ। কেউ বলবে, তাকে আজকের যুগে না মানলেও চলে। বিরোধীতা করলে বলবে জিহ্বার ভুল। তওবা করবেন না। তাদেরি কেউ বলবে আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন। কিন্তু বলেন না। তিনি আরশে আছেন। তার শরীর আরশের থেকে চার আঙুল বড়। আল্লাহ নিচে নামেন। আমরা যেমন সিঁড়ি বেয়ে উঠি-নামি। যেসব ব্যক্তিদের প্রায়-পুরো উম্মাহ (জাতি) ধিক্কার দিয়েছে, তাদের নায়ক বানাবে। প্রজন্মের থেকে প্রজন্ম ধরে বিধৌত-পরিশুদ্ধ নীতি-আইন অস্বীকার করবে।
যে সাধকেরা মা-মাটি ছেড়ে, রোদ-বৃষ্টি-নদী-জঙ্গল-বাঘ-সাপ-ক্ষুধা-তৃষ্ণা তোয়াক্কা না করে, দূরে-বহুদূরে, ইসলাম ছড়িয়েছেন; তাদের অসম্মান করবে। ‘মশারী কেন, মশা কামড়ায় নাকি’ টিটকারি মারবে। তাদের স্মরণকে শিরিক-বিদাত বলবে।
যখন রক্তঝরা-সম্ভ্রমহারা ফেব্রুয়ারি-মার্চ-ডিসেম্বরকে, দেশের পতাকাকে অবজ্ঞা করবে। ইসলামকে শুধুই হুর-গেলমানের ধর্ম বানাবে। সেই লোভে প্রজন্ম জঙ্গি হবে। বলবে, বিন-লাদেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাংলাভাইয়ের গুণগান গাইবে। ইসলামকে একটি ভীতিপ্রদ, আতঙ্কের অবয়বে পরিণত করবে। হাজার বছরের মূল্যবোধ-চেতনা-সংস্কৃতিতে লাথি মারবে। হাজার সাহাবার মাজার ভাঙবে।
কথায় কথায় রেফারেন্স চাইবে। কোরআনের আয়াত দিবেন। বলবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকারী ভুল। হাদিস দিবেন। চাইবে সহিহ হাদিস। মানে হাসান ও অন্যান্য মানের হাদিস হওয়ায় লাল-দোপাট্টা উড়িয়ে এসেছে। সেগুলো হাদিসই না। যাক, সহিহ হাদিস দিবেন। বলবে, প্রকাশনী ভুল। প্রকাশনী নিখুঁত দেখাবেন। বলবে- তোরা মাজার পূজারী! তোরা বানোয়াট। আমাগো শায়েখ ঠিক।
তার শায়েখ ঠিক। ১৩২৮ সালে দামাস্কাসে মরা, ১৭০৩ তে নজদে জন্মানো, ১৯৯৯ তে পটোল-তোলা শায়েখেরা সঠিক। ৮০ হিজরির আবু হানিফা ভুল। ৮৩২ এ জন্মানো মাতুরিদি ভুল। ১০৭৯ তে জন্মানো আব্দুল কাদির জিলানি ভুল। বইমেলার বেস্টসেলার সঠিক। কিন্তু ‘জজবুল কুলুব’-‘মাদারেজুন নবুয়ত’-‘মসনবি-‘কানযুল ঈমান’ ভুল। লালসালু সঠিক, হাদায়িকে বখশিশ ভুল… (আর কত কমু)!
কারো আদর্শের অবচেতন-আবেদন যখন মানুষকে এভাবে ভাবাতে শিখাবে, ইসলামের চেইন অব কমাণ্ড ভাঙবে, ইতিহাস থেকে ইসলামকে ছাঁটবে, প্রজন্মকে শিক্ষিত-অভদ্র, ধৃষ্ট-ধুরন্ধর বানাবে…
তখন! তখন! আর যাই হোক, যে যাই করুক, নাস্তিক নাচাক, মঙ্গলগ্রহের এলিয়নকেও মুসলমান বানাক – তার বিরোধীতা আবশ্যক! অত্যাবশ্যক!
কারণ; আকিদায় ধৃষ্টতার ক্ষেত্রে আপোষ নয়, প্রতিরোধ-প্রতিকার-নির্মূল করাই কাম্য।
যেমনটা ইমামে হক্বগণ করেছেন। কারবালা মুসলিমের আবেগ-অস্তিত্বের সংজ্ঞা। সেখানেও সাখাফিকে ছাড় দেয়া হয় নি। তুমি যাই করো, আকাইদ নেই তো কিছুই নেই। তোমার কাজ কচুপাতার পানি। প্রবাদ আছে না, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’।
এ বিরোধীতা সখে না। নিজের জন্য না। আমি আপনার জমির ভাগ পাই না। বিরোধীতার কারণ একটাই, একজন। যাকে প্রাণ, সম্পদ, আত্মীয়, সন্তান এমনকি মায়ের থেকেও বেশী ভালো না বাসলে কেউ মুমিন হয় না (তওবা : ২৪)। তার জন্যই এই বিরোধীতা। এ বিরোধী শুধু মদিনার জন্য। মদিনা-মুনিব সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জন্য। তিঁনি হয়ে তাঁর খোদার জন্য।
যদি দুধ চান। শুধু দুধ না, ক্ষীর দিতেও প্রস্তুত আছি। আশ্রয় চাইলে ঘর ছেড়ে দিব। কিন্তু নিজের গায়ে ইসলামের ব্রাণ্ড লাগিয়ে, মদিনার বিপরীতে যাবেন; তখন- অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে বিরোধীতা করতে আজন্ম প্রস্তুত আহলে সুন্নাহ। এটাই ঈমানের দাবী।
প্রজন্ম হে! চাকু দিয়ে সব্জি কাটে। আবার খুনও হয়। কোনটা হবে, নির্ভর করে চাকু-অলার ওপর। যে সহীহ হাদিসে ঢেকুর তুলে তোমাকে টানছে, চিন্তা করিও সে চাকু কিসের জন্য রেখেছে। মনে রাখিও-
মিথ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য ভঙ্গুর, ভেঙে যাবে। কিন্তু সত্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা ভয়ংকর।