আমেরিকার হাভার্ড ইউনিভার্সিটি। এর নিট ওর্থ ৩৬ বিলিয়ন। তিন লাখ বিশ হাজার সাতচল্লিশ কোটি দুই লাখ টাকা। যেখানে পুরো বাংলাদেশের বাজেট দুই লাখ বাইশ হাজার টাকা ছিল, ১৪-১৫ সালে। একটা দেশের থেকে হাভার্ডের বাজেট বেশি। আমেরিকার আরেক ইউনিভার্সিটি ‘জনস হপকিন্স’। এরা বছরে ২৪৩ কোটি টাকা ব্যয় করে গবেষণা খাতে। পশ্চিমাদের ওয়েব সাইট ঘাঁটুন। চোয়াল ‘হা’ হবে বিস্ময়ে। শিক্ষাকে এরা কোথায় নিয়েছে।
আমরা বলি না- মুসলিম মরছে, মার খাচ্ছে। কেন খাচ্ছে? ইংরাজিতে বলে,You won’t get anything until you deserve it- প্রাপ্য না হলে তুমি কিছুই পাবে না। এককালে বিশ্ব শাসিয়েছি। আজ মজলুমে পরিণত। এককালের আমরা, আর আজকের আমরা কি এক? জানেন আমরা কি ছিলাম?
ছোট্ট উদাহরণ দেই। ১১৫৮ সাল। বাগদাদ ধ্বংস করে হালাকু খান। চেঙ্গিস খানের নাতী। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। তেমনি বাগদাদের লাইব্রেরিও এড়ায় নি। হালাকুরা সমস্ত বই ডুবালো ফোরাত নদীতে। বাগদাদের পাশেই ফোরাত। চাঁদপুরের পদ্মা দেখেছেন। ফোরাত অনেকটা তেমনি। বিশাল বুক। ফোরাতের স্রোত আটকে গেল, বইয়ের চাপে। ফোরাতে নীলচে পানি কালো হল, বইয়ের কালিতে।
আহহা! কি ছিলাম! কি হলাম!
জিব্রাইল প্রথম নেমেই বলেছে-‘পড়ুন’। মদিনা-মুনিব (দ) ও পড়তে বলছেন। মনে পরে সে যুদ্ধবন্দীদের কথা। যারা ছিল শিক্ষিত। মালিক-রাজসিক (দ) বললেন, আপনারা প্রত্যেকেই দশজন শিশুকে অক্ষরজ্ঞান দান করবেন, তবেই মুক্তি আপনাদের। এখানেও শিক্ষার অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশের স্বাক্ষরতা ৭২.৭৬%। টিপসই না দিয়ে নাম লিখাই স্বাক্ষরতা। বাড়িয়ে বললে, সাক্ষরতা হচ্ছে পড়তে, লিখতে ও গুনতে পারা।
এটি ‘১৮ সালের হিসাব। ২০০৭ সালে এটি ছিল ৪৬.৬৬%। অতএব, সাল যতই পিছাবে, পরিমাণ ততই কমবে। ২০০৭ থেকে ২০০০ সালে আর কম। ২০০০ থেকে ১৯৫০ সালে আরো কম। এভাবে পেছাতে থাকুন। চলে যান ১৯০০ সালে। সমগ্র উপমহাদেশের কথা ভাবুন। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে মিয়ানমারের আরাকান অবধি। রোহিঙ্গরা আরাকানের মানুষ।
যা-হোক, ১৯০০ সালে সাক্ষরতা সমগ্র ভারতে কত ছিল? শতকরা ৩% জনও হবে না, আমার অনুমানে। যদিও শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা এক না। তবুও লিখছি, সে যুগে প্রতি একশ জনে ৯৭ জন জ্ঞানের ‘গ’-ও জানত না।
সে যুগেই ইমাম আ’লা হযরত ১,৫০০+ বই লিখেছেন। লিখেছেন জ্ঞানের ৭২ শাখার ওপর। আমি ভার্সিটিতে পড়ি। বিষয় “ইতিহাস’। ভার্সিটিতে আরো বিষয় আছে। রসায়ন, গণিত, পদার্থ ইত্যাদি। এই যে একেকটি বিষয় বা সাব্জেক্ট। এগুলাই জ্ঞানের একেকটি শাখা। ভাবুন, আপনি আমি একটি বিষয়ে চার বছর পড়ি। তিনি ৭২ বিষয় শুধু জানতেন না। এদের ওপর লিখেছেনও। জানলেই নিশ্চই লেখা যায় না। আমি ইতিহাস পড়লেই কিন্তু ইতিহাসবিদ নই।
মুসলিম মানেই মোল্লা না। এ সত্যটা তিনি আবার বুঝিয়েছেন। মুসলিমের মৌলিক সীমার বাহিরে এসেছেন তিনি। বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা মাতিয়েছেন। শব্দবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ভেষজ- একেএকে সব শাখাতেই সিদ্ধ ছিলেন।
তখন দরকার ছিল না এসব হয়ত। বৃটিশদের গুলি করলেই ভালো হত, জিহাদ হত। তিনি মহাবীর হতেন। ইতিহাসে নাম থাকত। তবুও এসব করেন নি তিনি। শুধু লিখেই গেছেন? কেন লিখেছেন, ভেবেছেন?
আজকের কথা ভাবুন। আল্লামা গুগলের কথা ভাবুন। ভাবুন ফেবু মুফতির কথা। আজকের পৃথিবী তথ্যের, ইনফর্মেশনের। তথ্যের অবাধ বিচরণ। তথ্য এখন সহজলভ্য। ইমাম আ’লা হযরত জানতেন এমন হবে। আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ হবে জ্ঞান ও তথ্যের। জানতেন দেখেই তিনি মুজাদ্দিদ। আর প্রতি শতাব্দীতে একজন মুজাদ্দীদ আসেন। আল্লাহ পাঠান। মুসলিমদের বর্তমানে রক্ষা করতে। আগত সময়ের জন্য প্রস্তুত করতে। ইমাম আ’লা হযরত আমাদের প্রস্তুত করছিলেন। জ্ঞানের দরজা খুলে দিচ্ছিলেন।
কিন্তু আমরা! পেরেছি কি নিজেদের গড়তে? শিক্ষাকে, তথ্যকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করেছি? করতে পারি নি। আমরা ব্যস্ত মহিষ নিয়ে। মাজারে আগরবাতি জ্বালাতে। হাকিমুল উম্মাত আহমাদ ইয়ার খান নঈমী তাই বলেছেন :আমরা ব্যস্ত গিলাফ চরাতে, তবারকের পাতিল নিয়ে; ওহাবীরা ব্যস্ত মাদ্রাসা নিয়ে, নিজেদের বিস্তারে। বলছি না এসব নিষিদ্ধ। বলছি, কৃষ্টির আগে অস্তিত্ব রক্ষা দরকার। শাহেনশাহে সিরিকোট যদি জামেয়া না বানাতেন! তবে কই যেতাম? তিনি শিক্ষাকেই সর্বাগ্রে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি এ-ও বলেছেন-মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদ্রাসা কো দেখ / আমাকে দেখতে চাইলে মাদ্রাসাকে দেখ। শিক্ষার দাম তারা দিয়েছে। তাই আজ আমরা দাঁড়িয়ে।
আল্লামা ইকবাল বলেন : আকল হ্যায় তেরে শিপার, ইশক হ্যায় খাঞ্জার তেরি। জ্ঞান আপনার ঢাল, প্রেম আপনার তরবারি। তরবারি ছাড়া যুদ্ধ হয় না। তেমনি ঢাল ছাড়া আত্মরক্ষা হয় না। দূর থেকেই তীর মারবে। তাই জ্ঞান ও প্রেম দুটিই দরকার।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। খুনিরা বাংলার মেধাবীদের মেরেছিল। শিক্ষাকে ধ্বংস করলেই জাতী ধংস হবে। এটা তারা জানত। করেছেও তাই।
এভাবেই মুসলিমরা খুন হচ্ছে। যুগেযুগে হচ্ছে। জ্ঞান ও প্রেম থেকে মুসলিমকে আলাদা করা হচ্ছে। তাই আমরা সিরিয়ায়, ইয়ামেনে মরি। ইরাক, আফগানে জ্বলি। অশিক্ষার অভিশাপ বড় ভয়ংকর।
ইসলামের চর্চা, তাসাউফের চর্চা, বিজ্ঞানের চর্চা নেই আমাদের। তাই আহালে হাদিস, সালাফিদের মত অভিশপ্তরা প্রতিষ্ঠিত হয়। সহজে বোকা বানায় মানুষকে। ভেল্কি দেখায়, রেফারেন্সের ভেল্কি।
নিজেকে আমরা গড়তে পারি নি। জয় তাই পশ্চিমাদের। অসভ্য ওহাবীদের। জয় তাই মানবতাহীনের। ইমাম আ’লা হযরত তাই সাবধান করেছেন। সাবধান হই নি আমরাই। তিনি বলেছেন না:
সুনা জাঙ্গাল রাত আন্ধেরী ছায়ি বাদলি কালি হ্যায়
আখোঁ কাজল সাফ চুরালে চোর অ্যায়সে নিরালি হ্যায়
আজকের এই যুগ নির্জন জঙ্গল। কালো মেঘে ছাওয়া। চোর চোখের কাজলও চুরি করে।
শিক্ষার আলোই এ চোর থেকে বাঁচার উপায়। মনে রাখবেন, নিজে চেষ্টা না করলে, শিক্ষিত না হলে আল্লাহও দয়া করবেন না।