হাফেয কাযিম আলি খান। ইমাম আ’লা হযরত এঁর পূর্বপুরুষ। তিনি জায়গীর পেয়েছিলেন। পুরষ্কার হিসেবে। জমিদারী তো বুঝি আমরা। বৃটিশরা এ প্রথা চালু করে। তেমনি জায়গীর ছিল মোঘলদের সৃষ্টি। জায়গীর অবশ্য আকৃতিতে বড়। কয়েকটি জমিদারী নিয়ে একটি জায়গীর হবে।
আ’লা হযরত এঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিতে ছিল। আর আওরঙ্গজেব মোঘলদের একমাত্র বাদশা। যাকে ‘ওয়ালিয়াল্লাহ’ বলা হত। পূণ্যবান শাসক।
আ’লা হযরত’দের জায়গীর ছিল ‘বুদাউন’ জেলার ‘কারটাউলি’ গ্রাম। বর্তমান বেরেলি শরীফ থেকে ৩৮ কি.মি. দূরে। পুরো গ্রামটাই তাঁদের ছিল ১৯৭৮ অবধি। চল্লিশ কি.মি. জুড়ে ছিল তাদের ভূ-সম্পদ। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব। এক জেলা থেকে আরেক জেলা। সে যুগে ভারতের গ্রাম বলতে এটাই বুঝাত। ভাবা যায়, ৪০ কি.মি.!
যা-হোক, লেখার উদ্দেশ্য সম্পত্তি না। কিন্তু কি বিশাল সম্পত্তি তাই না। অবাক তথ্য কি জানেন? এত সম্পত্তির পরেও আ’লা হযরত এঁর ওপর যাকাত ফরয হয় নি। মানে যাকাত পরিমাণ সম্পদ কখনো ছিলই না। আজব না!
আ’লা হযরত এঁর ভাই-বোনদের মাঝে সম্পদ ভাগ হল। আ’লা হযরত ও পেলেন। এবং সেদিনেই তাঁর সমস্ত কিছু শ্রদ্ধেয়া মায়ের নামে লিখে দেন। নিজে একদম শূণ্য।
আ’লা হযরত কে কারণ জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, আমি তো চালিয়ে নিব। যেমন করে হোক। কিন্তু আমার মা বিধবা। তিনি কি করবেন? তিনি যেন অসহায় বোধ না করেন। এবং কারো ওপর বোঝা না হন। তাই এমনটি করলাম। এছাড়া মায়ের সম্পদে তো সন্তানের অধিকার আছেই। কখনো লাগলে চেয়ে নিব।
এরপর শুধু বই কেনার জন্য তিনি মায়ের কাছে অর্থ নিতেন। এবং জানা যায় দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে শাম্মে হুদা ইমাম জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালাম এঁর সুন্নাত অনুসরণ করতেন। গভীর রাতে অসহায়ের দরজায় অর্থ রাখতেন। এবং নিয়মিত রাখতেন।
এমনিতে তো ছিল না কিছুই। যা আসত বিলিয়ে দিত। যাকাত ফরয হয় কিভাবে!
‘আরব্য উপন্যাস’ লিখছি না। মহামানবদের জীবনী এমনি। মনে হয় কোনো মহাকব্যের অংশ।
যা-হোক, মূল কথায় আসি। একটা জিনিষ খেয়াল করেছেন? খুব সুক্ষ্ম। অনুমান করুন। আচ্ছা বলছি, বিষটি হচ্ছে ‘নারী অধিকার’।
হ্যাঁ, নারী অধিকার। ১,৪০০ বছর আগে। মদিনায় সে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মদিনা-মুনিব (দ) সর্বোপ্রথম বলেন, নারীর পদতলে জান্নাত। ইসলামই গর্তচাপা থেকে নারীকে উঠিয়েছে। শিশুকন্যার চিৎকারে তখন প্রকম্পিত হত খেজুরপাতা। লুন্ঠিত হত মানবতা। ইসলাম তা ঠেকিয়েছে। মদিনা-মুনিব (দ) দুধমায়ের জন্য নিজের পবিত্র রুমাল বিছালেন। সাহাবারা অবাক হয়েছেন। এত সম্মান একজন নারীকে!
আ’লা হযরর তো ভিন্ন কেউ নন। বিচ্ছিন্ন কেউ নন। তিনি তো মদিনা’র মাইলফলক। তাই তিনি আর মদিনা ভিন্ন হবে কেন!
– তোমার কাছে একশ টাকা আছে। এ টাকা বাবা-মায়ের জন্য। তবে পঁচিশ টাকা বাবাকে দাও। বাকি ৭৫ টাকা দাও মাকে।
– বাবা এবং মা একসাথে পানি চাইলো। আগে মাকে পানি দাও। এরপর বাবাকে।
– বাবা-মা সফর থেকে এসছেন। পা চিপতে চাও। সেবা করতে চাও। তবে জেনে রাখো, অধিকার আগে মায়ের।
কথাগুলো আ’লা হযরত এঁর। এরচে অনন্য অধিকার আর কি হতে পারে? এই নৈতিকতা, সম্মানবোধ হল একটি দরজা। যা বিকশিত করে মানুষের মননে নারীর সম্মান, মমত্ব, মর্যাদা।
ইমাম আ’লা হযরত এঁর পাঁচ সম্মানিত কন্যা ছিলেন। সকলেই যুগ শ্রেষ্ঠা, অনন্যা। আলেমা ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ তাঁদের ছিল।
এ থেকে কি বুঝা যায়? ইমাম আ’লা হযরত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আপোস করেন নি। তিনি নিজের মেয়েদের পড়িয়েছেন। শরীয়ত সমৃদ্ধ করেছেন।
অথচ, ভারতেরই কেউ কেউ নারীশিক্ষাকে হারাম ফতওয়া দিয়েছিল। ইংরাজি শিক্ষাকে হারাম বলেছিল। এদের লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের পিছিয়ে দেয়া { আল্লাহ ও তাঁর প্রেমাষ্পদ (দ) ভালো জানেন}।
একটু ভাবুন। ভাবুন আ’লা হযরত কে নিয়ে। জানুন, পড়ুন। কতটা ডাইনামিক ছিল এ মানুষটা। কতটা মানবিক ছিল। কতটা সৎ ও নির্লোভ ছিল।
তাঁকে গালি দিয়েন না প্লিজ। আমাকে বকেন। গালিবের আঠারো গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। গালিব তো কিট তুল্য। মনে রাখবেন, আ’লা হযরত কে গালি দিলে, গালিটা লাগে মদিনা’র বুকে। সন্তানকে বকলে পিতাও আঘাত পান।
ইমাম আ’লা হযরর না থাকলে ‘ওহাবী’ চিনতাম না। ওহাবী শব্দটা তাঁর আবিষ্কার। ওহাবী না চিনলে মুসলিম থাকতাম কিনা খোদা মালুম। তিনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। ইমান রক্ষা করেছেন। এ ঋণ কি অস্বীকার করতে পারবেন!
আল্লাহ আমাদের কৃতজ্ঞ করুক। কৃতজ্ঞ হবার ক্ষমতা দিক। যাতে আমরা ঋণবোধ করি আমাদের এহসানের ওপর। যে এহসান করেছেন, আমার হৃদয়ের বাদশা। সেই বেরেলির শাহেনশাহ, ইমাম আ’লা হযরত আহমাদ রেযা খান।