বিষয়ঃ- মিলাদ অনুষ্ঠান এবং কিয়ামে তাযীমী
লেখকঃ- আল্লামা মুফতী নাজিরুল আমিন রেজভী,হানাফী, ক্বাদেরী।
খলিফায়ে খানদানে আলা হযরত ইউ,পি ভারত।
=====================================
মিলাদ অনুষ্ঠান করা এবং কিয়ামে তাযীমী পালন করা অবশ্যই বৈধ। অনেক ফযীলতপূর্ণ একটি আমল। মিলাদ অনুষ্ঠানের বৈধতার ব্যাপারে মুল্লা আলী ক্বারী স্বতন্ত্র “আল মাওরিদুর রাভী ফিল মাওলিদিন্নাবভী” নামে একটি পুস্তক লিখেছেন। এছাড়াও ইসলামের অনেক বিশিষ্ট ইমাম এ ব্যাপারে কলম ধরেছেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতীও এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র পুস্তক লিখেছেন- “হুসনুল মাকছাদ ফি আ‘মালিল মাওলিদ” নামে। যাতে তিনি মিলাদকে মন্দ বিদ‘আত যারা বলে এর খন্ডনও করেছেন।
* ইমাম সুয়ূতী তাঁর এ পুস্তকে বলেন-
عندي أن أصل عمل المولد الذي هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القرآن ورواية الأخبار الواردة في مبدأ أمر النبي صلى الله عليه وسلم وما وقع في مولده من الآيات ، ثم يمد لهم سماط يأكلونه وينصرفون من غير زيادة على ذلك – هو من البدع الحسنة التي يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبي صلى الله عليه وسلم وإظهار الفرح والاستبشار بمولده الشريف
অনুবাদঃ- ‘(ইমাম সুয়ূতী বলেন) আমার দৃষ্টিতে মিলাদ অনুষ্ঠান বলতে লোকজন জমায়েত হয়ে যদ্দুর সম্ভব কুরআন মাজীদ হতে যথাসম্ভব তিলাওয়াত করা। নবীজীর সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কিত ঘটনাবলীর বর্ণনা করা। অতঃপর তাঁর মিলাদ বা এ ধরায় শুভাগমনের সময় সংঘটিত ঘটনাসমূহের আলোচনা করা। সবশেষে উপস্থিত লোকজনকে খাওয়ানো তথা তাবারুক বিতরণপূর্বক যার যার গন্তব্যে ফিরে যাওয়া- এর অতিরিক্ত কিছু না করা- বিদ‘আতে হাসানা (উত্তম রীতি)। এর পালনকারীকে এজন্য ছাওওয়াব দেয়া হবে। কেননা এর মধ্যেই রয়েছে রাসূল পাকের শান-মান ও মর্যাদার প্রতি ভক্তি, বিশ্বাস, শ্রদ্ধার বিকাশ এবং তার মর্যাদাপূর্ণ মিলাদের জন্য সন্তুষ্টি ও আনন্দের প্রকাশ।’
* আল্লামা ইসমাইল হাক্কী তাফসীরে ‘রুহুল বয়ান’ এর ৯ম খন্ডের ৫৬ পৃষ্ঠায় সূরা ফাতহের ২৯নং আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন-
ومن تعظيمه- صلى الله عليه وسلم – عمل المولد إذا لم يكن فيه منكر قال الإمام السيوطي قدس سره يستحب لنا إظهار الشكر لمولده عليه السلام انتهى
অনুবাদঃ- ‘মিলাদ অনুষ্ঠান করাটা হল হুযুর পাকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যদি তা মন্দ বিষয় থেকে মুক্ত হয়। ইমাম সুয়ূতী বলেন, হুযুর পাকের বিলাদাতের কৃতজ্ঞতা পোষন করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’
* ইবনু হাজার হাইছামী বলেন-
وقد قال ابن حجر الهيتمي أن البدعة الحسنة متفق على ندبها وعمل المولد واجتماع الناس له كذلك أي بدعة حسنة
অনুবাদঃ- ‘নিশ্চয় বিদ‘আতে হাসানা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত আর মিলাদ অনুষ্ঠান করা এবং এ উপলক্ষ্যে লোকজনের সভা-সমাবেশ করা (মিলাদ মাহফিল করা)ও অনুরূপ বিদ‘আতে হাসানা।’ (রুহুল বয়ান, ৯/৫৬)
* ইমাম সাখাবী বলেন-
قال السخاوي لم يفعله أحد من القرون الثلاثة وإنما حدث بعد ثم لا زال أهل الإسلام من سائر الأقطار والمدن الكبار يعملون المولد ويتصدقون في لياليه بأنواع الصدقات ويعتنون بقراءة مولده الكريم ويظهر من بركاته عليهم كل فضل عظيم
অনুবাদঃ- ‘তিন যুগের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীর যুগ) মধ্যে কেউ মিলাদ শরীফ করেননি। তা পরবর্তীতে চালু হয়েছে। অতঃপর চারদিকে ও প্রতিটি শহরে-বন্দরে মুসলমান সবসময় মীলাদ শরীফ করে আসছেন ও নানা রকম দান-খয়রাতও করে যাচ্ছেন এবং হুযুর পাকের মিলাদ পাঠের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এ পবিত্র মাহফিলের বরকতে তাঁদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ নাযিল হয়।’ (রহুল বয়ান- ৯/৫৭)
* ইমাম ইবনু জাওযী বলেন-
قال ابن الجوزي من خواصه أنه أمان في ذلك العام وبشرى عاجلة بنيل البغية والمرام
অনুবাদঃ- ‘মিলাদ অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব এমন যে, এর বরকতে সারা বছর নিরাপদ থাকা যায় এবং এর ফলে উদ্দেশ্য সাধনের শুভ সংবাদ রয়েছে।’ (রুহুল বয়ান, ৯/৫৭)
আলোচ্য বর্ণনাসমূহে মিলাদ অনুষ্ঠানের বৈধতার ব্যাপারে ইমামগণের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে যে, প্রত্যেকেই এটিকে বিশেষ বরকতের মাধ্যমে এবং হুযুর পাকের প্রতি তা‘যীম প্রকাশ বলেছেন। আর এ বর্তমান প্রচলিত অনুষ্ঠানসমূহকে উত্তম বিদ‘আত বা ভাল নতুন প্রচলন বলেছেন। এ পদ্ধতিটি কুরুনে ছালাছায় ছিল না। কিন্তু এর মূলভিত্তি কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘য়ালা নিজেও মিলাদের আলোচনা করেছেন কুরআন পাকে এবং রাসূল পাকের আলোচনার নির্দেশ দিয়েছেন। নবীজীও নিজের মিলাদ নিজেই উদযাপন করেছেন এবং বুখারী শরীফে এর ফযীলতও বর্ণিত হয়েছে। আর বর্তমান প্রচলিত এ পদ্ধতি কখন থেকে আবিষ্কার হয় এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ূতী তার ‘হুসনুল মাকছাদ’ কিতাবে লিখেন-
وأول من أحدث فعل ذلك صاحبإربل الملك المظفر أبو سعيد كوكبري بن زين الدين علي بن بكتكين ، أحد الملوك الأمجاد والكبراء الأجواد ، وكان له آثار حسنة ، وهو الذي عمر الجامع المظفري بسفح قاسيون
অনুবাদঃ- ‘(বর্তমান প্রচলিত) মিলাদ অনুষ্ঠান সর্বপ্রথম যিনি (রাষ্ট্রীয়ভাবে) পালনের আয়োজন করেন, তিনি হলেন ইরবিলের বাদশাহ সম্রাট মুজাফফর আবু সাইদ কুবারী ইবনে যয়নুদ্দীন আলী ইবনে বকতেকীন। তিনি মহিমান্বিত বাদশাহগণের একজন ও বিখ্যাত দানবীরবর্গের অন্যতম। তার রয়েছে অসংখ্য সৎকর্মের নিদর্শন। তিনি-ই মাসিউনের সুবিখ্যাত মসজিদ আল-জামে‘ আল-মুজাফ্ফরী নির্মাণ করেন।’
বিরোদ্ধবাদীরা তাঁর (বাদশাহ) সম্পর্কেও অপবাদ আরোপ করেন যে, তিনি নেককার ছিলেন না-জালেম ছিলেন। অথচ তাদেরই মান্যবর ইবনু কাছির তার ‘বিদায়া ওয়া নিহায়া’ গ্রন্থে বাদশাহ মুজাফফর সম্পর্কে বলেন-
قال ابن كثير في تاريخه : كان يعمل المولد الشريف في ربيع الأول ويحتفل به احتفالا هائلا ، وكان شهما شجاعا بطلا عاقلا عالما عادلا ، رحمه الله وأكرم مثواه ، قال : وقد صنف له الشيخ أبو الخطاب ابن دحية مجلدا في المولد النبوي سماه ( التنوير في مولد البشير النذير ) ، فأجازه على ذلك بألف دينار ، وقد طالت مدته في الملك إلى أن مات وهو محاصر للفرنج بمدينة عكا سنة ثلاثين وستمائة ، محمود السيرة والسريرة
অনুবাদঃ- ‘তিনি (সম্রাট মুজাফফর) রবিউল আউয়াল মাসে মিলাদ শরীফ পাঠের আয়োজন করতেন। আর তা তিনি করতেন বিরাট জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন সুঠামদেহী, বলবান, বীরপুরুষ, বুদ্ধিমান, আলেম ও ন্যায়বিচারক। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি রহমত দান করুক এবং (পরপারে) তাঁর বাসস্থানকে করুন মর্যাদাশীল। আর মিলাদুন্নবীর উপর শাইখ আবুল খাত্তাব ইবনে দিহ্ইয়াহ একটি কিতাব লিখে সম্রাটকে হাদীয়া করেন। এর নামকরণ করেন, “আততানভীর ফি মাওলিদিল বাশীরিন নাযীর” নামে। অতি মূল্যবান এ রচনার জন্য সম্রাট তাঁকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন। তার রাজত্বকাল ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল। তিনি আক্কা নগরীতে অবস্থানকালীন পারস্যদেরকে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। ইতিহাসের এ মহানায়ক ৬৩০ হিজরীতে পরপারে চলে যান। তিনি ছিলেন অতি উত্তম প্রশংসনীয় চরিত্রের অধিকারী। আর তাঁর মন-প্রাণ ছিল অতি উত্তম।’ (হুসনুল মাকছাদ লিস্ সুয়ূতী)
* আর এ অনুষ্ঠানের মূলভিত্তি সম্পর্কে রুহুল বয়ান: ৯/৫৭ -এ এসেছে-
وقد استخرج له الحافظ ابن حجر أصلاً من السنة وكذا الحافظ السيوطي
অনুবাদঃ- ‘হাফিজ ইবনু হাজার ও হাফিজ সুয়ূতী মিলাদ অনুষ্ঠান সুন্নাত (হাদীস) দ্বারা প্রমাণ করেছে।’
* আনুষ্ঠানিক মিলাদ অনুষ্ঠানে কিয়ামে তাযিমীর ব্যাপারে উলামাগণের ঐক্যমত রয়েছে। যেমন- রুহুল বয়ানের ৯ম খন্ডের ৫৬ পৃষ্ঠায় এসেছে যে-
وقد اجتمع عند الإمام تقي الدين السبكي رحمه اللـه جمع كثير من علماء عصره فأنشد منشد قول الصرصري رحمه اللـه في مدحه عليه السلام
قليلٌ لمدحِ المصطفى الخطُّ بالذهَبْ … على وَرِقٍ مِن خَطِ أحسنِ مَن كتبْ
وأن تَنْهضَ الأشرافُ عندَ سَماعِهِ … قيامًا صفوفًا أو جُثِيًّا على الرُكبْ
فعند ذلك قام الإمام السبكي وجميع من بالمجلس فحصل أنس عظيم بذلك المجلس ويكفي ذلك في الاقتداء
অনুবাদঃ- ‘যুগশ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী মিশরী এর এক সমাবেশে যুগের বিখ্যাত অনেক উলামায়ে কিয়ামের উপস্থিতি ছিল। তখন তিনি হুযুর পাকের প্রশংসা সম্বলিত ইমাম ছরছরির রচিত দু’লাইন ক্বাছিদা পাঠ করেন। কাছিদার অর্থ হল- “সুন্দরতম কিতাবের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেও যদি নবী মুস্তফার নাম অঙ্কন করা হয়, তবুও তার বিশাল মর্যাদার তুলনায় অতি তুচ্ছ। অনুরূপভাবে শুধু তাঁর নাম শুনেও যদি উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা সারিবদ্ধ কিয়াম (দাঁড়িয়ে যায়) করে অথবা আরোহী অবস্থায় নতজানু হয়ে যায় তবু তাঁর মহান মর্যাদার তুলনায় অতি সামান্যই হবে।” ইমাম ছরছরির এ পংক্তি দু’টো পাঠ করে সাথে সাথে ইমাম সুবকীসহ মসজলিসের সকলে কিয়াম করেন এবং মজলিসে নবী প্রেমের ঢেউ খেলে গেলো, সকলেই আবেগাপ্লুত হলেন। কিয়ামের বৈধতার জন্য ইমাম সুবকী ও উপস্থিত উলামায়ে কিরামের অনুসরণই যথেষ্ট।’
** এখন দেখুন যে, প্রচলিত মিলাদের আলোচনা ও মূল ভিত্তি যে পবিত্র কুরআন পাকেই বিদ্যমান রয়েছে।
* আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَاذْكُرُواْ نِعْمَتَ اللّهِ عَلَيْكُمْ
‘তোমরা আল্লাহর নিয়ামতের আলোচনা কর’। (সূরা বাক্বারা: ২৩১)
* আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
‘আর আপনার রবের নিয়ামতের আলোচনা করুন।’ (সূরা দ্বুহা: ১১)
* বুখারী শরীফে ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণিত রয়েছে যে-
محمد صلي الله عليه وسلم نعمة الله
‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।’ (বুখারী-২/৫৬৬)
* আল্লাহ তা‘আলা সকল নবীগণকে নিয়ে মিছাকের দিবসে নবীজীর মিলাদের আলোচনা প্রসঙ্গে মজলিস করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُم مِّن كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ
অনুবাদঃ-‘হে প্রিয় রাসূল! স্মরণ করুন ঐদিনের কথা, যখন আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নবীগণ থেকে প্রতিশ্র“তি নিয়েছিলেন এ কথার উপর যে, যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হেকমত দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করব তারপর তোমাদের কাছে আমার মহান রাসূলের মিলাদ হবে এবং তোমাদের নবুয়ত ও কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করবেন তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ৮১)
* হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নবী পাকের মিলাদের আলোচনা স্বজাতীর মধ্যে করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ
অনুবাদঃ- ‘এমন রাসূলের সুসংবাদ, যিনি আমার পরেই আগমন করবেন (আমার পরে যার মিলাদ হবে) এবং তাঁর নাম হবে আহমাদ।’ (সূরা ছাফ্ফ: ৬)
* সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াতে আল্লাহ আমাদের উদ্দেশ্যে মিলাদুন্নবী বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ
‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের থেকেই একজন রাসূল এসেছেন।’
** এখন দেখুন মিলাদ অনুষ্ঠানের মূল ভিত্তি পবিত্র হাদীস শরীফেও বিদ্যমান রয়েছে।
* ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনানে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে-
عن العباس أنه جاء إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فكأنه سمع شيئا فقام النبي صلى الله عليه وسلم على المنبر فقال من أنا فقالوا أنت رسول الله عليك السلام قال أنا محمد بن عبد الله بن عبد المطلب
অনুবাদঃ- ‘হযরত আব্বাস থেকে বর্ণিত যে, তিনি একবার নবীজীর দরবারে যেন কিছু শুনে আসলেন। অতঃপর নবীজী মিম্বরের উপর কিয়াম করলেন (দাঁড়ালেন) এবং (মজলিসে) বললেন, আমি কে? সভায় উপস্থিতিগণ বললেন, আপনি আল্লাহর রাসূল। নবীজী ইরশাদ করলেন, আমি আব্দুল্লাহর পূত্র, আব্দুল মুত্তালিবের নাতী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা… (অতঃপর নিজের নসবের মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন)।’ (মিশকাত, ৫১৩)
এখানে নবীজী সভায় নিজের মিলাদ, নিজেই কিয়াম অবস্থায় বর্ণনা করেছেন। আর আলোচ্য হাদীসের মূল ভাষ্যটাই হল মিলাদ অনুষ্ঠানের মূলকথা।
* প্রতি সোমবার নবীজী নিজের মিলাদ নিজেই উদযাপন করেছেন। যেমন আবু কাতাদাহ আনসারী থেকে বর্ণিত আছে যে-
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الِاثْنَيْنِ فَقَالَ : ( فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَيَّ
অনুবাদঃ- ‘নবীজী সোমবার দিন রোজা রাখতেন এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ফরমান, এ দিনে আমার মিলাদ হয়েছে এবং এ দিনেই আমার উপর প্রথম ওহী নাযিল হয়েছে।’ (মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়)
* নবীপাকের মিলাদ উপলক্ষ্যে খুশি হওয়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে বুখারী শরীফের ২য় খন্ড, ৭৬৪ পৃষ্ঠায় কিতাবুন্ নিকাহর দুগ্ধদান সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে, আবু লাহাবের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে-
فلما مات أبو لهب أريه بعض أهله بشر حيبة قال له ماذا لقيت قال أبو لهب لم ألق بعدكم غير أني سقيت في هذه بعتاقتي ثويبة
অনুবাদঃ- ‘যখন আবু লাহাব মারা গেল, তখন তার পরিবারের কোন একজন স্বপ্নে তাকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, সে কোন অবস্থায় আছে? আবু লাহাব বলল, তোমাদের থেকে পৃথক হওয়ার পর আমি কোন শান্তিতে নেই। তবে হ্যাঁ, তর্জনী আঙ্গুল থেকে পানি পেয়ে থাকি কেননা আমি ছুয়াইবা নামক বাদীকে (নবীজীর মিলাদের সংবাদ দেয়ায় খুশী হয়ে) আযাদ করেছিলাম এ আঙ্গুলের ইশারায়।’
*** মিলাদের মজলিসে নবীজীকে তাযীম করণার্থে বা সালাত ও সালাম পেশকালে কিয়াম করা কুরআন ও হাদীসে পাওয়া যায়। বিষয়টিতো পূর্বেই ইমাম সুবকী থেকে ইবারত পেশ করা হয়েছে। এছাড়াও হযরত আব্বাস থেকে বর্ণিত হাদীস দেখানো হয়েছে যে, নবীজী নিজেই কিয়াম অবস্থায় নিজের মিলাদ বর্ণনা করেছেন।
* কুরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيماً
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীজীর উপর দরূদ এবং সালাম পেশ কর সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে।’ (সূরা আহযাব: ৫৬)
এ আয়াতে আল্লাহপাক এটা নির্দিষ্ট করে দেননি যে, নবীজীকে সালাম বসে দিব না দাঁড়িয়ে। অতএব সর্বাবস্থায়ই নবীকে সালাম পেশ করা বৈধ। দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পাঠ করা যাবে না বলে আল্লাহর কিতাবে সুনির্দিষ্ট বা বাড়াবাড়ি বৈধ নয়। আর সর্বোচ্চ সম্মান দাঁড়িয়েই প্রদর্শন করা উচিত।
* এছাড়াও কোন উত্তম কাজে বা কারও সম্মানে মজলিসে দাঁড়ানোর নির্দেশ কুরআনের সূরা মুজাদালার ১১ নং আয়াতেও লক্ষ্য করা যায়। ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحْ اللَّهُ لَكُمْ وَإِذَا قِيلَ انشُزُوا فَانشُزُوا
অনুবাদঃ- ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয় মজলিসের মধ্যে জায়গা ছেড়ে দাও তোমরা ছেড়ে দিবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য স্থান প্রশস্ত¡ করে দিবেন। আর যখন বলা হবে দাঁড়িয়ে যাও তোমরা দাঁড়িয়ে যাবে।’
তবে কারও সম্মানে রুকু বা সেজদার মত ঝুঁকে দাঁড়ানো যাবে না। এটার প্রতি নবীজী নিষেধ করেছেন। বলেছেন, “তোমরা অনারবীদের মত দাঁড়িয়ো না।”
* বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী তার মাওলুদে কাবীর নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে-
فيقال نظير ذلك في القيام عند ذكر ولادته صلي الله عليه وسلم. وأيضا قد اجتمعت الأمة المحمدية عن أهل السنة والجماعة علي استحسان القيام المذكور وقد قال صلي الله عليه وسلم لا تجتمعوا أمتي علي الضلالة
অনুবাদঃ- ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ পাঠকালে কিয়াম করা মুস্তাহাব। তিনি আরও বলেন, উল্লেখিত কিয়াম মুস্তাহসান হওয়ার ব্যাপারে উম্মতে মুহাম্মদী তথা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআহ’র ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর হুযুর পাক ইরশাদ করেন, “আমার উম্মতগণ কোন ভ্রষ্টতার উপর ঐক্যমত হবে না”।’ (আল-কাউকাবুল আযহার ওয়াদ্ দুআরুল মুয়াজ্জম: ১৪৩)
* দেওবন্দী আকাবেরদের পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী তাঁর ফায়সালায়ে হাফ্ত মাসায়েলে বলেন-
فقير كا مشرب يہ ہے کہ محفل مولد مين شریک ہوتاہو بلكہ بركات كا ذريعہ سمجھ کر ہر سال منعقد كرتاہون اور قيام مين لطف اور لذت پاتاہو
অনুবাদঃ- ‘ফক্বীরের নীতি হচ্ছে আমি মিলাদ মাহফিলে যোগদান করি বরং একে বরকত লাভের ওসীলা মনে করে নিজেই প্রতিবছর এর আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়ে থাকি।’
পরিশেষে এমন এক হাস্তীর মোনাজাতের একটি অংশ তুলে ধরছি যার কল্যাণে ভারতবর্ষে হাদীস শাস্ত্রের চর্চার উন্মেষ ঘটেছে। তিনি সকলের মান্যবর শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী। তিনি স্বীয় কিতাব ‘আখবারুল আখইয়ার’-এর শেষে একটি মুনাজাত রচনা করেন। এতে লিখেন-
اے اللہ !ميرا كوئی عمل ايسا نہین ہے جسے آپکے دربار مین پیش کرنے کے لائق سمجھو ميرے تمام اعمال مین فساد نیت موجود رہتی ہے البتہ مجھ حقير فقير كا ايك عمل صرف تيرے ذات پاک کی عنايت كيوجہ سے بہت شاندار ہے اور وہ یہ ہےکہ مجلس ميلاد كے موقع پر مین کھرے ہو کر سلام پرتا ہو اور نہایت ہی عاجزی وانكساری محبت وخلوص كے ساتھ تیرے حبيب پاک صلی اللہ عليہ وسلم پر درود وسلام بھیجتا رہاہون
অনুবাদঃ-‘হে আল্লাহ! আমার এমন কোন আমল নেই, যা আপনার আলীশান দরবারের উপস্থাপন যোগ্য। আমার জীবনের সকল নেক আমলই নিয়্যাতের ঘাটতিতে আবদ্ধ। তবে এটা দৃঢ়তর সাথে বলছি যে, আমি ফকীরের একটি আমল শুধুমাত্র আপনার পবিত্র সত্ত্বার দয়ায় বড়ই শানদার (উপস্থানযোগ্য)। আর তা এই যে, মিলাদের মজলিসের সময়ে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাম পাঠ করি অতীব বিনয়-নম্রতা ও আন্তরিক মুহাব্বতের সাথে আপনার হাবীব পাকের উপর দরূদ ও সালামের হাদীয়া পেশ করে থাকি।’
আল্লাহ বুঝার তৌফিক দিন। আমিন!