পনেরো শতক আগে হিন্দু প্রধান ছিল কাশ্মির। পরে বৌদ্ধধর্মে ধাবিত হয়। নবম শতকে শৈব মতবাদ আসে। ১৩-১৪ শতকে ইসলামের বিস্তার ঘটে। নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি কাশ্মীরকে অঙ্গীভূত করে। ফলে জন্মায় কাশ্মিরি সুফিধারা, সুফি বিপ্লব।
শাহ মীর প্রথম মুসলিম শাসক। তিনি ‘শাহমীর’ রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। ১৩৩৯ সালে। পরের পাঁচ শতক মুসলিম শাসন ছিল। এর মধ্যে মুঘল আসে। ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত। আফগান দুররানীরা ১৭৪৭ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত। এরা সবাই মুসলিম।
১৮১৯ সালে শিখরা কাশ্মির দখল করে। রাজা রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইংরেজ-শিখ যুদ্ধ হয়। ধবলকুষ্ঠ ইংরেজরা জিতে। এরপর অমৃতসর চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের থেকে কিনে নেয়। এবং কাশ্মিরের নতুন শাসক হয়। ১৯৪৭ অবধি তার বংশ ব্রিটিশের অনুগত হিসেবে কাশ্মির শাসন করে। শাসক ভিন্ন হলেও- কাশ্মির সব সময় সুন্নি-সুফি মুসলিম অধ্যুষিত ছিল।
সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়। জন্মায় ভারত-পাকিস্তান। কাশ্মিরে তখন মাহারাজা হরিসিং শাসক। সে দু’মাস স্বাধীন থাকে। মানে ভারত-পাকিস্তান কোনোটাতেই ঢুকে নি। ভারত ও পাকিস্তানের সাথে চুক্তি করে হরিসিং। ট্যান্ডস্টিল এগ্রিমেন্ট বা স্থিতাবস্তা চুক্তি। চুক্তিটা এমন- কাশ্মির দু’দেশের কোনো বিষয়ে নাক গলাবে না। সামরিক-বেসামরিক কিছুতেই না। বিনিময়ে স্বাধীন থাকবে কাশ্মির। কাশ্মির স্পর্শকাতর এলাকা। তাই ভারত-পাকিস্তান মেনে নেয় চুক্তি।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে। ব্রিটিশরা ভেগেছে। রেখে গেছে অস্ত্রসস্ত্র। ব্রিটিশ বাহিনীতে বিশাল পরিমাণ মুসলিম সেনা ছিল। হরিসিং মুসলিম সেনাদের অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। এবং বন্টন করে হিন্দুগ্রামগুলোতে। মুসলিমরা কোনোভাবেই তা মানে নি। পরিস্থিতি উস্কে দেয় বিদ্রোহ।
পশতুন নামে পাকিস্তানে একটি জাতি আছে। এরা মূলত আফগানিস্তানের। ব্রিটিশরা বেলুচিস্তান দখল করে উনিশ শতকের শেষে। যা আফগানিস্তানের প্রদেশ ছিল। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমায় লাগোয়া। পরে দেশভাগের সময় বেলুচিস্তান ও পশতুনরা পাকিস্তানের অংশ হয়। যাহোক, পশতুনদের একাংশ কাশ্মির বিদ্রোহে যোগ দেয়। ফলে হরিসিং বিপাকে পরে। অবশ্য পশতুনদের এ পদক্ষেপে পাকিস্তানের মত ছিল কিনা নিশ্চিত না।
হরিসিং ভারতের সাহায্য চায়। ভারতের গভর্নর জেনারেল বিরোধিতা করে। গভর্নর বলেন- একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সৈন্য পাঠানো বিপদজনক, যদি না কাশ্মির অঙ্গীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় প্রথমে। মানে- ভারতে যোগ দিতে হবে। নইলে সাহায্য নেই।
ভারত ছাড়াই হরিসিং যুদ্ধে নামে। হরিসিং এর বাহিনী ও আরএসএস একজোট হয়। আরএসএস হচ্ছে- একটি চরমপন্থী হিন্দু সংগঠন। দু’বাহিনী জাম্মু এলাকায় মুসলিম-গণহত্যা করে। বলা হয়- বিশ হাজার থেকে একলাখ মুসলিম মারা যায়। বিশ হাজার শিখ ও হিন্দুও মরে।
পরিস্থিতি হাত ছাড়া হতে থাকে। হিন্দুরাজা হরিসিং ভারতের শর্ত মেনে নেয়। আর গতি ছিল। ভারতের নিকট সাময়িক ভাবে কাশ্মিরকে সমর্পণের করে। দিনটা সাতচল্লিশের ২৬ অক্টোবর। পাকিস্তান হরিসিং-ভারতে চুক্তির বিরোধিতা করে। বলে- হরিসিং এর চুক্তি করার অধিকার নেই। কারণ, হরিসিং এখনো পাকিস্তানের স্ট্যাণ্ডস্টিল চুক্তিতে বলবৎ আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ভারত-হরিসিং চুক্তি হয়।
২৭ অক্টোবর ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে নামে। বিদ্রোহী কাশ্মিরি ও পশতুন জাতির সাথে। এটাই ভারত-পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল জওহার লাল নেহুরে। নেহেরু কাশ্মিরে গণভোটের ওয়াদা করে। বলে :- জাম্মু-কাশ্মিরের ভাগ্য অবশ্যই গণমানুষের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে, যে অঙ্গীকার আমরা করেছি- তা শুধুই কাশ্মিরের মানুষের কাছে না, সারাবিশ্বের কাছে করেছি; আমরা কখনো পিছপা হব না, হতেও পারব না।
এর দু’মাস পরে কথা। জাতিসংঘে একটি বিতর্ক উস্থাপন করে ভারত। বলা বাহুল্য- বিতর্কের ইস্যু কাশ্মির। ১৩ আগস্ট ১৯৪৮ সালে একটি সমাধান গৃহীত হয়। দু’দেশকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলে জাতিসংঘ। প্রত্যাহার হলেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। কাশ্মিরকে তার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহার কখনই হয় নি। গণভোটও হয় নি।
৪৯ সালের ১লা জানুয়ারী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়। দ্বিখণ্ডিত হয় কাশ্মীর। ভাগ হয় ভারত-পাকিস্তানে। এরপরে ভারত-পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। দু’দেশেই কাশ্মিরকে বিশ্বের সবচে সৈন্যবহুল এলাকা বানিয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেই শুধু ছয় লাখ সৈন্য মোতায়েন। এদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ আছে। যেমন- ধর্ষণ, নিপীড়ন, গুম ইত্যাদি। যা আজো হয়ে চলছে। আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ কাশ্মিরি হত্যা হয়েছে এ অবধি।
পাকিস্তান অংশেও আছে ভারী সৈন্য। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে- কাশ্মির হচ্ছে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের নিষিদ্ধ ভূমি।
ভারত সেখানে বহিরাগত দখলদারের মত সব আচরণই করছে। যেমনটা করেছে ব্রিটিশ। নিজদেশে কোন জাতি এভাবে পূর্ণ জাতিগতভাবে আক্রান্ত হয় না। স্রেফ ঔপনিবেশিকরাই কোন অঞ্চলকে এভাবে পূর্ণ অবদমন করে। ভারতীয়দের কাছে কাশ্মির নিজের জমিন মনে হতেই পারে, কিন্তু কোন কাশ্মিরির কাছে ভারত আর নিজের দেশ নেই। এটাই চরম সত্য। কাশ্মির আজ ভারত-পাকিস্তান চায় না। চায় স্বাধীনতা।
প্রত্যেক “সন্তুষ্ট” ভারতীয় আজকে দখলদার তুষ্ট অসুর। আর এ রূপান্তর, মোদীয় রূপান্তর।
___________
আজকে ইতিহাস জানলাম। তথ্য পেলাম। আগামী পর্বে বিস্তর আলাপ হবে। কাশ্মির-গাজওয়াতুল হিন্দ, খোরাসানের কালো পতাকা, দাজ্জাল, ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম, জায়নিস্ট-ফ্রিম্যাসন-ইজরাইলি বসতি স্থাপন পদ্ধতি, ভারত-ইজরাইল লেয়াজোঁ, দেওবন্দি-তালেবানদের কাশ্মির ভাবনা, মুসিলমদের গতি পথ- এসব আসবে আলোচনায়।
সাথে থাকুন। মালিক ভরসা।