অভিযোগকারীরা এ সংক্রান্ত একটি সহীহ বর্ণনার সাথে বানোয়াট বর্ণনা যোগ করে পেশ করে থাকে।
বর্ণনাটি হল, রাসূল (ﷺ) মসজিদে নববী নির্মাণের সময় হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (رضي الله عنه) কে বলেছেনঃ
ويح عمار! تقتلك الفئة الباغية
‘আম্মারের জন্য আফসোস, তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। [মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং-২৬৫৩]
এ বর্ণনাটি ইকরিমা (رحمة الله) এর সূত্রে বুখারীসহ অন্যান্য কিতাবে অতিরিক্ত বাক্যসহ আসছেঃ
وَيْحَ عَمَّارٍ، تَقْتُلُهُ الفِئَةُ البَاغِيَةُ، يَدْعُوهُمْ إِلَى الجَنَّةِ، وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ
‘আম্মারের জন্য আফসোস, তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। সে তাদেরকে আহবান করবে জান্নাতের দিকে আর তারা তাকে আহবান করবে জাহান্নামের দিকে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৪৭]
কেউ আরেকটু আগ বেড়ে এমনও বর্ণনা করেছেন যে,
لا انا لها الله شفاعتى يوم القيامة
এ লোকেরা কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ পাবে না।
উপরোক্ত বর্ণনাগুলোকে সামনে রেখে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর বিরোধীরা এ দাবী করেন যে, হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) বিদ্রোহী হবার কারণে জাহান্নামী এবং নবীজী (ﷺ) এর সুপারিশ থেকে মাহরূম হবে।
উত্তর
উত্তরটি বুঝার সুবিধার্থে আমরা প্রথমে বিষয়গুলোকে তিনটি পর্যায় থেকে দেখে নেই।
এক বর্ণনায় এসেছে যে, আম্মার (رضي الله عنه) এর হত্যাকারীগণ বিদ্রোহী।
আরেক বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে যে, তারা জাহান্নামের দিকে আহবানকারী।
আরেক বর্ণনায় আরো অতিরিক্ত আসছে যে, তাদের জন্য সুপারিশ নিষিদ্ধ।
এবার আবার উক্ত তিনটি বিষয়ের হাকীকত সম্পর্কে বুঝে নেইঃ
আলোচনার সুবিধার্তে হাদীসের মাঝে শেষের দু’টি বর্ধিত অংশ সম্পর্কে আমরা প্রথমে জেনে নেই।
সুপারিশ নিষিদ্ধ?
মুহাদ্দিসীনে কেরাম বর্ণনা হিসেবে উদ্ধৃত উপরোক্ত অংশের ক্ষেত্রে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, এটি বানোয়াট। এর কোন ভিত্তি নেই।
১
وَأَمَّا قَوْلُهُ: ” «لَا أَنَالَهُمُ اللَّهُ شَفَاعَتِي» ” فَكَذِبٌ مَزِيدٌ فِي الْحَدِيثِ، لَمْ يَرْوِهِ أَحَدٌ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ بِإِسْنَادٍ مَعْرُوفٍ (منهاج السنة-6/141)
২
موضوع لا اصل له: كذب واضح، ليس ف ىشيء من كت السنة، وليس له اسناد يعرف به، وهو اختلاق من لا يخشى الله واليوم الآخر نسأل الله العافية (التعليق على منهاج السنة لمحمد ايمن الشبراوى-6/141، رقم الحامش-253)
৩
ومن زاد في هذا الحديث بعد تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ – لَا أَنَالَهَا اللَّهُ شَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ – فَقَدِ افْتَرَى فِي هَذِهِ الزِّيَادَةِ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَإِنَّهُ لَمْ يَقُلْهَا إِذْ لَمْ تُنْقَلْ مِنْ طَرِيقٍ تُقْبَلُ (البداية والنهاية-3/218، 3/365
৪
وما زاده الروافض في هذا الحديث بعد قوله الباغية «لا أنا لها والله شَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَهُوَ كَذِبٌ وَبَهْتٌ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَإِنَّهُ قَدْ ثَبَتَتِ الْأَحَادِيثُ عَنْهُ صَلَوَاتُ اللَّهِ عَلَيْهِ وسلامه بتسمية الفريقين مسلمين، (البداية والنهاية-7/271
মোটকথা হল, উক্ত হাদীসের মাঝে উপরোক্ত বাক্যটি সাহাবা বিদ্বেষীরা নিজের পক্ষ থেকে সংযুক্ত করে নবীজী (ﷺ) এর দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছে। অথচ এমন কোন কথা নবীজী (ﷺ) ইরশাদ করেননি।
জাহান্নামের দিকে আহবানকারী!
এ অংশটি আমভাবে বুখারীসহ উপরোক্ত শব্দেই এসেছে। কিন্তু অন্য একটি তুরুকে ভিন্ন শব্দেও বর্ণনাটি এসেছে। যা ইমাম বুখারী তার কিতাব তারীখে আওসাতের মাঝে উল্লেখ করেছেনঃ
سعيد بن عَامر الْقرظِيّ قَالَ حَدَّثتنِي أم عمَارَة حاضنة لعمَّار قَالَت اشْتَكَى عمار قَالَ لَا أَمُوتُ فِي مَرَضِي حَدَّثَنِي حَبِيبِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنِّي لَا أَمُوتُ إِلا قَتْلا بَيْنَ فِئَتَيْنِ مُؤْمِنَتَيْنِ
আম্মার (رضي الله عنه) এর সেবাকারীনী উম্মে আম্মারা বলেন, একবার হযরত আম্মার অসুস্থ হয়ে গেলেন। (আমরা তার অসুস্থতার কারণে অনেক পেরেশান হয়ে গেলাম, তখন তিনি) বলেন, আমি এ অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করবো না, আমার হাবীব রাসূল (ﷺ) আমাকে বলেছেন, ঈমানদার দুই দলের মাঝে যুদ্ধ হবে সেই সময় আমি মৃত্যুবরণ করবো। [ইমাম তাবারানীঃ মু’জামে আওসাত-১/৭৯, বর্ণনা নং-৩১২]
উক্ত বর্ণনা দ্বারা কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়ঃ
১
হযরত আম্মার (رضي الله عنه) এর মৃত্যু বিছানায় হবে না, বরং হত্যার সূরতে হবে।
২
হযরত আম্মার (رضي الله عنه) এর মৃত্যু মুমিনদের দুই জামাতের মাঝে সংঘটিত হবে।
৩
যুদ্ধরত দুই জামাতই ঈমানদার হবে। কোন জামাতই বে-ঈমান হবে না।
৪
দুই জামাতের অবস্থা এমন হবে না, কোন দল ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। বা ঈমানের গন্ডি থেকে দূরে সরে গেছে। বরং তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও যুদ্ধ হবে ইজতিহাদী কারণে।
বর্ধিত অংশটি কতটুকু বিশুদ্ধ?
আমরা আগে দেখতে পেলাম যে,
বর্ণনাটি বুখারীসহ অনেক কিতাবে যে অতিরিক্ত অংশ তথা
1.জাহান্নামের দিকে আহবানকারী বাক্যটি এসেছে, সেটি আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায় না।
2.বরং সেখানে জাহান্নামের দিকে আহবানকারীর বদলে উক্ত দলকে ঈমানদার ও মুসলমান দল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
3.‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী’ বাক্যটি আসেনি।
এ কারণেই উলামায়ে কেরাম উক্ত বর্ধিত অংশকে ইকরিমা রাবীর পক্ষ থেকে ‘ইদরাজ’ বা সংযোজন বলে মত পেশ করেছেন। এ অংশটি শুধু ইকরিমাই বর্ণনা করেছেন। অন্য কোন রাবী এ বক্তব্যটি বর্ণনা করেননি।
এ বর্ণনাটি হাদীস ও তারীখের অনেক কিতাবেই বিভিন্ন সূত্রে একাধিক রাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র ‘ইকরিমা ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে’ এ সূত্র ছাড়া আর কোন সূত্রে এ বর্ণনাটি পাওয়া যায় না।
সুতরাং এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, আসল বর্ণনা তথা ‘বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে’ এর মাঝে ধারণা প্রসূতভাবে ইকমিরা ‘তারা জাহান্নামের দিকে আহবানকারী’ বাক্যটি সংযোজন করে দিয়েছেন। যা মূল হাদীসের অংশ নয়।
ইকরিমা এমন ‘ইদরাজ’ করতে পারেন এ বিষয়টি বুঝার জন্য ইকরিমা (رحمة الله) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা জরুরী।
ইকরিমা (رحمة الله) এর পরিচয়
ইকরিমা আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (رضي الله عنه) এর আযাদকৃত গোলাম ও তার ছাত্র ছিলেন। তার আসল নাম হল, আব্দুল্লাহ ইকরিমা আলবারবারী আলমাদানী।
ইকরিমা এর ব্যাপারে জারাহ তা’দীলের ইমামগণ নির্ভরযোগ্য হবার স্বীকৃতি দেবার সাথে সাথে তার কিছু বিষয়ে সতর্কও করেছেন। যেমন-
১
عَنْ يَحْيَى البَكَّاءِ: سَمِعْتُ ابْنَ عُمَرَ يَقُوْلُ لِنَافِعٍ: اتَّقِ اللهَ، وَيْحَكَ، لاَ تَكْذِبْ عَلَيَّ كَمَا كَذَبَ عِكْرِمَةُ عَلَى ابْنِ عَبَّاسٍ (تهذيب التهذيب-7/267، رقم-476، سير اعلام النبلاء-5/22، تاريخ دمشك-41/107، تهذيب الكمال-20/279
ইয়াহইয়া আলবাক্কা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর (رضي الله عنه) কে নাফে’ কে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনেছি যে, ‘তুমি আল্লাহকে ভয় পাও! সাবধান! আমার উপর মিথ্যাচার করো না, যেমন ইকমিরা তিনি ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর উপর মিথ্যাচার করেছে।
[তাহজীবুত তাহযীব-৭/২৬৭,
সিয়ারু আলামিন নুবালা-৫/২২,
তারীখে দামেশক-৪১/১০৭,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৭৯]
২
عن سعيد بن المسيب أنه كان يقول لغلامه برد يا برد لا تكذب علي كما يكذب عكرمة على بن عباس (تهذيب التهذيب-7/268، لسان الميزان-2/269، الطبقات الكبرى-5/103، تاريخ ابن ابى خيثمة-2/194، تاريخ دمشك-41/109، تهذيب الكمال-20/280)
সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব তার গোলাম বুরদকে বললেন, হে বুরদ! ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর উপর ইকরিমা যেমন মিথ্যাচার করেছে তেমন আমার উপর তুমি মিথ্যাচার করো না।
[তাহযীবুত তাহযীব-৭/২৬৮,
লিসানুল মীযান-২/২৬৯,
আততাক্বাতুল কুবরা-৫/১০৩,
তারীখে ইবনে আবী খাইছামা-২/১৯৪,
তারীখে দামেশক-৪১/১০৯,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৮০]
৩
على بن عبد الله بن عباس…. انه قال: عكرمة يكذب على ابى (تاريخ دمشك-41/113، تاريخ ابن ابى خيثمة-2/194، تهذيب الكمال-20/280، سير اعلام النبلاء-5/23
ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর ছেলে আলী বিন আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, … ইকরিমা আমার উপর পিতার নামে মিথ্যাচার করতো।
[তারীখে দামেশক-৪১/১১৩,
তারীখে ইবনে আবী খাইছামা-২/১৯৪,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৮০,
সিয়ারু আলামিন নুবালা-৫/২৩]
৪
قال على بن المدينى كان عكرمة يرى راى نجدة الحرورى (تاريخ دمشك-41/120، تهذيب الكمال-20/278، سير اعلام النبلاء-5/21، ميزان الاعتدال-3/96)
আলী বিন মাদিনী বলেন, ইকরিমা হারওয়ী (খারেজী) সম্প্রদায়ের মতাদর্শ পোষণ করতো।
[তারীখে দামেশক-৪১/১২০,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৭৮,
সিয়ারু আলামিন নুবালা-৫/২১,
মীযানুল ইতিদাল-৩/৯৬]
৫
قال مالك: ولكنه كان يرى راى الخوارج راى الصفرية (الكامل فى ضعفاء الرجال-6/470، تاريخ دمشك-41/114، تهذيب الكمال-20/287ـ تهذيب التهذيب-7/269
ইমাম মালেক বলেন, ইকরিমা খারেজীদের মতাদর্শ পোষণ করতো।
[তারীখে দামেশক-৪১/১১৪,
আলকামেল-৬/৪৭০,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৭৮,
তাহযীবুত তাহযীব-৭/২৬৯]
৬
وحكى عن يعقوب الحضرمي عن جده … قال وكان عكرمة يرى رأى الإباضية (تاريخ دمشك-41/118، تهذيب الكمال-20/278
ইয়াকুব হাযরামী তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ইকরিমা ইবাজী (খারেজীদের একদল) সম্প্রদায়ের মতাদর্শ পোষণ করতো।
[তারীখে দামেশক-৪১/১১৮,
তাহযীবুল কামাল-২০/২৭৮]
৭
عكرمة مولى ابن عباس من اوعية العلم تكلموا فيه لراية لا لحفظه اتهم براى الخوارج الخ (المغنى فى الضعفاء-2/438
ইকমিরা ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর আযাদকৃত গোলাম ছিল। অনেক ইলমের অধিকারী ছিলেন। তার মতাদর্শের কারণে তার ব্যাপারে সমালোচনা করা হয়েছে। তিনি খারেজীদের মতাদর্শের অধিকারী বলে অভিযোগ রয়েছে।
[আলমুগনী ফিজ যুআফা-২/৪৩৮]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমাদের কাছে একথা পরিস্কার যে, ইকরিমা ব্যক্তিগতভাবে বিতর্কিতও বটে।
তাই উপর্যুক্ত বাক্যটি সন্দিহান। তাছাড়া উপরোক্ত বাক্যটির ব্যাপারে ইকরিমার কোন সমর্থক বর্ণনাকারী পাওয়া যায় না। তাই অভিযোক্ত রাবীর সমর্থকবিহীন বর্ণনাটির উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না। তাই তার এ ‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী’ সংযুক্ত বাক্যটি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাগী বা বিদ্রোহী দল
হাদীসের আলোকে বুঝা যাচ্ছে আম্মার (رضي الله عنه) কে যারা হত্যা করবেন, তারা হবেন বিদ্রোহী দল। যেহেতু উক্ত দলের নেতৃত্বে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ছিলেন, তাই তিনিও বিদ্রোহী হিসেবে পরিগণিত।
বাগী তথা বিদ্রোহী ব্যক্তি ফাসিক নয়। তার সাক্ষ্য শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। বাগীর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং জুমআর ইমামতি, হজ্বের আমীর এবং বিচার নিযুক্ত হওয়া শরীয়তে জায়েজ।
বাগী তার নিজের কাজে মুজতাহিদের পর্যায়ভূক্ত। বাগীর ভুলকে কবিরা গোনাহ বলা যায় না। তাই তাকে কাফের বা জাহান্নামী বলাতো দূরে থাক ফাসিকও বলা যাবে না।
হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর বিদ্রোহটা কোন ব্যক্তিগত কারণে ছিল না। বরং দ্বীনী কারণে ছিল। অন্য শব্দে বললে এটি ছিল ইজতিহাদী বিষয়। যদিও হযরত আলী (رضي الله عنه) এর ইজতিহাদ সঠিক ছিল। আর হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর ইজতিহাদ ভুল ছিল।
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর ইজতিহাদ ভুল হবার পরও তিনি একটি সওয়াবের অধিকারী হবেন।
“কারণ, মুজতাহিদ ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দু’টি সওয়াব পান, আর ভুল করলে গোনাহ নয় বরং একটি সওয়াবের অধিকারী হন।“
[সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৭৩৫২]
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর বিদ্রোহটা সেই সময়কার নাজুক পরিস্থিতিতে অপারগতার হালতে ছিল। যেমন নামাযে দাঁড়ানোর পর নামায ছাড়া জায়েজ নয়, কিন্তু চোখের সামনে কাউকে গর্তে পড়ে যেতে দেখলে নামায ছেড়ে দিতে হয়। তেমনি সেসময় মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) তার ইজতিহাদ অনুপাতে চূড়ান্ত অপারগ অবস্থায় চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এটি তার ইজতিহাদী ভুল ছিল। কিন্তু এ কারণে তিনি ফাসিক, কাফের বা জাহান্নামী হয়ে যাননি।
এ কারণেই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের উলামাগণ এ বিষয়ে পরিস্কার ভাষায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেনঃ
ان اهل السنة اجمعوا على ان من خرج على على كرم الله وجهه خارج على الامام الحق الا ان هذا البغى الاجتهادى معفو عنه (الناهية عن طعن معاوية-38
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের এ বিষয়ে ইজমা ও একমত যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীগণ ইজতিহাদের ভিত্তিতে এমনটি করেছেন। তাই তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত।
[আননাহিয়াহ আন তা’নি মুয়াবিয়া-৩৮]
ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেছেনঃ
والظنّ بالصحابة في تلك الحروب أنهم كانوا فيها متأوّلين، وللمجتهد المخطئ أجر، وإذا ثبت هذا في حق آحاد الناس، فثبوته للصحابة بالطريق الأولى (الاصابة فى تمييز الصحابة-7/260، 4/151
অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه) এর পারস্পরিক যুদ্ধ বিষয়ে আমাদের ধারণা এই যে, তারা উপরোক্ত যুদ্ধ বিষয়ে মুজতাহিদ ছিলেন। আর ভুল ইজতিহাদকারী একটি সওয়াব পায়। যখন সাধারণ মুজতাহিদ ভুল করলে একটি সওয়াবের অধিকারী হন, সুতরাং এটি সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রে তা আরো অগ্রগণ্যতার সাথে সাব্যস্ত হবে।
[আলইসাবাহ ফী তাময়িজিস সাহাবাহ-৭/২৬০, ৪/১৫১]
হাফেজ ইবনে কাসীর (رحمة الله) লিখেছেনঃ
وَلَا يَلْزَمُ مِنْ تَسْمِيَةِ أَصْحَابِ مُعَاوِيَةَ بُغَاةً تَكْفِيرُهُمْ كَمَا يُحَاوِلُهُ جَهَلَةُ الْفِرْقَةِ الضَّالَّةِ مِنَ الشِّيعَةِ وَغَيْرِهِمْ لِأَنَّهُمْ وَإِنْ كَانُوا بُغَاةً فِي نَفْسِ الْأَمْرِ فَإِنَّهُمْ كَانُوا مُجْتَهِدِينَ فِيمَا تَعَاطَوْهُ مِنَ الْقِتَالِ وَلَيْسَ كُلُّ مُجْتَهِدٍ مُصِيبًا بَلِ الْمُصِيبُ لَهُ أَجْرَانِ وَالْمُخْطِئُ لَهُ أَجْرٌ،
হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর জামাআত বিষয়ে বাগী তথা বিদ্রোহী মন্তব্য করার দ্বারা তাদেরকে কাফের বলা প্রমাণ করে না। যেমনটি অজ্ঞ দল পথভ্রষ্ট শিয়া ও অন্যান্যরা বলে থাকে। যদিও তারা মৌলিকভাবে বিদ্রোহী হন না কেন, কিন্তু তারা এ যুদ্ধ বিষয়ে মুজতাহিদ ছিলেন। আর সব মুজতাহিদই সর্বদা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বরং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দু’টি সওয়াব পান, আর ভুল করলে একটি সওয়াব পান।
[আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৩/২৬৫, ৩/২১৮, ৪/৫৩৮]
আবুশ শাকুর সালেমী বলেন,
وقد قلنا ان الباغى لا يفسق لان شهادته مقبولة بالاتفاق، والثانى ان الباغى ماول فى دعواه، ولان حد الباغى ان يدعى الامارة مع شبهة الدعوى وكان لهم شبهة الدعوى فتاولوا فى ذلك واخطأوا فى تاويلهم وخطاهم ما كان من الكبائر فى الدين حتى يوجب الفسق والكفر……. ولانه يجوز الصلاة والجمعة والحج وتولية القضاء وغير ذلك من الولاية من جهة الباغى دل أنه ما كان فاسقا (كتاب التمهيد فى بيان التوحيد لابى الشكور السالمى-167-168
অর্থাৎ,
আমরা বলি যে, বাগী ফাসিক নয়। কেননা, তার সাক্ষী সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত, বাগী তার দাবীতে ব্যাখ্যাকারী। কেননা, বাগী ব্যক্তি আমীরত্বের দাবী করে থাকে আমীর হবার যোগ্য মনে করার কারণে। এক্ষেত্রে তারা ইজতিহাদ করে থাকে।
আর তাদের ইজতিহাদটি ভুল। আর ভুলকারী ব্যক্তি দ্বীনের ক্ষেত্রে কবীরা গোনাহের হকদার হয় না। তাই ফাসিক বা কাফের হয় না। ….. তাছাড়া নামায, জুমআ, হজ্বের আমীর হওয়া এবং বিচারক হবার যোগ্যতা বাগী হবার কারণে তার থেকে হারিয়ে যায় না। যা প্রমাণ করে বাগী ব্যক্তি ফাসিক নয়। [আততামহীদ ফী বয়ানিত তাওহীদ, আবুশ শকুর সালেমীকৃত-১৬৭-১৬৮]
সাদুদ্দীন তাফতাজানী (رحمة الله) তার কিতাব শরহুল মাকাসিদ গ্রন্থে, জঙ্গে সিফফীন ও জামালে অংশ নেয়া সাহাবাগণকে ফাসিক, কাফের, জালিম বলা জায়েজ নয় হবার কথা স্পষ্ট করেছেন। সেই সাথে হযরত আলী (رضي الله عنه) ও শামবাসীকে অভিশম্পাতকারীদের নিষেধ করে জানিয়েছেন যে, তাদের উপর অভিশম্পাত করো না, কারণ তারা আমাদেরই ভাই। তবে তারা ইজতিহাদী কারণে আমাদের বিরোধীতা করেছেন।
وليسوا كفارا ولا فسقة ولا ظلمة لما لهم من التاويل وان كان باطلا فغاية الامر انهم اخطأوا فى الاجتهاد وذلك لا يوجب التفسيق فضلا عن التكفير، ولهذا منع على رضى الله عنه اصحابه من لعن اهل الشام وقال اخواننا بغوا علينا (شرح المقاصد لسعد الدين التفتازنى-5/308
মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) লিখেছেন,
ثم كان معاوية مخطيا الا انه فعل ما فعل عن تأويل فلم يصر به فاسقا (شرح الفقه الاكبر-82
হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ভুলের উপর ছিলেন। কিন্তু তার কাজটি ছিল ইজতিহাদের ভিত্তিতে। তাই তাকে ফাসিক বলা যাবে না।
[শরহে ফিক্বহুল আকবার, মোল্লা আলী কারীকৃত-৮২]
ইমাম গাযালী (رحمة الله) লিখেছেন,
والظن بمعاوية أنه كان على تأويل وظن فيما كان يتعاطاه وما يحكى سوى هذا من روايات الآحاد فالصحيح منه مختلط بالباطل والاختلاف أكثره اختراعات الروافض والخوارج وأرباب الفضول الخائضون في هذه الفنون. فينبغي أن تلازم الإنكار في كل ما لم يثبت، وما ثبت فيستنبط له تأويلاً. فما تعذر عليك فقل: لعل له تأويلاً وعذراً لم أطلع عليه (الاقتصاد فى الاعتقاد-511-512
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা একথা পরিস্কার জানতে পারলাম যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামাগণের ঐক্যমত্ব হল যে, হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ও তার জামাআত হযরত আলী (رضي الله عنه) এর খিলাফত বিষয়ে বাগী তথা বিদ্রোহী হলেও তিনি কাফেরতো দূরে থাকা ফাসিকও নন। বরং তিনি মুজতাহিদ হিসেবে সওয়াবের অধিকারী।
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে ফাসিক বলা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের প্রতীক নয়, বরং মু’তাজিলারদের প্রতীক।
▶জামেউল ঊসূল কিতাবে ইবনুল আছীর জাযারী (رحمة الله) প্রথমে লিখেন যে,
وذهب جمهور المعتزلة إلى أن عائشة وطلحة والزبير ومعاوية. وجميع أهل العراق والشام فُسَّاق بقتالهم الإمام الحق
জমহুর মু’তাজিলারা হযরত আয়শা (رضي الله عنه), হযরত তালহা (رضي الله عنه), হযরত যুবায়ের (رضي الله عنه), হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এবং ইরাক ও শামবাসীকে হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সাথে যুদ্ধ করার কারণে ফাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করে।
[জামেউল উসুল ফী আহাদিসির রাসূল, ইবনুল আছীর জাযারীকৃত-১/১৩৩, ১/৭৩]
তারপর তাদের রদ করে লিখেনঃ
وكل هذا جُرأة على السلف تخالف السنة، فإن ما جرى بينهم كان مبنيًا على الاجتهاد، وكل مجتهد مصيب، والمصيب واحد مثاب، والمخطئ معذور، لا تردُّ شهادته.
এসব পুরোটাই সালাফের বিপরীত স্পর্ধা প্রদর্শন এবং সুন্নাহ বিরোধী কাজ। কেননা, তাদের মাঝে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তা ছিল ইজতিহাদ নির্ভর। আর প্রতিটি মুজতাহিদই সওয়াব পায়। যিনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেন, তিনি সওয়াব পান, আর যিনি ভুল করেন, তারাও এতে মাজূর। তাদের সাক্ষ্য অগ্রহণীয় হয় না। [জামেউল উসূল ফী আহাদিসির রাসূল, ইবনুল আছীর জাযারীকৃত-১/১৩৩, ১/৭৪]
▶হযরত ইবনে কাসীর (رحمة الله) লিখেছেনঃ
وقول المعتزلة: الصحابة عدول إلا من قاتل علياً -: قول باطل مرذول ومردود.
আর মু’তাজিলাদের কথা যে, সাহাবায়ে কেরামগণ ন্যায়নিষ্ঠ তবে যারা হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সাথে যারা যুদ্ধ করেছেন তারা ন্যায়নিষ্ঠ নন: তাদের এ দাবীটি বাতিল, ঘৃণিত এবং অগ্রহণীয়।
[আলবায়িছুল হাছীছ ইলা ইখতিছারি উলুমিল হাদীস, ইবনে কাছীরকৃত-১৮২, ১৮১]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, সাহাবাগণের পারস্পরিক মতভেদ ও ইজতিহাদী মতভিন্নতার কারণে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এর কারণে তাদেরকে ফাসিক ইত্যাদি বলার কোন সুযোগ নেই।
আর হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সহ অন্যান্য সাহাবাগণকে ফাসিক বলাটা মু’তাজিলার বক্তব্য। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্য বা মতাদর্শ এটা নয়।
এছাড়াও হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর উপর ততক্ষণ বাগী বা বিদ্রোহী হবার অভিযোগ করা যায়, যতক্ষণ না তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সাথে সন্ধিচুক্তি করেছেন।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে,
▶হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সাথে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ৪০ হিজরীতে সন্ধিচুক্তি করেছেন। এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ইরাকের অধীন সমস্ত রাষ্ট্র হযরত আলী (رضي الله عنه) এর শাসনাধীন থাকবে। আর শামের অধীন সমস্ত রাষ্ট্রগুলো হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর শাসনের আওতাধীন থাকবে।এক দল অন্যদলের উপর কোন হামলা করবে না। কোন যুদ্ধ করবে না।
[তারীখে তাবারী, ইবনে জারীরকৃত-৬/৮১,
আল-কামেল, ইবনে আছীর যাজারীকৃত-৩/১৯৩,
আল-বিদায়া ওয়াননিহায়া, ইবনে কাছীরকৃত-৭/৩২২]
▶হযরত আলী (رضي الله عنه) এর শাহাদতের পর হযরত হাসান (رضي الله عنه) ৪১ হিজরীতে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর সাথে সন্ধি ও শাস্তি চুক্তি করেন। সেই সাথে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর হাতে বাইয়াতও গ্রহণ করেন।
[তারীখে খলীফা ইবনে খাইয়্যাত-১/১৮৭]
এ সন্ধিচুক্তি এবং হযরত হাসান (رضي الله عنه) এর বাইয়াতের পর হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) পুরো মুসলিম মিল্লাতের জন্য সহীহ ও গ্রহণযোগ্য মুসলিম খলীফা নির্দিষ্ট হয়ে যান।
▶এ কারণে ইবনে হাজার হাইতামী (رحمة الله) লিখেছেনঃ
فَالْحق ثُبُوت الْخلَافَة لمعاوية من حِينَئِذٍ وَأَنه بعد ذَلِك خَليفَة حق وَإِمَام صدق (الصواعق المحرقة فى الرد على اهل البدع والزندقة لابن حجر المكى الهيتمى-588، 2/625، 627،
সন্ধি চুক্তির পর থেকে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর জন্য খিলাফত হক হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি একজন হক খলীফা এবং যথার্থ ইমাম। [আসসাওয়ায়েকুল মুহরাকাহ, ইবনে হাজার হাইতামীকৃত-৫৮৮]
▶একটু পর আবার লিখেছেনঃ
أَنه بعد نزُول الْحسن لَهُ خَليفَة حق وَإِمَام صدق (الصواعق المحرقة-590، 2/627، 219
হযরত হাসান (رضي الله عنه) এর বাইয়াতের পর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) হক খলীফা এবং মান্যবর ইমাম হয়ে যান। [আসসাওয়ায়েকুল মুহরাকাহা-৫৯০]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমাদের কাছে প্রতিভাত হল যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকীদা বিশ্বাস অনুপাতে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সহ তার অনুসারীগণ কেউ ফাসিক বা কাফির বা কবীরে গোনাহের অধিকারী নন।
হযরত হাসান (رضي الله عنه) এর সাথে সন্ধি এবং হযরত হাসান (رضي الله عنه) এর বাইয়াতের মাধ্যমে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) পুরো মুসলিম মিল্লাতের গ্রহণযোগ্য ইমাম ও খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। এরপর থেকে তাকে বিদ্রোহী বা বাগী বলারও কোন সুযোগ নেই।
তাই এ মহান সাহাবীকে বিদ্রোহী, ফাসিক ইত্যাদি বলে গালি দিয়ে নিজের আখেরাতকে বরবাদ না করি।
(আহলে হক)