শাইখুল ইসলাম, ইমামে আহলে সুন্নাত, অধ্যক্ষ আল্লামা হাফেজ এম আব্দুল জলিল আল্-ক্বাদেরী (রা:) পরিচিতি ও কর্মজীবন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

পরিচিতি: 

এদেশে সুন্নী ভিত্তিক ইসলাম প্রচারে উল্লেখযোগ্য নামের মধ্যে আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল আল্-ক্বাদেরী (রা:) একজন। তিনি আকাঈদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত অনুসারী, মাযহাবে হানাফী এবং তরিকায় ক্বাদেরী ছিলেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী আদম আলী মোল্লা (র:) এবং মাতার নাম মালেকা খাতুন (র:)। তিনি ১৩৪০ বঙ্গব্দে ২৬ শে ভাদ্র শনিবার চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর-এর অধিনস্ত আমিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চার বোন ও ছয় ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

বংশ পরিচয়: 

দিল্লীর বুযুর্গ ফেকাহবিদ, মুফাচ্ছির এবং বাদশাহ আলমগীরের ছেলের ওস্তাদ হযরত মোল্লা আহমদ জিয়ুন (রা:) ছিলেন আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) এঁর বংশের পূর্ব পুরুষ। হযরত মোল্লা আহমদ জিয়ুন (রা:) রচিত ফেকাহ নীতি শাস্ত্র ’নূরুল আনওয়ার’ গ্রন্থখানি দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ফাযিল জামাআতের পাঠ্যভুক্ত কিতাব। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের কারণে ইংরেজ কর্তৃক মুঘল সালতানাতের পতনের পর হযরত মোল্লা জিয়ুন (রা:) এঁর বংশধরগণের একটি শাখা প্রাণ ভয়ে তৎকালীন ত্রিপুরা, বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতিতে হিজরত করে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জানা যায় কালক্রমে ঐ বংশই বর্তমান চাঁদপুরস্থ আমিয়াপুর গ্রামে বসবাস করতে থাকে।

মায়ের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন সৌভাগ্যবান। তাঁর নানা হযরত ভোলা গাজী মিয়াজী (রা:) ছিলেন একজন কামেল অলি এবং বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন যিনি নিজ হাতে কুরআন শরীফ কপি করে এবং মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মৃত্যুর পর জ্বীনেরা এসে রাতের আঁধারে তাঁর কবরের পাশে আলো জ্বালিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতো, যা সর্বজন বিদিত। মতলব উত্তরের একই গ্রামের মিয়াজী বাড়িতে তাঁর নানা সমাধী অবস্থিত। (আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) এঁর পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য)

শিক্ষাদীক্ষা ও কর্মজীবন: 

আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) প্রথমে মক্তবে কুরআন মজিদ ও কিছু কিতাব শিক্ষা করেন। ৪র্থ শ্রেণী পাস করার পর হিফজ্ আরম্ভ করেন এবং ১৯৫২ সালে দু’বছর তিন মাসে হিফজ শেষ করেন। তারপর ১৯৫৫ সালে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল (হাদীস) ১ম বিভাগে বৃত্তিসহ (১৯৫৬-১৯৬৪ ইং সালে) উত্তীর্ণ হন। তারপর ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রি এবং এম.এ (জেনারেল ইতিহাস) উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে স্টাইপেন্ডসহ (১৯৬৪-১৯৭০) পাস করেন। ১৯৭০ সালে জেনারেল শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৯৭২ সালে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ছাগলনাইয়া কলেজ ও নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজে ১৯৭৫ ইং সাল পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

উচ্চতর শিক্ষালাভের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে তিনি চট্টগ্রাম শহরে ১৯৬৪-৭৮ ইং পর্যন্ত হযরত তারেক শাহ্ (রা:) দরগাহ মসজিদে ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপনার ফাঁকে ১৯৭৩ ইং সালে এক বছর অগ্রণী ব্যাংকে প্রবেশনারী অফিসার হিসাবে কাজ করে ইস্তফা দেন। ১৯৭৩ ইং সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হাজীগঞ্জ বড় মসজিদে ১৯৭৫ সালে ছয় মাস ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম চলে যান। সেখানে তিনি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে ১৯৭৭ সালে যোগদান করেন।

অত:পর ১৯৭৮ সালে ঢাকা মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদে ছিলেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ ইং সাল পর্যন্ত মধ্যখানে ৪ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর ইমাম ট্রেনিং প্রজেক্ট ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে ডাইরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে পুনরায় যোগদান করেন এবং এখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শাহজাহানপুর গাউছুল আযম জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা খতীব এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নির্বাচিত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে বাতিল ফের্কার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁরও ভূমিকা ছিল উল্লেযোগ্য। ওলী-আল্লাহ বিদ্বেষী, জঙ্গীবাদী গোষ্ঠির বিরুদ্ধে তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আজ তাঁকে এক কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট। বিভিন্ন ইসলামী সেমিনার, ওয়াজ-মাহফিল, মসজিদের মিম্বরে জুমুআয় প্রদত্ত তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শ্রোতাদের ইসলামের সঠিক রূপরেখার নির্দেশনা প্রদান করতো।

বিদেশভ্রমণ: 

আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) ১৯৮০ ইং সালে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ করেন। ভারতের আজমীর শরীফে হযরত খাজা গরীব নওয়াজ (রা:) ও বেরেলী শরীফে আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত শাহ্ আহমদ রেজা খান বেরলভী (রা:) এঁর মাযার শরীফ জিয়ারত করে ফয়েয ও বরকত লাভ করেন। ১৯৮২ইং সালে ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে বাগদাদে অনুষ্ঠিত মোতামারে ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছীন প্রতিনিধি দলের সাথে সেদেশ ভ্রমন করেন। সেই সাথে সাথে তিনি পবিত্র হজ্ব ও জিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করেন।

কারবালা ও বাগদাদ শরীফের গাউসুল আযম (রা:) এঁর মাযারসহ অসংখ্য ওলী ও নবীর মাযার শরীফ জিয়ারত করেন। ১৯৮৪ ইং ও ১৯৮৫ ইং সালে দু’বার ইরাক সরকারের আহ্বানে পুনরায় জমিয়াতুল মোদাররেছীনের প্রতিনিধি হিসাবে ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করেন এবং সেই সাথে যথাক্রমে হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেন। ১৯৯৭ ইং ২৪শে নভেন্বর বাগদাদ শরীফের মোতাওয়াল্লী সাইয়্যেদ আবদুর রহমান জিলানী হতে কাদেরিয়া তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত হন। আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) নিজ গ্রাম আমিয়াপুরে হযরত বিবি ফাতেমা (রা:) মহিলা দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন।

প্রকাশনা: 

বুখারী শরীফসহ তাঁর লিখিত, অনুদিত ও সম্পাদিত ২০ খানা গ্রন্থের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯ খানা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত ‍উল্লেখযোগ্য কিতাবগুলো হচ্ছে- (১) আহকামুল মাযার (২) নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (জিবনী গ্রন্থ) (৩) হায়াত মউত কবর হাশর (৪) ফতোয়ায়ে ছালাহীন বা ত্রিশ ফতোয়া (৫) শিয়া পরিচিতি (৬) কালেমার হাক্বীক্বত (৭) কারামাতে গাউছুল আজম (রা:) (৮) গেয়ারভী শরীফের ইতিহাস (৯) ইসলাহে বেহেস্তী জেওর (১০) আকায়েদ ও মাসায়েল শিক্ষা (১১) মিলাদ কিয়ামের বিধান (১২) নারী পর্দায় থাকবে কেন? বা নারী মুক্তির পথ (১৩) ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নাত লহরী। তাঁর অসমাপ্ত সর্বশেষগ্রন্থ জলিলুল বয়ান ফী তাফসিরীল কোরআন। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে মাসিক সুন্নীবার্তা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেন।

ওফাত: 

২০০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রোজ বুধবার আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রা:) মাওলায়ে হাকিকীর দরবারে গমন করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। তাঁর নিজ গ্রাম মতলব (উত্তর), চাঁদপুরস্থ আমিয়াপুরে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিবি ফাতেমা (রা:) মহিলা দাখিল মাদ্রাসা কাছেই মা-বাবার কবরের পাশে এই মহান গুণীকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment