সমস্ত প্রাণীকুল যেমন নবী করীম (ﷺ) এর অনুগত ও ফরমাবরদার ছিলো, তেমনি গাছপালা ও উদ্ভিদরাজিও নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলো।
গাছপালা নবী করীম (ﷺ) এর সাথে কথা বলেছিলো, তাঁকে সালাম করেছিলো, তাঁর রেসালতের সাক্ষ্য দিয়েছিলো এবং তাঁর হুকুমও তামিল করেছিলো। উম্মুল মুমিনীন সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর হাদীছে আছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমার নিকট ওহী আসা শুরু হলে সমস্ত বৃক্ষরাজি ও প্রস্তরখ- আমাকে বলতো আসসালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ।
হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) বলেন, একদা আমরা রসুল করীম (ﷺ) এর সঙ্গে মক্কা মুকাররমার বিভিন্নস্থানে গিয়েছিলাম। তখন রাস্তার সমস্ত গাছপালা ও পাহাড় পর্বত বলেছিলো আসসালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ। এই হাদীছখানা ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। হাকিম (رحمة الله) তাঁর হাদীছগ্রন্থ মুস্তাদরেকে উত্তম সনদের মাধ্যমে হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করছেন, আমরা একদা রসুল করীম (ﷺ) এর সঙ্গে কোনো এক সফরে ছিলাম। এক বেদুইন আমাদের সামনে পড়লো। লোকটি নবী করীম (ﷺ) এর নিকট এলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো? সে বললো, আমার পরিবার পরিজনের কাছে। তিনি বললেন, কোনো কল্যাণ কি তুমি কামনা করো? সে বললো, সেটা আবার কী? তিনি (ﷺ) বললেন, ‘আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই আর মোহাম্মদ তাঁর বান্দা এবং রসুল’- এই সাক্ষ্য প্রদান করা। সে বললো, আপনি যা বললেন তার সত্যতার সাক্ষী কে? তিনি (ﷺ) বললেন, এই বৃক্ষটিই আমার সাক্ষী। রসুলেপাক (ﷺ) এক প্রান্তে অবস্থিত গাছটিকে ডাক দিলেন। বৃক্ষটি তৎক্ষণাৎ মাটি চিরে চিরে দুই ভাগ করে দৌড়ে রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে উপস্থিত হলো। তারপর তিনি গাছের নিকট থেকে তিনবার সাক্ষ্যগ্রহণ করলেন। গাছটি আবার যথাস্থানে ফিরে গেলো। ইমাম দারেমীও এরকম একটি বিবরণ দিয়েছেন। উহুদ যুদ্ধের দিন দুরাচার কাফেরেরা নবী করীম (ﷺ) এর চেহারা মোবারককে রক্তরঞ্জিত করেছিলো, তাঁর দাঁত মোবারকের ক্ষতি করেছিলো। ওই সময় রসুলেপাক (ﷺ) ময়দানের এক কোণে অবস্থান করছিলেন।
জিব্রাইল (عليه السلام) এসে তাঁর হালঅবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি নবী করীম (ﷺ) কে চিন্তিত দেখে বললেন, আমি কি আপনাকে এমন একটি নিদর্শন দেখাবো, যাতে আপনি সান্ত¡নাবোধ করেন? তারপর জিব্রাইল (عليه السلام) ওই গাছটির দিকে নযর করলেন, যা পাহাড়ের পিছনে ছিলো। তিনি বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আপনি গাছটিকে ডাক দিন। রসুলেপাক (ﷺ) গাছটিকে ডাক দিলেন। গাছটি দৌড়ে এসে রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন, এখন গাছটিকে স্বস্থানে ফিরে যেতে বলুন। তিনি (ﷺ) হুকুম করলে গাছটি আবার তার নিজের জায়গায় ফিরে গেলো। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হাসবী, হাসবী (হয়েছে- যথেষ্ট হয়েছে)। এই ঘটনাটি ইমাম দারেমী হজরত আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। হজরত বুরায়দা আসলামী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, এক বেদুইন একদিন নবী করীম (ﷺ) এর কাছে মোজেজা দেখতে চাইলো। রসুলেপাক (ﷺ) বেদুইনকে বললেন, ওই গাছটিকে যেয়ে বলো, আল্লাহ্র রসুল তোমাকে ডাকছেন। গাছটি তখন আগে পিছে একটু নড়া চড়া করে মাটি থেকে শিকড়গুলো বের করে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। বললো, আসসালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ!
বেদুইন বললো, এখন গাছকে স্বস্থানে ফিরে যেতে বলুন। তিনি হুকুম করলেন। আর অমনি গাছটি নিজের জায়গায় ফিরে গেলো। তার ছোটবড় সমস্তশিকড় মাটির ভিতর প্রবেশ করলো এবং যমীন পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে গেলো। বেদুইন নিবেদন করলো, আমাকে অনুমতি দিন, আপনাকে সেজদা করি। রসুলেপাক (ﷺ) অনুমতি দিলেন না। সে বললো, তাহলে আপনার হাত ও কদম মোবারক চুম্বন করার অনুমতি দিন। রসুল (ﷺ) অনুমতি দিলেন।
বর্ণিত আছে, এক অন্ধকার রাতে নবী করীম (ﷺ) উটের উপর সওয়ার হয়ে নিদ্রাবস্থায় কোনো এক স্থানে সফর করছিলেন। হঠাৎ সামনে পড়ে গেলো একটি কুলগাছ। সঙ্গে সঙ্গে কুলবৃক্ষটি দু’টুকরো হয়ে নবী করীম (ﷺ) এর চলার পথকে বাধামুক্ত করে দিলো। সেই ঘটনার পর থেকে গাছটির নাম হয়ে গিয়েছিল সিদ্রাতুন্নবী।
হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, এক বেদুইন একদিন রসুলেপাক (ﷺ)কে বললো, আমি কেমন করে জানবো যে, আপনিই আল্লাহ্র রসুল? তিনি (ﷺ) বললেন, আমি খেজুরের ডালকে ডাকছি, সেই এসে সাক্ষ্য দিবে। ডাক দিতেই সেই ডালটি গাছ থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ে গেলো। রসুল (ﷺ) ডালটিকে বললেন, স্বস্থানে চলে যাও। ডালটি উঠে পুনরায় গাছে জোড়া লেগে গেলো। ঘটনা দেখে বেদুইন ইসলাম কবুল করলো।
এই হাদীছখানা ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, হাদীছটি সহীহ্। হজরত জাবের (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে একখানা দীর্ঘ সহীহ্ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একদা আমরা এক উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁবু ফেলেছিলাম। রসুলেপাক (ﷺ) প্রকৃতির ডাকে চলে গেলেন। আমিও তাঁর পিছে পিছে পানির পাত্র নিয়ে যেতে লাগলাম। কোথাও আড়াল নেই। হঠাৎ প্রান্তরের এক প্রান্তে একটি বৃক্ষ দেখা গেলো। রসুলেপাক (ﷺ) সেই বৃক্ষটির দিকে চললেন। গাছের একটি ডাল ধরে বললেন, আল্লাহ্র হুকুমে আমার আনুগত্য করো। ডালটি রসুলেপাক (ﷺ) এর এমন অনুগত হলো, উটের নাকে রশি লাগালে সে যেমন তার প্রভুর অনুগত হয়। তারপর সেই ডালটি গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরেকটি গাছের দিকে চলে গেলো। বর্ণনাকারী বলেন, সেই ডালগুলো পরস্পরে মিলিত হয়ে রসুলেপাক (ﷺ) কে আড়াল করে ফেললো। অন্য আরেক বর্ণনা- রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হে জাবের, গাছটিকে বলো, আল্লাহ্র রসুল বলছেন, তোমরা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাও, যাতে তিনি তোমাদের আড়ালে বসতে পারেন। তাই বললাম। গাছটি অন্য আরেকটি গাছের সঙ্গে মিলিত হলো। রসুলেপাক (ﷺ) তার পিছনে বসলেন। আমি দূরে বসে দেখছিলাম এবং চিন্তা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম, রসুলেপাক (ﷺ) আসছেন। তারপর দেখলাম, গাছ দু’টি পৃথক হয়ে আপন আপন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।
এই রকম বর্ণনা হজরত উসামা ইবনে যায়েদের হাদীছেও এসেছে। তিনি বর্ণনা করেন, এক যুদ্ধে নবী করীম (ﷺ) আমাকে বললেন, তুমি কি আল্লাহ্র রসুলের প্রকৃতির প্রয়োজন পূরণের জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা দেখতে পেয়েছো? আমি নিবেদন করলাম, এ প্রান্তরে নির্জন কোনো জায়গা দেখছি না। চারিদিকে শুধু খেজুর গাছ আর পাথর। তিনি বললেন, গাছগুলোকে বলো, রসুলুল্লাহ্র জন্য তারা যেনো পরস্পরে মিলিত হয়ে যায়। পাথরগুলোকেও একথা বলো। আমি নির্দেশ পালন করলাম। কসম ওই মহান জাত পাকের যিনি আল্লাহ্র রসুলকে সত্যের সঙ্গে প্রেরণ করেছেন, আমি দেখলাম, গাছগুলো একটি অপরটির কাছে এসে গেলো। আর পাথরগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হলো। তারপর রসুলে করীম (ﷺ) প্রয়োজনমুক্ত হলে বললেন, ওদেরকে একে অপর থেকে পৃথক হতে বলো।
এ ধরনের মোজেজা রয়েছে অনেক। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেছেন, লোকেরা রসুল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করলো, এমন কোন জিনিস আছে, যা আপনার রেসালতের সাক্ষ্য প্রদান করে? তিনি বললেন, এ গাছটিই আমার রেসালতের সাক্ষ্য দেবে। তারপর গাছকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বৃক্ষ! কাছে এসো। সঙ্গে সঙ্গে গাছ এসে গেলো এবং সাক্ষ্য দিলো। কাযী আয়ায (رحمة الله) বললেন, সাহাবা কেরামের এক দল এবং বহুসংখ্যক তাবেয়ীন উক্ত মোজেজার ব্যাপারে একমত।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]