মোজেজা সম্পর্কে আরও কিছু কথা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

রসুলেপাক (ﷺ) এর নবুওয়াতের প্রমাণস্বরূপ জন্মক্ষণে, দুগ্ধপানের সময়ে, বাল্যকালে এবং নবুওয়াত প্রকাশের জামানায়, সমস্ত জীবনে যে সব মোজেজা প্রকাশ পেয়েছিলো, তার কিছু কিছু আলোচনা করা হলেও সমস্ত জীবনের সকল মোজেজার পুরো বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালার মর্জি হলে যথাস্থানে আরও কিছুর আলোচনা করা যাবে। কাযী আবুল ফযল আয়াস মালেকী (رحمة الله) বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর উজ্জ্বল মোজেজাসমূহ থেকে এই অনুচ্ছেদে কিছু মোজেজার আলোচনা করবো, যা তাঁর সমগ্র মোজেজাসমূহের তুলনায় বিন্দুতুল্য।  ওটুকুই আমাদের জন্য যথেষ্ট। প্রকৃতপ্রস্তাবে আমাদের পয়গম্বর সরওয়ারে কায়েনাত (ﷺ) এর মোজেজাসমূহ অন্যান্য পয়গম্বরগণের মোজেজা থেকে অধিক পূর্ণ ও অধিক উজ্জ্বল। কোনো কোনো মোজেজা এমন যে, সেরকম মোজেজা অন্য কোনো পয়গম্বরকে দেয়াই হয়নি। অন্যান্য আম্বিয়া কেরামকে যত মোজেজা দেয়া হয়েছিলো, আমাদের নবী (ﷺ) এর মোজেজা হয় তার সমান, না হয় তার চেয়ে অধিক পূর্ণ। মোজেজাগুলোর মধ্যে কোরআন মজীদ অন্যতম। গোটা কোরআনই মোজেজায় ভরপুর। কোরআন মজীদ মোজেজা হওয়ার যতগুলো দিক রয়েছে, তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষুদ্রতম সুরা ইন্না আ’ত্বইনাকাল কাউছার। কোরআন মোজেজা হওয়ার ব্যাপারে পূর্বে যা আলোকপাত করা হয়েছে, তা দুই ধরনের। প্রথমটি ফাসাহাত বালাগতের দিক দিয়ে। আর দ্বিতীয়টি ছন্দ ও মিলের দিক দিয়ে।

রসুলেপাক (ﷺ) এর মোজেজাসমূহ অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের যাবতীয় মোজেজা থেকে বেশী- এই  প্রসঙ্গে একটু আলোকপাত করা যাক। যে জামানায় যে বিদ্যা ও জ্ঞান অধিকতর পূর্ণ ছিলো, সে জামানার নবীকে সেই বিদ্যা বা জ্ঞানের আলোকেই মোজেজা দেয়া হয়। যেমন হজরত মুসা (عليه السلام)কে সেই বিদ্যা বা জ্ঞানের আলোকেই মোজেজা দেয়া হয়েছিলো। তাঁর জামানায় বিদ্বানদের জ্ঞানের চূড়ান্ত ছিলো যাদুবিদ্যা। তাই আল্লাহ্তায়ালা হজরত মুসা (عليه السلام) কে যাদুর মোজেজা দিয়েছিলেন। যাদুর উপর সে জামানার লোকদের পূর্ণ দখল রয়েছে বলে যখন তারা দাবি করলো, তখন হজরত মুসা (عليه السلام) তাদের দাবিকৃত শক্তিকে ধ্বংস করে দিলেন।

হজরত ঈসা (عليه السلام) এর জামানায় চিকিৎসাবিদ্যার যথেষ্ট মর্যাদা ও প্রভাব ছিলো। আর সে  সময় চিকিৎসাবিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জনকারীরা গৌরববোধ করতো এবং দর্প প্রকাশ করতো। তাই ঈসা (عليه السلام) এমন মোজেজা প্রদর্শন করলেন, যা ছিলো তাদের শক্তিবহির্ভূত। তিনি এমন কিছু পেশ করলেন, যার ধারণা ও কল্পনা তারা করতেই পারে না। যেমন মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে চক্ষুদান করা এবং কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে দেয়া ইত্যাদি। অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের মোজেজাসমূহের অবস্থা এরকমই বুঝে নিতে হবে। সবশেষে সাইয়্যেদে আলম মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)কে প্রেরণ করলেন আল্লাহ্তায়ালা। তিনি যখন আবির্ভূত  হলেন, তখন আরবদের মধ্যে চারটি বিদ্যা ছিলো প্রধান। ১. ফাসাহাত বালাগত ২. কবিতা, ৩. কাহিনী ৪. জ্যোতির্বিদ্যা।

আল্লাহ্তায়ালা  রসুলেপাক (ﷺ) এর  উপর কোরআন নাযিল করলেন,  যা উপরোক্ত চারটি বিষয়ের প্রকৃত রূপকার। কোরআনে করীম এমন ফাসাহাত বালাগত, সংক্ষেপণ রীতি,  সূক্ষ্ম রচনাশৈলী ও বিস্ময়কর পদ্ধতিতে সমৃদ্ধ ছিলো, যা ছিলো তাদের শৈলী বহির্ভূত। এর ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি তারা। ধ্বনি ও ছন্দমিলের রীতি, ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য বিষয়ের সংবাদ প্রদান, গোপনভেদ ও অন্তর্জগতের বিষয় সম্পর্কিত বর্ণনা ইত্যাদি যেরকম কোরআনে করীমে বিবৃত হয়েছে, হুবহু তাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এসকল দিক দিয়ে তাদের জাগতিক বিদ্যা ও জ্ঞান কোরআনের জ্ঞানের নিকটবর্তী হতে পারেনি। কোরআনের এ কৃতিত্বকে সকলেই নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছিলো। জ্যোতির্বিদ্যা বাতেল বলে স্বীকৃত হয়েছিলো। কেনোনা জ্যোতির্বিদ্যা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের একটি সত্য হলেও দশটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতো। যেসব শয়তান জ্যোতির্বিদদের কানে চুপিসারে খবর পৌঁছিয়ে দিতো, সে শয়তানদেরকে উল্কাপিণ্ড মেরে আকাশ থেকে বিতাড়িত করা হতো। কোরআন মজীদের মাধ্যমে অতীত জামানা, পূর্ববর্তী উম্মত ও নবীগণ, অতীতকালের ঘটনাসম্ভার ও অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসের কাহিনী এমন এক ভঙ্গিমায় প্রকাশ করা হয়েছে, যা কোরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ করতে পারেনি। তারপরও এই কোরআন মজীদ যাবতীয় মোজেজা সহকারে কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে এবং থেকে যাবে, যাতে করে পরবর্তী সময়ের পৃথিবীর মানুষ কোরআনের অলৌকিকত্ব ও অবিসংবাদিতা নিয়ে চিন্তাগবেষণা করার প্রয়াস পায়।

পৃথিবীর প্রত্যেক যুগেই কোরআনে বর্ণিত বিজ্ঞপ্তিসমূহের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে মানুষের ইমান উত্তরোত্তর সতেজ ও সজীব হয়েছে। প্রাপ্ত সংবাদ দৃশ্যমান ঘটনার সমতুল্য নয়। যা বলা হয়েছে, তা দৃশ্যমান হয়েছে। আর বিশ্বাসবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাক্ষুষ দর্শন যথেষ্ট প্রভাবশালী। এলমুল একীনের পাশে আইনুল একীন পাওয়া গেলে অন্তরের দৃঢ়তা বৃদ্ধি  পায়, যদিও সর্বাবস্থায়ই কোরআনের মাধ্যমে একীন সৃষ্টি হয়ে থাকে। পূর্ববর্তী নবীগণের সমস্ত মোজেজা তাঁদের নবুওয়াতের সময়সীমা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের পয়গম্বর সরওয়ারে কায়েনাত (ﷺ) এর মোজেজা শেষ হয়নি, বিচ্ছিন্ন হয়নি, অকার্যকরও হয়নি।

আমাদের পয়গম্বর সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর মোজেজাসমূহ স্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ এই যে, তাঁর মোজেজা তাঁর উপর নাযিলকৃত ওহী বা আল্লাহর কালামের কারণে হয়েছে।  কালাম স্থায়ী। তাই মোজেজাও স্থায়ী। যেহেতু কালাম আল্লাহ্তায়ালার, তাই তার মধ্যে কোনোরূপ কল্পনা, টালবাহানা, বিকল্প উপায় অবলম্বন এবং হেঁয়ালী কিংবা অযথার্থ উপমার অনুপ্রবেশ সম্ভব নয়।

তিনি ব্যতীত অন্যান্য নবীগণের মোজেজার বেলায় দেখা যায়, বিরুদ্ধবাদী দুশমনেরা মোজেজা তলব করেছিলো। দুর্বল চিন্তা, খেয়াল অনুসারে যেরকম মোজেজায় অভিলাষী তারা হতো, সেরকম মোজেজাই তাদেরকে দেখানো হতো। যেমন ফেরাউনের যাদুকরেরা রশিকে সাপ বানিয়ে দিলো। সাপগুলো ময়দানে দৌড়াতে লাগলো। মোকাবেলা করার জন্য  আল্লাহ তায়ালা তারই অনুরূপ মোজেজা সৃষ্টি করে দিলেন হজরত মুসা (عليه السلام) এর লাঠির মধ্যে। লাঠি অজগর সাপ হয়ে তাদের সাপগুলো খেয়ে ফেললো।

কোরআন  নামক যে  মোজেজা রসুলেপাক  (ﷺ) কে দেয়া হলো,  তার মধ্যে যাদুর কোনো অবলম্বন নেই। তদুপরি কোরআনে করীমে নিছক কল্পনার প্রতিফলন এবং সাদৃশ্য বা  অনুকরণেরও অবকাশ নেই। যেমন কোনো ব্যক্তির মধ্যে কবিত্বের অথবা বক্তৃতা প্রদানের যোগ্যতা  না থাকা সত্ত্বেও সে অন্য কবি বা বক্তার অনুকরণে চেষ্টাসাধ্য করে কোনো উপায় বের করে কবিতা রচনা করতেও পারে অথবা বক্তৃতা দিতে পারে। কিন্তু কোরআনে করীমের বেলায় এরকম হয় না। আহলে সুন্নাতওয়াল জামাতের বিশ্বাস এই যে, কোরআনের অনুরূপ কিছু রচনা করা কারও ক্ষমতা ও সাধ্যের আওতাভূত নয়। হলে কেউ না কেউ সক্ষম হতো। এ সম্পর্কে মুতাযেলাদের মত এই যে, কোরআনের অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করা  বান্দার ক্ষমতার অন্তর্ভূত। কিন্তু সে ক্ষমতা অনুসারে বান্দা যখন কিছু করতে উদ্যত হয়, তখন আল্লাহ্তায়ালা তার সাহস, শক্তি ও সংকল্প অকার্যকর করে দেন। ফলে সে অক্ষম হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে প্রথমোক্ত মতটিই যথার্থ। ওয়াল্লাহু আ’লাম।

➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment